কেন শিশুটিকে ছোটমনি নিবাসে পাঠাতেই হলো!

“কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে দুগ্ধপোষ্য একটি শিশু যার নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্য বিদ্যমান ছিল এবং বেশ কিছু মহতী মানুষ তার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল– তা সত্ত্বেও সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হলো তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার।”

আমিনুল সজলআমিনুল সজল
Published : 9 August 2022, 12:55 PM
Updated : 9 August 2022, 12:55 PM

ঘটনার শুরু হয়েছিল একটা মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা দিয়ে। গত ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ট্রাকচাপায় জাহাঙ্গীর আলম, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম ও চার বছরের মেয়ে সানজিদা মারা যায়। এ সময় ট্রাকের চাপায় মায়ের পেট ফেটে বেরিয়ে এসে রাস্তায় জন্ম নেয় একটি শিশু– মর্মান্তিক এ খবরটি মিডিয়ার মাধ্যমে সকলের নজরে আসে। মিরাকল বেবি হিসেবে পরিচিত এই শিশুটি প্রথম দুই দিন নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিল। দুর্ঘটনায় তার হাত ভেঙে গিয়েছিল। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৮ জুলাই রাতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সুস্থ হয়ে উঠলে সদ্য বাবা-মা হারা এ শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। শিশুটির দাদা-দাদি বেঁচে আছেন। কিন্তু, জেলা শিশুকল্যাণ বোর্ড মনে করেছে দাদা-দাদির সংসারে শিশুটিকে দেখাশোনা করার উপযুক্ত কোনো লোক নেই এবং বাড়ির পরিবেশ এই মুহূর্তে শিশুটির লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত নয়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে বের করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কাছে হস্তান্তর করলে, পরে তাকে ঢাকার আজিমপুরের ছোটমনি নিবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে দুগ্ধপোষ্য একটি শিশু যার নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্য বিদ্যমান ছিল এবং বেশ কিছু মহতী মানুষ তার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল– তা সত্ত্বেও কেন সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হলো তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার।

শিশুর লালন-পালনের প্রধান দায়িত্ব মা-বাবার, তাদের অবর্তমানে ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনদের। তবে শিশু আইনের ৮৬ ধারা অনুযায়ী শিশু কল্যাণ বোর্ড বা প্রবেশন কর্মকর্তা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় এনে শিশুর জন্য সবচাইতে উপযুক্ত পরিচর্যার উপায় নির্ধারণ করতে পারে। এই শিশুটির ক্ষেত্রে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে শিশু কল্যাণ বোর্ড তার দাদার উপস্থিতিতে ছোটমনি নিবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালকের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশ হয় যে, শিশুটির দাদার সম্মতিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে জন্মের পরে হাসপাতালে থাকার সময় শিশুটির মৃত বাবা জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই তার ভরণ-পোষণসহ লালন-পালনের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার দাদাও এই কথা বলেছিলেন। এছাড়াও অনেকেই শিশুটিকে দত্তক বা পালতে নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।

প্রথমে পরিবারের সদস্যদের আগ্রহ থাকার কথা জানা গেলেও, পরবর্তীতে কেন তারা আর শিশুটিকে নিলেন না বা ঠিক কোন বিবেচনায় শিশু কল্যাণ বোর্ড মনে করল যে তার পরিবার শিশুটিকে প্রতিপালনের জন্য উপযুক্ত নয় সেটা খুব পরিষ্কার নয়। তবে তার দাদা বলেছেন, তিনি এক বছরের মধ্যে শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। দাদা আরও বলেছেন তিনি যখন খুশি তার নাতিকে দেখতে পারবেন। যদিও ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার আজিমপুরে এসে দরিদ্র দাদার পক্ষে যখন খুশি তখন দেখা কতটা সম্ভবপর হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।

দেশের সাধারণ মানুষ এবং সরকার মা-বাবা, পরিবারের যত্ন বঞ্চিত শিশুদের এতিমখানাতে পাঠানোকে মোটামুটি শিশুদের জন্য একটা ভালো উপায় এবং মহৎ কাজ হিসেবেই দেখে। শুধু বাংলাদেশই না, গোটা পৃথিবীতেই এই ধারণাই ছিল। অনেক প্রাচীন কাল থেকেই, মূলত কুড়িয়ে পাওয়া বা পরিত্যক্ত শিশুদের যত্ন ও পরিচর্যার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র (foundling asylum) প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস পাওয়া যায়। একটা সময় ছিল যখন ইউরোপের কোনো কোনো জায়গায় ‘অপ্রত্যাশিত’ শিশু এবং প্রতিবন্ধি শিশুদের হয় মেরে ফেলা হতো বা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়া হতো যাতে তারা শেষ পর্যন্ত মারা যায়। ৭৮৭ সালের দিকে ইতালির মিলানে ফেলে যাওয়া এরকম শিশুদের দেখ-ভাল করার জন্য চার্চের উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র করার কথা জানা যায়।

ইতালিতেই পরিত্যক্ত শিশুদের আশ্রয়ের জন্য বড় আকারের প্রতিষ্ঠান প্রথম চালু হয় ১৪৪৫ সালের দিকে। সান্তা মারিয়া ডেগল'ইনোসেন্টি নামের এই আশ্রয় কেন্দ্র ১৪৮৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০০ এইরকম শিশুর আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে এই ধরনের আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এরপর ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতিম ও পরিত্যক্ত শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে রাশিয়া ও ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে এতিমখানা ধরনের বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এছাড়া আফ্রিকাতে এইচআইভি-জনিত কারণে মা-বাবা, আত্মীয় হারানো অনেক শিশুর আশ্রয় হয় এতিমখানায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী গোটা বিশ্বের ১৪০ দেশে এখন ২.৭ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন ধরনের শিশু পরিচর্যা প্রতিষ্ঠানে বসবাস করে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ৬৬৬ শিশু এই ধরনের কেন্দ্রে বসবাস করে।

উদ্দেশ্য অনেক মহৎ হলেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ইউরোপে গড়ে ওঠা আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবারের অভাব ইত্যাদি কারণে শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৫০-৭০%। সম্প্রতি অনেক গবেষণায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানে শিশুর যত্নের চেয়ে অযত্নই বেশি হয়। শিশুর বেড়ে ওঠায় প্রতিষ্ঠানিক সেবায় অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব আছে।

প্রতিষ্ঠানে যারা শিশু যত্নের কাজে নিয়োজিত তারা যথাযথ ভাবে প্রশিক্ষিত না। শিশু ও যত্নপ্রদানকারীর মধ্যে যে অনুপাত থাকা জরুরী সেটা অর্জন করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। একেক সময় একেকজন শিশুর পরিচর্যা করার ফলে শিশুর সাথে তাদের কোনো ধরনের আবেগীয় বন্ধন তৈরি হয় না। যেসব সুযোগ-সুবিধা ও যত্ন শিশুর পাওয়া দরকার তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু পায় না। এর মধ্যে পুষ্টিকর খাবার, যথাযথ স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি পোশাক। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানে বেড়ে ওঠা শিশুর শারিরীক ও মানসিক গঠন ও বিকাশে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, দেরি করে বিকাশ ঘটে। খুব কম বয়সী শিশুদের (বিশেষ করে যাদের বয়স ৬ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে) বেলায় ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। আর প্রতিষ্ঠান ছাড়ার পরেও সারা জীবন শিশুদের এই ক্ষতির ভার বয়ে বেড়াতে হয়।

প্রতিষ্ঠানে শিশু লালন-পালনে খরচও অনেক বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে শিশুকে পরিবারে রেখে লালন-পালনের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে লালন-পালনের খরচ আট গুণ বেশি। ইউরোপে গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতিবন্ধিতা নেই এমন শিশুদের ফস্টার ফ্যামিলিতে রেখে লালন-পালনে প্রতি শিশুর জন্য খরচ হয় ১,৯০৭ ইউরো, যা প্রতিষ্ঠানে রেখে করলে হয় ১৪,৮৩৭ ইউরো। আমাদের দেশে তুলনামূলক এই হিসাব আছে কিনা জানা যায়নি। তবে সরকারি শিশু পরিবার, ছোটমনি নিবাস, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র এবং চার হাজারের উপর বেসরকারি এতিমখানায় সরকারি অনুদানে প্রতি বছর বেশ বড় অংকের টাকা খরচ হয়। মোটা দাগে সাড়ে চারশো কোটি টাকা। এ ছাড়াও আরও প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের শিশু সুরক্ষা খাতের খরচের সিংহ ভাগই খরচ হয় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের পেছনে।

প্রতিষ্ঠানে শিশুর বড় হওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে পারিবার কেন্দ্রিক শিশু পরিচর্যার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ১৯১০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানে শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৩০%। পক্ষান্তরে পারিবারিক পরিচর্যার আওতায় এতিম শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে ৬১,০০০ থেকে ২,৭০,০০০ তে। ১৯৮০ সালে দত্তক সহায়তা ও শিশু কল্যাণ আইন পাশ হওয়ার পরে আমেরিকায় এখন প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পরিচর্যা নেই বললেই চলে। ইউরোপেও ধীরে ধীরে কমছে, তবে এখনো অনেক শিশু আছে প্রতিষ্ঠানিক সেবার আওতায়।

এর মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিকল্প পরিচর্যার ওপর জোর দিয়েছে। ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, মাতা-পিতার যত্ন বঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিবার কেন্দ্রিক সেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিভিন্ন রকম পরিবার কেন্দ্রিক সেবার মধ্যে ফস্টার কেয়ার, দত্তক এবং কাফালার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রথম দিকেই শিশু অধিকার সনদ অনুস্বাক্ষর করে। তবে দত্তক সম্পর্কিত অনুচ্ছেদটা বাদ দিয়ে। এরপর ২০০৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিকল্প পরিচর্যার উপর বিশদ গাইডলাইন অনুমোদন করে। ২০১৯ সালে সাধারণ পরিষদ পারিবারিক পরিষেবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একটি রেজ্যুলুশন পাশ করে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আমাদের দেশে দত্তক অনুমোদন দেওয়া হলেও, এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে অপব্যবহারের অভিযোগে তা বাতিল করে দেয়। তবে গার্ডিয়ানশিপের অবয়বে দত্তক এখনো চলে। হিন্দু পারিবারিক আইনে বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে দত্তক এখনো বহাল আছে। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে তখনকার সময়ের জন্য একটা প্রগতিশীল শিশু আইন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের অধীনে। ২০১৩ সালে একটা নতুন শিশু আইন করে সরকার মাতা-পিতার যত্ন বঞ্চিত শিশুর পরিচর্যার জন্য জাতিসংঘের গাইডলাইনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়। বলা হয় পরিবার কেন্দ্রিক পরিচর্যাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা।

সেই শিশু আইনের ৮৪(১) ধারা মতে ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু’– যাদের বিশেষ সুরক্ষা, যত্ন-পরিচর্যা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তাদের পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্বিক ও শিক্ষাগত পটভূমি বিবেচনা পূর্বক, সার্বিক কল্যাণ ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকল্পে, বিকল্প পরিচর্যার (alternative care) উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, বিকল্প পরিচর্যায় প্রেরণের পূর্বে ধারা ৯২ অনুযায়ী শিশুর যাচাই (assessment) সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বিবেচনা করতে হবে।

এই শিশুটির ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইনের বড় কোনো ব্যাত্যয় হয়নি। তবে শিশুটির সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত হয়েছে কিনা তাতে কিছু সন্দেহ থেকে গেছে। কারণ শিশুটির দাদা, তার এক চাচা এবং কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি প্রথমে দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পরে কেন তারা পিছিয়ে গেলেন তা সমাজসেবার প্রতিবেদন না দেখে বলা যাবে না। সমাজসেবা ঠিক কোন কারণ দেখিয়ে দাদার বাড়িতে উপযুক্ত যত্ন হবে না সাব্যস্ত করল তা স্পষ্ট না। তারপরে তাকে পাঠানো হলো দাদার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। দাদার বাড়িতে শিশুটিকে রেখে সমাজসেবা কি তাদের শিশুটি লালন-পালনের জন্য সহযোগিতা করতে পারত না? তাতে করে শিশুটি বাড়িতে পারবারিক পরিবেশে বড় হতো। বিশেষ করে যখন শিশু আইনের ৮৭ ধারায় বলা হয় যে শিশুর যথাযথ পরিচর্যা নিশ্চিত করার জন্য তার মাতা-পিতা এবং তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্যকে কাউন্সেলিংসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের জন্য সমাজসেবা কার্যালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

আমাদের সমাজে শিশুদের এতিমখানা বা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে রাখার একটা প্রবণতা আছে। এতিমখানা ছাড়াও আবাসিক স্কুল-মাদ্রাসা আছে। অনেকে আবার ধর্মীয় বা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে এতিমখানা চালু করেন। তাদের উদ্দেশ্য মহৎ। কেউ পরকালীন শান্তির আশায় আবার কেউ অসহায় এতিমদের সহযোগিতা করার জন্য এটা করে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় যাদের মা-বাবা অথবা মা-বাবার একজন বেঁচে আছেন, এমন শিশুকে সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এতিমখানায় দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক অবিভাবক মনে করেন এতে শিশুর পড়ালেখাটা ঠিক মতো হবে। তবে এই অবিভাবকদের অনেকেরই পারিবারিক গণ্ডির বাইরে প্রতিষ্ঠানে বড় হওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা নাই।

শিশুর বিকাশে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে, শিশুকে যতদূর সম্ভব পারিবারিক পরিবেশে লালন-পালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। মা-বাবা না থাকলে, আত্মীয়-স্বজন, বর্ধিত পরিবার এই দায়িত্ব নিতে পারে। ফস্টার ফ্যামিলি, কমিউনিটিতে রেখে শিশুর লালন-পালন করতে পারে। দত্তক না হলেও অভিভাবকত্বের মাধ্যমেও সমাজের আগ্রহীরা এই ভার নিতে পারে। এই কাজে সমাজসেবা অধিদপ্তর উৎসাহ ও সহযোগিতা করতে পারে। আসলে আইন অনুযায়ী এটা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাজ। যেসব যত্নকারী প্রতিষ্ঠানে শিশু পরিচর্যা করছেন, তারা তখন মা-বাবা, বর্ধিত পরিবারকে এই শিশুদের লালন-পালনের জন্য সহযোগিতা করবেন, লালন-পালনকারীদের প্রশিক্ষণ দেবেন, শিশুদের বিকাশের পর্যবেক্ষণ করবেন। তারা চাকরি হারাবেন না, তাদের কাজের ধরন পরিবর্তন হবে। সরকার এখন যে খরচগুলো করছে প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্যে, তখন এই টাকাটা দিয়ে শিশু ও তার পরিবারকে সহযোগিতা করা যাবে।

তবে এর মানে এই নয় যে, প্রতিষ্ঠান একেবারেই থাকবে না। কিছু প্রতিষ্ঠান থাকবে, তবে তা ব্যবহার হবে কেবল শেষ ব্যবস্থা হিসেবে এবং সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের জন্য। এমন অবস্থা হতে পারে যেখানে শিশুকে প্রতিষ্ঠানে না রেখে আর কোনো উপায় নাই। তখন তাকে প্রতিষ্ঠানে পাঠানো যেতে পারে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানে শিশুর সংখ্যা কম থাকবে, তাদের যত্নও তখন ভালো হবে। তবে প্রতিষ্ঠান কখনো পরিবারের বিকল্প হতে পারে না।

সব শিশু পারিবারিক মমতায় বেড়ে উঠুক। সেই জন্য সকলেরই তৎপর ভূমিকা দরকার।