'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে'

বিতর্কের সূচনা যে ‘হাওয়া’ নামের ছবিটি নিয়ে তা আমাদের প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া চলচ্চিত্র জগতে মুক্ত, দখিনা ‘হাওয়া’ দান করেছে। অনেকদিনের পড়ে থাকা জঞ্জাল, আবর্জনা উড়িয়ে দিয়ে অচলায়তনটিকে জাগিয়ে দিয়েছে।

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 25 August 2022, 04:39 PM
Updated : 25 August 2022, 04:39 PM

‘হাওয়া’ ছবিতে খাঁচায় একটি পাখি দেখানোকে কেন্দ্র করে নানা ক্ষেত্রে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকে পাখিকে খাঁচাবন্দি করার প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কেউবা নিজেকে খাঁচায় বন্দি করে রাখছেন। কেউ কেউ ছবি এবং তার পরিচালকের পক্ষে বলছেন। খাঁচাবন্দি পাখি আমিও দেখতে চাই না। এসব নিয়ে লিখতে গিয়ে হঠাৎ 'জীবন থেকে নেয়া' ছবির একটি গান মনে পড়ছিল। অসাধারণ সে ছবিটির দ্যোতনাময় গানটি হলো, 'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে।' পাকিস্তানি উপনিবেশবিরোধী সে গানটি এখনো কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত হই। এ যেন শুধু মানুষের মুক্তি নয়, সমগ্র বিশ্বের সকল প্রাণির মুক্তিরও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। এ ছবিতে খাঁচাবন্দি পাখির দৃশ্যের ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণির প্রতি অনেকের ভালোবাসা দেখে আমি প্রাণিত হয়েছি। বলতে চাই, শুধু ‘হাওয়া’ ছবির খাঁচা নিয়ে নয়, বিশ্বের দেশে লাখ লাখ বন্যপ্রাণিকে যে চিড়িয়াখানার নামে, সাফারি পার্কের নামে, বড় লোকদের সৌখিনতার নামে খাঁচায় পুরে রাখা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক মানুষ। খাঁচাবন্দি সকল প্রাণি মুক্ত হোক। তারা তাদের স্থানে ফিরে যাক। বন্যেরা বনেই সুন্দর থাক।

বিতর্কের সূচনা যে ‘হাওয়া’ নামের ছবিটি নিয়ে তা আমাদের প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া চলচ্চিত্র জগতে মুক্ত, দখিনা ‘হাওয়া’ দান করেছে। অনেকদিনের পড়ে থাকা জঞ্জাল, আবর্জনা উড়িয়ে দিয়ে অচলায়তনটিকে জাগিয়ে দিয়েছে। মানুষকে হলমুখী করেছে। সিনেমামুখী করেছে। মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র জগতকে মৃতসঞ্জীবনী দান করেছে।

২৫ অগাস্ট কাঁটাতারের বেড়ার আদলে সেট তৈরি করে সেই মঞ্চে বসে সরব হয়েছেন নির্মাতা ও শিল্পীরা; দাবি তুলেছেন ‘হাওয়া’ সিনেমা এবং পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বিরুদ্ধে মামলা তোলার। পাশাপাশি পরিচালক মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’কে মুক্ত করার দাবির কথাও বলেছেন তারা। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে।

কেননা, এর আগে আমরা চলচ্চিত্রবিহীন চলচ্চিত্রশিল্পীদের নোংরা রাজনীতি দেখেছি। নির্বাচনের নামে তামাশা দেখেছি। সে তামাশার নির্বাচনের জয়-পরাজয় নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও দেখেছি। শুটিংবিহীন এফডিসি দেখেছি, কিন্তু প্রকৃত সিনেমা বা সুস্থ বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের নির্মাণ দেখিনি। এই খরার মধ্যে শান্তির বারিধারার মতো দুটো ছবি মুক্তি পেলো, ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’। ‘পরাণ’ ছবিটি গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবি। কয়েকবছর আগে বাংলাদেশের একটি জেলায় ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনার গল্পের আদলে নির্মিত ছবিটি অ্যাকশনধর্মী হলেও কাহিনি, অভিনয় এবং নির্মাণকুশলতার কারণে দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়। মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গেছে। আমি নিজেও গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখেছি, অন্যকেও দেখতে উৎসাহিত করেছি।

এরপরই মুক্তি পায় ‘হাওয়া’। মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই ছবিটি বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনায় আসে। বিশেষ করে একটি গান 'তুমি বন্ধু সাদা পাখি' ছবি মুক্তির আগেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনপুরার পরে ‘হাওয়া’ দ্বিতীয় ছবি যার গান, কাহিনি তরুণ থেকে বয়স্ক সবশ্রেণির মানুষের কাছে আগ্রহোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে যারা ভাবেন, দেশের কোনো ইতিবাচক ঘটনায় যারা প্রবল আশাবাদী হয়ে ওঠেন তাদের কাছে মাত্র দুটো ছবি হিট হয়েছে সেটাও অনেক বড় অর্জন বলে বিবেচিত হয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। এক কথায় বলি আনন্দিত হয়েছেন।

কিন্তু বাংলায় একটি শব্দ আছে 'পরশ্রীকাতরতা'। এটার ইংরেজি কী জানি না। বিজ্ঞজনেরা বলেন, শুধু ইংরেজি নয়, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় এই শব্দটির প্রতিশব্দ নেই। কেন নেই? পরশ্রীকাতরতার অর্থই তারা জানে না, কারণ তাদের চরিত্রে পরশ্রীকাতরতাই নেই। অন্যের সাফল্য দেখে, উত্থান দেখে এরা ঈর্ষান্বিত হয় না। বরং তারা খোলা মনে প্রশংসা করে। উৎসাহিত করে। 'নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা'র মতো বাগধারার খোঁজও অন্যভাষায় পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশে এটা প্রবলভাবে বর্তমান। সমাজে কারো অগ্রগতি অন্যরা সহ্য করে না। একজন উঠতে চাইলে নয়জন তাকে টেনে নিচে নামাবে।

বাঙালির এই চরিত্র নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বর্গ-নরক পরিদর্শনে গেছেন। স্বর্গ দেখার পর তারা নরক পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন নরকবাসী পাপীদের জ্বলন্ত চুলার ওপর বড় বড় কড়াইয়ে সেদ্ধ করা হচ্ছে। একেকটি কড়াইয়ে একেক দেশের পাপীরা আছে। প্রতিটি কড়াইয়ে চারপাশে প্রহরীরা বড় বড় লাঠি হাতে দণ্ডায়মান। কড়াই থেকে কেউ উঠে পালাবার চেষ্টা করলে তাকে লাঠি দিয়ে গুতিয়ে আবার কড়াইতে ফেলা হচ্ছে। পরিদর্শকরা যেতে যেতে দেখছেন আর জিজ্ঞেস করছেন, এটা কোন দেশের? ওটা কোন দেশের? প্রহরীরা তাদের জানাচ্ছেন কোনটা কোন দেশের পাপীদের কড়াই। দেখতে দেখতে একটি কড়াইয়ের সামনে এসে তারা থ বনে গেলেন। দেখলেন সেখানে কোনো প্রহরী নেই। পরিদর্শকরা জানতে চাইলেন এটা কোন দেশের? প্রহরীরা জানালো এটা বাংলাদেশের। পরিদর্শকরা সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বাহ, চমৎকার! বাঙালিরা এত সভ্য ও ভদ্র। তাদের পাহারা দিতে হয় না। প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল, সেটা নয় মোটেই। কারণ হলো এক বাঙালি কড়াই থেকে পালাতে চাইলে শত বাঙালি তাকে টেনে আবার কড়াইতে ফেলে ফলে আমাদের কষ্ট করে পাহারা দিতে হয় না।

বাঙালির টানাটানির এই প্রতিযোগিতায় পড়েছে ‘হাওয়া’ ছবিটি। শেষ খবর হলো একট আইনি নোটিশ। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর এবার ‘হাওয়া’ সিনেমা প্রদর্শন বন্ধের আইনি নোটিস দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় এ নোটিস দেওয়া হয়েছে। ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনসহ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানকে এ নোটিস পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার এই নোটিস পাঠান। সে নোটিসে বলা হয়েছে, মুক্তি পাওয়া মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সিনেমায় খাঁচায় শালিক পাখি বন্দি অবস্থায় দেখা যায়। একপর্যায়ে সেটিকে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নোটিসে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হাওয়া’ সিনেমাটিতে ভায়োলেন্সপূর্ণ খুনের দৃশ্য, অশ্লীল গালি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর ধারা ৩৮(১), ৩৮(২), ৪০ ও ৪৬ লঙ্ঘন হলেও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড সদস্যরা পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনকে ‘হাওয়া’ সিনেমার বিতর্কিত দৃশ্যগুলো কর্তন বা আইন লঙ্ঘনের চিত্র সংস্কার করতে বলেননি। বরং ‘হাওয়া’ সিনেমাটিকে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ছাড়পত্র প্রদান করে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘনে এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব তৈরিতে উৎসাহ প্রদান করে সমঅপরাধ সংঘটিত করেছেন।'

নোটিসে বলা হয়, নোটিস প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে ‘হাওয়া’ সিনেমাটির ছাড়পত্র বাতিল করে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে প্রচার, সম্প্রচার ও প্রদর্শন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্য, আইনজীবী ও পরিবেশবিদদের সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে কোন সিনেমার ছাড়পত্র দেয়ার আগে চলচ্চিত্রটিতে যেন ভায়োলেন্সপূর্ণ খুনের দৃশ্য, অশ্লীল গালি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর কোন ধারার লঙ্ঘন না হয়, সেই ব্যাপারে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেও বলা হয়েছে।

এর আগে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে 'হাওয়া'র পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের নামে মামলা করে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। ১৭ অগাস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি করা হয়। জানা গেছে, 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২'- এর ধারা ৩৮ (১-২), ৪১ ও ৪৬ লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। মামলায় বাদী হয়েছেন বন্যপ্রাণী পরিদর্শক নারগিস সুলতানা। সাক্ষী করা হয়েছে তদন্ত কমিটিতে কাজ করা অপর তিন সদস্য আব্দুল্লাহ আস সাদিক, অসীম মল্লিক ও রথিন্দ্র কুমার বিশ্বাসকে। ছবিতে একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখা ও এক পর্যায়ে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানোর মাধ্যমে বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ অগাস্ট এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়, দেশে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা ৩৩টি সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ)।

মনে হচ্ছে, ছবিটি আইনি জটিলতায় পড়তে যাচ্ছে। তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারা অনেকদিন পর চলচ্চিত্রে সুবাতাস এলো বলে প্রাণিত হয়েছিলাম, চলচ্চিত্র শিল্প আবার দাঁড়াবে বলে আশান্বিত হয়েছিলাম তারা হতাশ হলাম। মামলার বিষয়টি উহ্য রেখে আমরা ভাবছি অন্যত্র যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেসবের ভিত্তি কতটা দৃঢ়। কতটা যৌক্তিক। যেমন, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা তো সমাজবিযুক্ত আলাদা কিছু নয়। সব মাধ্যমে সমাজের প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হয়। সমাজে বিদ্যমান ঘটনা, চ্যুতি-বিচ্যুতি, অসামঞ্জস্য, অন্যায়-অসংগতি-গলদ ইত্যাদিই তুলে ধরা হয় নাটক, সিনেমা, গল্প-উপন্যাসে। সেটা তুলে ধরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু নির্মমতাও দেখাতে হয়। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করতে গেলে যুদ্ধের প্রসঙ্গটা অবধারিতভাবেই আসবে। তাতে মৃত্যু বা হত্যার দৃশ্যও আসতে পারে।

এই ছবির বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ তোলা হয়েছে। ভায়োলেন্স, অশ্লীল ভাষার ব্যবহার ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। কাহিনির প্রয়োজনে নাটক-সিনেমায় খুনোখুনির দৃশ্য নতুন নয়। দেশিয় ও বিদেশি অজস্র ছবিতে দর্শকরা হাকসার ভায়োলেন্সপূর্ণ ছবি দেখছে। তারপরও খুনোখুনির দৃশ্য বা অশ্লীল সংলাপ, দৃশ্য ও নৃত্যের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে তো সামান্য অতীতে ফিরে যেতে হবে আমাদের। গত শতকের শেষে এবং চলতি শতকের শুরুতে বাংলা ছবির এমন অবস্থা হয়েছিল যে, দেশের অধিকাংশ শিল্পীরা চলচ্চিত্রজগৎকে বয়কট করেছিল। ভায়োলেন্স ও অশ্লীলতার মাত্রা এতটাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে, কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে বাংলা ছবিতে অভিনয় করা বা বাংলা ছবি দেখা সম্ভব ছিল না। আর এই পরিস্থিতির কারণেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সিনেমা হলবিমুখ হয়ে পড়ে তাদের আর হলমুখী করা যায়নি। যার পরিণামে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক সিনেমাহল।

‘হাওয়া’ ছবিটি জেলেদের জীবন নিয়ে নির্মিত হলেও গল্পের মূলে রয়েছে এক পৌরানিক কাহিনি। গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে কাহিনিকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে মার্জ করতে পেরেছেন। সে কাহিনি গড়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের মাছধরার ট্রলারের জেলেদের সমুদ্রজীবন নিয়ে। তো জেলেদের নিয়ে যে কাহিনি সেখানে তো তাদের ভাষাই ব্যবহৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তা না করে জেলেরা কি প্রমিত বাংলায় কথা বলবে? সে ভাষায় কি দৈনন্দিন কথা বলে তারা? আর আঞ্চলিক ভাষায় তথাকথিত অশ্লীলতা তো থাকবেই। পৃথিবীর সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় অশ্লীল শব্দ বা বাক্য থাকে।

এবার শেষ অভিযোগের ব্যাপারে আসি। বলা হয়েছে, খাঁচায় শালিক রাখা এবং একপর্যায়ে শালিকটি পুড়িয়ে খাওয়ার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আবার বলতে হয়, বাংলাদেশের অন্তত কয়েকলাখ পরিবার আছে যেখানে এমন খাঁচাবন্দি পাখি পাওয়া যাবে। তারা নানান জাতের পাখি পোষে খাঁচায়। সেটা রাখঢাক করে নয়। এমন পোষাপাখি নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে প্রদর্শনীও হয়। দেশের শত শত স্থানে পাখির বাজার আছে, যেখানে নানান জাতের পাখি বিক্রি হয়। শুধু পোষার জন্য নয় খাওয়ার জন্যও দেশের অনেক স্থানে প্রকাশে দেশি-বিদেশি পাখি বিক্রি হয়।

যারা বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তাদের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই কারণ প্রাণির প্রতি তারা যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা অনন্য। তাই তাদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে তারা যেন যেকোনো পর্যায়ে প্রাণিদের সুরক্ষা দিতে পিছ পা না হন। দেশের সর্বত্র প্রতিনিয়ত যেসব পশু-পাখি মানুষ কর্তৃক অত্যাচারিত হয় তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হন। একটি চলচ্ছিত্রের বিষয় ছাড়িয়ে আরও বৃহত্তর পরিসরে যেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেন। যেমন, আমাদের চিড়িয়াখানাগুলোতে প্রতিদিন প্রাণিদের যে পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয় তার বিরুদ্ধে যেন তারা বলেন। চিড়িয়াখানার নামে বনের পশুদের এনে এভাবে খাঁচাবন্দি করে রাখা কোনোভাবেই সভ্য কাজ হতে পারে না। মানবিক হতে পারে না। এভাবে বন্দী করে রাখা বনের পশুদের দেখিয়ে আমাদের সন্তানদের লাভের বদলে ক্ষতিই হয় বেশি। তখন থেকেই তারা ভাবতে শেখে যেকোনো প্রাণিকে বেঁধে রাখার মধ্যে কোনো ধরনের অপরাধ নেই। শিশুদের বনের পশুকে চাক্ষুষ দেখানোর মধ্যে ইতিবাচক কোনো শিক্ষা নেই। আমি প্রথম চিড়িয়াখানা দেখি যখন আমার বয়স ত্রিশ বছর। এরপর আর কখনো চিড়িয়াখানায় যাইনি, যাওয়ার আগ্রহও হয়নি। আমার সন্তানকেও নিয়ে যাইনি, তাতে তার মনোবিকাশ বা শিক্ষায় কোনোরূপ ঘাটতি হয়নি। বিশ্বজু্ড়ে চলমান এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। প্রকৃতি ও প্রাণিপ্রেমিদের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

চিড়িয়াখানার নামে, ইকোপার্কের নামে, সাফারি পার্কের নামে বনভূমি ধ্বংস করা, বিকৃত করা চূড়ান্তভাবে প্রকৃতিবিরোধী কাজ করার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা দরকার। সরকারের কাছে দাবি তোলা দরকার। বনের পশুকে ধরে এনে খাঁচায় পুরে দর্শনীর বিনিময়ে তা প্রদর্শন করার মধ্যে কোনোরূপ মানবিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আসুন আগে বড় অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। বিশ্বব্যাপী যে লাখ লাখ খাঁচা আছে সেখানে বন্দি করে রাখা প্রাণিদের মুক্তির বিষয়ে বলি, সে খাঁচা ভাঙার দাবি তুলি। একটি ছবিতে একটি পাখিকে খাঁচাবন্দি করার চেয়ে এই অপরাধ অনেক বড়।