২১শে, ২৬শে, ১৬ই উদযাপন কি শির্ক?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 25 March 2018, 02:39 PM
Updated : 25 March 2018, 02:39 PM

চলে গেছে একুশে, দ্বারে সমাগত ছাব্বিশে, দূরে দাঁড়িয়ে স্মিতহাস্যে ষোলোই।  রক্তক্ষতের অলংকারে সজ্জিত আমাদের তিনটে অভ্রভেদী দিবস।   সাংঘর্ষিক মেরুকরণও আছে, এই তিনটে দিন উদযাপন জাতির এক অংশের কাছে চেতনা ও অস্তিত্বের গর্বিত মেরুদণ্ড, অন্য এক অংশের কাছে সেটা আল্লাহর প্রতি সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ যা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়।

এর নেতৃত্বে আছেন আমাদের ইসলামী নেতৃত্বের একটা অংশ। তাদের ওয়াজ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁরা জাতিকে (প্রধানত: গ্রামগঞ্জের গণমানসকে)  কী বিষয়ে, কোন দিকে ও কী পদ্ধতিতে প্রভাবিত করছেন।

তাঁরা বলেন শির্ক হতে পারে বিশ্বাসে, মুখের কথায়, আচার ব্যবহারে, ইবাদতের মধ্যে এমনকি ভাষার মধ্যেও যেমন আল্লাহকে 'খোদা' বলা, বান্দার কিছু নাম যেমন বন্দে আলী, গোলাম নবী, গোলাম মোস্তফা, গোলাম রসুল, গোলাম হোসেন ইত্যাদি।  অনেকের শির্কের তালিকায় আরো আছে রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা, মজহাব না মানা, ঘরে ছবি বা মূর্তি রাখা,  যে কোনো দিবস পালন যেমন জন্ম-মৃত্যুদিবস, বাংলা ইংরেজি নববর্ষ, ভ্যালেন্টাইন ডে সহ একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর ইত্যাদি।

কিছু বক্তা শান্তভাবে এবং কিছু বক্তা উন্মত্তভাবে হাত ছুঁড়ে কোরানের কিছু আয়াত ও কিছু হাদিস বর্ণনা করে তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।  শির্কের কিছু ব্যাপার নিয়ে তাঁদের মধ্যে তুমুল বিরোধ আছে যেমন পীর-মুরীদি, মাজারপন্থিদের কার্যকলাপ, ওরসে কারো জন্য কিছু মানত করা, ঝাড়ফুঁক-তাবিজ-পাথর, কবরে ফুল দেয়া বা গোলাপ পানি ছিটানো,  'রসুল (সা) গায়েব জানতেন' বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি।  এ বিরোধ এতই তীব্র যে একে অপরকে 'মুশরিক' বলে দাবি করে থাকেন।

এ নিবন্ধের বিষয় একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর উদযাপন/পালন শির্ক কিনা। শহীদ মিনারের প্রতি দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল জামাতের বিরোধিতা সবাই জানেন এবং তাঁরাও সেটা স্পষ্টই বলে থাকেন। যেমন, – 'দৈনিক সংগ্রাম' পত্রিকার ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়: 'আইয়ুব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশি করার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পূজামণ্ডপ বলা যেতে পারে, কিন্তু মিনার কিছুতেই না' – চ্যানেল আই অনলাইন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

জামাত শিবিরের বাধার জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি দীর্ঘ তিরিশ বছর – কালের কণ্ঠ  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১।

শির্কের বিষয়ে তাঁরা বলেন:-

১. আল্লাহ বাকি সব গুনাহ ক্ষমা করতেও পারেন কিন্তু শির্ক সেই কবীরা গুনাহ যা আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না – সুরা নিসা: ৪৮, ১১৬, মায়িদাহ:৭২, আনাম:১৬৩, কাহফ : ১১০, ইমরান: ৬৪, আল জিন: ২৬, আনাম: ৫৯ ইত্যাদি।

২. সহি মুসলিম-৯৩, আবু দাউদ:৩২৩৬(ইফা), ফতহুল বারী ৭/৪৪৮, আবু দাউদ:৪০৩৩, ইবনে মাজাহ ৫২০৪ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু আল্লাহর প্রতি সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ যা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয় সেই 'শির্ক'টা আসলে কি?  তাঁরা বলেন 'শির্ক' শব্দটা এসেছে "শরিক" থেকে, অর্থাৎ কোন কিছুর ওপরে অংশীদার বা যৌথ-মালিকানা।  সম্পত্তি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন অংশীদার থাকে সেরকম।   উদাহরণ – আদি মুসলিম সমাজে  দাস-দাসীর ওপরে যৌথ মালিকানার প্রথা ছিল:-

(ক) হানাফি আইন হেদায়া- পৃষ্ঠা ২৩১:- 'অংশীদারগণ পরস্পরের সম্মতিক্রমে ক্রীতদাসীকে দৈহিক উপভোগ করিতে পারিবে'।

(খ) সহি বোখারী – মদীনা বিশ্ববিদ্যায়ের ডঃ মুহম্মদ মহসীন খান,-  ভল্যুম ৩, হাদিস নং ৬৯৮ –  "আলাহ'র নবী (দঃ) বলিয়াছেন, যদি কেহ কোন এজমালি দাস-দাসীকে নিজ অংশ হইতে মুক্ত করে এবং তাহার কাছে পুরা মুক্তি দিবার মত যথেষ্ট অর্থ থাকে তাহা হইলে তাহার উচিত কোন ন্যায়পরায়ণ লোক দ্বারা সেই দাস-দাসীর উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করা এবং অংশীদারদেরকে তাহাদের অংশের মূল্য দিয়া সেই দাস-দাসীকে মুক্ত করিয়া দেওয়া।  তাহা না হইলে সে শুধু সেই দাস-দাসীকে আংশিক মুক্ত করিল"।  এটা আছে হাদিস ৬৯৭, ৬৯৯, ৭০১, ৭০২ ইত্যাদিতেও।

মাওলানারা বলেন – আল্লাহ'র সাথে শরীক করা মানে একমাত্র আল্লাহ'র যা প্রাপ্য তাতে অন্য কিছুকে বা কাউকে অংশীদার করা।   সে অংশীদার হতে পারে কোনো বস্তু যেমন, গাছ-পাথর-মাজার-প্রতিমা, বা অন্য কোন জীবন্ত বা প্রয়াত মানুষ যেমন পীর আউলিয়া মুর্শিদ এমনকি নবী মুহম্মদ (স) পর্যন্ত।

সব মিলিয়ে শির্কের সংজ্ঞা আছে কোরানের বাংলা অনুবাদে, মওলানা মুহিউদ্দীন খান পৃষ্ঠা ২৫৪ থেকে উদ্ধৃতি:-  "আল্লাহ তাআলার সত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কে যেসব বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, তেমন কোন বিশ্বাস সৃষ্ট বস্তুর ব্যাপারে পোষণ করাই হল শেরক।

এরই কিছু বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:

(ক) জ্ঞানের ক্ষেত্রে শরীক সাব্যস্ত করা:  অর্থাৎ, (১) কোন বুজুর্গ বা পীরের ব্যাপারে এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আমাদের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি অবহিত। (২) কোন জ্যোতিষ পণ্ডিতের কাছে গায়বের সংবাদ জিজ্ঞেস করা কিংবা (৩) কোন বুজুর্গের বাক্যে মঙ্গল দেখে তাকে অনিবার্য মনে করে নেয়া অথবা (৪) কাউকে দূর থেকে ডাকা এবং সাথে সাথে এ কথা বিশ্বাস করা যে, সে আমার ডাক শুনে নিয়েছে অথবা (৫) কারো নামে রোজা রাখা।

(খ) ক্ষমতার ক্ষেত্রে শরীক করা: অর্থাৎ, কাউকে হিত বা অহিত তথা ক্ষতি-বৃদ্ধি সাধনের অধিকারী মনে করা। কারো কাছে উদ্দেশ্য যাঞ্চা করা।  কারো কাছে রুজি-রোজগার বা সন্তান-সন্ততি প্রার্থনা করা।

(গ) এবাদতে শরীক সাব্যস্ত করা: কাউকে সেজদা করা, কারো নামে কোন পশু মুক্ত করা, কারো নামে মানত করা, কারো কবর কিংবা বাড়িঘরের তাওয়াফ করা, আল্লাহ তাআলার কোন হুকুমের তুলনায় ওপর কারো কথা কিংবা কোন প্রথাকে প্রাধান্য দেয়া, কারো সামনে রুকু করার মতো অবনত হওয়া, কারো নামে জীব কোরবানি করা, পার্থিব কাজ-কারবার কিংবা বিবর্তনকে নক্ষত্রের প্রভাব বলে বিশ্বাস করা এবং কোন কোন মাসকে অশুভ মনে করা প্রভৃতি।" উদ্ধৃতি শেষ।

এখন দেখা যাক আমরা আল্লাহ'র কাছে কি প্রার্থনা করি:-

  • জানা অজানা সব অপরাধের ক্ষমা,
  • পরকালে বেহেস্ত প্রাপ্তি ও দোজখ থেকে নাজাত,
  • রোগ শোক বলা মুসিবত থেকে পরিত্রাণ,
  • সন্তান লাভ,
  • পরীক্ষায় ভালো ফল, বিয়ে বা ব্যবসায়ে সাফল্য ইত্যাদির লম্বা তালিকা

ইসলাম তো সিরাতুল মুস্তাকিম অর্থাৎ সহজ সরল ধর্ম।  তাই এবারে একটা সহজ সরল অংক করা যাক।  আমরা যে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ ষোলোই ডিসেম্বর উদযাপন করি তাতে:-

(১) আমরা কী একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর উদযাপন করার সময় ওপরের কোন কিছু করি?  জবাব : না !  প্রশ্নই ওঠেনা।

(২)   আমরা কি দিনগুলোকে ইবাদত করি?  জবাব: না, অবশ্যই করিনা।

(৩) আমরা কি দিনগুলোর কাছে অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করি?  জবাব: না, নিশ্চয়ই করিনা।

(৪) আমরা কি দিনগুলোর কাছে বেহেস্ত প্রার্থনা করি?   জবাব:- না, প্রশ্নই ওঠেনা।

(৫) আমরা কি দিনগুলোর কাছে দোজখ থেকে নাজাত প্রার্থনা করি?  জবাব: না, অবশ্যই করিনা।

(৬) আমরা কি দিনগুলোর কাছে রোগশোক, বালামুসিবত থেকে রেহাই প্রার্থনা করি?  জবাব: না, করিনা।

(৭) আমরা নি:সন্তান হলে দিনগুলোর কাছে কি সন্তান প্রার্থনা করি?  জবাব: না, কখনোই করিনা।

(৮) আমরা কি দিনগুলোর কাছে পরীক্ষায় ভালো ফল, বিয়ে বা ব্যবসায়ে সাফল্য প্রার্থনা করি?  জবাব: না, প্রশ্নই ওঠেনা।

(৯) আমরা কি শহীদ মিনারে, বিজয় স্তম্ভে বা স্মৃতিসৌধে রুকু সেজদা করি?  জবাব: না, করিনা।

তাহলে?  উনাদের সংজ্ঞা মোতাবেকই ওই দিনগুলো পালনে শির্কের লেশমাত্র নেই।

চিন্তার সংঘাত সামাজিক অগ্রগতির চাবিকাঠি।  কিন্তু সেই সংঘাতে কেউ কেউ কতল করা পর্য্ন্ত নেমে এসেছে। ভলটেয়ার বলেছেন – "তোমার বক্তব্যের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় আমি জীবন দেব।"

উনাদের বলার অধিকার আছে, উনারা বলতে থাকুন।  দিনগুলো উদযাপনের অধিকার জাতির আছে, জাতি উদযাপন করে যাবে।   বছর ধরে উনারা 'গান হারাম' বলে চিৎকার করেছেন, জাতি শোনেনি।   সংগীত এখন বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে, হাজারো মেধার সৃষ্টিধর্মী বিশাল কর্মকাণ্ড চলছে, হাজারো লোকের সংসার চলছে, চলবে।   প্রায় নব্বই বছর আগে এই বাংলায় 'বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলন' সংগঠন থেকে  ইসলামের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন করেছিলেন 'শিখাগোষ্ঠী' যাতে জড়িত ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ কাজী আনোয়ারুল কাদীর থেকে বয়োকনিষ্ঠ আবুল ফজল ও কাজী মোতাহার হোসেন পর্যন্ত – যার প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হোসেন ও কাজী আবদুল ওদুদ।  তাঁরা জাতিকে সতর্ক করেছিলেন 'আদেশের নিগ্রহ', 'নিষেধের বিড়ম্বনা' ইত্যাদি নিবন্ধে। বলেছিলেন, জাতিকে ইসলামের নামে এতো এতো শেকলে শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে যার পরিনাম হবে ভয়াবহ – 'নির্বাচিত প্রবন্ধ – আবুল হোসেন' প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা।

আজ কলুষিত রাজনীতির ছত্রছায়ায় বিভিন্ন আদেশের নিগ্রহ ও নিষেধের বিড়ম্বনায় ছেয়ে গেছে দেশ, জাতি হয়েছে বিভ্রান্ত।  কিন্তু ইতিহাসের অটল অমোঘ ধারা বয়ে চলেছে ধীরে, অলক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়তি। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড প্রশ্নাতীত অভ্রভেদী, ইতিহাসে বারবার প্রমাণ হয়েছে সেটা।  তাকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যেতে পারে কিন্তু আখেরে তাকে পরাজিত করার সাধ্য কারো নেই।

দেশের নাম বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান নয়।