বড়দেশগুলো যেকোনো জোট বা সম্মেলন বা গোষ্ঠীমিলন থেকে নিজেদের সমস্ত সুবিধা আদায় করে নিয়ে চলে যায়। ছোট দেশগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে।
Published : 17 May 2023, 06:18 PM
আমার সামান্য কাণ্ডজ্ঞান বলে, হিমোষ্ণ ঠাণ্ডাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে প্রথাগত ভূসম্পদ দখলের লড়াই তথাগত হবে। এর পরের লড়াই হবে জলের লড়াই। জল মানে, মহাসমুদ্র দখলের লড়াই তথা বাণিজ্যবিস্তারের লড়াই। মহাসমুদ্রকেন্দ্রিক নতুন দিনের ‘ব্লু ইকোনমি’ বা ‘সুনীল অর্থনীতি’ হাতছানি দিয়ে ডাকছে পৃথিবীর প্রতিটি ভূ-খণ্ডকে। পৃথিবীর তিনভাগ জল হওয়া সত্ত্বেও যে দেশের সমুদ্রবন্দর নেই, সে প্রকৃতির কাছে সাগরহীনতার জন্য আগে যতটা ফরিয়াদ করেছে, ভুবনায়নের নতুন পৃথিবীতে সেটা হয়তো আরও তারস্বরে শোনা যাবে।
সমুদ্রবর্তী ছোট-বড় সব দেশই এই নতুন লড়াইয়ে নিজের হিস্যা বুঝে নিতে ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’র মতো ‘সূচ্যগ্র সলিল’ও ছাড় দেবে না। এ লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে প্রকৃতি বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে বঙ্গোপসাগর। তবে, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনার অবারিত দ্বার খুলে দেবে, তেমনই শংকাও জাগিয়ে রাখবে।
দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী চন্দ্রধর বনিক অর্থাৎ চাঁদ সওদাগরের সময় যেভাবে গভীর সাগরে বাণিজ্য হতো, সেই অবস্থা আরও বহু আগেই ভেঙে গেছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়। ফলে, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে আজকের নতুন দিনের ব্যবসার রঙ দেয়া হয়েছে, ‘সুনীল অর্থনীতি’। কথাটা জনপ্রিয় হয়েছে গেল দশ বছরে। বিশ্ব ব্যাংকের সংজ্ঞানুযায়ী, এই অর্থনীতিতে ব্যবসার কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতি মোটাদাগে হলো এই যে, সামুদ্রিক প্রতিবেশের (ইকোসিস্টেম) সুরক্ষা নিশ্চিত করে অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি, জীবনব্যবস্থাপনা ও জীবিকার উন্নতির নিমিত্তে সমুদ্র-সম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার (সাসটেইনেবল ইউজ) করা।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্দশটিকে বলা হয়েছে ‘জলের নিচের জীবন’। এ বিষয়ে বিশ্বসংস্থাটি বলেছে, ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদসমূহ রক্ষা করা ও টেকসইভাবে ব্যবহার করাই আমাদের উচিত’। এই উচিত বা অনুচিতের প্রশ্নে বড় দেশগুলো তাদের রাজনৈতিক শক্তির বদৌলতে যে পরিমাণ ক্ষতি সাগর বা মহাসাগরের করবে, তা সামনের দিনে জলের নিচের জীবনকে তো বিপন্ন করবেই, একইসঙ্গে জলের বাইরের জীবনকেও সংকটময় করবে। এক শুধু কার্বন নিঃসরণে সমুদ্রের জলদূষণের কারণে সমুদ্রের পানির উষ্ণতা ও উচ্চতা বৃদ্ধি ভূখণ্ডকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। ‘মোখা’রা এমনি এমনি দাপুটে হয়ে ওঠে না, এর পেছনে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষেরও দায় আছে।
২.
বঙ্গোপসাগরে মোখা যখন চোখ রাঙাচ্ছে প্রান্তজনের ওপর, সমাজের এলিট লোকজনের সমাবেশ তখন ঘটেছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী (১২-১৩ মে, ২০২৩) ‘ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে’ (ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স—আইওসি)। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি নতুন লাগতে পারে। তবে, ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ইতোমধ্যেই এই আইওসির পাঁচটি সম্মেলন হয়ে গেছে। ঢাকায় হলো এর ষষ্ঠ পর্ব। এবারের সম্মলেনর প্রতিপাদ্য ছিল: ‘শান্তি, সমৃদ্ধি ও অংশীদারিত্ব (পিপিপি): একটি স্থিতিস্থাপক ভবিষ্যতের জন্য’। এর আগের পাঁচটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ভারত মহাসাগরের কোলঘেঁষে থাকা এ অঞ্চলের পাঁচটি দেশের পাঁচটি শহরে— সিঙ্গাপুর, কলম্বো, হ্যানয়, মালে ও আবুধাবী। সপ্তমটি হবে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে।
এই আইওসির স্বপ্নদ্রষ্টা ও আয়োজক ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। চিন্তাটা খেয়াল করেন। ভারত এখন শুধু বঙ্গোপসাগরীয় বা আরব সাগরীয় নেতা হয়ে থাকতে চায় না। সে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর, পৃথিবীর সমস্ত জলভাগের ২০ শতাংশ আয়তনের আধার, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ ও তেল পরিবহনের ৬০ ভাগের কেন্দ্র ভারত মহাসাগরীয় নেতা হয়ে উঠতে চলেছে। সে লক্ষ্যে ভারত মহাসাগরীয় ২৫টি ছোট-বড় দেশ প্রস্থে অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকা এবং দৈর্ঘ্যে বাংলাদেশ থেকে এন্টার্কটিকা পর্যন্ত ভারতের নেতৃত্বে সংযুক্ত হয়েছে।
বড় দেশ ও ছোট দেশ শক্তিতে একবিন্দুতে মিলতে পারে, যদি ছোট দেশ সাহসী ও শক্তিশালী হতে চায়। তবে, সেই শক্তির ভারসাম্য আদৌ রক্ষা হবে কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে, ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে এই যে সম্মিলনের উদ্যোগ, তা একটা নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ বিশ্বকে উপহার দিতে চলেছে বলা যায়, যদিও এর কার্যকারিতা ও রূপরেখা কী হবে, তা সম্মেলন থেকে পরিষ্কার হওয়া মুশকিল ঠেকছে।
আরও একটি মুশকিল প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর মেলেনি, সেটি হলো— চীনের উচ্চপদস্থ কোনো নেতা কেন আমন্ত্রিত হননি? বা কেন ছিলেন না পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধি? আশ্চর্য বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি থাকলেও, রাশিয়া থেকে কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর জানানো হয়নি মিয়ানমারকে এবং এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অবস্থান। এই অবস্থানের জন্য বাংলাদেশের সাধুবাদ পাওয়া উচিত। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি থাকলেও, চীনের কূটনৈতিক পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি না থাকা চাঞ্চল্যকর। এর মধ্যে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির কোনো ইঙ্গিত আছে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশ কী পেল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা। প্রাপ্তি স্বীকারের ক্ষেত্রে, বস্তুত ঢাকা বলছে, বঙ্গোপসাগর যে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে অবস্থিত, সেটা নতুন করে প্রমাণ হলো। হাস্যকর হলেও সত্য, বঙ্গোপসাগর যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝার জন্য সম্মেলন প্রয়োজন হয় না। এ অঞ্চলে দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমোঝতা কী করে হবে, শান্তি কী করে প্রতিষ্ঠা হবে, ছোট দেশের ওপর বড় দেশের আগ্রাসন কমবে কি না, সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কীরকম সমৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে সেগুলোর দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল না।
এই উদ্যোগের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছে স্বয়ং ভারত। শুধু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নয়, ভারত বিশ্বরাজনীতিতে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে, যেখানে সে উদ্যোক্তা হয়ে পৃথিবীর বহুদেশকে নিজের ছায়াতলে আনতে সমর্থ হয়েছে— সেটা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা বা ওশেনিয়া, যেখানেই হোক। এভাবে তাই ভারত হয়ে উঠেছে চিরন্তন ঔপনিবেশিক হেজিমনির এক অবিকল্প প্রত্যুত্তর।
৩.
চীন যেমন, ঠিক তেমনই ভারতও নিরন্তর প্রমাণ করে চলেছে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারা এক মস্তবড় জনশক্তিরই জানান দেয়া। কেননা, শেষপর্যন্ত এই জনশক্তির করকমলে এসে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে যায় বিশ্ববেনিয়ার মনোজগত। ফলে, রাজনৈতিক শক্তিতেও সে হয়ে উঠেছে ‘ইমপসিবল টু ডিস্টার্বে’র অসিতে গরীয়ান। এজন্যই মনে রাখতে হবে ছোট ও বড়র পার্থক্যও বিস্তর। এই পার্থক্যের একটা বড় প্রমাণ রোহিঙ্গা ইস্যু।
বড়দেশ ভারত রোহিঙ্গা ইস্যু তাদের জন্য সমস্যা তৈরির আগেই সমাধান করে ফেলেছে। রোহিঙ্গা ইনফ্লাক্স তাই ভারতে নয়, হয়েছে বাংলাদেশে। এই ইনফ্লাক্স কিংবা বিশাল এক্সোডাস ভারতে ঘটা সম্ভবই ছিল না। ঘটেওনি। যতই চীনের সমর্থন থাকুক, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ভারতে পুশ করার কাজটা করার সাহস করত না। ভারতে রোহিঙ্গারা গিয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু ভারত রাখেনি। ভারত তিব্বতিদের পাশাপাশি আফগানি শরণার্থীদের কিন্তু ঠিকই রেখেছে, ফলে ধর্মীয় হিসাব চলে না। মিয়ানমার জানত, ভারতের সঙ্গে এই সাহস দেখিয়ে লাভ নেই।
অন্যদিকে, মিয়ানমার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পাঠিয়েছে এটা জেনেই যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সেনা শক্তির ক্ষয় তো করবেই না, উল্টো বাংলাদেশ এদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রেও নাজেহাল হবে। সেটাই হচ্ছে। ছোট দেশ বলে কথা!
অনেক বাংলাদেশিই এই ঢাকা আওসিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমাধানের প্রশ্নে কথা বলেছেন। কিন্তু, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও ত্রাণ সহায়তার কথা স্মরণ ব্যতিত অন্য কোনোদিকে কোনো নেতা বা কূটনীতিকই কথা এগোলেন না। না মিয়ানমারের কথা পাড়লেন, না মিয়ানমার রাষ্ট্রক্ষমতার এমন অপকর্মের মূল শক্তিদাতা চীনের কথা উল্লেখ করলেন। রোহিঙ্গা-ইস্যুর সঙ্গেও মূলত সাগর-দখলের খেলা জড়িত। এটা প্রকাশ্যে খুব কমই বলা হয়েছে কিংবা বলা হলেও, সেটা বলা হয়েছে অনেক পরে।
২০১৮ সালে রাখাইন প্রদেশের দক্ষিণে কাউকপিউ শহরের বঙ্গোপসাগর লাগোয়া সীমান্ত অঞ্চলটি ৫০ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিয়েছে মিয়ানমার। এটা চীনের সড়ক-সমুদ্র (রোড-সি) তথা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পেরই অংশ। এর মধ্য দিয়ে চীনের বঙ্গোপসাগরে নোঙর ফেলা যেমন নিশ্চিত হয়েছে, তেমনই অনিশ্চিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ কতদিন ও কীভাবে মোকাবেলা করে, তা সময়ই বলে দেবে। এ ইস্যুতে মিয়ানমার তার সঙ্গী হিসেবে চীনকে পেলেও, বাংলাদেশের ‘ঘনিষ্ঠতম মিত্র’ ভারত সরাসরি কোনো অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে নেয়নি। সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর ছয় প্রস্তাবের একটিতে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা বলে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি প্রত্যাশা করেছেন। কিন্তু, বাংলাদেশের কোনো প্রত্যাশার কথা কারও কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে বলে মোটেও মনে হচ্ছে না!
৪.
রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি সম্মেলনে উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের সংগঠন সার্কের কথাও। ভারত 'পড়শি প্রথম' বললেও, সার্ক নিয়ে তার মাথাব্যথা কম। সার্ক বিষয়ে সব কথাই আদতে হতাশাব্যঞ্জক! বহুদিন পর সার্কের নাম শোনা গেল, এ বাবদও হাসাহাসি হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানকে বাদ রেখে সম্মেলন হতে পারে কি না সে প্রশ্নেও সার্কের সদস্য সচিব জবাব দিয়েছেন, পাকিস্তান সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলে তাদের বাদ রেখে সম্মেলন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সার্ক কবে নাগাদ সম্মেলনে বসবে, তার কোনো উত্তর কূটনৈতিকদের কাছে নেই, রাজনীতিকদের কাছেও নেই। সার্ক সৃষ্টির উদ্যোক্তা ছিল বাংলাদেশ। সেই দেশটাও সার্ক নিয়ে তার উদ্যোগ জারি রাখতে পারেনি ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক লড়াইয়ের খপ্পরে পড়ে। পরমাণু শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ডামাডোলের কারণে পাকিস্তান তো এখন একটা প্রায় ‘গন কেইস’। আর বিপরীতে ভারত হয়ে উঠেছে একটা রাজনৈতিক মহিরুহ। যে কারণে, লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ডও আর নেই।
ভারতের তাই সাতচল্লিশের পার্টিশন নিয়ে খুব একটা খেদ এখন বুঝি হয় না। সাতচল্লিশে ভাগ হয়ে ভারত ভৌগোলিকভাবে শক্তি খুঁইয়েছিল এটা ঠিক, কিন্তু, আজকে ভারত বাকি দু-দেশকে ছাপিয়ে বিশ্বমানচিত্রে রাজনৈতিকভাবে যে শক্তি অর্জন করেছে, তা ঈর্ষণীয়!
শুধু তা-ই নয়, সম্মেলনের ভারতীয় ডেলিগেটদের তরফে সূক্ষ্মভাবে এটাও তুলে ধরা হয়েছে যে, এ অঞ্চলের নাম ‘দক্ষিণ এশিয়া’ নয়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশ’। অস্ট্রেলিয়ার বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী টিম ওয়াটস তাঁর বক্তব্যে এই টার্ম ব্যবহার (দক্ষিণ এশিয়া না বলে ভারতীয় উপমহাদেশ বলেছিলেন হয়তো বেখেয়ালে) করার জন্য প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁকে ধন্যবাদও জ্ঞাপনও করেছেন দর্শকসারিতে বসে থাকা সম্মেলনের প্রতিনিধি ‘প্রগ্না ভারতী’র সহসভাপতি গিরিধর ম্যামিডি।
ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার। ভারত এশিয়ান পরিচয় বাদ দিয়ে ভারতীয় পরিচয়কেই এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চায়। জাতিগতভাবে মঙ্গোলিয়ান জাতিগোষ্ঠীকে এশিয়ান তো বলাই হয়, কিন্তু,নৃতাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় ও আরবীয় বংশোদ্ভুতরা এশিয়ান কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়। ফলে, নতুন করে ভারত রাষ্ট্রের তরফে এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছে বলেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে, সম্মেলনে ইন্দো-প্যাসিফিকের পাশাপাশি ‘ইন্দো-এশিয়া-প্যাসিফিক’ নামেও একটা নতুন টার্ম উঠে এসেছে। তার মানে, মেরুকরণ নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পনার মধ্যে আছে। ‘আসিয়ান’ভুক্ত দেশগুলোর দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো দেশ এখানে নেই। চীন-জাপান-দুই কোরিয়ার মতো হেভিওয়েট দেশও অবশ্য নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আসিয়ানও কলেবরে বৃদ্ধি পেলে, পূর্ব এশিয়ার এই হেভিওয়েট দেশগুলোকেও হয়তো দেখা যাবে।
আবার, সার্কের গায়ে ‘দক্ষিণ এশিয়ান’ তকমা লেগে থাকায়, সেটাও ভারতের তরফে সার্ক সম্মেলন চালু করতে না চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি না তলিয়ে দেখা দরকার। সার্কের ঠিক ‘বিকল্প’ হিসেবেই এখানে কাজ করছে বঙ্গোপসাগরস্থ সাতটি দেশের সংগঠন বিমসটেক, সার্কের সবদেশই এখানে আছে, নেই শুধু বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সম্পর্কহীন পাকিস্তান ও আফিগানিস্তান, বদলে আছে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। এই নামটা যে ঠিক বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে রাখা হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, পাকিস্তানকে যতভাবে সম্ভব এধরনের জোট বা গোষ্ঠী থেকে দূরে রাখতে ভারত একদম কূটনৈতিকভাবেই ক্রিয়াশীল। ফলে, সার্কেও মরচে ধরে গেছে!
যে কারণেই হোক, সার্ক নিয়ে ভারতের উদাসীনতা প্রচুর হলেও, তার মনোযোগ ব্রিকস (ব্রাজিল-রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চীন-সাউথ আফ্রিকা), কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়া) এবং জি২০ গোষ্ঠীর দিকে প্রবল। এক সময় স্বপ্ন দেখা হতো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো সার্কেরও আঞ্চলিক অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলিত হবে। এমনকি দেশগুলোর মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থাও চালু হবে। কিন্তু, সব আশায় গুঁড়েবালি! সার্ক এখন কাজীর গরু, কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। উল্টো এই সম্মেলন চলাকালেই খবর এলো, ব্রিকস চালু করতে যাচ্ছে অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা এবং এ জোটে ধীরে ধীরে যোগ দেবে বাংলাদেশসহ অন্তত বিশোধিক দেশ। ব্রিকসের নাম হবে ব্রিকস প্লাস (ব্রিকস+)। শুধু তাই নয়, বিশোধিক এই দেশগুলো তো সমর্থন দিচ্ছেই, বিশ্ববাজারে ডলারের আধিপত্য কমাতে ব্রিকসের পদক্ষেপকে আরও শক্তি দিতে তাদের নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে চাইছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের সংগঠন আসিয়ান এবং আরব বিশ্বের ছয়টি দেশের সংগঠন গালফ কোওপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)।
ভারতের জি২০-তে অবস্থানও অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের ১৪ দেশের আইপিইএফেও ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, এমন বৈশ্বিক জোটের মধ্যে ভারত শুধু জি৭-এই নেই। তবে, পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বটে। এই জোটগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়েও কখনও কখনও অনেক শক্তিশালী। ভারতের লক্ষ্য খুবই পরিষ্কার যে, সে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য হতে চায়। সার্বিক দিক বিবেচনায়, ভারত বিশ্বরাজনৈতিক মেরুকরণীয় দুই নৌকায় পা দেয়ার পরও, ভারতের গোষ্ঠীবদ্ধ আন্তর্জাতিক বিস্তৃতি দারুণ রকম সাফল্য জাগানিয়া।
৫.
ভারত সরকারের এই নীতিকৌশলের কারণে, ভারতীয়রা সারা পৃথিবীতে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিখাত, ভিসামুক্ত যাতায়াত ইত্যাদিতে যে পরিমাণ দ্বিপাক্ষিক সুযোগ সুবিধা পান, তা আমাদের পেতে হলে বহু কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হবে। ভাগ হয়ে যাওয়া ভারত কোথায় চলে যাচ্ছে ভাবাই যায় না! ভারতভাগের কারণে এ অঞ্চলে যে চিরঅশান্তি আজও বিরাজমান, তা যদি ঠেকানো যেত, তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশ কোথায় চলে যেত কে জানে!
নিজেদের অঞ্চলে ভারতের আচরণ অবশ্যই সম্প্রসারণবাদী, কিন্তু, সারা পৃথিবীর সাপেক্ষে ভারত যেভাবে পশ্চিমের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেছে, সেটা এক অর্থে উপনিবেশবিরোধী এক লড়াইয়েরই দিশা দেবে এ অঞ্চলকে। ভারত তথাগত পশ্চিমা সভ্যতার ঔপনিবেশিক মনোজগতকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে, শুধু সেই লড়াইটা যদি এ অঞ্চলেও সে একই আদর্শ নিয়ে করত, তাহলেই একটা পাটাতন তার পক্ষে বিনা বাক্যব্যয়ে সৃষ্টি হয়ে যেত।
এ অঞ্চলে ভিসা ফ্রি যাতায়াত দরকার, অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা দরকার। অভিন্ন নদীপ্রবাহের পানির সমবন্টন দরকার। দরকার দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা। আন্তঃরাষ্ট্রীয় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দরকার উপনিবেশপূর্ব শিক্ষাব্যবস্থাকে আবারও সামনে তুলে ধরা।
ইউরোপের দেশে দেশে সীমান্তে কোনো কাঁটাতার নেই। নেই সৈন্য-সামন্ত। অথচ, এই ইউরোপ সাম্রাজ্যবাদী লড়াইয়ে দু’ দু’টি মহাযুদ্ধ বাঁধিয়েছে। আরও আগেও যুদ্ধ করেছে। এত এত যুদ্ধ বিগ্রহের পরেও, ইউরোপ যদি আজ শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না! পারি না, কারণ এ অঞ্চলে শান্তি ও আস্থার অভাব প্রকট। ইউরোপ ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ নামে যে ‘সুই জেনেরিস’ রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করেছে, তা পৃথিবীতে একটি বিরল ধারণা। অফিসিয়ালি না হলেও, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একাডেমিকরা একটি ফেডারেল ব্যবস্থাই বলে, যেটি আন্তঃসরকারি ও আধিরাষ্ট্রিক হাইব্রিড মডেলে চলে। ভারত উপমহাদেশীয় অঞ্চলে কনফেডারেশন হবে, এ এক দূরাশা। কিন্তু, এত জোট-মহাজোট করার চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটা হাইব্রিড মডেল তৈরি করাই সবচেয়ে কার্যকর হবে গণমানুষের জন্য।
৬.
ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন এক অর্থে ভারতের চূড়ান্তরকম দাপট দেখানোরই মঞ্চ। ভারত অনেক কিছুই বোধহয় নিয়ে গেল, কিন্তু, বাংলাদেশ কী পেল, তার ফর্দ পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে!
সমস্যা এটাই যে, বড়দেশগুলো যেকোনো জোট বা সম্মেলন বা গোষ্ঠীমিলন থেকে নিজেদের সমস্ত সুবিধা আদায় করে নিয়ে চলে যায়। ছোট দেশগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে। পৃথিবীতে ছোট-বড় দেশ মিলিয়ে অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যত গ্রুপ বা জোট সক্রিয় আছে, সবগুলোতেই আদতে বড়দের দাপট।
এজন্যই বলি, এভাবে জোট-মহাজোট করে প্রকৃত অর্থে জনগণের মুক্তি আসবে না। দরকার সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলা যা এ অঞ্চলে আরেকটা ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ সৃষ্টি করে দেখাবে।