Published : 05 Oct 2020, 02:50 PM
বিশ শতকের বাংলা আর বাঙালির ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে দেশভাগ এবং দেশভাগজনিত পূর্বাপর পরিস্থিতি একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকে। এই পর্যায়টি সবসময় আবেগ এবং পক্ষপাতিত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাতিরেকে যে সবসময়ে দুই বাংলাতেই আলোচিত হয়েছে, এটা জোর গলায় বলা যায় না। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ বিশ শতকের বাঙালির জনজীবনের সার্বিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে, ধর্মীয় পরিচয়কে দূরে রেখে, ধর্মীয় ভাবাবেগকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখে, যেরকম নির্মোহ, নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে, পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তেমনটা সবসময়ে হয়নি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের ইতিহাসবিদ যেমন তাদের গবেষণাতে মুসলমান সমাজের ভূমিকা, অবদান সম্পর্কে প্রচুর ইতিবাচক তথ্য দিয়েও সিদ্ধান্ত টানার ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছিলেন। সেই পরিচয় দেশের প্রথম স্বাধীনতার লড়াইয়ের (১৮৫৭) উপাদান উপস্থাপনের ক্ষেত্রকে অবলম্বন করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তার হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনাই ঐতিহাসিকের চেতনার থেকে বড় হয়ে উঠেছিল। আবার ড. অমলেন্দু দে'র মতো বামপন্থী শিবিরের মানুষ মুসলমান সমাজ সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাসনির্ভর, শ্রদ্ধাজ্ঞাপক তথ্য উপস্থাপিত করলেও, ফজলুল হক এবং তার পরিবার ব্যাতীত অন্য কারো সম্পর্কে আদৌ বিশেষ ইতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন বলে, বঙ্গজননী সুফিয়া কামালকেও তিনি মুক্তকন্ঠে প্রগতিশীল বলতে পারতেন না। অথচ তসলিমা নাসরিনের মতো ব্যক্তিত্ব যার একমাত্র কাজ হল পবিত্র ইসলামের বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সংঘাত তৈরির ভেতর দিয়ে আত্মপ্রচার ও আত্মসমৃদ্ধি অর্জন, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে সঙ্কোচ ছিল না অমলেন্দু দে'র।
এই পর্যায়ের ইতিহাসবিদেরা পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে দেশভাগের দায় যতটা মুসলিম লীগের উপর চাপিয়েছেন তার সিকিভাগ দায় তারা চাপাননি আরএসএস, হিন্দু মহাসভাসহ গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের উপরে। মুসলিম লীগের ভেতরে মুসলীম জাতীয়তার তত্ত্বে কট্টোরপন্থী মানুষ অবশ্যই ছিলেন। এই অংশের মানুষেরাই যে সম্প্রীতির চেতনায় বিশ্বাসী মুসলমানদের একটা বড় অংশকে দেশভাগের কালে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছিলেন, যার দায় পূর্বতন পূর্বপাকিস্থানকে যেমন দিতে হয়েছে, তার দায় তেমন আজও স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকেও চোকাতে হয়। অথচ সব মুসলীম লীগের সমর্থক, নেতা-কর্মীই যে উগ্র হিন্দু বিরোধিতায় বিশ্বাসী ছিলেন না, এমনকি মুসলীম জাতীয়তায় বিশ্বাসী মানুষের একটা বড় অংশই যে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, এই নির্মোহ ইতিহাসটা আজকের প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয় না। 'লাহোর প্রস্তাবে' যে মুসলিম জাতীয়তার দিকনির্দেশ ছিল, সেটিকে যে পরবর্তীতে বিভাজনের উদ্দেশে হিন্দু-মুসলমান উভয় শিবিরেরই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের স্বার্থে দেশভাগের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে–এই সহজ সত্যটাও সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না। মুসলমান সমাজের ওপর ব্রিটিশ এবং একাংশের হিন্দুর আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎপীড়ন যে কতখানি তত্ত্বের বিচারকে অতিক্রম করে স্বত্ত্বের প্রশ্নকে প্রকট করে তুলেছিল, সেই কঠিন, কঠোর উদ্ধৃত অথচ অসহায় ইতিহাস আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয় না।
মুসলমান মানেই মুসলীম লীগ নয়। আর মুসলীম লীগ মানেই সাম্প্রদায়িক নয়, মৌলবাদী নয়। দেশভাগের উগ্র সমর্থক নয়, হিন্দু বিদ্বেষী নয়–এই ইতিহাসগত সত্যকে তুলে ধরার যে দায় ইতিহাসবিদদের আছে, রাজনীতিকদের আছে, সাহিত্যিকদের আছে, সমাজকর্মীদের আছে–এটা অন্নদাশঙ্কর রায়, কাজী আবদুল ওদুদ, সুফিয়া কামাল, রেজাউল করীম, গৌরী আইয়ুব, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফিদের মতো হাতেগোনা মানুষ ছাড়া কেউ মনে রাখেননি। রাজনীতিকদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জ্যোতি বসু, মুজফফর আহমদ, হোসেন শাহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহদের পরের প্রজন্মে হাতে গোনা মানুষ, যেমন; শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গে মহ. সেলিম মনে রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতি করা গৌতম দেবের মতো মানুষও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রদায়িকতা বোঝাতে মমতা মুসলীম লীগ হয়ে গেছেন, অবলীলায় বলে দেন। বাংলায় মুসলীম লীগের ভেতরে যে একটা ধর্মপ্রাণ অথচ পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ধারা ছিল, সেই চর্চাটাই কখনো বিভাগোত্তর কালে হয়নি। তাই গৌতম দেবের মতো মানুষ সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহের সঙ্গে রাজনীতি করেও থেকে গিয়েছিলেন আরশিনগরে বাস করা, পড়শিকে না চেনা একজন মানুষ। কারণ, মনসুর হাবিবুল্লাহের মাতুল আবুল হাশিম (১৯০৫, ২৭ জানুয়ারি-১৯৭৪, ৫ অক্টোবর) ছিলেন দেশভাগ কালে মুসলিম লীগের বাংলা তথা অবিভক্ত ভারতের অন্যতম প্রধান একজন নেতা, মুসলিম লীগের বাংলা শাখার সম্পাদক যিনি বিশ্বাস করতেন বহুজাতির সমষ্টি এই ভারতকে, ভারতের মানুষকে, সংস্কৃতিকে, সভ্যতাকে, অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে, বসুধাকে খণ্ড ও ক্ষুদ্র করে দেখার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে না। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার চিন্তার অন্যতম স্থপতি আবুল হাশিমকে নিয়ে এক বিন্দু চর্চা আমরা করিনি। মুসলিম লীগের ভেতর বামপন্থী চেতনা যিনি প্রবাহিত করেছিলেন, বদিউজ্জামান ইলিয়াসের (বগুড়ার মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন, বাংলা সাহিত্যের ঝড়ের পাখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আব্বা) মতো মানুষদের নিয়ে যিনি বদলে দিতে চেয়েছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদের কোটরে বন্দি মুসলিম লীগকে, সেই মানুষটিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা একদিনের জন্যেও কি চর্চা করেছেন? শ্যামাপ্রসাদের সাঙাত হয়ে গোটা পূর্ববঙ্গে যে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব স্তরের হিন্দুদের ক্ষেপিয়েছেন, তারপর দেশভাগ হলে কেবল বর্ণহিন্দুদের জন্যে ভেবেছেন, দলিত, তপশিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত হিন্দুদের দিকে ফিরেও তাকাননি, সেই এন সি চ্যাটার্জী ব্যক্তি সংঘাতের জেরে হিন্দু মহাসভা ত্যাগ করেন। লোকসভার উপনির্বাচনে এহেন ব্যক্তিকে সমর্থন করে জেতাতে পিছপা হননি পশ্চিমবঙ্গে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু তাদের কোনো স্তরের নেতা, কর্মী, সমর্থক একটিবারের জন্যেও বর্ধমানের ভূমিপুত্র, বহুত্ববাদী চেতনার ভারতকে টিকিয়ে রাখতে জিন্নাহর চক্ষুশূল হওয়া আবুল হাশিমকে স্মরণ করেনি।
মুসলমান সমাজের ওপর হিন্দু সমাজের ধারাবাহিক আর্থিক ও সামাজিক শোষণ মুসলমান সমাজে নবজাগরণের ফলে একটা বড় অংশের ভিতরে ক্ষোভকে দানা বাঁধার মতো জায়গায় নিয়ে আসে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মুসলমানদের ক্ষোভকে সম্বল করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মুসলমান সমাজের যে অংশ উঠে আসতে থাকে তাদের ভেতরে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এর পাশাপাশি উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতাকে সংহত করতে যে জাতীয়তার চেতনা বিকাশ লাভ করতে থাকে, প্রায় শুরু থেকেই তা বিকশিত হয় 'হিন্দু জাতীয়তার' রূপ ধরে। মুসলমান সমাজ ভারতের প্রথম জাতীয় সংগ্রামে (১৮৫৭) ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেও তিলক, বঙ্কিম, অরবিন্দের চেতনায় যে জাতীয়তাবাদ সমৃদ্ধ হয় সেই বোধে মুসলমানকে আপন করে নেওয়ার পরিবর্তে ঘৃণার মানসিকতা বৃদ্ধির দিকেই অনেক বেশি ঝোঁক দেখা যায়। এর পাশাপাশি হিন্দু মহাসভা ও তাদের মানসিকতাসম্পন্ন আরো বহু সংগঠন এবং আরএসএস (জন্ম ১৯২৫) যেভাবে সামাজিক মেরুকরণকে তীব্র করে রাজনীতির পরিবেশকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভিমুখ দিতে থাকে, তার পাল্টা হিসেবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার অঙ্গ হিসেবেই মুসলিম জাতীয়তার ধারণা দানা বাঁধতে থাকে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের প্রথমপর্ব কিন্তু আদৌ সাম্প্রদায়িকসংশ্রবপূর্ণ ছিল না। তার রাজনৈতিক জীবনের পরিপূর্ণপর্বে, ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজে পাঠরত ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি তাকে বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন। সে কথাকে ন্যুনতম পাত্তাও কিন্তু জিন্নাহ দেননি। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যে 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপন করেছিলেন যাকে বিকৃতভাবে 'পাকিস্থান প্রস্তাব' বলা হয়, সেই প্রস্তাবেও বিচ্ছিন্নতার কথা কখনোই বলা হয়নি। বরঞ্চ তার অনেক আগে লাহোর থেকে প্রকাশিত হিন্দু আধিপত্যের পত্রিকা 'ট্রিবিউন', লালা লাজপত রাই প্রমুখেরা হিন্দু স্বার্থরক্ষায় দেশভাগের কথা বলে আসছিলেন। আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসুরা যখন অখণ্ড বাংলার দাবি তুলেছিলেন, তখন তাদের অন্যতম প্রধান যুক্তি এটাই ছিল যে, লাহোর প্রস্তাবে কখনোই দেশভাগের কথা বলা হয়নি। বাংলাভাগ তো নয়-ই। তাহলে কেন বাংলাকে ভাগ করা হচ্ছে?
আবুল হাশিমের প্রমাতামহ আবদুল জব্বার ছিলেন উনিশ শতকের জাগরণের একজন অগ্রদূত। উনিশ শতকের জাগরণে যে মুসলমান সমাজেরও কোনো কোনো মানুষের ঐতিহাসিক অবদান ছিল–এটা বেশিরভাগ ভারতীয় ঐতিহাসিকই স্বীকার করতে চান না। ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ হিসেবে রামমোহন রায়ের বেশ কিছু আগেই যে হুগলীর দানবীর হাজি মহম্মদ মুহসীন নিজেকে মেলে ধরেছিলেন–এটা স্বীকারেও ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠতে পারেন না। তাই আবুল হাশিমের প্রমাতামহ আবদুল জাব্বারের উনিশ শতকের নবজাগরণে ভূমিকা অনুল্লিখিতই থেকে যায়। তার মতো মানুষকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েও বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলমান সমাজকে অনৈতিক, অনৈতিহাসিকভাবে কলঙ্কিতই কেবল করে গিয়েছেন সেটাও আজ পর্যন্ত কোনো বঙ্কিম জীবনীকার লেখেননি। আবুল হাশিমের ভিতরে তার আব্বা আবুল কাশিম, মাতামহ আবদুল জাব্বারসহ আরো যেসব পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রবাহিত হয়েছিল সেগুলির সম্যক আলোচনা একটা সময়ে বাংলাদেশে হয়েছে। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার শৌখিন মজদুরি করা পশ্চিমবঙ্গে আর দশজন মনীষী যারা জন্মসূত্রে মুসলমান, তাদের নিয়ে যেমন আলোচনা হয় নাই বলা যেতে পারে, তেমনই এদের নিয়েও তেমন কিছুই হয়নি। অথচ বাংলা, বাঙালির সংস্কৃতির শেকড়ে এদের অধিষ্ঠান!
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে '৪৬-এর দাঙ্গার জন্যে দায়ী না করে জল খান না – এমন প্রগতিশীল(!) হিন্দু বাঙালির অভাব ভারতে নেই। অথচ জ্যোতি বসুর মতো রাজনীতিক সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। '৪৬ এর স্মৃতিচারণ করে বর্তমান নিবন্ধকারকে জ্যোতি বাবু বলেছিলেন; দাঙ্গার সময়ে, দাঙ্গা থামাতে পরামর্শ করতে তিনি এবং সোমনাথ লাহিড়ী কলকাতার পার্ক সার্কাসে বাংলার সেই সময়ের প্রিমিয়ার সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে যান। তারা যেতেই সোহরাওয়ার্দী নিজে তাদের নিয়ে আসেন নিজের শয়নকক্ষে। বলেন; বসবার ঘরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এসেছেন। দাঙ্গাকারীর সঙ্গে তো আপনারা যারা দাঙ্গা থামাতে চান, তারা একাসনে বসতে পারেন না। তাই আপনাদের আমি বেডরুমে নিয়ে এলাম আলোচনার জন্যে।
লাহোর প্রস্তাবকে যখন একটি বিচ্ছিন্নতার ধারক হিসেবে জিন্নাহ উপস্থাপিত করতে তৎপর হন, তখন মুসলিম লীগের বাংলা প্রাদেশিক শাখা কখনোই সেই বিচ্ছিন্নতার গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়নি। মুসলিম লীগের বাংলা শাখার একটা বড় অংশের লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্থান প্রস্তাবে রূপান্তরিত করার অভিপ্রায়ের বিরোধীতার ভেতর দিয়ে সবথেকে বড় যে সত্যটি উঠে আসছে সেটি হল; বাংলার মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জিন্নাহসহ অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের দেশভাগের ভাবনার সঙ্গে সহমত ছিলেন না। বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের একটা বড় অংশের দেশভাগের প্রশ্নে তাদের নিজেদের দলেরই অবাঙালি নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধের ভিতরেই কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের কফিনে পেরেক ঠুকে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বিজয়বৈজয়ন্তী ওড়াবার সলতে পাকাবার কাজটি শুরু হয়েছিল। অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং হিন্দু মহাসভার দাবির অনুকূলে থেকে দেশভাগের ভেতর দিয়েই যে ব্রিটিশেরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে তা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘোষণার ভিতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। অ্যাটলি অবশ্য সেই ঘোষণাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা ধার্য করেছিলেন ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত। যদি না কংগ্রেস আর লীগ পারস্পরিক সমঝোতায় আসতে পারে, না হলে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাল্টা চাপ ওই ঘোষণার ভিতর দিয়ে অ্যাটলি দিয়েছিল। এই ঘোষণাটিকেই মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব যেমন তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে, তেমনটাই করেছিল জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরকার হিন্দু সাম্প্রদায়িক লবি। যার নেতৃত্বে ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন প্রমুখ। পরবর্তীতে এই পর্যায়টিকেই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে প্যাটেলের কৃতিত্ব হিসেবে জওহরলাল নেহরুবিরোধী, জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা অভিহিত করেন। এ নিয়ে প্যাটেলপন্থী তথা ঘোরতর নেহরুবিরোধী জাতীয় কংগ্রেসের বাংলার প্রাদেশিক স্তরের নেতা অতুল্য ঘোষ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে কংগ্রেসের শতবর্ষের কালে ('৮৫) 'ভারতবিভাগ: কার্য ও কারণ' (দেশ, বিশেষ সংখ্যা) লিখেছিলেন। এই অতুল্য ঘোষই হিন্দু স্বার্থে বাংলাভাগ চেয়ে সেইসময়ে পুস্তিকাও লিখেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড একযোগে বাংলাভাগের পক্ষে হিন্দু জনমতকে একত্রিত করতে জোরদার প্রচার চালাতে শুরু করে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম 'স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রে'র প্রস্তাবকে সামনে এনে বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বাংলা ভাগের যাবতীয় ভাবনাতে যে রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতা এবং চেতনার তীব্রতা ছিল, যা মুসলমান সমাজের একটা অংশকেও বিচ্ছিন্নতায় উৎসাহিত করেছিল। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমরা প্রথম থেকেই সেই বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা যাতে বাঙালির মননলোককে গ্রাস না করে, সেইদিকটির ওপরে সবথেকে বেশি নজর দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতা এবং রাজনৈতিক মুসলমান মানসিকতায় যে দেশভাগকেই একমাত্র সমাধান সূত্র হিসেবে ধরা হচ্ছে, এ যুক্তির অন্তঃসারশূন্যতা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী একটি ঐতিহাসিক বক্তৃতা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সাংবাদ সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীর দেওয়া সেই বক্তৃতা ছিল বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ কেন থাকতে হবে, তার পক্ষে অকাট্যযুক্তির সমাহার। স্বাধীন অখণ্ড বাংলা হিন্দু-মুসলমানমানের ধারাবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে কেন বিশেষ প্রয়োজন তা যে যুক্তি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী তুলে ধরেছিলেন জিন্নাহ থেকে নেহরু, প্যাটেল – কেউই সেই যুক্তির পাল্টা যুক্তি দিতে পারেননি (সোহরাওয়ার্দির সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা প্রবন্ধকার Quaid i Azam Papers F458, 64-73 থেকে সংগ্রহ করেছেন)। বাংলাভাগ যে ভারতের বাঙালি হিন্দুদের জন্যে আত্মহত্যার সমতুল্য হবে, অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষাতে সোহরাওয়ার্দী সেইকথা ওই বক্তৃতাতে বলেছিলেন। অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে বাংলাকে যেকোনো অবস্থাতেই ভাগ করা যায় না, একথা সোহরাওয়ার্দী অত্যন্ত জোরের সঙ্গে সেই বক্তৃতাতে বলেছিলেন। অখণ্ড বাংলা যে ভারতীয় উপমহাদেশে সবথেকে সমৃদ্ধ একটি দেশ হবে এটা ছিল এই আন্দোলনকারীদের দৃঢ় প্রত্যয়। সোহরাওয়ার্দী যখন এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন, তরুণ বঙ্গবন্ধু কিন্তু সেই সময়ে তার একান্ত সহযোগী।
বাংলাভাগের জন্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যে আন্দোলন এবং অরাজকতা করছে, তার পেছনে যে প্রত্যক্ষভাবে বিদেশি পুঁজি এবং সেই বিদেশি পুঁজির ভারতীয় দোসরেরা অর্থাৎ; বম্বে এবং গুজরাট, রাজস্থানেরও পুঁজি কাজ করছে – এইকথা প্রথম অত্যন্ত স্পষ্ট করে, জোরের সঙ্গে আবুল হাশিম বলেছিলেন। বাংলাভাগের চক্রান্তের পেছনে বিদেশি পুঁজির খেলার বিষয়টি কিন্তু কমিউনিস্টরাও আবুল কাশেমের মতো এত দৃঢ়তার সঙ্গে, স্পষ্টভাবে সেইদিন বলেননি। '৪৭ সালের ২৯ এপ্রিল, বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে আবুল হাশিম বলেছিলেন; বাংলার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হল হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। তাই এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে পদানত করে রাখবে এটা আদৌ বাস্তবসম্মত কথা নয়। এই পদানত করে রাখার কথা বলে দুটি সম্প্রদায়কেই ভুল বোঝানো হচ্ছে (Star of India, ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৭, পৃষ্ঠা- ২, ৫। সাপ্তাহিক মিল্লাত, ০২.০৪.১৯৪৭, পৃষ্ঠা-১, ২)। যুক্ত বাংলায় নির্বাচন থেকে প্রশাসন পরিচালনা সবক্ষেত্রেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের 'বেঙ্গল প্যাক্ট'কেই আদর্শ করা হবে, একথাও আবুল হাশিম খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন।
সোহরাওয়ার্দীকে যখন '৪৬ এর দাঙ্গার নায়ক হিসেবে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা কার্যত যুগ্মভাবে বঙ্গীয় বিধানসভাতে আক্রমণ করছে, সোহরাওয়ার্দী তখন আইনসভাতে বলেন; লোকেরা আমাকে বাংলার সমস্যা ভারতের অন্য যেকোনো এলাকার সমস্যার থেকে একদম আলাদা করে দেখার কথা বলেন। এর ভেতর দিয়ে আসলে তারা পাকিস্থানের যে আদর্শের কথা তুলে ধরা হচ্ছে, সেই আদর্শকেই মেনে নেন। কারণ, স্বীকার করা হচ্ছে যে, এলাকাভিত্তিক সমস্যার ভিন্নতার ভেতরে কোনো ঐক্যধারা নেই। এই অনৈক্যের সমস্যার কথা যারা বলছেন, তারাই চাইছেন সেগুলির সমাধান। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি আগামী দিনে বৃহত্তর বাংলা কায়েম হবে। সেই বৃহত্তর বাংলাতে বাংলার মানুষ, নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করবে (Star of India-20/01/1947)।
আবুল হাশিম যুক্ত বাংলার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলার কংগ্রেস নেতা শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়দের ও যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে অনুজ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কংগ্রেস দলের সম্পর্ক ঘিরে শরৎ বসু সেই সময়ে নিজের দলেই যথেষ্ট কোনঠাসা ছিলেন। ফলে শরৎ বাবু কতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে এই যুক্তবাংলা আন্দোলনকে গ্রহণ করেছিলেন, সেই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, আর কতখানি জাতীয় কংগ্রেসে নিজের কোনঠাসা অবস্থা কাটিয়ে উঠবার জন্যে এই কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছিলেন, তা তর্ক সাপেক্ষ। তবে কিরণশঙ্কর রায়কে পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারন, পরবর্তীতে, বিধান রায়ের মন্ত্রী হিশেবে কিরণশঙ্করের তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতার সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং অন্নদাশঙ্কর রায়। 'এই সময়' গ্রন্থে কিরণশঙ্কর রায়ের সেই মুসলিম বিদ্বেষের সাক্ষ্য অন্নদাশঙ্কর রেখে গেছেন। আবুল হাশিম দের আন্দোলন সফল না হলেও, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার মৃত্যু ঘটিয়ে, ভাষাভিত্তিক, সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তার বিকাশের প্রশ্নে তাদের আন্দোলন, ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল সংযোজন।