ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতার পরও কেন এই হাহাকার?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 27 June 2022, 04:23 PM
Updated : 27 June 2022, 04:23 PM

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ডামাডোলে বন্যার্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খবরগুলো কিছুটা চাপা পড়ে গেছে। অথচ দেশের প্রায় চল্লিশ লাখ বন্যার্ত মানুষ এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এবার সিলেট সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় নজিরবিহীন বন্যা হয়েছে। গত দুই দিনে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে ধীর গতিতে পানি নামছে। উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। তবে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ এখনও কমেনি, একইসঙ্গে চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। অনেক এলাকার আবাসস্থল থেকে এখনও পানি নামেনি। অন্যদিকে, পানি কমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাই পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে, বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এদিকে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি বাড়ছে। এতে ছয় জেলায় বন্যার অবনতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ অথবা শেষ সপ্তাহে যমুনা অববাহিকায় বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, আগামী সেপ্টেম্বর অব্দি বর্ষাকাল জুড়ে বন্যা হতে পারে। কাজেই ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় উদাসীনতা দেখানোর সুযোগ নেই।

বন্যাকবলিত এলাকায় এই ভয়ংকর সময়ে ভরসা কেবল মানবিকতা। অভূতপূর্ব বন্যা এক অদৃষ্টপূর্ব সংকট সৃষ্টি করেছে—বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সর্বত্রই আজ বন্যার্তের হাহাকার। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের প্রায় সব এলাকায় বানভাসি মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়েছে। যদিও সরকার বর্তমান সংকট মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ রকম সময়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে বন্যার্তদের সেবায় ভূমিকা নিতে হবে সমাজের প্রতিটি মানুষকে। প্রতিটি এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে।

বন্যার পানি যাদের বসতবাটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোমতে টিকে আছেন, পরিবারের বয়স্ক অসুস্থ সদস্যটিকে নিয়ে অকূল সমস্যায় পড়েছেন কিংবা প্রসূতি ও ছোট ছোট শিশুসন্তানকে নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে রয়েছেন, তাদের সত্যিকারের সহায়তা দেওয়া কেবল সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে সামাজিক সংগঠন এবং সমাজসচেতন ব্যক্তিদের। ক্ষমতা যতই সীমিত হোক, আর্তের কল্যাণে সকলের যৌথ প্রচেষ্টাই দুর্যাগের প্রধানতম রক্ষাকবচ।

বন্যার সময় ত্রাণ বণ্টনের স্বচ্ছতা বজায় রাখাও সময়ের দাবি। একজন প্রকৃত বানভাসিই যাতে ত্রাণ পেতে পারেন, সেটা সুনিশ্চিত করতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা নিতে হবে সামাজিক সংগঠনগুলোকে। দেখা গেছে, এক শ্রেণির মানুষ বন্যাসহ যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অবৈধভাবে সরকারি, বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে লালায়িত থাকে। এর ফলে প্রকৃত দুর্গত ব্যক্তি বঞ্চিত হন। মনে রাখতে হবে, বিপন্নদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ বা বণ্টন স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা খুব সহজ বিষয়ও নয়। কিন্তু মানবিকতার স্বার্থে কিছুটা কঠোর হয়ে প্রকৃত বিপন্নদের বঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে।

বন্যা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আহরণ করার ক্ষেত্রে যাতে নাকানিচুবানি খেতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে প্রশাসনকে। বন্যাকবলিত এলাকায় পণ্য পরিবহন করাটাও কঠিন হয়ে যায়। এক শ্রেণির মজুতদার এর ফায়দা নেবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে এখানে প্রশাসনের দৃঢ়তা অব্যাহত থাকলে মানুষের দুর্গতি কিছুটা হলেও লাঘব হবে। অন্তত আলু, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, সয়াবিন ইত্যাদির দাম যাতে আকাশছোঁয়া না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারা দেশের মানুষ। মানুষের অভূতপূর্ব সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে ওই বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে। সরকারের পক্ষ থেকেও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এই কাজে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনীও। এত বিপুল ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মানুষের হাহাকার কমছে না। অনেকের হাতেই পৌঁছচ্ছে না ত্রাণ। ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও বানভাসী মানুষের এত হাহাকার আর অভিযোগ কেন?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় সরকারিভাবে তাৎক্ষণিক বরাদ্দকৃত ত্রাণ বেশ অপ্রতুল। এর উপর রয়েছে ত্রাণ বিতরণে নানা অনিয়ম। ফলে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না। বিশেষ করে যারা বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান না নিয়ে বিভিন্ন উঁচু টিলা, বেড়িবাঁধ, পাকা রাস্তা কিংবা পাকা দালানের ছাদে ঠাঁই নিয়েছেন, তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ বানভাসি মানুষ সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের ত্রাণ থেকে বঞ্চিত। আশ্রয় কেন্দ্রে যারা অবস্থান করছেন, তারা খুব বেশি ত্রাণ পাচ্ছেন না। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে বন্যার্তদের চাহিদামতো জিনিসও সরবরাহ করা হচ্ছে না। যেখানে রান্না করার কোনো সুযোগ নেই, সেখানে চাল-ডাল-তেল দিয়ে কোনো উপকার হয় না। সেখানে দিতে হয় শুকনো খাবার। আবার নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন, পানির জার, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, ব্লিচিং পাউডার জরুরি হলেও ত্রাণ সামগ্রির মধ্যে এসব আইটেম থাকে না। বন্যার্তদের প্রকৃত চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব ত্রাণ সমন্বয়ের মাধ্যমে বিতরণ করা হলে এ সংকট তৈরি হতো না।

সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলার কিছু কিছু প্রত্যন্ত গ্রাম এবং আশ্রয় কেন্দ্রে প্রশাসন সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। কারণ সেসব স্থানে পৌঁছানোর মতো নিরাপদ জলযান নেই। ফলে অনেকেই শহরাঞ্চলের আশপাশের মানুষদের ত্রাণ দিয়ে কর্তব্য সারছে। প্রায় প্রতিবছর বন্যা হলেও দুর্গত এলাকার মানুষকে উদ্ধার এবং তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে তেমন কোনো জলযান কেন রাখা হচ্ছে না— এটিও একটি প্রশ্ন।

শুধু সিলেট, সুনামগঞ্জ বা নেত্রকোনাই নয়, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ নতুন করে প্লাবিত প্রায় সব জেলাতেই ত্রাণ বিতরণে প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। বানভাসি মানুষদের যে পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন, কাগজে-কলমে তা দেওয়া হলেও বাস্তবের সঙ্গে তা মেলে না। একই ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ পেলেও অনেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থাকেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে চর ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ। তাদের ভাষ্য, বিতরণ কার্যক্রমের ধীরগতি এবং সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গত অনেক পরিবার ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে না। এদিকে যেসব এলাকায় পানি নেমে যাচ্ছে সেসব এলাকার মানুষরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন। নিরাপদ খাবার পানির অভাবে একদিকে পানিশূন্যতা, আবার অনিরাপদ পানি কিংবা খাবার খেয়ে হচ্ছে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো রোগ। বন্যার পানি থেকে হচ্ছে চর্মরোগ। পানি ও টয়লেটের অভাবে গর্ভবতী নারী, প্রতিবন্ধী, শিশুরা ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার উপায় নিয়ে তেমন কোনো ভাবনাচিন্তা ও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে বন্যা মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে দেশের কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই ভালো কাজ করছেন। কিন্তু পুরো রাজনৈতিক সংগঠন ও জনপ্রশাসনকে বন্যার্তদের কল্যাণে পরিচালিত করা সম্ভব হয়নি।

বিভিন্ন দুর্গত এলাকা থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গরিব হিসেবে পরিচিত, তারাই ত্রাণ পেয়েছে। অথচ বন্যায় গরিব-মধ্যবিত্ত-বড়লোক সবারই বাড়িঘর-সম্পদ তলিয়ে গেছে। সবার ঘরেই পানি উঠেছে। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক খাদ্য-সহায়তা সবার দরকার হলেও তুলনামূলকভাবে সম্পন্নরা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারাও যে খাদ্যসংকটে আছে, এটা কেউ বুঝতে চায়নি। তারা এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে।

ব্যক্তি পর্যায়ে ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে আসা সবাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতো। কারণ কারা ত্রাণ পায়নি, কারা বেশি দুর্গত, এসব তথ্য স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে আছে। যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা যদি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ত্রাণকাজে অংশ নেন, তাহলে সবাই ত্রাণ পেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে স্থানীয় এনজিওগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে এমন অনেক এনজিও রয়েছে, যাদের কার্যক্রম প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকার যেখানে পৌঁছতে পারে না, সেখানে এনজিওরা সহজেই পৌঁছে যেতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মাঝে ত্রাণ পৌঁছাতে তাদের ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু জনপ্রতিনিধিদের হাতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ছেড়ে দিলে ন্যায়সঙ্গত বণ্টন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ চেয়ারম্যান-মেম্বার বা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হলে অনেক সময় তারা কেবল নিজের ঘনিষ্ঠজন ও ভোটারদের সহায়তা প্রদান করেন। এতেও অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত ভুক্তভোগীরা বঞ্চিত হয়। স্থানীয় এনজিওদের সহায়তা নিলে এই সমস্যার সমাধান মিলতে পারে।

পরিকল্পিতভাবে বণ্টন হলে দুর্গত এলাকার প্রত্যেক ব্যক্তিই উপকৃত হবেন। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্যে প্রত্যেক উপজেলায় আলাদা আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠন করা দরকার। এ কাজে স্থানীয় প্রতিটি এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে যুক্ত করলে সুফল মিলবে। বানভাসি প্রতিটি মানুষের হাতে দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব, তা যতই দুর্গম এলাকা হোক।