Published : 06 Jun 2022, 11:32 PM
আবার আগুন, আবার মৃত্যুর মিছিল। এবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো। এই ডিপোতে রক্ষিত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নামক অতি দাহ্য পদার্থ থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশে কিছুদিন পর পর আগুন লেগে মৃত্যুর ঘটনা এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তাই আগুনের ঘটনায় তাদের জবাবদিহিতারও কোন প্রমাণ মেলে না। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার আইন আছে কিনা- আমার জানা নেই। থাকলেও সেটার যে তদারককারী কোনও সংস্থা নেই, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। যদি থাকতোই তাহলে কেন সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের লোকবল দিয়ে ঘটনার তদন্ত করা হয়? কেন বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে তদন্ত করা হয় না?
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিদুর্ঘটনায় ৮০ জনের অধিক মানুষ নিহতের ঘটনার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম 'কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা: আমাদের করণীয়' নিয়ে। সেখানে আলোচনা করেছিলাম কিভাবে উন্নত দেশগুলো কর্মক্ষেত্রে উন্নতমানের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আমি উল্লেখ করেছিলাম, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে প্রধাণত দুইভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়- বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ও দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণ।
সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ভয়াবহতার কারণ হিসেবে দাহ্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড-কে দায়ী মনে করা হচ্ছে। যদিও আগুন লাগার কারণ এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এ লেখাটিতে আমি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণ থেকে কিভাবে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখা যায়, সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাতের চেষ্টা করেছি।
প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের প্রধান সমস্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা জানিই না জরুরি সময় কিভাবে সঠিক কাজটি করতে হবে। তারপরেই আসবে কর্মক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতার বিষয়টি। কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখা একার কোনও বিষয় নয়। এটা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। তবে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারি পর্যায় থেকে। কল-কারখানাগুলোর রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণের রাডারে নিয়ে আসতে হবে। দেখতে হবে তাদের কর্মীরাও সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্য এবং জরুরি সময় করণীয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা। এক্ষেত্রে প্রধানত নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
এক. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যের শ্রেণিকরণ
কল-কারখানার সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানতে হবে তাদের গুদামে কোন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ আছে। সকল রাসায়নিক পদার্থ ঝুঁকিপূর্ণ নয়। আবার একেক রাসায়নিকের ঝুঁকি একেক রকম। প্রতিটা রাসায়নিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিক্রয়ের সময় তাদের কেমিকেলের সাথে ম্যাটারিয়াল সেইফটি ডেটা শিট (এমএসডিএস) বা রাসায়নিক পদার্থের বিবরণ এবং নিরাপদ সংরক্ষণের তালিকা অবধারিতভাবে দিয়ে থাকে। এগুলো সাধারণ ক্লাসিফাইড করা থাকে যাতে সংশ্লিষ্ট যে কেউ বুঝতে পারে রাসায়নিকটি কোন শ্রেণির ক্ষতিকারক ঝুঁকি তৈরি করে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক মোটা দাগে দুই শ্রেণিরর ঝুঁকি তৈরি করে; স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও ভৌত রাসায়নিক ঝুঁকি।
যখন কোনও রাসায়নিক দ্রব্য বা তাদের বাষ্প আমরা নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করি বা আমাদের ত্বকের সংস্পর্শে আসে, তখন এসব রাসায়নিক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করে। আর যেসব ক্ষেত্রে এইসব রাসায়নিক বিপদজনকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কারণে আগুন লাগা বা বিস্ফোরণ ঘটার ঝুঁকি তৈরি করে, এই জাতীয় ঝুঁকি ভৌত রাসায়নিক ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেনার ডিপোর বিস্ফোরণ এই শ্রেণিভুক্ত।
দুই. রাসায়নিক দ্রব্যের ঝুঁকি শনাক্তকরণ
স্বাস্থ্যগত বা ভৌত রাসায়নিক যেকোন ঝুঁকিই শনাক্ত করার প্রথম ধাপ হলো, সংশ্লিষ্ট কনটেইনারের গায়ের লেবেল এবং এমএসডিএস ভালো করে পড়া। সাধারণত রাসায়নিক দ্রব্যের লেবেল কনটেইনার বা শিপিং প্যাকেটের গায়ে লাগানো থাকে, যাতে নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। আর এমএসডিএস- এ সাধারণত উক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সাতকাহন লেখা থাকে। যেমন- এরমধ্যে কী জাতীয় মৌল বা যৌগ কোন মাত্রায় আছে, এর বৈশিষ্টগুলো কী কী, এটা মানুষের কী কী ক্ষতি করতে পারে, কীভাবে রাসায়নিক দ্রব্যটি সংরক্ষণ করতে হবে, ব্যবহারের সময় কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, এটি পরিবেশের কী কী ক্ষতি করতে পারে ইত্যাদি।
অনেক সময় কেবল রাসায়নিক দ্রব্যটির লেবেল ও এমএসডিএস দিয়ে রাসায়নিক দ্রব্যটির ঝুঁকি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। যেমন- গুদামের অবস্থান, সেখানকার আশপাশের পরিবেশ, বিশেষত আশপাশ থেকে অন্য কোনভাবে নির্গত ধোঁয়া বা বায়ুপ্রবাহের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে এমএসডিএস স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। এটা গুদামের মালিক কর্তৃপক্ষকে সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের নির্দেশনার সাহায্য নিতে হয়।
তিন. রাসায়নিক দ্রব্যের ঝুঁকি মূল্যায়ন
এই ধাপে কারখানা বা গুদামে রাসায়নিক দ্রব্যটি কোথায় এবং কেমন করে রাখা এবং ব্যবহার করা হবে, তার উপর নির্ভর করে রাসায়নিক দ্রব্যটির সার্বিক ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই এই ধাপে রাসায়নিক দ্রব্যটির রক্ষণাবেক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সকল শ্রমিককে যুক্ত করে এমএসডিএস বুঝতে পারঙ্গম উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মালিক পক্ষ সকলে মিলে কারখানা বা গুদামে রাসায়নিক দ্রব্য রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবহারের সময় কী কী ঝুঁকি থাকতে পারে- তা মূল্যায়ন করা হয় এবং ঝুঁকির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
চার. ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ
এই ধাপে ঝুঁকি মুল্যায়নের তালিকা থেকে প্রতিটা ঝুঁকি নিম্নোক্ত অনুক্রম অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ঝুঁকি নির্মূলকরণ: এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ঝুঁকিটিকে বিকল্প কোনও উপায়ে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়। যেমন, কোথাও কিছু জোড়া লাগানোর কাজে রাসায়নিক আঠা ব্যবহারের পরিবর্তে তাঁরকাটা বা পেরেক ব্যবহার করা ইত্যাদি।
ঝুঁকি প্রতিস্থাপন করা: ঝুঁকি নির্মূল করা সম্ভব না হলে এই ক্ষেত্রে তুলনামুলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্য বা উপকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। যেমন উচ্চ দাহ্য পদার্থের পরিবর্তে একই বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম তুলনামূলক কম দাহ্যপদার্থের ব্যবহার করা।
ঝুঁকি বিচ্ছিন্ন করা: ঝুঁকি নির্মূল বা প্রতিস্থাপন করা না গেলে, এই ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকে শ্রমিকদের রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। আবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা একটি রাসায়নিক দ্রব্যকে অন্যটি থেকে পৃথক করা।
প্রকৌশল বা যন্ত্রবিজ্ঞানের সাহায্যে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ: এই ক্ষেত্রে কারখানা, গুদাম, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি প্রভৃতির ডিজাইন পরিবর্তন করে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
প্রশাসনিকভাবে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ: উপরোক্ত উপায়সমুহেও যদি ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হয়, তখন কল-কারখানার উর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাগন নতুন পলিসি করে, শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে বা বৃদ্ধি করে, রাসায়নিক দ্রব্যের আমদানির পরিমাণ কমিয়ে ইত্যাদি উপায়ে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামুলক সরঞ্জাম ব্যবহার করে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ: এটি হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সবশেষ উপায়। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের উপরোক্ত সবগুলো পদ্ধতি প্রয়োগ করার পর শ্রমিকরা রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসার আগে বা কারখানায় ঢোকার সময় বিশেষভাবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য তৈরি প্রতিরক্ষামুলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন- শক্ত জুতা, হেলমেট, চশমা, আগুন নিরোধক হাতা লম্বা শার্ট, প্যান্ট ইত্যাদি। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সাধারণত প্রতিটা কল-কারখানার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার বাধ্যতামুলক।
পাঁচ. ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন
এই ধাপে কর্মক্ষেত্রে সরাসরি রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসা শ্রমিকের স্বাস্থ্যের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হয়। এই ক্ষেত্রে দেখা হয় যে, দীর্ঘ সময় কোন নির্দিষ্ট কেমিকেলের সংস্পর্শে আসার ফলে নিঃশ্বাস বা ত্বকের সাহায্যে শোষিত বাষ্প শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর কোন বিরূপ প্রভার পড়ছে কিনা।
ছয়. জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য এত কার্যাবলী সম্পাদন করার পরও তাদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত নয়। ঝুঁকিমুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাই শ্রমিকের নিরাপত্তার সবশেষ ধাপ হিসেবে জরুরি অবস্থায় বহির্গমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এটাও একটা বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার আগে প্রকাশিত পূর্বেল্লিখিত ওই লেখায় তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ আয়তনে ছোট দেশ। এর মধ্যে যদি কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে ক্লাসিফাইড প্লান্টের অনুমোদন দেওয়া হয়, যাদের দাহ্য পদার্থ রক্ষণাবেক্ষণের কোন শিক্ষাই নেই, দুর্ঘটনার জন্য তাহলে দোষ দেব কাকে? প্লান্টের কর্মীদের, মালিককে, নাকি সরকারের অনুমোদনকারী সংস্থাকে?