বিদেশি সংবাদ-মাধ্যমে গাফফার চৌধুরীর প্রয়াণ

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 12 June 2022, 07:48 AM
Updated : 12 June 2022, 07:48 AM

একুশের অমর কবিতাটি কিংবদন্তিতুল্য সদ্য প্রয়াত আবদুল গাফফার চৌধুরী সাহেবকে একদিকে যেমন করে তুলেছে অ-মৃতসম, অন্যদিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে। তার জীবনকালেই গানে রূপান্তরিত অমর কবিতাটি ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যেটি বিবিসি বাংলা বিভাগের জরিপে তৃতীয় স্থান দখল করেছিল। তার গান শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি গোটা বিশ্বের সকল বাঙালির কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিবসটি যে দেশেই পালিত হয়েছে, সেখানেই দিন শুরু হয়েছে তার লেখা- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গান দিয়ে। সর্বত্রই এই গানকে ভাষা দিবসের সিগনেচার টিউন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

বাংলাদেশের পরেই যে অঞ্চলটিতে বাঙালি জনসংখ্যা সর্বাধিক, সেই পশ্চিম বাংলায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বহু বছর ধরে, সেখানেও গাফফার চৌধুরী সাহেবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তার লেখনি সেখানকার জনপ্রিয় এবং বহুল পরিচিত 'আনন্দবাজার পত্রিকা' এবং স্টেটসম্যানসহ বেশ কিছু পত্রিকায় বহু বার ছাপা হয়েছে। গাফফার চৌধুরীর মহাপ্রয়াণের পরদিনই আনন্দবাজার পত্রিকায় তার ছবিসহ দুই কলামব্যাপী সংবাদটি অতীব গুরুত্ব এবং গভীর শ্রদ্ধাভরে প্রকাশ করা হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২০ মে প্রকাশিত গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে লেখা সংবাদটির কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপ:

প্রয়াত 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'র রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী

লন্ডনে বার্নেট হাসপাতালে ভারতীয় সময় সকাল ছ'টার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। বৃহস্পতিবার লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে ভারতীয় সময় সকাল ৬টার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন ৮৭ বছরের গাফফার। চিকিৎসাধীন ছিলেন বার্নেট হাসপাতালেই।

গাফফারের পরিচয় অবশ্য শুধুমাত্র সাংবাদিকতার জগতেই নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও অবদান রয়েছে তাঁর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক 'জয় বাংলা'র প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' গানটি লিখেছিলেন গাফফার। বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রভাতফেরির 'সিগনেচার টিউন' হয়ে রয়েছে ওই গানটি।

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের উলনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন গাফফার। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। ওই বছরই সাংবাদিকতায় যোগ দেন। এর পর কর্মজীবনে একের পর এক মাইলস্টোন ছুঁয়েছেন গাফফার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকাশ করেন 'দৈনিক জনপদ' নামে পত্রিকা। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে তিনি পাড়ি জমান ব্রিটেনে।

দেশে না থাকলেও গাফফারের সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মিক যোগ ছিল। লন্ডনে থাকলেও দেশের বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, অ্যাকাডেমি পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা রয়েছে গাফফারের ঝুলিতে।

প্রয়াত গাফফারের চার কন্যা সন্তান এবং এক পুত্র সন্তান। ঘটনাচক্রে, গত ১৪ এপ্রিল প্রয়াত হন গাফফারের ছোট মেয়ে বিনীতা। ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। সেই সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন গাফফারও। ছোট মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেই শোক আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গাফফারের মৃত্যুতে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ জুড়ে।"

আনন্দবাজার পত্রিকা প্রয়াত গাফফার চৌধুরী সাহেবের শেষ যাত্রার খবর ছাপিয়ে গত ২৯ মে পুনরায় তার ছবিসহ একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল 'একুশের গানেই শ্রদ্ধা, সমাহিত গাফফার চৌধুরী'। সেই প্রতিবেদনের অংশবিশেষ:

একুশের গানেই শ্রদ্ধা, সমাহিত গাফফার চৌধুরী

শনিবার দুপুরে লন্ডন থেকে বিশেষ বিমানে গাফফার চৌধুরীর মরদেহ এসে পৌঁছায় ঢাকায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন

ঢাকার যে ভাষা শহীদ মিনারে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে তাঁর লেখা গান বাজিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ করেন বাংলাদেশের মানুষ, সেই বেদিতে শনিবার শেষ শ্রদ্ধা জানানো হলো আবদুল গাফফার চৌধুরীকে। তখনও স্পিকারে নিরন্তর বেজে চলেছিল তাঁর রচিত সেই একুশের গান- ''আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…"। 

গত ১৯ মে লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও সম্পাদক গাফফার চৌধুরী, এক কথায় যাঁকে বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বাতিঘর। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্থান একুশের গানের গীতিকার হিসেবে। দেশের প্রতিটি সঙ্কটে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখা তাঁর কলমের জন্য অপেক্ষা করতেন বাংলাদেশের মানুষ। দীর্ঘদিন কলম লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকাতেও। ছিলেন ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধাও। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন একটা সময়ে।

শনিবার দুপুরে লন্ডন থেকে বিশেষ বিমানে গাফফার চৌধুরীর মরদেহ এসে পৌঁছায় ঢাকায়। বিমান থেকে তাঁর দেহ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত কফিনটি বাইরে আসার পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাঁর স্মরণে "গার্ড অব অনার" দেয় বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ বাহিনী। এক মিনিট নীরবতাও পালন করা হয়। তার পরে একটি শকটে কফিনটি আনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ভাষা শহীদ মিনারে। সেখানে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ এবং তার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফে পুস্পস্তবক দেওয়া হয়। এর পরে শ্রদ্ধা জানান সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। তার পরে ছিলেন বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। শাসক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কফিনে ফুল দিয়ে বলেন, "আমাদের সংস্কৃতি জগতের সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষটির পতন ঘটল। তাঁর রচিত 'একুশের গান'-এ তিনি আমাদের মধ্যে চিরটা কাল বেঁচে থাকবেন।" নেতাদের পরে হাজার হাজার গুণমুগ্ধ সাধারণ মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে এসে তাঁর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে ধর্মীয় আচার পালনের পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয় গাফফার চৌধুরীকে।

পশ্চিম বাংলায় গাফফার চৌধুরীর এক বিশিষ্ট গুণমুগ্ধ ব্যক্তি হলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক শ্রী মানস ঘোষ। সর্বভারতের এই খ্যাতিমান সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষ অবদানের জন্য 'মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু' হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন। 

আমি গত এপ্রিল মাসে যে কদিন লন্ডন ছিলাম, তার প্রতিটি দিনই তিনি আমাকে ফোন করে গাফফার চৌধুরীর খোঁজ নিতেন, কেননা হাসপাতালে তাকে ফোনে পাওয়া দুষ্কর ছিল। গাফফার চৌধুরীর সাথে আমার তোলা হাসপাতালের ছবি মানস বাবু, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, পিযূষ বন্দোপাধ্যায়সহ বেশ কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলাম। সেই ছবি পেয়ে মানস ঘোষ, মুনতাসির মামুন, পিযুষ বন্দোপাধ্যায় অঝোরে কেঁদেছিলেন বলে আমাকে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জানিয়েছিলেন। সেই মানস বাবুও গত ২ জুন পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয়, 'সুখবর' নামক পত্রিকায় গাফফার চৌধুরীর প্রতি সম্মাননা জানিয়ে, তার ছবিসহ যা লিখেছেন, সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ। 

মুক্তিযুদ্ধের এক বিরল সৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী

মানস ঘোষ

আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রয়াণে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মহীরূহের পতন ঘটল। তাঁকে নিজের দেশের মানুষ ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষরা বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ বলে গণ্য করেন। তাকে বাংলাদেশের গুণীজনরা কি শ্রদ্ধাভরে দেখতেন তা সম্প্রতি 'সম্প্রীতি বাংলাদেশ' আয়োজিত এক ওয়েবিনার স্মরণসভায় সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। তার আপোশহীন সততা, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও আদর্শবাদী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠেন। তাই তিনি তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকালের জন্য অসীম শ্রদ্ধার মানুষ হয়ে থাকবেন। এপার বাংলার বাঙ্গালি ও অসমের বরাক উপত্যকার বাঙ্গালিদের কাছেও কালজয়ী ভাষা আন্দোলনের অমর গীতিকার হিসেবে তিনি মানস জগতে চরম শ্রদ্ধার স্থান পেয়েছেন।

তিনি বরাক উপত্যকার বাঙ্গালিদের কাছে তাঁদের ঐতিহাসিক বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাদাতা হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কাকতালীয়ভাবে গাফফার ভাই এই ইহজগৎ থেকে ছেড়ে চলে গেলেন এমন এক দিনে যা ছিল বরাক উপত্যকার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবসের বর্ষপূর্তির দিন।

আমার স্মৃতিপটে গাফফার ভাইয়ের যে ছবিটি চিরভাস্বর হয়ে থাকবে তা হলো, একাত্তরে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সপরিবারে ভারতে আসা ও কলমযোদ্ধা হিসাবে তাঁর খ্যাতিলাভ। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির হৃদয়ে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় তার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এতটাই ছিল যে আমি তা দেখে বিস্মিত হতাম। বাঙালি জাতিকে পাক-ই-স্তানের প্রভুদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে একাত্তরে তিনি তাঁর স্ত্রী ও ৩ পুত্র-কন্যা নিয়ে ত্রিপুরা হয়ে কলকাতায় আসেন।

'আমি বন্দুক, পিস্তল চালাতে জানতাম না। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, আমার কলম বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী আর তা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করবে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।'- এই ছিল গাফফার ভাইয়ের মর্মবাণী।

'আমি ভারতে এসে যে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াচ্ছি, সে চিন্তা আমার একবারও মনে আসেনি। শুধু ভেবেছি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে আরো জোরদার করতে পারব। আমার সংসারের কীভাবে ভরণ-পোষণ করব, সেই চিন্তা মাথায় কোনোদিন আসেনি। আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা আমায় এপ্রিলের শুরুতে বলে, 'সারা দেশে পাক-মিলিটারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বিমান ও রেল পরিষেবা সব স্বাভাবিক হওয়ার পথে। ভারতে আসার চিন্তা ছেড়ে দে। না হলে পস্তাবি।' কিন্তু আমার মধ্যে দেশপ্রেম এমনভাবে দানা বেঁধে উঠল যে, কোনো বাধাকেই আমি বাধা হিসাবে গণ্য করলাম না। আমার বদ্ধমূল ধারণা হল, ভারতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারব। তোমার ভাবি আমায় সাহস জুগিয়ে বললেন, 'তুমি যেখানে যাবে আমরাও সেখানে যাব। তোমার সিদ্ধান্ত, আমাদেরও সিদ্ধান্ত।'

বলতে দ্বিধা নেই, গাফফার ভাই দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে কোনো মূল্য দিতে ও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে তিনি কি কষ্টের মধ্যে নিজের ও পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে কলকাতায় দিনাতিপাত করেছেন, তার আমি সাক্ষী। তিনি আওয়ামী লিগের মুখপত্র 'জয় বাংলা' সাপ্তাহিকের সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন পার্ক সার্কাসের বালু হাক্কাক লেনের এক জীর্ণ বাড়িতে। টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। কিন্তু গাফফার ভাই ছিলেন এই সাপ্তাহিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। অর্থাৎ প্রকাশনার সব দায়দায়িত্ব তার ওপর ছিল। লেখা জোগাড়, তার ঝাড়াই-বাছাই , সম্পাদকীয় লেখা এমন কি রণাঙ্গনের সংবাদ- সবই তিনি নিজের হাতে সামলাতেন। যাঁরা তাঁকে সাহায্য করতেন তাঁরা তা করতেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধের মতো।

তাঁর বাড়তি দায়িত্বের মধ্যে ছিল খোন্দকার মোস্তাকের কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'আগামী' পত্রিকার যেসব মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর খবর ছাপা হতো সেগুলোকে খ-ন করে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করা। এই কাজটি করতে তাঁকে প্রচুর সময় দিতে হতো। তিনি বলতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিপথে চালিত করতে খোন্দকার আদা-জল খেয়ে নেমেছে। তাকে কোনো মতেই এই নোংরা খেলায় জয়ী হতে দেব না। কিন্তু যে মাইনে তিনি তাঁর কাজের জন্য পেতেন তা তাঁর সংসার চালানোর জন্য অপ্রতুল ছিল।

মনে আছে, একদিন তিনি আমার স্টেটসম্যান দফতরে এসে এক আনন্দ সংবাদ দিলেন। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান সন্তোষ ঘোষের সঙ্গে দেখা করে তার দেওয়ার 'অফারটির' সংবাদ দিলেন। সন্তোষ বাবু গাফফার ভাইয়ের লেখার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আনন্দবাজারের উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় লেখা দিতে বলেন। তার জন্য তাঁকে ভালো সাম্মানিক দেওয়া হবে বলে নিশ্চিন্ত করেন। তাঁর অবসর সময়ে নিউজ ডেস্কে তিনি যদি কাজ করেন, সেজন্য আলাদা পারিশ্রমিক পাবেন। সন্তোষ বাবু তাকে স্থায়ী চাকরি দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু গাফফার ভাই একে বিদেশি, তাও আবার পাক-ই-স্তানি হওয়াতে তাঁকে স্থায়ী চাকরি দেওয়া সম্ভব নয় বলে নিরাশ করেন।

গাফফার ভাই আমাকে প্রায়শই সন্তোষবাবু ও আনন্দবাজারের প্রতি তাঁর গভীর কৃতজ্ঞতার কথা বলতেন। তাঁর জীবনে এক কঠিন পরিস্থিতির সময় তাঁর পাশে দাঁড়ানোর জন্য। গাফফার ভাইয়ের উত্তর সম্পাদকীয় এপার বাংলার পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় যখন স্টেটসম্যানের সংবাদদাতা হিসাবে আমার পোস্টিং হলো, তখন গাফফার ভাইকে আরো কাছে পেলাম। সপরিবারে তাঁর লন্ডন চলে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে পড়ে। প্রায় তিন দশক পরেই তিনি ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে আমায় ফোন করে জানালেন, তিনি কলকাতায় আসতে চান। মাসখানেক থাকবেন। তাঁর সঙ্গে আসবেন বঙ্গবন্ধুর এককালের উপ-প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা। তিনি তাঁর দেখাশোনা করেন। তিনি সোজাসুজি জানালেন, দু'জনের কলকাতার কোনো হোটেলে এক মাস থাকার পয়সা নেই। কলকাতায় আসা-যাওয়ার পয়সা জোগাড় করেছেন।

তখন খালেদা জিয়া জামায়াতের শাসনকাল। বাংলা ভাই ও তাঁর জেএমবি'র জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গাফফার ভাইয়ের হিতাকাঙ্ক্ষী তাঁকে ঢাকায় আসতে বারণ করেছেন। কারণ তিনি তাঁদের টার্গেট হয়ে যাবেন। বরং তিনি যদি কলকাতায় আসেন, তাঁরা ঢাকা থেকে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের হাল-হকিকৎ জানিয়ে যাবেন। কোনো রাখঢাক না রেখেই তিনি জানান, আপনাদের বাসায় যদি উঠি, আপনাদের অসুবিধা হবে কি? আমি বললাম, আপনারা আমাদের বাসায় স্বাগত। উত্তরে বললেন, বৌদিকে জিজ্ঞাসা করুন। কারণ আমার খাওয়ায় অনেক রেস্ট্রিকশন আছে। আমার স্ত্রীকে বলা মাত্র সে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে জানিয়ে দিল, আপনি চলে আসুন তো।

২০০৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ভোর ৪টেয় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে গাফফার ভাই কলকাতায় এলেন। তাঁকে দেখে হকচকিয়ে যাই। ঢাকার গাফফার ভাই আর আগের মতো নেই। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব। হাতে ছড়ি। তার উপর ভার করে চলেছেন। চলতে অসুবিধা হচ্ছে। গাড়িতে ওঠার সময় বললেন, বিমানবন্দরে অনেক ভারতীয় নেতার ছবি দেখলাম।" 

"দেড় কোটি শরণার্থীর সিকিভাগের বেশি আশ্রয় পায় এই রাজ্যে। এই শহরের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছিলেন, পাক-ই-স্তান হলে তারা কি তা রাখতে পারত। তারপর গাফফার ভাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ফজলুল হকের ১৯৪৮ সালের অবিভক্ত বাংলার সরকার পরিচালনার অনেক অজানা কাহিনী শোনান।"

"মনে আছে, ২৭ জানুয়ারি আমি গাফফার ভাইকে স্টেটসম্যান অফিসে নিয়ে যাই। কারণ, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন কলকাতায় এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা ও মত বিনিময় করতে। মামুন সাহেব সল্টলেকের রাস্তার সঙ্গে পরিচিত নন বলে আমার অফিসে গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানালেন। দুপুরে ওরা যখন সবাই আমার ঘরে আড্ডায় ব্যস্ত, ঢাকা থেকে আমাদের সংবাদদাতা বাসুদেব ধর খবর দিলেন, আওয়ামী লিগের বর্ষীয়ান নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী শামস কিবরিয়া বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। গাফফার ভাই ও মামুন সাহেবকে বলেই বসলাম, দু'জনকেই আগুনঝরা লেখা লিখতে হবে উত্তর সম্পাদকীয় পাতার জন্য, যা পরের দিন ছাপা হবে। দুজনেই বললেন, 'আমাদের একটু নিরিবিলিতে বসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।' তাঁদের আমাদের প্রয়াত প্রবাদপ্রহিতম ডেপুটি এডিটর লিন্ডসে এমার্সনের ঘরে বসালাম। দিনের শেষে তাঁরা যা লিখলেন তা আমাকে এতটাই রোমাি ত করে যে, আমি প্রথম পাতায় একটি বক্সে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাঠকদের জানাই, তাঁরা যেন বাংলাদেশের দুই স্বনামধন্য লেখকের দুটি অনবদ্য লেখা সম্পাদকীয় পাতায় নিশ্চয়ই করে পড়ে, যাতে তাঁরা জানতে পারবেন, বাংলাদেশে কী সব ভয়ানক কা- ঘটছে ও ঘটতে যাচ্ছে যা ভারতের জন্য খুবই উদ্বেগের। আমি সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখলাম, ভারতের পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে। আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। যেমন করে হোক এই আগুন নেভাতে হবে।

পরের দিন সার্কুলেশন বিভাগ জানাল, সব কাগজ বিক্রি হয়ে গেছে। ভোরে আবার মেশিন চালিয়ে আরো ৫,০০০ কপি ছাপানো হয়েছে। গাফফার ভাই আর মুনতাসির ভাইয়ের যুগলবন্দি লেখার ঢেউ ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঢাকা থেকে পিযুষ বন্দোপাধ্যায়, আবেদ খান ও আরো অনেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আরো অনেকে এলেন যাঁদের নাম আমার মনে নেই। তিনি বাঙ্গালি জাতির আলোকবর্তিকা ছিলেন তা বুঝলাম, যখন দেখতাম তাঁর লেখা পড়ে পশ্চিম বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষরা তাঁকে একনজর দেখতে আমার বাড়িতে ভিড় করত। তখন বুঝেছি, গাফফার ভাই কি বিশাল মাপের ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়ে জেলা-শহরে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সব সময় গাড়ির বহর আমাদের বাড়ির সামনে হাজির থাকত। অনেককে বলতে শুনেছি, 'আপনি আমাদের জেলায় গেলে আমরা ধন্য হই। একটু পায়ের ধুলো দিন।

লন্ডনের বরো অব টাওয়ার হ্যামলেট এর অফিসিয়াল মুখপত্র গত ২-৫ জুন এর সংখ্যায় গাফফার চৌধুরী সাহেবের ছবিসহ তার প্রয়াণের সংবাদ ঘটা করে প্রকাশ করে উল্লেখ করেন 'ফ্রি ম্যান অব টাওয়ার হ্যামলেট' সম্মাননা প্রাপ্ত বিশিষ্ট বাঙালি সাংবাদিক বাংলা ভাষা শহীদদের সম্মানে যে গানটি লিখেছেন, সেটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। এই গানটি ছাড়াও তিনি ৩৫টিরও অধিক বই লিখেছেন, যার জন্য তিনি বহু পদক এবং সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাকে 'ফ্রি ম্যান অব টাওয়ার হ্যামলেট' সম্মাননা প্রদান করা হয়। 

আরও বেশ কিছু বিদেশি পত্র-পত্রিকায় প্রয়াত গাফফার চৌধুরীর সম্মানে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, যা উল্লেখ করতে গেলে অনেক লিখতে হয়। এসব লেখনি প্রমাণ করছে তিনি বাংলাদেশের বাইরেও কত প্রখ্যাত এবং জনপ্রিয় ছিলেন।