বিএনপি কি বিকল্প?

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের এই অংশ বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষী। তারা চান বিএনপি আগামী সংসদীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসুক। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তারা চাইতেই পারেন। তবে তারা কি কখনো নিজেদের প্রশ্ন করেন- বিএনপি কি বিকল্প?

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 5 Sept 2022, 12:53 PM
Updated : 5 Sept 2022, 12:53 PM

[এই লেখাটি মূলত নতুন প্রজন্মের জন্য, যাদের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে এবং তারপরে। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি। যারা নিকট ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক অঙ্গনে। এ লেখাটি অর্থনীতি নিয়ে নয়। অথবা, রাজনৈতিক দলের অর্থনৈতিক পরিচালনার ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ঘিরেও নয়। লেখাটি রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনার বিষয় ঘিরে রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ক। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এটা সত্য, রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনার উপাদানগুলোতে অনৈক্যের কারণে দেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও দ্বিধাবিভক্ত। এর আশু নিষ্পত্তি অপরিহার্য। যে জাতি তার রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনায় ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, সে জাতি শুধু আত্মমর্যাদা্য় নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পিছিয়ে পড়ে। এটা প্রমাণিত।]

এটা সত্য, অতীতে বিএনপি কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। কখনও ক্যু-র মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর নির্বাচনে। কখনও জামায়াতের প্রত্যক্ষ, কখনও বা পরোক্ষ সমর্থনে। দলটি ২০১৩ সাল থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে, ক্ষমতায় আসার এ প্রক্রিয়ায় বিএনপি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং দৈনন্দিন জীবনে উৎপাদন ব্যাহত করার পন্থাই বরাবর বেছে নিয়েছে। এর বাইরে কখনও আবার বিপরীত বা ভিন্নধর্মী আদর্শালম্বী ডজন ডজন দলের সাথে আঁতাতও করেছে দলটি। তবে তাতে সফলকাম হয়নি এখনো।

২০১৩ পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হলেও, যথার্থ অর্থে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। সামনে নির্বাচন। এ নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত। তাহলে কি তারা ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করবে? যদি নির্বাচনে ফেরেও, প্রকৃত অর্থেই অংশ নেবে কি? নাকি ২০১৮ সালের মতো শিথিল-উদ্যমে অংশগ্রহণে শুধুই লোক দেখানো উদ্দেশ্য থাকবে?

বিগত বছরগুলোয় দলটির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে বড় ধরনের ধস নেমেছে। নেতৃত্বের অভাব, অনুপযোগী ও অসঙ্গত কৌশল অবলম্বন এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এ ধসের মূল কারণ বলে বাংলাদেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, পত্র-প্ত্রিকার কলাম লেখক, এনজিও কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, এক কথায় সুশীল সমাজের একটি অংশের ধারণা। তারা বিএনপির ভুল কৌশল ও সিদ্ধান্তে নিদারুণভাবে হতাশ; যা তাদের লেখা কলামের শিরোনাম এবং বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। তাদের বক্তব্যে মনে হয় যদি সুযোগ পেতেন, তাহলে তারাই বিএনপির জন্য সঠিক কৌশলগুলো প্রণয়ন ও রূপায়ন করে দিতেন। যেমন, কেউ কেউ বিএনপির নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন – “লন্ডনে বসে ‘ওহি’ পাঠাবেন না। স্কাইপের মাধ্যমে দল পরিচালনা করবেন না। বরং, দুই বছরের মাস্টার্স কিংবা এমফিলে পড়াশোনা করেন”। আবার কখনো নেতাদের মেয়েদেরকে বিএনপির নেতৃত্বে আনা উত্তম হবে বলে উপদেশ দেন।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের এই অংশ বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষী। তারা চান বিএনপি আগামী সংসদীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসুক। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তারা চাইতেই পারেন। তবে তারা কি কখনো নিজেদের প্রশ্ন করেন- বিএনপি কি বিকল্প?

অনেকে ভাবতে পারেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? অতীতে যে দল কয়েকবার ক্ষমতায় এসেছে, সে দল ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিকল্প নয় কেন?

বিএনপি কেন বিকল্প নয়, তা তাদের অর্থনৈতিক পরিচালনার দক্ষতা ঘিরে সিদ্ধান্ত নেওয়া অথবা উপসংহার টানার বিষয় নয়। দলটি মোট চার-চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। উন্নয়নের লক্ষ্যে ৭০ দশকের খাল কাটা থেকে শুরু করে ২০০১ এর পর বিদ্যুতায়নের মতো প্রকল্পও হাতে নেয়। এতে দেশের উন্নতি কতদূর হয়েছে তা সকলের জানা। তবে হ্যাঁ, ‘নয়েজ’ হয়েছে বেশ। বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক মাপকাঠিতে বিশ্বসংস্থাগুলো প্রদত্ত পরিসংখ্যানে আওয়ামী লীগ আমলে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে জনগণের কাছে আজ আর অজানা নয়। তাই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সাথে বিএনপি আমলের তুলনা করা স্রেফ হাস্যকর।

বিএনপি কি বিকল্প- প্রশ্নটি মূলত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা বিষয় ঘিরে। ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক চিন্তাধারা – এ সব মিলেই গড়ে উঠে একটি জাতির মনন, যার উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় একটি রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনার মৌলিক উপাদান। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধে আমরাও অর্জন করেছিলাম জাতির দিকনির্দেশনার উপাদানগুলো। যেমন, বাঙালি জাতীয়তা, সামাজিক সহাবস্থান, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে দিকনির্দেশনার উপাদানগুলো রূপায়নে জাতি ধারণ করে একটি ‘জাতীয় ধ্বনি’, যার অন্ত:করণে দানা বাঁধে সেই জাতির সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা। আর যার উচ্চারণে প্রকাশিত হয় জাতির আত্মবিশ্বাস। আমরাও ধারণ করেছিলাম তেমনি ‘জয় বাংলা’ নামক এক ধ্বনি। একাত্তুরে এ ধ্বনিতেই সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, সেপাই। এ ধ্বনি কোনও দলের নয়। এ ধ্বনি বাঙালি জাতির ধ্বনি, জাতীয় ধ্বনি।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাতেই বাংলাদেশ হারিয়েছে রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনার মৌলিক উপাদানগুলো।

'বিজয়ের ধ্বনি' পরিত্যাগ করে বিএনপি চাপিয়ে দেয় 'পরাজিত ধ্বনি'; আত্মবিশ্বাসের ধ্বনির পরিবর্তে স্থাপন করে ‘অধীনতার ধ্বনি’। যে জাতি তার রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনায় ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, সে জাতি শুধু আত্মমর্যাদায় নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পিছিয়ে পড়ে।

বিএনপি দাবি করে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। প্রমাণ সাপেক্ষে শুধু যে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে, তাই নয়; বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রাক্তন সেনা-অফিসারদের সংখ্যা বেশি, সেটাও দাবি করে। পরিসংখ্যান নেই, তবে কথাটা মিথ্যা নাও হতে পারে। অন্যদিকে, এটা সত্য, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। সেই অর্থে, নিঃসন্দেহে তিনি স্বাধীনতার পক্ষের একজন যোদ্ধা। তবে তিনি কি স্বাধীনতার ‘চেতনায়’ বিশ্বাসী ছিলেন? কতটুকু ছিলেন? তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সন্দেহ থাকতে পারে কি?

‘স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’ হওয়া, আর 'চেতনায় স্বাধীনতাকে ধারণ করা'– দুটো ভিন্ন জিনিস। চেতনায় স্বাধীনতাকে ধারণে বিশ্বাসী হলে জিয়াউর রহমান পারতেন কি জাতির দিকনির্দেশনার মৌলিক উপাদানগুলো পরিত্যাগ করতে? পারতেন কি ‘বিজয়ের ধ্বনি’ পরিত্যাগ করে ‘পরাজিত ধ্বনি’ চাপিয়ে দিতে? সন্দেহটা সেখানেই। সন্দেহটা ঘনীভূত হয় যখন প্রখ্যাত শিক্ষা ও কূটনীতিবিদ খান সারওয়ার মুরশিদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হই।

ঘটনাটা ঘটে লুসাকাতে, ১৯৭৯ সনের অগাস্ট মাসে কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠকের সময়। জিয়াউর রহমানের সাথে কূটনীতিবিদ খান সারওয়ার মুরশিদও এ বৈঠকে যোগ দেন। ব্যক্তিগত এক আলোচনার সময় জিয়া বাঙালির ‘আলস্য ও কর্মবিমুখতার’ জন্য ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বাঙ্গালির আসক্তিকে’ রূঢ়ভাবে দায়ী করেন বলে তিনি জানান। জিয়ার এই মন্তব্যের জন্য দুঃখ করে খান সারওয়ার বলেন– ‘আমার সোনার বাংলা’র কবির প্রতি আমাদের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের আসল মনোভাবটা ছিলো এই।’ (bdnews24.com (2020), ‘শ্রাবণ’ পত্রিকার সাথে খান সারওয়ার মুরশিদের সাক্ষাতকার’, ১৯ জানুয়ারি (পুনঃপ্রকাশিত), ঢাকা)। রাষ্ট্রপ্রধানের কেন এরূপ মনোভাব? আমাদের জাতীয় সঙ্গীতও যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তা কি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে?

এই শেষ নয়। বিএনপি-র জন্মলগ্নে যে সব শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে জিয়াউর রহমান দল গঠন করেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। এ তালিকায় রয়েছেন- শাহ আজিজুর রহমান, মসিউর রহমান যাদু মিয়া, আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে আরো অনেকে। তারা যে শুধু স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন তাই নয়, তাদের অনেকে যুদ্ধাপরাধীও। সেই সাথে, জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোলাম আজমসহ জামায়াত ও রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেন। পরবর্তীতে খালেদা জিয়াও আল বদর-আল শামস্‌ এর শীর্ষ নেতা নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী বানান।

বিএনপির এই ধরনের মনোভাব আর কার্যকলাপ থেকে তাদের ‘স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস’ সম্পর্কে কী ধারণা দেয়? আমাদের প্রজন্ম যারা স্বাধীনতা দেখেনি, তাদের কাছেই বা কি বার্তা দেয়? তবে কি বিএনপি স্বাধীনতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী?

যার জন্ম ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যরাতে, আজ তার বয়স পঞ্চাশ উর্ধ্বে। জীবনের প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ সময় সে সন্তানটি পড়েছে এবং প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের এক ধরনের ইতিহাস; আর গত দশ-বারো বছর ধরে দেখছে, শিখছে অন্য ইতিহাস। তার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে– তবে কি অতীতের পাঠ করা ইতিহাস ভুল, মিথ্যা বা মিথ্যা-সত্য মেশানো অর্ধ সত্য? তবে কি বিএনপি স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে আসছে প্রতিনিয়ত?

‘স্বাধীনতার ঘোষকে’র বিষয়টাই ধরুন। বঙ্গবন্ধুই যে স্বাধীনতার ঘোষক তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা দাবি করছেন জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। দালিলিক প্রমাণ বাদেও, এ দাবি করার মেজর জিয়াউর রহমানের কি কোন রাজনৈতিক বা নৈতিক অধিকার ছিল? বলাবাহুল্য, শুধু একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাঝেই একজন মানুষ অর্জন করতে পারে সেই অধিকার। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের মন্তব্য পরিষ্কার। তিনি বলছেন-

“A declaration of independence can only derive from a legitimate authority otherwise any citizen could proclaim any part of the globe independence. In Bangladesh of 1971 it was unreal to imagine that an unknown army officer could proclaim independence for 75 million Bangladeshis without any authority to do so…” (Rehman Sobhan (2015, p. 288), From Two Economies to Two Nations – My Journey to Bangladesh, Daily Star Books, Dhaka).

তারপরও বিএনপি ইতিহাস বিকৃত করেই চলেছে। কয়েক বছর আগে স্বয়ং খালেদা জিয়া দাবি করেন যে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক (Dhaka Tribute, 27 March 2014)। তারেক রহমান আর এক ধাপ উপরে উঠে লন্ডনে বসে দাবি করেন, জিয়া শুধু স্বাধীনতার ঘোষকই নন, তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্টও (bdnews24.com, 26 March 2014)। চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতেই পুত্রের সাথে সুর মিলিয়ে খালেদা জিয়াও বলেন, তার স্বামী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি (Daily Star, 28 March 2014)।

এখানে দুটি বিষয়।

এক. খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতে আবার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই তার মুখে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা শুধুই অশোভনই নয়, দায়িত্বহীনতার সামিলও।

দুই. খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আখ্যায়িত করছেন তার পরিণতি কী হতে পারে তা কি তারা বোঝেন? ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তাই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার কেবল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত কোনও সংসদ সদস্য। অন্য কারও দাবি এবং তার প্রচার করা সরাসরি ক্যু করার সমতুল্য।

এ কে খান, শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি এবং একজন প্রবীণ রাষ্ট্রনায়ক, জিয়াউর রহমানের ২৭শে মার্চের কালুরঘাটের বিবৃতি শুনে হতবাক হন এবং তার জামাতা এম আর সিদ্দিকীকে (সে সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী) নির্দেশ দেন শিগগিরই জিয়ার বিবৃতি বদলাতে, নচেৎ, এ কে খান বলেন, - “Zia’s claim to be the head of the state would be regarded as an army coup and the liberation movement would lose support nationally and internationally” (S A Karim (2005, p. 204), Sheikh Mujib – Triumph and Tragedy, UPL, Dhaka)।

এসব বিবেচনায় বলা যায়, পঁচাত্তরে নয়, বরং একাত্তরের ২৭শে মার্চ কালুরঘাটে নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দাবি এবং তা প্রচার করার মধ্য দিয়ে মেজর জিয়া প্রথম ক্যু করার প্রচেষ্টা নেন। যদিও তা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের হস্তক্ষেপে সফল হয়নি, তবে ব্যর্থ ক্যু-র জন্য তাকে মরণোত্তর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলে অবাক হবার কিছু নেই।

এসব কারণেই খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপি নেতাদের বিবৃতি-বক্তব্যে যত্নবান হওয়া অপরিহার্য। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে আবার শুরু হয়েছে ইতিহাস বি্কৃতি। এবার খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং তারেক শিশু মুক্তিযোদ্ধা (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২২)। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষী সুশীল সমাজের কোনও বক্তব্য শোনা যায় না। তবে কি তারাও এসবে বিশ্বাসী?

আমাদের লজ্জা পাবার কথা এই জেনে যে, বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষী সুশীল সমাজের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের এগিয়ে আসতে হয় বিএনপির ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদ করার জন্য (bdnews.com, ২৭ মার্চ ২০২২ - তাদের নেত্রী না কি এক নম্বর (নারী) মুক্তিযোদ্ধা’: পুলিশ কমিশনার)।

বিএনপি শুধু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের সংখ্যায় অবিশ্বাসী নয়, তারা এ সংখ্যাকে বিতর্কিতও করে। ইতিহাস বিকৃত করার এ আর এক দৃষ্টান্ত। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক সমাবেশে খালেদা জিয়া মন্তব্য করেন- "আজকে বলা হয় এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে; এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে” (bdnews24.com, 22 Dec 2015 )।

শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার সমতুল্য। এ মন্তব্যে অবাক হবার কিছু নেই। যে কথাগুলো এতদিন পাকিস্তানের আমলা, লেখক এবং বুদ্ধিজীবীরা বলে আসছে, সেই একই কথা খালেদা জিয়া বলেন। তিনি কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিএনপি-র অবস্থান পুনর্নিশ্চিত করেছেন।

মনে রাখতে হবে, শহীদের সংখ্যা কেবল সংখ্যা নয়। এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের অহংকার জড়িত, সমগ্র জাতির ভালবাসা জড়িত। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে– কেন এবং কার স্বার্থে বিএনপি শহীদদের অন্তিম বিসর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করার প্রয়াস চালায়?

অতীতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বহুবার বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন, যা খালেদা জিয়া এই অনুষ্ঠানেও করার ধৃষ্টতা দেখান। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে খালেদা জিয়া বলেন – “তিনি স্বাধীনতা চাননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন” (bdnews24.com, 22 Dec 2015)। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতা না চেয়ে থাকেন, তবে স্বাধীনতা এলো কীভাবে? জিয়াউর রহমান যে ২৭শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, সেটা তিনি কার নামে করেছিলেন! তিনি যে জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন, সে জেড-ফোর্সই বা কোন সরকারের অধীনে ছিল? কে ছিল সে সরকারের নেতৃত্বে? সন্দেহ হয়, এসব বিষয়ে খালেদা জিয়ার ধারণা আছে কি না! তবে এটা সত্য, যে নিজেদের সঠিক জন্মদিনের গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ, তার এসব মন্তব্য মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অভেদ্যভাবে জড়িত। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি স্বাধীনতা অর্জনে সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক মন্ত্রে, এক মঞ্চে দাঁড় করাতে সক্ষম হন। যিনি জীবন উৎসর্গ করেন বাঙালি আর বাংলাদেশের জন্য। অথচ, বিএনপি তার অবদানই অস্বীকার করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি- যা স্বাধীনতা অর্জনের দিক-নির্দেশনা, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে জুগিয়েছে অসীম সাহস, যে ভাষণ দেশে-বিদেশে বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা- বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সেই ভাষণ নিষিদ্ধ করেন। ১৫ই অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের বিচার জিয়া আইন করে বন্ধ করেন এবং বিদেশি দূতাবাসে কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেন। এসব কিসের ইঙ্গিত? বিএনপি কি সত্যি স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী?

বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ১০ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয়। অতঃপর, ১৭ই এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকুঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে। তারপর থেকে বৈদ্যনাথতলা ‘মুজিবনগর’ নামে পরিচিত, আর এ দিনটি পালিত হয় ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে। মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে। বাংলদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিবস, অথচ বিএনপি মুজিবনগর দিবস’ পালন করে না। প্রশ্ন জাগে– তবে কি বিএনপি বাংলদেশের সৃষ্টির ইতিহাসে অবিশ্বাসী?

উপরের আলোচনা থেকে বিএনপি সম্পর্কে আমরা কী উপসংহার টানতে পারি? আমরা কি বলতে পারি-

  • বিএনপি বাংলাদেশের দিকনির্দেশনার মৌলিক উপাদানগুলি প্রত্যাখ্যান করেছে?

  • ‘বিজয়ের ধ্বনি’ পরিত্যাগ করে বিএনপি চাপিয়ে দিয়েছে ‘পরাজিত ধ্বনি’; আত্মবিশ্বাসের ধ্বনির পরিবর্তে স্থাপন করে ‘অধীনতার ধ্বনি’?

আমরা কি বলতে পারি –

  • বিএনপি যুদ্ধাপোরাধী বিচারে অবিশ্বাসী; বরঞ্চ, তাদের পুরস্কৃত করতে উৎসাহী?

  • বিএনপি স্বাধীনতার চেতনায় অবিশ্বাসী; তাই তারা স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিতে আগ্রহী?

আমরা কি বলতে পারি -

  • ৭ই মার্চ ও মুজিবনগর দিবস পালনে বিএনপি নিরুৎসাহী কারণ তার ইতিহাস বিকৃতিতে বিশ্বাসী?

  • বিএনপি শুধু বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করে না; তারা জাতির জনককে অস্বীকার করার প্রয়াস চালায়?

এক কথায়, বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলধারার মূল্যবোধে অবিশ্বাসী। আসলে বিএনপি কি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী? এরপরও কি বিএনপি-র হিতাকাঙ্ক্ষী সুশীল সমাজ মনে করে – বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক? মনে করে কি বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প?

তারপরও বলবো, বর্তমান বৃত্ত থেকে বিএনপি’র বেড়িয়ে আসা অসম্ভব নয়। তবে পথ একটাই, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের দিকনির্দেশনার মৌলিক উপাদানগুলোয় বিশ্বাসী হয়ে ওঠা; বাঙালির ‘বিজয়ের ধ্বনি’ জয়বাংলা-তে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা। স্বাধীনতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা। বাংলদেশের জন্মের ইতিহাসে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা। তবেই সম্ভব। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বিএনপি পারবে কি স্বাধীনতার মূল্যবোধে আলোকিত হতে? বর্তমান নেতৃত্বে কি তা সম্ভব?