চলতি আলাপখানি মণি সিংহকে ‘মিথ’ বা ‘মহান’ হিসেবে বিবৃত করছে না, টংক আন্দোলনের স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেতর দিয়ে তাঁকে স্মরণ করছে। টংক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে মণি সিংহ মূলত কোন জিজ্ঞাসাকে হাজির করেছিলন, তাঁর টংক-প্রশ্নকে খুঁজে দেখার সাহস করছে।
Published : 01 Jan 2024, 07:02 PM
কমরেড মণি সিংহের বহু নাম। পরিবার নাম রেখেছিল মণীন্দ্র কুমার সিংহ। কমিউনিস্ট পার্টি ছদ্মনাম দেয় কমরেড আজাদ, পার্টি-পরিসরে ‘বড় ভাই’ ডাকত বহুজন, পাবলিক পরিসরে তিনি ‘মণি সিং’ নামে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে মণি সিংহের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ঢাকার কল্যাণপুরে, বাঁশের বেড়ায় ঘেরা এক টিনের ঘরে, ছাত্রকর্মীদের এক বৈঠকে।
সেলিম তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, মণি সিংকে তিনি ‘কমরেড আজাদ’ নামে চিনেছিলেন, সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টি ‘নিষিদ্ধ আন্ডারগ্রাউন্ড’ থাকায় নেতৃবৃন্দ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। যেমন, জ্ঞান চক্রবর্ত্তীর নাম ছিল ‘কমরেড করিম’, অনিল মুখার্জির নাম ছিল ‘কমরেড আমিন’, মোহাম্মদ ফরহাদ ‘কমরেড কবির’ নামে পরিচিত ছিলেন।
কোনো বিশেষণের বন্ধনীতে বন্দী না করে চলতি আলাপখানি ব্যক্তিগত গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে মণি সিংহের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর নিমিত্তে রচিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রামে তাঁর নব্বই বছরের সশরীর উপস্থিতি এবং তারপর এখনো তিনি নানাভাবে বিপ্লবের জমিনে প্রখর হয়ে আছেন। মণি সিংহের আত্মজীবনী ‘জীবন-সংগ্রাম’ বইটি বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাস, কৃষক আন্দোলন এবং শ্রেণিসংগ্রামে মধ্যবিত্তের যুক্ততা বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ দলিল। বহু লড়াই সংগ্রামের স্বাক্ষী বা লড়াকু হলেও টংকপ্রথা বিরোধী কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বেশি আলোচিত। যেমন, তেভাগা সংগ্রামের আলাপে ইলা মিত্র ‘নায়ক’ হয়ে ওঠেন বা জাতিগত আত্মপরিচয়ের আন্দোলনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আমাদের কেন্দ্রবিন্দু।
চলতি আলাপখানি মণি সিংহকে ‘মিথ’ বা ‘মহান’ হিসেবে বিবৃত করছে না, টংক আন্দোলনের স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেতর দিয়ে তাঁকে স্মরণ করছে। টংক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে মণি সিংহ মূলত কোন জিজ্ঞাসাকে হাজির করেছিলন, তাঁর টংক-প্রশ্নকে খুঁজে দেখার সাহস করছে চলতি আলাপ।
প্রগতির বই ও গ্রাম সভা
পরিবারে যত সহস্র্রজনের গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, মণি সিংহ তাঁদের একজন। সুনামগঞ্জে রক্তি নদীর ধারে বাবাদের আলমাডহর গ্রামের বাড়িতে রবি দাম, মণি সিংহ, লালমোহন রায়, বরুণ রায় সভা করতেন। বাবা তাদের কাছ থেকে রাশিয়া থেকে প্রকাশিত প্রগতি প্রকাশনীর বই উপহার পেতেন। বরুণ রায়কে বাবা মামা ডাকতেন। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কৃষক নেতা অনিমা দাশকে ডাকতেন দিদি। বাবার ‘অনিমা দিদির’ সঙ্গে ১৯৩৫ সালে মণি সিংহের বিয়ে হয়। বাবা সেইসব বহু ঘটনার স্বাক্ষী। ১৯৮০ সালে রিকশা দুর্ঘটনায় অনিমা সিংহ মারা গেলে সেই ঘটনার শোকে বাবা কয়েকদিন পাথর হয়েছিলেন। কবি শামসুর রাহমান মণি সিংহকে ‘ভাস্বর পুরুষ’ বলেছিলেন। কিন্তু অনিমা সিংহের মৃত্যুর পর সেই ‘ভাস্বর পুরুষ’ নিদারুণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। আমাদের ঠাকুরমা অনন্তবালা দাশের সঙ্গে মণি সিংহের মা সরলা দেবীর বহু মিল ছিল। কালী কুমার সিংহ মারা যাওয়ার পর কলকাতা থেকে পুত্র মণি সিংহকে নিয়ে সরলা দেবী সুসং দুর্গাপুরে নিজের বাবার বাড়িতে চলে আসেন। আমাদের দাদু বসন্ত কুমার তালুকদার মারা যাওয়ার পর যেমন অনন্তবালাও সন্তানদের নিয়ে এলাহাবাদ থেকে নিজ বাবার বাড়ি সুনামগঞ্জ চলে আসেন। মণি সিংহ বাবাকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিতেন। আলমাডহর, রঙ্গিয়ারচর, বারুংকা, বেহেলী, দিরাই, শাল্লা কিংবা মধ্যনগরে কৃষকদের নিয়ে সভা করতেন।
গর্বিত বত্রিশ বছর
মণি সিংহ কীভাবে বিপ্লবী হয়ে ওঠেছেন, চলতি আলাপ সেই বিস্তারে যাচ্ছে না। কিন্তু কীভাবে তিনি টংকপ্রথা বিরোধী কৃষক আন্দোলনের ময়দানে জড়িয়ে পড়েন সেই পরিসর কিছুটা টানা জরুরি। ১৯১৪ সালে স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী ‘অনুশীলন দলে’ যুক্ত হন মণি সিংহ। ১৯২১ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও আন্দোলনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয় এবং চাবাগানের শ্রমিকেরা ঐতিহাসিক ‘মুলুকযাত্রা’ আন্দোলন সংগঠিত করেন। আর এ সময়টাতেই মণি সিংহ অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওঠেন। ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯২৮ থেকে কর্মী হিসেবে দিন বদলের লড়াইয়ে যুক্ত হন। কলকাতায় মেটিয়াবুরুজ শ্রমিক আন্দোলন ও ধাঙ্গর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে জনদ্রোহ ফেনিয়ে ওঠে এবং তৎকালীন পাবলিক পরিসর টগবগ হতে থাকে নানামুখী তৎপরতায়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদেররা ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসকদের অস্ত্রাগার ‘ছিনিয়ে নেওয়ায়’, ব্রিটিশ ব্যাটাগিরি আরো উসকে ওঠে। তখন প্রচলিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ কিংবা কমিউনিস্ট নয়; যাকে খুশি তাকে আটক ও নির্মম শাস্তি দেয় ব্রিটিশ সরকার। এ ঘটনার পর মণি সিংহকেও আটক করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুসং দুর্গাপুর নিজ বাড়িতেই তিনি অন্তরীণ হন। সরকার থেকে তখন কৃষকদের পাট কম বোনার নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু মণি সিংহ পাটের ন্যায্যমূল্য দাবি করায় আবার তার জেল হয়। ১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরুনোর পর সুসং দুর্গাপুরে টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন কিংবা বলা যতে পারে টংক আন্দোলনকে একটা সাংগঠনিক চেহারায় দাঁড় করান। মণি সিংহের বিপ্লবী জীবনের ১৯১৪ থেকে ১৯৪৬ প্রায় বত্রিশ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কারণ এ সময়টাতেই একজন মণি সিংহ কৃষক আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেছেন।
টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং টংকবিপ্লবী ও তৎকালীন কৃষক নেতাদের স্মৃতিভাষ্যে আমরা মণি সিংহকে পাঠ করবার কিছুটা দুঃসাহস করি আসুন।
এক অন্যায় খাজনা-ব্যবস্থার নাম টংক
মণি সিংহ তাঁর ‘জীবন-সংগ্রাম’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন, “কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট ও শ্রীবর্দী এলাকার গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং, গারো, ডালু, কোচ ও রাজবংশীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ’। এই তথ্যখানি উল্লেখ করা জরুরি এ কারণে যে, টংক আন্দোলনের এলাকার ‘বিশেষ পরিচয়কে’ আলাপে টেনে আনা। কারণ টংক কিংবা এমনকি তেভাগার মতো ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বিবরণগুলো বরাবরই ‘বাঙালি অধিপতি আয়নায়’ দেখা হয়। গায়েব হয়ে যায় আদিবাসী নিম্নবর্গের ইতিহাস। টংক আন্দোলনের জন্মভূমি ঐতিহাসিকভাবেই আদিবাসী-অঞ্চল।
মান্দি বা গারো, কোচ ও ডালুরা এই অঞ্চলের পাহাড়ি টিলায় জুম-আবাদ করত। আবার হাজং, বানাই, হদি, রাজবংশীরা সমতলের লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিআবাদ করত। ব্রিটিশ উপনিবেশকালেই এ অঞ্চলে জোর করে জুম-আবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। ভূমির উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার চুরমার হয়ে যায়। অধিকাংশ জমি হয়ে যায় রাষ্ট্রের সম্পত্তি। বনবিভাগের মাধ্যমে বিশাল চালা বা উঁচু টিলা জমি কেড়ে নেয় রাষ্ট্র। অপরদিকে সমতল জমি হয়ে যায় ব্রিটিশ উপনিবেশের জমিদারির অংশ। উল্লিখিত অঞ্চলটি একসময় বহু বুনো প্রাণী ও উদ্ভিদের এক বিরল বাস্তুতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সুসংয়ের মহারাজা শ্রী ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহের ‘গারো পাহাড়ে শিকার কাহিনি (২০১৮)’ বইতে নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অঞ্চলের যে বিবরণ দিয়েছেন তার কিছুই আজ নেই। এশীয় হাতির এক অন্যতম বিচরণস্থল এই এলাকা। হাজং ও মান্দিদের কাছে হাতি খুব পবিত্র প্রাণী। হাতির কোনো অনিষ্ট করা পাপ। কিন্তু ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন শুরু হলে সরকার যুদ্ধ বাহাদুরির জন্য বনের হাতি ধরতে বাধ্য করলো হাজংদের। শুরু হলো ‘হাতি বেগার প্রথার’ মতো জুলুম। বনের হাতি ধরতে গিয়ে নিহত হলো বহু আদিবাসী মানুষ।
বনের হাতি ধরে বিক্রি করা পাপ বলে গ্রামে গ্রামে হাজংরা ফুঁসে ওঠে। সংগঠিত করে ‘হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলন’। বনের হাতির প্রাণ বাঁচাতে হাজংরা ‘রাজা অবাধ্য’ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার নির্দয়ভাবে হাতিখোদা বিপ্লবীদের হত্যা করে। মনা হাজং, গোরাচাঁদ হাজং, সোয়া হাজং, রতি হাজং, মংলা হাজং, বেহারী হাজং, জগা হাজং, বাঘা হাজং হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে হাতিখেদা আইনত নিষিদ্ধ হয়। ১৮৮৪ সালের ১৯ মে ব্রিটিশ সরকার সুসং জমিদারদের কাছ থেকে হাতিখেদা তৈরির ক্ষমতা তুলে নেয়। বনের হাতি ধরে বিক্রি করার কাজ বন্ধ হওয়াতে জমিদারগণ আরো অন্য যেকোনোভাবে বেশি খাজনা আদায়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর বেশি জমিদারি জুলুমের বেশি অর্থের লোভ থেকেই টংকপ্রথা জারি হয়।
অন্যায় জমিদারিব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা নামের নির্মম সব খাজনাপ্রথা ছিল। গারো পাহাড়ের পাদদেশের দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দী এবং খাসি পাহাড় সীমান্তবর্তী এলাকা তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরে প্রচলিত ছিল টংকপ্রথা নামে তেমনি এক শোষণমূলক ব্যবস্থা। জোত-স্বত্ব জমির বন্দোবস্তি নিতে হলে সোয়া একর জমির জন্য জমিদারকে একশ থেকে দুইশ টাকা নজরানা দিতে হতো। কিন্তু সেসময় কৃষকদের কাছে এতো বেশি নগদ টাকা থাকতো না। তাই গরিষ্ঠভাগ আদিবাসী কৃষক টংকপ্রথার মাধ্যমে জমি চাষ করতে বাধ্য হতো। সেসময় জোত-জমির খাজনা সোয়া একর জমির জন্য ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। তখন প্রতিমণ ধানের দর ছিল প্রায় আড়াই টাকা। কিন্তু টংকপ্রথার কারণে সোয়া একর জমির জন্য জমিদারকে ধান দিতে হতো বছরে প্রায় সাত থেকে পনের মণ। প্রতিবছর এই ধান খাজনা বাড়তে থাকে। কারণ বছরে কৃষিজমি নিলাম ডাকতো জমিদার। যে কৃষক বেশি ধান দেয়ার ঘোষণা দিতো, সেই জমি চাষের সুযোগ পেত। গ্রামে গ্রামে ক্ষুব্ধ হাজংরা টংকের বিরোধিতা করতে থাকে। বিরোধীদের ওপর আসে জুলুম ও নির্যাতন। তখনও আন্দোলনের কোনো কাঠামোগত আদল গড়ে ওঠেনি।
১৯৩৭ সালের দিকে সোয়া একরের জন্য ১৫ মণ ধান খাজনা দিতে বাধ্য করা হয় কৃষকদের। মণি সিংহ তাঁর ‘জীবন-সংগ্রামে’ লিখেছেন, টংকপ্রথার কারণে সোয়া একর জমির জন্য বছরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো প্রায় ১১ থেকে ১৭ টাকা বেশি। তিনি এই প্রথাকে ‘জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই অন্যায় প্রথার মাধ্যমে সুসংয়ের জমিদার বছরে প্রায় দুই লাখ মণ ধান আদায় করতেন। গরিব আদিবাসী কী বাঙালিদের পক্ষে কোনোভাবেই টংকের এতে খাজনা ধান দেয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি শিলাবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফসল বিনষ্ট হলেও টংকের খাজনা ধান যেকোনোভাবেই জমা দিতে হতো।
মণি সিংহ এসময় হাজংদের সঙ্গে একাত্ম হন এবং টংকপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তিনি প্রথমে তাঁর নিজের জমিদারি এলাকার কৃষিজমিতে টংকপ্রথা বিলুপ্ত করেন। এই আন্দোলন প্রায় ১৯৫০ পর্যন্ত জমিদারি প্রথা বিলোপ অবধি মেঘালয় সীমান্তের গ্রামে গ্রামে কোনো না কোনো ভাবে জীবন্ত ছিল।
টংকের প্রধান চার পর্ব
টংক, নানকার ও তেভাগা প্রায় সমসাময়িককালে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। দেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে গড়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলন ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জনপরিসরকে প্রস্তুত করে। প্রায় একইসময়ে ১৯৩০ সালে দেশের আরেক সীমান্তবর্তী এলাকা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, কমলগঞ্জে শুরু হয় পৃথিমপাশার জমিদার আল আমজাদ খানের নিপীড়ন। লীলাবর্তী শর্মার নেতৃত্বে সংগঠিত হয় ভানুবিল আন্দোলন।
টংক আন্দোলন প্রধানত চারটি প্রধানপর্বে সংগঠিত হয়। সুনামগঞ্জের বেহেলী গ্রামে ১৯৩৭ সালে ‘সুরমা উপত্যকা প্রাদেশিক কৃষক সভার প্রথম সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। ভাসান পানি আন্দোলনের সংগঠন কমরেড মধ্যনগরের এক আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, মণি সিংহও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আগে থেকেই অবিচ্ছিন্ন দানা বাঁধা প্রতিরোধ এবং দ্রোহ সমন্বিত করে এ সময়টাতেই টংক আন্দোলনের প্রথমপর্ব শুরু হয়। এটিও স্মরণে রাখা জরুরি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব তখন কৃষকদের সংগঠিত করা এবং ঔপনিবেশিক জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠতে থাকে।
১৯৩৮ সালে কুমিল্লায় সারা-ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালে কিশোরগঞ্জে জেলা কৃষক সম্মেলন হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কৃষক সম্মেলন বন্ধ থাকে। ১৯৪০ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর ও সুনামগঞ্জের মেঘালয় সীমান্তে একটি জরিপ চালায়। তারপর কোথায় অর্ধেক, কোথাও তারচেয়ে কিছু কম টংক ধান খাজনা ধার্য করা হয়। কিন্তু নির্দয় টংক-শোষণ রয়েই যায়।
১৯৩৯ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে তীব্র খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ শুরু হলে গ্রামে গ্রামে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। কমরেড হেনা দাস তাঁর ‘চার পুরুষের কাহিনী (২০০৪)’ শীর্ষক জীবনকথায় সেই সময়কার নারী কমরেডদের বিষয়ে লিখেছেন, তাদেরই একজন যুঁইফুল বসু (রায়), যিনি সুসং দুর্গাপুর অঞ্চলে হাজং নারীদের সংগঠিতকরণেও ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষক এবং রাজনীতিক সুনামগঞ্জের কলায়া নিবাসী বিপিন বিহারী তালুকদারের ‘ডায়েরির পাতা থেকে (২০১৮)’ বইতে ১৯৪৩ সালে কলায়া গ্রামে ‘সুরমা উপত্যকা বিভাগীয় কৃষক সম্মিলনীর বার্ষিক অধিবেশন’ আয়োজনের বিবরণ আছে। দেখা যায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান গেয়ে গেয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরেে মুষ্টিভিক্ষা যারা করেছেন, তাদের ভেতর অনিমা দাশ (সিংহ) অন্যতম। ১৯৪৩ সালে সুসং-দুর্গাপুরে জেলা কৃষক সম্মেলনে আদিবাসী-বাঙালি মিলে প্রায় সাত হাজার মানুষ উপস্থিত হন। এই সম্মেলনে টংকপ্রথা সম্পূর্ণ উচ্ছেদের দাবি জানানো হয়। শুরু হয় টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয়পর্ব।
১৯৪৫ সালের ৪ থেকে ৫ এপ্রিল নেত্রকোণায় নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নাগড়া মাঠে। মণি সিংহ ছিলেন এই বিশাল সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় এবং প্রতিবেলা আহার করে প্রায় একুশ হাজার লোক। কমরেড হৃদয় হাজংয়ের আদলে আট ফুট উচ্চতার এক বিশাল ভাস্কর্য তৈরি করেন পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর থেকে আগত লক্ষী পাল। ভাস্কর্যটি বসানো হয় নাগড়ার বিশাল মাঠে সমাবেশস্থলের সামনে। ভাস্কর্যটি খুব প্রতীকী, হাতের শেকল ভেঙে গেছে কিন্তু পায়ের শেকল রয়ে গেছে। মণি সিংহ ‘জীবন-সংগ্রামে’ জানাচ্ছেন, ‘এই অতুলনীয় অর্থবহ ভাস্কর্য-শিল্পের দর্শকমাত্রই অকুন্ঠ প্রশংসা করেন।’
শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে প্রায় শত মাইল রাস্তা হেঁটে এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলন হাজার হাজার হাজং নারী। নেত্রকোণার সারা-ভারত কৃষক সম্মেলনের সেই অভিজ্ঞতা জানতে বহুজনের কাছে গিয়েছি। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আলাপ হয় কৃষকনেতা আবু চাঁনের সঙ্গে। নেত্রকোণা আটপাড়ার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের পুখলগাঁওয়ের নিজ বাড়িতে শতবর্ষী এই নেতা বলেন, “আমরা মুগী, জোনালু ভাত খাইয়া সভায় গেছি। রামেশ্বরপুরের রজ্জব আলীরা গেছে লোহাটাং খাইয়া। আমরা চাইল, চিড়া লইয়া গেছি। মাডি দিয়া একটা বড় হাইজং বেডারে বানাইছিল। সব মাতবরি হাইজংরাই করছে। আমরা সবরে মাতবরি দিছিল মনি সিং। এই সভার পরে আমরার কিছু লাভ অইছিল। আগে খত দিয়া ট্যাহা আনতে অইতো, টংক দিয়া ধান নিত, এই সভার পরে ইতা বাতিল অয়।”
১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হয় টংক আন্দোলনের রক্তাক্ত তৃতীয় পর্ব। ১৯৪৬ সালের পয়লা জানুয়ারি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির আয়োজনে সুসং দুর্গাপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে টংক আন্দোলনের নীতি ও কৌশল নিয়ে এক সমাবেশ হয়। রাশিমনি, কুমুদিনী, দিস্তামণি, ভদ্রমণি, অশ্বমণি, সমাপতী, যাদুমণি, বিপুলা, মালতী, সুরূপা, ললিত, রামনাথ, পরেশচন্দ্র, বিপিন, মঙ্গল, বাসন্তি ও নবীন হাজংরা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কলমাকান্দার লেঙ্গুরার নয়ানকান্দির নবীন হাজংয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। ২০১৩ সালে তাঁর বাড়িতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, সেই সভাটি মূলত পরিচালনা করেছিলেন মণি সিংহ। ১৯৪৬ সালে দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনী সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে এবং গ্রাম ঘুরে ঘুরে হাজং বাড়িতে হামলা করে এবং নির্যাতন শুরু করে। হাজং বাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি বাড়িতে বাস্তুস্থান এবং বানা তাঁত থাকে। হামলা এড়াতে তখন গ্রামে গ্রামে হাজং তাঁত পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর সেই থেকে হাজং গ্রাম তাঁতশূন্য হয়েছে। একই সালের ৩১ ডিসেম্বর টংক নেতা লংকেশ্বর হাজংকে খুঁজতে বহেরাতলী গ্রামে আসে ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর পুরুষেরা।
লংকেশ্বরকে না পেয়ে তার স্ত্রী টংকনেতা কুমুদিনীকে টেনে হেঁচড়ে ক্যাম্পে নিতে চায়। রাশিমনি হাজং গ্রামবাসীদের নিয়ে ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর সহিংসতা রুখে দাঁড়ান। ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর গুলিতে রাশিমনি হাজংসহ বহুজন শহীদ হন। এরপর বহেরাতলীসহ হাজং গ্রামে শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের নির্মম নিপীড়ন। কলকাতা থেকে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন রাজনীতিক জ্যোতি বসু, আইনজীবী স্নেহাংশু আচার্য এবং সাংবাদিক প্রভাত দাশগুপ্তকে ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য পাঠায়। মণি সিংহ তখন মাঠর্যায়ে সবকিছু সমন্বয় করছেন। এর ভেতর ব্রিটিশ সরকার বহু হাজং নেতাকে আটক করে জেলে পাঠায়, অনেকে অন্তরীণ হন।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে আবারো টংক আন্দোলনের চতুর্থপর্বের নয়াপ্রস্তুতি শুরু হয়। এমদাদ খানের ‘লড়াই সংগাম আন্দোলনে নেত্রকোণা (২০১১)’ বইতে এ সময়ের ডিসেম্বরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের নাগেরপাড়ায় কমিউনিস্ট পার্টি ময়মনসিংহ জেলা কমিটি সভা করে পুনরায় টংক আন্দোলন চাঙ্গা করার সিদ্ধান্তের কথা বলা আছে। কলমাকান্দার লেঙ্গুরার চৈতানগর গ্রামের নীলচান হাজংয়ের টংক ধান জবরদস্তি করে নেয়ার সময় গ্রামবাসী বাধা দেয় এবং নীলচানকে সেই ধান ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস উত্তাল হয়ে ওঠে এবং টংক-বিপ্লবীদের রক্তে কলমাকান্দা লাল হয়ে যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি লেঙ্গুরা বাজারে পুলিশ নির্বিচার গুলি করে এবং প্রায় বিশেরও বেশি হাজং কৃষক শহীদ হন। ১৯৪৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি টংক ধান বাঁচাতে গেলে পুলিশের গুলিতে দুজন শহীদ হন। মণি সিংহ কেবল একা নন, মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তকেও টংক বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে তুলেন। মুক্তাগাছার জমিদার টংক আন্দোলনে সংহতি জানান এবং সাধ্যমতো টংক-বিপ্লবীদের সহযোগিতা করেন। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা রহিত হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন ঔপনিবেশিক জুলুম শুরু হয় হাজং এলাকায়। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন টংকপ্রথা তুলে নেয়ার মিথ্যা সাফাই দিয়ে মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় আরেক বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক শোষণ শুরু করেন। মণি সিংহ টংক আন্দোলনের প্রায় পনের বছরের ইতিহাসে নানাভাবে যুক্ত হয়েছেন। কর্মী, নেতৃত্ব, সমন্বয় কিংবা বিপ্লবী নানাভাবে ঐতিহাসিক এই কৃষক আন্দোলনে মণি সিংহের সাংগঠনিক অবদান থেকেও তাঁর সাংস্কৃতিক আত্মিক অংশগ্রহণটি আমার বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক।
মণি সিংহ অন্যায্য ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছিলেন
সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের ইটাউরী গ্রামের কমরেড লাল মোহন রায়ের কাছে শুনেছি, ভাসান পানি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও মণি সিংহের ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও কৌশল বিষয়ে মণি সিংহ, বরুণ রায়ের সাথে তাদের বহু আলাপ হয়েছে। পংকজ ভট্টাচার্য তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সেইসব দিনে (২০২৩)’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি আলাপ করতে গিয়ে মণিসিংহের প্রসঙ্গ নানাভাবে উত্থাপন করেছেন। বিশেষ করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মণি সিংহের ভূমিকা। পাবনার সাংবাদিক ও রাজনীতিক রণেশ মৈত্র তাঁর ‘আত্মজীবনী (২০২১)’ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতায় তেভাগাবিপ্লবী ইলা মিত্রের বাসায় মণি সিংহের সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিষ্ট পার্টি ও ন্যাপ’ গেরিলা বাহিনী কীভাবে কাজ করবে সেইসব বিষয়ে। বাংলাদেশের জন্ম, বিকাশ ও রূপান্তরে মণি সিংহের অবদান এবং ভূমিকাকে নানাভাবে আলাপ করবার সহ¯্র জায়গা আছে। কিন্তু টংকের মতো কৃষক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও ৪০ বছর (১৯৮৮)’ শীর্ষক পুস্তিকায় লেখক নুরুল ইসলাম টংক, তেভাগা এবং নানকার কৃষক আন্দোলনকে ‘ঐতিহ্যবাহী কৃষক আন্দোলন’ হিসেবে উল্লেখ করে এসব আন্দোলনকে কমিউনিস্ট পার্টির বীরত্বপূর্ণ অর্জন বলে উল্লেখ করেছেন। টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে মণি সিংহ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর অধিপতি ব্যবস্থার জুলুমকে প্রশ্ন করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে এই অবস্থান এক সার্বভৌম খাদ্যব্যবস্থার ইশারা জাগায়।
টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলন কৃষকের নেতৃত্বে কৃষি রূপান্তরের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা। এই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। কারণ ব্রিটিশ উপনিবেশ ও জমিদারি শাসনের পর আজ বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য জগৎ মূলত বহুজাতিক কর্তৃত্ব ও করপারেট উপনিবেশে বন্দি। এমনকি আজ স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কী দেখছি? টংক আন্দোলনের উল্লিখিত অঞ্চলে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান। এতো হাজং, মান্দি, ডালু, হদি, বানাই, কোচ তারা কোথায় গেল? ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্থান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ জাতিরাষ্টের তিন কালপর্বে এই অঞ্চলের জনমিতি নির্দয়ভাবে বদলে ফেলা হয়েছে। টংক প্রথাকে প্রশ্ন করবার ভেতর দিয়ে মণি সিংহ যেভাবে অন্যায় ও অন্যায্যর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই সাহসী ব্যাকরণকে সঙ্গী করে আজ আমাদের জিজ্ঞাসাকে আরো জোরালো করা দরকার।