উপেক্ষিত বাংলাদেশ গণহত্যা

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 25 March 2021, 12:00 PM
Updated : 25 March 2021, 12:00 PM

ইতিহাসে স্মৃতি ধরে রাখার সত্যিই কোনও প্রয়োজন আছে? বিশেষত স্মৃতিটি যখন হিংসার, নিগ্রহের, লাঞ্চনার, ধর্ষণের কিংবা গণহত্যার। জাতিগত সহিংসতায় রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়া রুয়ান্ডার শাসকগোষ্ঠী মনে করে হিংসা আর ঘৃণার সেই স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে ফেলবে। গণহত্যার ইতিহাস তারা পড়ান না, গণহত্যার নথি যাদের হাতে আছে, তাদের রুয়ান্ডায় প্রবেশ নিষেধ। হুগো ব্রিক পরিচালিত ব্ল্যাক আর্থ রাইজিং সিরিজে ইতিহাসে চেপে রাখার রুয়ান্ডার সেই কৌশল দৃশ্যমান হয়।

অনেকেই আবার লাঞ্ছনার আর হিংসার সে ইতিহাসে আগামীর ঠিকানা খুঁজে নিতে চায়। তাইতো একশ বছর পরেও আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান তুর্কিদের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের নীতির কারণে সংঘটিত দুর্ভিক্ষকে গণহত্যার আখ্যা দিয়ে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘকে চাপ দিচ্ছে। নেটফ্লিক্সে প্রচারিত 'দ্য ডেভিল নেক্সট ডোর' সিরিজে নাজিদের গণহত্যার দয় পোল্যান্ডের ওপর চাপানোর অভিযোগ করেছেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। তিনি নেটফ্লিক্সকে চিঠি দিয়ে সিরিজে ব্যবহৃত পোল্যান্ডের বর্তমান ম্যাপের পরিবর্তে পুরনো ম্যাপ ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। অর্থাৎ এই শতকে এসে কেউ গণহত্যার স্বীকৃতি চাচ্ছে, আবার কেউবা চাচ্ছেন নিষ্কৃতি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সার্বিকভাবে গণহত্যার স্মৃতিকে স্মরণ রেখে কি আদৌ কোনো লাভ হবে? সাধারণত জেনোসাইড স্টাডিজের গবেষকরা বলে থাকেন যে, গণহত্যা অস্বীকার নতুন গণহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তুলে। এই ক্ষেত্রে ইতালির সেই ভাবুকের জনপ্রিয় উক্তিটাই যথার্থ, Those who cannot remember the past are condemned to repeat it.

গণহত্যার স্মৃতি স্মরণ করে ও ভিকটিমদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা আরো মানবিক হয়ে উঠি। এ মানবিক হয়ে ওঠা একটি মানবিক সমাজ গঠনের গোড়ার শর্ত।

গণহত্যা-নির্যাতনের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে হয় ইতিহাসের প্রয়োজনে। এটি ইতিহাসের দায়। লাঞ্ছনার, নিগ্রহের ইতিহাস মানুষকে সচেতন করে, বোধ শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। নতুন প্রজন্ম এই নিগ্রহের ইতিহাস থেকে আগামীর শিক্ষা নেয়। যে শিক্ষা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার স্মৃতি একটি মানবিক ইউরোপের রূপরেখা তৈরি করেছে, মানুষের বিবেককে জাগ্রত করেছে।

টুপাক আমারোকে তিনশ বছর ভুলে ছিল লাতিন আমেরিকা। স্প্যানিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়েছিলেন টুপাক। স্প্যানিয়ার্ডরা ফাঁসিতে ঝোলানোর মুহূর্তে টুপাক আমারো মাতা ধরিত্রীকে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন, 'আমি আবার ফিরে আসবো'। টুপাক ফিরে এসেছিল তিনশো বছর পরে, সিমন বলিভারের নেতৃত্বে যখন গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে তুমুল স্বাধীনতার যুদ্ধ তখন টুপাক আমারোর আত্মদান হয়েছিল তাদের অনুপ্রেরণা।

স্মৃতি কিভাবে মানুষের ভেতরের বোধকে জাগ্রত করে সেটি তুলে ধরেছেন সুসান। লিখেছেন- স্মৃতির প্রেক্ষিত নানারকম। হলোকাস্টের স্মৃতি জার্মানিতে একধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। নতুন প্রজন্ম বিনয় আর অপরাধবোধের শিক্ষায় বড় হচ্ছে। ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে উগ্রবাদের প্রতি, একনায়কতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম।

একাত্তরের পরে বাংলার বাণী, সংবাদ, ইত্তেফাক পত্রিকার পাতায় পাতায় নিখোঁজ সংবাদ। বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে সংঘটিত গণহত্যার সংবাদ, বীরাঙ্গনা, নির্যাতিত মানুষের আত্মত্যাগে সয়লাব ছিল পত্রিকার পাতা। মানুষের মনে সজীব ছিল নির্যাতনের-লাঞ্ছনার ইতিহাস। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে মলিন হতে শুরু করে নিখোঁজ মানুষের স্মৃতি। মানুষের স্মৃতি থেকে হারাতে শুরু করে হত্যার, লাঞ্ছনার, নিগ্রহের অভিজ্ঞতা। তিন দশকের সামরিক শাসন, স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা মানুষের স্মৃতিকে মুছে দেয়। মানুষ সত্যিই ভুলে যায় একাত্তরের ভয়াবহ নিগ্রহের, লাঞ্ছনার ইতিহাস, বঞ্চনার স্মৃতি।

মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের, ঘোষণার, সামরিক কৃতিত্বের এবং সেক্টরভিত্তিক ইতিহাসের কাঠামোতে দাঁড় করানো হয়। জনযুদ্ধ ঢাকা পড়ে সামরিক বাহিনীর নানা বীরত্বের গল্পে। এই সময় রণাঙ্গনের অনেকের স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়। স্মৃতিচারণগুলোতে বিজয়ের দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। একাত্তরের একটি ন্যারেটিভ দাঁড়িয়ে যায়। যার মূল অনুষঙ্গ 'বিজয়', কিন্তু একাত্তরের ইতিহাস কতটা বিজয়ের? যে ভূখণ্ডের প্রতি সাতজন লোকের একজন শরণার্থী হয়েছিলেন, প্রতি ১৫ জন নারীর মধ্যে (১৫-৪০ বছর) একজন ধর্ষিত হয়েছিলেন, প্রতি ২০ জন লোকের একজন মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন- সেই জাতির পক্ষে বিজয়ের গল্পে বিমোহিত হওয়ার সুযোগ কোথায়?
বিজয়ের গাঁথায় একাত্তরের জনযুদ্ধের স্বরুপ বোঝানো যায় না। একাত্তর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসে বেঁচে থাকবে বিষাদের সুরে, হারানোর শোকে। গণহত্যা ফিরে আসবে যুদ্ধের ইতিহাসে। একাত্তরের যে চেতনা, একাত্তরের যে স্পিরিট- সেটা হারানোর শোক থেকে জন্ম নিয়েছে। লাঞ্ছনার, বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

অনেকেই ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়কে নিয়ে গর্ব করে। অতীত থেকে ভবিষ্যতের পাঠ নিতে চায়। একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার পর বাংলাদেশ কী চেয়েছে সেটা এখন দেখার বিষয়।

প্রথমত, আমাদের গত পাঁচ দশকের ইতিহাস পাঠ পর্যালোচনায় দেখা যায় আমরা গণহত্যার এ স্মৃতি ভুলে যেতে চেয়েছি। বিজয়ের গল্পে বিমোহিত হয়ে হারানোর ক্ষত শুকানোর চেষ্টা করেছি। বিজয়ী বীরদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উপেক্ষিত হয়েছে গণ শহীদরা, তাদের কোন তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি, দেয়া হয়নি কোন সুযোগ সুবিধা। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে খুব সাধারণ বিষয় মনে হবে, কিন্তু আসলে এর পেছনে রয়েছে একটা রাজনীতি, যার নাম 'গণহত্যার রাজনীতি'।
দ্বিতীয়ত, প্রায় সারা জীবন পরাধীন এই জাতির জাতীয় ইতিহাস নির্মিত হল বীরত্বের গল্পে। ফলে ইতিহাসের এই যে গ্যাপ এর সুযোগ নিয়ে পচাঁত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনকালে গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িতরা আবার সক্রিয় হলো রাষ্ট্রে। আমরা এত বেশি উদাসীন আর ইতিহাসবোধহীন জাতি সেই রক্তের দাগ লেগে থাকা ঘাতকদের ফিরিয়ে এনেছি শাসন ক্ষমতায়। গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে তারা সংগ্রামের ভিন্ন ন্যারেটিভ তৈরি করলেন। বদলিয়ে দেওয়া হল পাঠ্য বইয়ে জাতীয় ইতিহাস। গণহত্যা, বধ্যভূমি কিংবা বীরঙ্গনার চেয়ে রাষ্ট্রের সংগ্রামের মূল নিয়ামক হয়ে দাড়াঁল স্বাধীনতার ঘোষণা।

একাত্তরে সংগঠিত ভয়াবহ গণহত্যা- নির্যাতন কিভাবে বাঙালিরা ভুলে গেল, এটা ভেবে মাঝে মধ্যে অবাক হয়। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এই ভুলে যাওয়ার ইতিহাসতত্ত্ব যখন বিশ্লেষণ করি, স্পষ্টত দেখতে পাই আসলে আমাদের স্মৃতি থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে আমরা জনযুদ্ধ বলি, কিন্তু বিশ্বাস করি না। ইতিহাসে আমরা এটাকে সামরিক বিজয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি, তৈরি করে রেখেছি তার ইতিহাসতত্ত্ব। রাজনৈতিক অনৈক্য, দীর্ঘদিন সামরিক শাসন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ক্ষত তৈরি করেছে। স্বাধীনতার বিরোধীরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাষ্ট্র বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।

তৃতীয়ত, প্রায় তিন দশক বিকৃত ইতিহাস পড়ে বেড়ে উঠেছে অনেকগুলো প্রজন্ম। যারা বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে হিংসার রাজনীতির বিস্তার করা হয়েছে। এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার মানে না, একাত্তরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, এরা বিশ্বাস করে বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধের মতে প্রাণ দিয়েছে। এরা প্রতিষ্ঠা করতে চায় একাত্তরে ভারত নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান ভেঙেছে।
মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতীয় ইতিহাসকে যারা অস্বীকার করছে, বাংলাদেশে তাদের সংখ্যাটি খুব ছোট নয়।আমাদের গণহত্যা যে আন্তর্জাতিকভাবে উপেক্ষিত তার প্রথম কারণ দেশের অনেকেই এই গণহত্যা বিশ্বাস করেন না।

চতুর্থত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সংঘটিত এ গণহত্যা অস্বীকার আন্তর্জাতিক মিডিয়া বা দুনিয়াতেও হয়েছে এবং হচ্ছে। এই অস্বীকারের কারণ যতটা না মতাদর্শিক তার চেয়ে বেশি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও রাজনীতির সাথে জড়িত। একাত্তর সালে ইউরোপের অনেক দেশই মুক্তিযুদ্ধের বিবিধ রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় থাকলেও গণহত্যা বিষয়ে নিরব বা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। মুসলিম দেশের অধিকাংশ দেশই পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, গণহত্যাকে সমর্থন দিয়েছিল এবং অল্প কিছু দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এই মুসলিম দেশসমূহের গণহত্যা অস্বীকারের কারণ মূলত লুকিয়ে ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে তাদের সম্পর্ক ও বনিবনার হিসেব নিকেশের মধ্যে। এই মুসলিম রাষ্ট্রসমূহও পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী শাসনের কবলে ছিল, ফলে তারা পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের কর্মকাণ্ডও গণহত্যাকে সমর্থন দিতে পিছপা হয় নি। এখনো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির যে লড়াই সেখানেও স্বীকারকারী ও অস্বীকারকারী দুই পক্ষেরই নিজস্ব অবস্থানের শেকড় নিহিত থাকে রাষ্ট্রীয় ও আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্কের ভেতর।

জেনোসাইড স্টাডিজের গবেষক গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন গণহত্যা কীভাবে ধাপ ধাপে সংগঠিত হয় তার একটা কার্যকরী ছক এঁকেছেন। গণহত্যা সংগঠনে তিনি ৮টি ধাপ (পরবর্তীতে ১০ টা ধাপ) এর কথা বলেছেন। একটা সমাজ ও রাষ্ট্রে কীভাবে গণহত্যার জমিন তৈরি হয় তারও একটা আভাস এতে পাওয়া যায়। তিনি যে ৮টি ধাপের কথা বলেছেন সেখানে সবশেষ ধাপ হচ্ছে অস্বীকার (ডিনায়েল) করা, মানে খোদ গণহত্যাকে অস্বীকার করতে হবে।

গণহত্যাকারীরা গণহত্যার যাবতীয় নিদর্শন মুছে ফেলার চেষ্টা করে- যেমন, গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলা, লাশ পুড়িয়ে ফেলা, দলিলাদি নষ্ট করে ফেলা ইত্যাদি। তারা যে শুধু অস্বীকারই করে তা না, উল্টো ভিকটিমকেই দোষারোপ করে। রিচার্ড হোভানিসিয়ান বলছেন যে, একটা জাতিগোষ্ঠির মানুষকে হত্যা ও তাদের সাংস্কৃতিক উপাদান ধ্বংসের পর শুধু স্মৃতিটুকুই রয়ে যায়। এরপর এই স্মৃতিটুকুও আক্রমণের শিকার হয়। তার মতে, মানুষকে পুরোপুরি নির্মূল করতে তার স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা দরকার পড়ে। পৃথিবীর প্রায় সকল গণহত্যাকে কেউ না কেউ কোনো না কোন ভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। আর্মেনিয়ান জেনোসাইড ও হলোকাস্ট সেই ডিনায়েলের ধ্রুপদী উদাহরণ।

অ্যাডাম জোন্স গণহত্যা অস্বীকারের প্রায় ৯টি কমন ডিসকোর্সের নমুনা দিয়েছেন। যেমন, প্রথমেই নিহতের সংখ্যা নিয়ে একধরনের আলোচনা তোলা হবে, দাবি করা হবে- hardly anybody died. শর্মিলা বোসদের মতো একদল গবেষক দাঁড়িয়ে যাবেন, বিকৃত তথ্যে যারা মনগড়া ইতিহাস লিখে খ্যাতি পেয়ে যাবেন।

জেনোসাইড ডিনায়েল বা গণহত্যা অস্বীকার যেমন রাষ্ট্রীয় বিষয়াদির সাথে জড়িত তেমনি মতাদর্শিক কারণেও তা হতে পারে। গ্রেগরি স্টেনটন দেখাচ্ছেন তুরস্কের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক-সামরিক সম্পর্কের কারণেই আমেরিকা কখনো আর্মেনিয়ান জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেয়নি। আবার কেউ কেউ মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আবেগ-মোহের কারণে গণহত্যাকে অস্বীকার করেন। যে কোনো মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আবেগ বা এমন প্রবণতাকে জর্জ অরওয়েল নাম দিয়েছিলেন 'জাতীয়তাবাদী মন'। তিনি তার বিখ্যাত 'Notes on Nationalism'  প্রবন্ধে এমন প্রবণতার কিছু নিদর্শন আমাদের সামনে হাজির করেছেন। অনেক বুদ্ধিজীবী যারা হিটলারের গণহত্যা নিয়ে সরব ছিলেন, তারা আবার স্ট্যালিনের গণহত্যা নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন; আবার, অনেক বুদ্ধিজীবী হিটলারের গণহত্যা নিয়েও নীরব ছিলেন। অরওয়েলের ভাষায়-

জাতীয়তাবাদীরা কেবল নিজেদের নৃশংসতাকে অস্বীকারই করে না, বরং এগুলো শুনতে না পারার মত একটা দারুণ ক্ষমতাও আছে তাদের। ছয় বছর যাবৎ হিটলারের ইংরেজ সমর্থকরা 'ড্যাচাউ' এবং 'বুচেনওয়াল্ড' এর অস্তিত্ব সম্পর্কে না জানার মতলব করেছিলেন। এবং যারা জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের জোরালো সমালোচনা করছিলেন, তারা প্রায়ই অজ্ঞাত ছিলেন, অথবা এমনকি খুব অল্প পরিমাণে জ্ঞাত ছিলেন যে রাশিয়াতেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আছে। ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ইংরেজ রুশোফিলদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। বর্তমান যুদ্ধের সময় জার্মান ও পোলিশ ইহুদিদের ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনা অনেক ইংরেজই জানতেন না। তাদের ইহুদিবিদ্বেষ এত বড় অপরাধকেও তাদের চেতনার আড়াল করে রেখে দিয়েছিল।

গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন গণহত্যা অস্বীকারের যতগুলো উপায়ের কথা উল্লেখ করেছেন তার সবকয়টাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক চালানো গণহত্যায় পরিলক্ষিত হয়। এই অঞ্চলে গণহত্যা অস্বীকারের প্রথম যেই লক্ষণটি দেখা যায় তা হচ্ছে 'Number Game', মানে গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা কম করে দেখানোর প্রবণতা। যার ফলে অনেকটা এমনভাবে দেখানো যায় যেন 'গণহত্যা হলেও তা এতোটা ভয়াবহ ছিল না'। এই অস্বীকারের প্রবণতা বাংলাদেশে এতোটাই প্রবল যে দেখা যায় দেশের একটি প্রধানতম রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ সেই দলটির শীর্ষস্থানীয় বহু নেতা ১৯৭১ সালের গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা 'বাড়িয়ে' বলা হচ্ছে বলে দাবি করে থাকেন।

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা সংগঠনকারী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহায়ক সশস্ত্র সহযোগী সংগঠন ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে এই দলের সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে এবং এসব অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর সহ অনেক কেন্দ্রিয় নেতা কর্মীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া এই দলটি কোনোদিন নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চায়নি বরং সিস্টেমেটিক উপায়ে গণহত্যাকে অস্বীকার করে গেছে।

যেমন মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নেওয়ার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা বলেছিলেন, "কেউ সুন্দরী নারীর লোভে, কেউ ভারতীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ করেছে।" এই উক্তির মধ্যে দিয়ে দেখা যায় নির্মম গণহত্যাকে প্রতিহত করতে চাওয়া নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে হেয় করে দেখার একটি প্রবণতা। বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদের ডিন এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম বলেছেন, "যুদ্ধাপরাধী হতে হলে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। বাংলাদেশ সেই যুদ্ধের অংশ ছিল না। এ কারণে বাংলাদেশে কখনও যুদ্ধাপরাধী ছিল না।" এখানে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের একটি পক্ষকে অস্বীকার করে গোটা প্রতিরোধ যুদ্ধটাকেই অস্বীকার করার একটি প্রচেষ্টা। একই ধরনের কথা বলেছেন প্রেস ইন্সটিটিউটের সাবেক সভাপতি সাদেক খান। তিনি মন্তব্য করেন, মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধাপরাধ করেছে, তিনি তাদেরও বিচার দাবী করেন। শেষ উক্তিটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় গণহত্যাকারী এবং গণহত্যা প্রতিহতকারীদের সমান 'অপরাধী' বলে গণহত্যাকারীদের অপরাধকে লঘু করা হচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায় গণহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত ব্যক্তিরা সবসময়ই এই অপরাধকে অস্বীকার করে আসছেন। অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় লক্ষ করলে দেখা যায় অধিকাংশই মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাথে যুক্ত। এই দলটির অ-যুদ্ধাপরাধী সদস্য কিংবা দলীয় মতাদর্শের মানুষজনের ভেতরেও গণহত্যা অস্বীকারের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। আবার এই দলটি যেই বৃহত্তর জোটের অংশ সেই বৃহৎ জোটের (বিশ দলীয় জোট) অধিকাংশ দল মোটাদাগে গণহত্যাকে অস্বীকার বা খাটো করে থাকে। যেহেতু এই বিশ দলীয় জোটকে বলা হয় বাংলাদেশের রাজনীতির দুটি মেরুর একটি মেরু। সেহেতু এই বিষয়টি সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশে গণহত্যা অস্বীকারের প্রবণতা ভয়াবহ।

পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে ও গবেষণাপত্র মুক্তিযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বিষয়, প্রতিরোধ যুদ্ধ ও বিজয়-পর্ব যতটা আলোচিত হয়েছে ততটাই অনালোচিত থেকে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্তৃক গণহত্যা-নির্যাতনের দিকটা। গণহত্যা সম্পর্কে সব মহলে একধরনের নীরবতা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় বারেবারে সমস্যা তৈরি করেছে, কেননা যে কোনো হিসেবেই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্টকে এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে চর্চার জায়গাটা মোটেও শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার যে বয়ান আমরা শুনে অভ্যস্ত তারা সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত। যার ফলে ঢাকা শহরে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনা যতটা আলোচনায় আসে খুলনা জেলার কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা সেভাবে আলোচনায় আসে না।

বাংলাদেশকে গত শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এই গণহত্যাকে অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা বলে দাবি করেছেন। এ সময় যে জেনোসাইডাল রেইপ এর ঘটনা ঘটে সেটাকে কেউ কেউ 'রেইপ অব নানকিং' এর সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু একাত্তরের পরে দেশ ও বিদেশ দুই স্তরেই এই গণহত্যা সম্পর্কে অদ্ভুত নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। এই নিরবতা মোটেও রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। দেশের প্রেক্ষিতে আলোচনাকালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই এই নীরবতার জন্যে দায়ী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় রাজনৈতিক মঞ্চে যে পটপরিবর্তন ঘটে তার ফলেই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী অংশ রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করে। শান্তি কমিটি- রাজাকার-আলবদর নেতারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসীন হোন। তারা শুরুতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। এরপর শুরু হয় গণহত্যা বিষয়ে নীরবতার পালা, নীরবতা একসময় নিয়ে যায় তথ্য-বিকৃতির দিকে, তথ্য-বিকৃতি জন্ম দেয় গণহত্যা অস্বীকারের রাজনীতি।