প্রতিবাদ হয়েছিল পাকিস্তানেও। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালায় তার প্রতিবাদে মার্চের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেগম নাসিম আখতার, বেগম তাহিরা মাজহার আলী ও তাদের সহযোদ্ধারা বিক্ষোভ করেন পাকিস্তানের লাহোরের মল রোডে। ওইদিনই তাদের গ্রেফতার করা হয়।
Published : 01 Mar 2025, 02:46 PM
১৯৭১ সালে দেশে দেশে এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যারা নানাভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার, ভূমিকা রেখেছিলেন আমাদের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে। ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়েই বিশ্বের মানুষকে তারা আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে। ওই প্রতিবাদ আর উদ্যোগগুলোই ১৯৭১-এ বাংলার শোষিত মানুষের পক্ষে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। ইতিহাসের পাতা থেকে তেমনি কিছু প্রতিবাদ আর উদ্যোগের কথা জানাতেই এ লেখার অবতারণা।
‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ’
সাহসী এক লোকের নাম হার্ব ফিথ। অস্ট্রেলিয়ান। মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। সময়টা মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা তখন ঢাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে। বন্দি করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সারাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালিকে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এ খবর প্রচার হতে থাকে গুরুত্বের সঙ্গে।
এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া’ ছিল প্রথম বিদেশি মিডিয়া, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ গণহত্যার নানা খবর প্রচারিত হতো। ওই খবরগুলো স্পর্শ করে হার্ব ফিথ ও তার বন্ধুদের। ফিথকে প্রধান করে তারা তখন গঠন করে ‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি কমিটি। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এ কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য লিফলেট, পোস্টার ও সেমিনারের মাধ্যমে প্রচার করে এবং বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে চাপ দিতে থাকে।
একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Asia’s Flashpoint, 1971: Bangladesh’ শিরোনামে একটি বক্তব্য প্রদান করেন হার্ব ফিথ। সেখানে তিনি পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্থোলেমিড গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করে এর নিন্দা জানান। পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায়যুদ্ধ তা স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়ে বক্তব্যে বিশদভাবে তুলে ধরেন।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পদযাত্রা
হার্ব ফিথ ছাড়াও একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জনমত গড়ে তুলেছিলেন একদল অ্যাক্টিভিস্ট। গণহত্যার প্রতিবাদে তারা মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডেভিড এলিস। আরও ছিলেন মাইক ক্রেমার, ডক্টর অ্যালেক্স রস প্রমুখ। অসুস্থতা, দুর্বলতা, সানস্ট্রোক ও পানিশূন্যতার কারণে অনেকে পদযাত্রা শেষ করতে না পারলেও লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন সাতজন। পদযাত্রাটি একাত্তরের ২০ নভেম্বর শুরু হয়ে ৭ ডিসেম্বর ক্যানবেরায় এসে শেষ হয়। সেখানে ফেডারেল পার্লামেন্টের সামনে তারা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারকে বাংলাদেশের মানুষের নৈতিক অধিকারের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে প্রতিবাদ
প্রতিবাদ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মানুষ। বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর থেকে অস্ত্র নিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ ‘পদ্মা’। ১৪ জুলাই ১৯৭১ তারিখের ঘটনা। একদল শ্রমিক ও স্থানীয় জনসাধারণ যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়। এ ছাড়া কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতকগুলো ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজের গতিপথও বন্ধ রাখে। এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস খান। তার সঙ্গে ছিলেন মি. ডিক টেলর, স্যালি উইলবি, স্টেফানি হলিম্যান, চার্লস গুডউইন, ওয়েইন লাউসার প্রমুখ।
সেদিন এ আন্দোলনের কারণে তাদের গ্রেফতার করা হলেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করা যায়নি। এরপরই ধর্মঘট ডেকে বসে পোর্ট শ্রমিকেরা। ‘রক্তমাখা টাকা নেব না’— এমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানি জাহাজে মালপত্র তোলা থেকে বিরত থাকে। ‘No arms to Pakistan,’ ‘End all Us Aid to Pakistan’— লেখা ফেস্টুন নিয়ে তারা সেদিন ধর্মঘট করে। এ আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচার করে গণমাধ্যমগুলো। ফলে মার্কিন জনগণ ভিন্নভাবে জেনে যায় বাংলাদেশে সংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা।
লন্ডনের ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘অপারেশন ওমেগ’
বাংলাদেশের পক্ষে একাত্তরে প্রতিবাদ হয় লন্ডনেও। লন্ডনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন কিছু মানুষ। অক্সফোর্ড পড়ুয়া ব্রিটিশ তরুণী ম্যারিয়েটা প্রকোপে। ১৯৭১-এ গণমাধ্যমে প্রচারিত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ছবি তাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। ২০ এপ্রিল ব্রিটেনে তার নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক সভায় তাকে সাধারণ সম্পাদক করে গড়ে তোলা হয় একটি নতুন সংগঠন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। প্রেস ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল কনসেন্স ইন অ্যাকশন, পিস নিউজ, ইয়ং লিবারেলস, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিউ, বাংলাদেশ নিউজ লেটার ফ্রেন্ডস পিস কমিটি ও বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা ওই সভায় অংশ নেয়। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর প্রধান কাজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার নৃশংসতা সম্পর্কে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে তোলা। লন্ডনের ক্যামডেনে ম্যারিয়েটার নিজ বাড়িতে ছিল ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কার্যালয়। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাস অক্লান্তভাবে এদেশের মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহ আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করার জন্য কাজ করেন ম্যারিয়েটা। বিশ্বখ্যাত টাইমস ও গার্ডিয়ান পত্রিকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে তারা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার নানান চিত্র।
ম্যারিয়েটার সঙ্গে একাত্তরে যুক্ত ছিলেন আরও দু’জন উদ্যোগী মানুষ। তাদের একজন স্কুলশিক্ষক পল কনেট। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন নিউ জার্সির মেয়ে এলেন। দু-জনেই লন্ডনভিত্তিক ওয়ার রেজিস্টার্স ইন্টারন্যাশনালের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশে নিরীহ নিরপরাধ জনমানুষের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনমত গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন এই দম্পতি। পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে— এমন খবরে বসে থাকতে পরেননি তারা। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন ও অসহায় বাঙালিদের সাহায্য করতে ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ১ অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে তারা বিশাল এক জনসভার আয়োজন করে। যেখানে মূল দাবি উত্থাপিত হয়— বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান। জনসভা শেষে বেশকিছু ত্রাণ সামগ্রীসহ একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পলের স্ত্রী এলেন কনেট চলে আসেন ভারতে। অতঃপর অক্টোবরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যশোরের উপকণ্ঠ শিমুলিয়া দিয়ে ঢোকেন বাংলাদেশে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে এবং দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়।
ভারতীয়দের প্রতিবাদ
আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত। ১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সেখানেই হয়েছিল সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ ও ঘেরাও কর্মসূচি।
২৭ মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অতঃপর তারা প্রকাশ্যে ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এ ছাড়া গণহত্যা শুরুর তিন দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৯ মার্চ দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সহস্রাধিক ভারতীয় নাগরিক।
সেদিন তাদের মুখে উচ্চারিত হয়— ‘স্বাধীন বাংলা-জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ’, ‘গণহত্যা-বন্ধ করো’ প্রভৃতি স্লোগান। অতঃপর দূতাবাসের সামনেই এক বিক্ষোভ সমাবেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানান তারা। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিসহ অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বাংলার মাটি ত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয় ওই সমাবেশ থেকে। ওইদিন কণ্ঠ আকাশে তুলে তারা স্লোগান দেয়— ‘ইয়াহিয়া খান, ইয়াহিয়া খান, ওহাপাস যাও পাকিস্তান’।
একাত্তরে চীন ও আমেরিকার নীতিগত সমর্থন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে। তাই ভারতের মানুষ মোটর শোভাযাত্রা করে দিল্লিতে চীনা দূতাবাসও ঘেরাও করে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে চীনা উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। জুন মাসের ২৫ তারিখে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরাও বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে এবং স্মারকলিপি প্রদান করে। তাদের হাতে হাতে ছিল ফেস্টুন। সেখানে লেখা দাবিগুলো ছিল— ‘Arms aid to Pakistan is abetment of genocide’, ‘Stop The Ship’ প্রভৃতি। ওইদিন তাদের মুখে উচ্চারিত হয়— ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ- হাত উঠাও, হাত উঠাও’, ‘খুনিকা হাতিয়ার চালা-বান করো, বান করো’ প্রভৃতি।
১৯৭১ সালের ৬ অগাস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের জনসংঘ পার্টি বড় ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং শেখ মুজিবের মুক্তিরও দাবি জানায়। বিক্ষোভকারীদের ব্যানার ও ফেস্টুনে দাবিগুলো ছিল— ‘Release Mujib’, ‘Down with Pak-Us conspiracy against Bangladesh’ প্রভৃতি। বাংলার মানুষের দুঃখকে নিজেদের মনে ধারণ করে ওইদিন তারা আওয়াজ তোলে— ‘হাম সব-এক হে’। একই দাবিতে কলকাতায় ৬টি শ্রমিক ও বাম সংগঠনের উদ্যোগে ২৯ অগাস্ট ২৪ ঘণ্টা হরতালও পালিত হয়।
পাকিস্তানের লাহোরে প্রতিবাদ
প্রতিবাদ হয়েছিল পাকিস্তানেও। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন পাকিস্তানেও এর বিরুদ্ধে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে হত্যার মাধ্যমে যে নিধনযজ্ঞ চালায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেগম নাসিম আখতার ছিলেন তার প্রত্যক্ষদর্শী। এর প্রতিবাদে মার্চের শেষ সপ্তাহে বেগম তাহিরা মাজহার আলীসহ সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি বিক্ষোভ করেন পাকিস্তানের লাহোরের মল রোডে। ফলে ওইদিনই তাদের গ্রেফতার করা হয়। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কথা বলায় তার পরিবারকেও পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর লাহোর কারাগারে বন্দি ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন পাকিস্তানের এ নেত্রী।
ফ্রান্সে নাটকীয় প্রতিবাদ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর জেনে উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরেন লিজিয়ন গঠন করে বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলেন তিনি, উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বিশ্বজনমতকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকারের কাছে তিনি আকুতি জানিয়েছিলেন— ‘আমাকে একটা যুদ্ধবিমান দাও, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ লড়াইটা করতে চাই’। ফ্রান্স সরকারের উদ্দেশে তার এ আকুতি আজও ইতিহাস হয়ে আছে। তার এই আকুতি ফ্রান্সের জনগণের মনকে স্পর্শ করে। ওই সময় তিনি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার আহ্বানে পশ্চিমা লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ফলে অনেকেই পাকিস্তানি বর্বরতার প্রতিবাদ করেন।
আঁদ্রে মালরোর রচনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হন পল ক্যুয়ের। মালরোর বাংলাদেশের পক্ষে লড়বার সংকল্প বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে তাকে। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। পল ক্যুয়ের একটি ঘটনা ঘটিয়ে বসলেন। প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে এসে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। একটি ব্যাগের ভেতর থেকে বৈদ্যুতিক তার বের করে দেখিয়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ব্যাগে বোমা আছে। এরপর তিনি দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়তে থাকা মানুষের জন্য অবিলম্বে ২০ টন মেডিকেল সামগ্রী ও রিলিফ প্লেনটিতে তোলা না হলে তিনি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্লেনটিকে উড়িয়ে দেবেন। তার দাবি অনুযায়ী বিমানে রিলিফ সামগ্রী তোলাও হয়। পরে রেড ক্রস ও বিমানবন্দর কর্মীদের ছদ্মবেশে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ব্যাগ খুলে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে কতকগুলো বই, এক কপি বাইবেল ও একটি ইলেক্ট্রিক শেভার। এভাবে পাঁচ ঘণ্টায় শেষ হয় বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি। তবে অভিনব এ ঘটনার পর ওষুধ ও রিলিফ সামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স সরকার।
ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না কোনো কোনো মানুষ। কেউ কেউ দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষ নিজেদের সামিল করে গণমানুষের কাতারে। রুখে দাঁড়ায় সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে। কখনো গর্জে ওঠে তার কণ্ঠ, হাতিয়ার কিংবা সে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বিপন্ন করেই। এ কারণেই তারা স্মরণীয় হয়ে থাকে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দেশে দেশে যে মানুষগুলো কাজ করেছিল, ইতিহাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে।