পুকুর ও দিঘিসহ জলাশয়গুলোকে রক্ষা করুন

বিধান চন্দ্র পালবিধান চন্দ্র পাল
Published : 7 May 2022, 04:28 PM
Updated : 7 May 2022, 04:28 PM

সংস্কৃত পুষ্কর থেকে উদ্ভুত পুকুর (pond/pool) যেটাকে ছোট জলাশয় বলা হয়ে থাকে। অনেকে এটাকে পুষ্করিণী হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। কৃষ্ণদাসের (১৫৮০) সময়ে ব্যবহৃত এই শব্দটি এখন আর তেমন একটা শুনতে না পেলেও পুকুর অর্থেই পুষ্কর্ণি, পুষ্কর্ণী কিংবা পুষ্কর্নি শব্দগুলোকে আমরা খুঁজে পাই বিভিন্ন সময়ের স্বনামধন্য লেখকদের লেখায়।

আমরা জানি, পুকুর হলো এক ধরনের স্থির পানির জলাশয়। এর পরিসর সাধারণত ছোট হয়ে থাকে, হ্রদের চেয়েও ছোট। আর পুকুরের থেকে একটু বৃহৎ জলাশয় হলো দিঘি, পুকুরে সারাবছর পানি না থাকলেও দিঘিগুলোতে কম-বেশি সারাবছরই পানি থাকে।

পুকুর বা দিঘি সাধারণভাবে দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি প্রকৃতি প্রদত্ত। আর অন্যটি মনুষ্য সৃষ্ট বা খননকৃত। আমাদের দেশে কতগুলো প্রকৃতি প্রদত্ত আর কতগুলো খননকৃত পুকুর বা দিঘি আছে– সে বিষয়ে ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

প্রকৃতি প্রদত্ত এবং মানুষের তৈরি এই দুই ধরনের জলাশয়ের নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, শিশুদের বেড়ে ওঠা, মানুষের জীবনমান ঠিক রাখাসহ বিভিন্ন বিবেচনায় আলাদা গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। মানুষের তৈরি পুকুর বা দিঘি– তা যদি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং দীর্ঘদিনের পুরোনো হয়ে থাকে তাহলে অন্যরকম বিশেষত্বও বহন করে থাকে। সারাদেশে এ ধরনের ছোট-বড় অনেক পুকুর বা দিঘি রয়েছে।

একটি এলাকায় কতগুলো পুকুর ও দিঘি বা জলাশয় রয়েছে তার একটি সাধারণ পরিসংখ্যান প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের সরকারি অফিসগুলোতেও জানামতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান নিয়ে আমার মতো অনেকের মনেই গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে– এগুলো কি সংখ্যা হিসেবে শুধুই টাঙিয়ে রাখার ও উল্লেখ করার জন্য! নাকি নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে তথ্য হালনাগাদ রাখা এবং সে অনুসারে পুকুর, দিঘি কিংবা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে মান/স্ট্যাটাস পরিবর্তন করার জন্য? যাতে উপযুক্তভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় এবং কোনো ধরনের অন্যায় কার্যক্রম সেই পরিসরে না হতে পারে।

প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন। আমার মতে, মানুষের তৈরি পুকুর ও দিঘিও দুই ধরনের হতে পারে। একটি, হঠাৎ করে কিংবা প্রয়োজনে তৈরি করা; আর অন্যটি হলো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিংবা দীর্ঘদিনের পুরোনো। দেশের প্রকৃতি প্রদত্ত, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও দীর্ঘদিনের পুরোনো পুকুর কিংবা দিঘিগুলোর বেশিরভাগই ঐহিত্যবাহী এবং এগুলোর অনেকগুলোর সাথেই আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশ ও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সংশ্লেষ রয়েছে।

পুকুর, দিঘি বা এ ধরনের জলাশয় বহু কারণে থাকাটা বাঞ্ছনীয়। কারণ পুকুরে জলচর, স্থলচর, উভচর এসব ধরনের প্রাণীরাই বসবাস করতে পারে। পোষা ও বণ্য প্রাণী খুব ভালোভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলতে পারে। আর আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সব ধরনের প্রাণীর সামঞ্জস্যপূর্ণ বসবাসের পরিবেশ থাকাটা খুবই দরকার।

পুকুরের পানি অনেক ধরনের পরিবেশবান্ধব গাছপালা এবং জীবজন্তুর জীবনপ্রণালীতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের সময় পানির সংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পুকুর-দিঘির মতো জলাশয়ের একটা অনন্য ভূমিকা রয়েছে। একসময় এই সকল পুকুর ও দিঘিসমূহ সুপেয় পানির উৎস হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এছাড়া ভূগর্ভে পানি ঢোকার একটা প্রাকৃতিক পথ হলো পুকুর, দিঘি বা এ ধরনের জলাশয়সমূহ। এই পথ সচল থাকলে পানির স্তর একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে থাকে, যা সকল প্রাণীকূলকে বেঁচে থাকতেও সহায়তা করে। উপরন্তু অনেক এলাকায় পুকুর ও দিঘিগুলো পানি ধরে রাখার ও পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করে থাকে। ফলে বৃষ্টির সময় বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কামুক্ত থাকে ও নানারকম ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওপরের এসব বিষয়ের সাথে যে দিকটি খুব বেশি করে যুক্ত হয়েছে সেটি হলো, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পুকুর, দিঘি কিংবা জলাশয়সমূহের বহুল ব্যবহার এবং সেগুলো ভরাট করে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়গুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দৌরাত্ম্যে একেবারেই ভাটা পড়ে যাচ্ছে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে– যা কখনোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।

জলাশয় কমে যাওয়ার ফলে একদিকে অল্প বৃষ্টিতে যেমন জলাবদ্ধতার সমস্যা আগের তুলনায় আরও বেড়েছে, তেমনি অনেক এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট তৈরি হচ্ছে, ধীরে ধীরে এই সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে শুরু করেছে। জলাশয় ভরাট করে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে, সেগুলোও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ধারণা করা হয়, ছয় (৬) মাত্রার ভূমিকম্প হলেই এসব ভবন প্রায় সবই ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক স্থানে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সার্বিক বিবেচনায় পুকুর ও দিঘিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য অশনিসংকেত।

সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি, ঢাকার গেণ্ডারিয়াতে অবশিষ্ট থাকা বড় পুকুরটিও দখলবাজির কারণে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো কুমিল্লা নগরের উজিরদিঘি ভরাটের অপচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা লক্ষ্য করেছি কুমিল্লায় ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ের বহু পুরোনো একটি পুকুর কীভাবে আইন ও আদেশকে অমান্য করে ভরাট করা হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইন লঙ্ঘন করে কীভাবে একটি সরকারি পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে সেটাও আমরা খেয়াল করেছি।

ভোলার লালমোহন উপজেলার ফরাসগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ ইজারা নেওয়া জমির পুকুর কীভাবে ভরাট করেছে তাও আমরা দেখেছি। অযত্নে, অবহেলায় আর তত্ত্বাবধানের অভাবে সারাদেশের এরকম অসংখ্য ছোট-বড় জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐহিত্য। একসময় একটি এলাকার নামকরণ হয়েছে যে পুকুরকে ঘিরে, এখন সেই এলাকার নাম থেকে গেছে, কিন্তু পুকুর বা দিঘির অস্তিত্ব নেই। যেমন, চট্টগ্রামের নন্দনকাননের একটি এলাকার নাম রথের পুকুরপাড়। ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরটি এখন বহুতল ভবনের নিচে হারিয়ে গেছে।

রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সোনাদিঘি পুকুরের নামটাও এ প্রসঙ্গে বলতে চাই। একসময় এই পুকুরের পানি মানুষ পান করত, কাপড় কাচা ও গোসল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এর দুই পাড়ে লোহার ফ্রেমে কাঠের ছাউনিসহ বসার ব্যবস্থা ছিল। মানুষ বিকেলে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে সেখানে গিয়ে বসত। কিন্তু এখন সেই সোনাদিঘি পুকুরকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না– এর চারপাশে এখন বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে, চারিদিকে কংক্রিটের দেয়াল।

একইভাবে সাগরদিঘির পাড়, লালদিঘির পাড়, রামের দিঘির পাড়, চারদিঘির পাড়, মাছুদিঘির পাড়– এগুলো সিলেট নগরের একেকটি এলাকার নাম হলেও সেখানে ওইসব নামে বাস্তবে কোনো দিঘির অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ধরনের চিত্র প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই আমরা কম-বেশি লক্ষ্য করছি। সময়ের পরিক্রমায় যতগুলো পুকুর কিংবা জলাশয় এখন অবশিষ্ট রয়েছে তার বেশিরভাগই যেন তথাকথিত উন্নয়ন লোভীদের লালসার দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন।

ওপরের কাহিনীগুলো কম-বেশি আমাদের সকলেরই জানা যা পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় আমরা বিশেষভাবে খুঁজে পাই, সেটা হলো, যারা পুকুর, দিঘি ও জলাশয়গুলো ভরাট কিংবা দখল করেছেন ও করছেন, তাদের বেশিরভাগই আসলে লোভ ও লালসা থেকেই করছেন। ফলে, এই ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে বেআইনিভাবে এবং কখনও কখনও যোগসাজশে আইনের ফাঁক গলিয়ে।

এসব ক্ষেত্রে আইন রক্ষার দায়িত্ব যে সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সে সকল প্রতিষ্ঠানকেও আমরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত কিংবা মানুষের সৃষ্টি করা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ও পুরোনো পুকুর, দিঘি এবং জলাশয়গুলোকেই বেশি নষ্ট করছি, ভরাট ও দখল করছি।

একদিনে একটি স্থানে কিছু গাছ লাগালেই যেমন একটি বন তৈরি করা যায় না। ঠিক তেমনি একদিনে একটি স্থানে পুকুর কিংবা দিঘি খনন করে ফেলা হলেই সেটা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ও ঐতিহ্যবাহী পুকুর কিংবা দিঘি হয়ে ওঠে না। ফলে সেটা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান সহসাই রাখতে পারে না।

ফলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, একটি পুকুর, দিঘি কিংবা জলাশয়কে ঘিরে যে জীববৈচিত্র্য, যে নান্দনিকতা তৈরি হয় এবং সার্বিকভাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টিতে একটি পুকুর ও দিঘি যে ভূমিকা পালন করে, হঠাৎ করে একটি পুকুর বা দিঘি খনন করে কয়েক বছরের মধ্যেও সেটা কোনোভাবেই তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী ও প্রকৃতি প্রদত্ত পুকুর ও দিঘিগুলোকে ভরাট করার ফলে আমরা একদিকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নষ্ট বা ধ্বংস করছি, অন্যদিকে পরিবেশ ও প্রতিবেশকেও হুমকি এবং চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এ পরিষ্কার বলা আছে, "অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুন না কেন, জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট করা যাইবে না।"

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একইসঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

এছাড়া ২০০০ সালের ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্যসচিব স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, "কোনো অবস্থাতেই খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে খাল-বিল, পুকুর, নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয়/জলাধার বন্ধ করা যাবে না।"

অথচ স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় আইন ও অফিস আদেশ অমান্য করে এবং প্রকৃতির শর্তকে অগ্রাহ্য করে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই দেশজুড়ে নগরায়ণ চলছে। খাল, বিল, পুকুর, দিঘি ভরাট করে, ভূগর্ভের পানি নিঃশেষ করে নাগরিক মানুষ 'উন্নততর' জীবনযাপন করার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ যে কতখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা আমরা খুব একটা আমলে আনছি না, সে ধরনের ইতিবাচক উদাহরণ খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য শহরের ভেতরের পুকুর, দিঘি বা অন্য সব জলাশয় অনেকটা আর্শিবাদের মতো। কিন্তু সাময়িক কিংবা স্বল্পমেয়াদি লাভের তাড়না ও লোভ-লালসায় সেগুলো অর্থাৎ সারাদেশের সব পুকুর, দিঘি ও জলাশয়গুলোকে আমরা যেন একের পর এক গলাটিপে হত্যা করে যাচ্ছি। প্রতিটি স্থানেই বাছ-বিচার না করে কোথাও পরিত্যক্ত, কোথাও নানান স্পর্শকাতর বিষয়ের (যেমন, চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা বা পরিসর বৃদ্ধি করা) দোহাই দিয়ে এবং সে সকল বিষয়কে বড় করে সামনে তুলে ধরে, একের পর এক সব ধরনের পুকুর, দিঘি ও জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে।

কোন পুকুর, দিঘি বা জলাশয় ভরাট করা যাবে, আর কোনটা একেবারেই যাবে না– সে ধরনের কোনো সচেতনতাই যেন আমাদের মধ্যে নেই। ফলে যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। 'চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাভূমির স্থানিক ও কালিক পরিবর্তন' শীর্ষক একটি গবেষণায় (১৬ জুলাই ২০২১ তারিখের জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত) চট্টগ্রামের জলাশয় নিয়ে সর্বশেষ জরিপের শুরুতে ভূ-উপগ্রহের ধারণ করা চিত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে সরেজমিনে জরিপ চালিয়ে মোট ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। অথচ এর আগে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ২৫০টি জলাশয় পাওয়া গিয়েছিল। আর ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫২৩টি জলাশয়। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, পুকুর, দিঘিসহ সব ধরনের জলাশয়সমূহ কমে যাচ্ছে। আর এই কমে যাওয়ার পেছনে গড়ে উঠেছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যা বন্ধ করাটা অত্যন্ত জরুরী।

আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশের সকল জলাশয়, দিঘি ও পুকুরগুলোকে চিহ্নিত করা ও সেগুলোর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করার জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। তাহলেই হয়তো প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে। আর উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তি ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাও সম্ভবপর হবে। এটা একার কাজ নয়। এ ধরনের কাজে গবেষণা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহকে কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি কাজে লাগানো যেতে পারে সুপারিশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লক্ষ্যে পরিচালিত 'প্রভা অরোরা'-এর মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে। তাদের অনন্য উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও সক্ষমতাকে গবেষণালব্ধ সুপারিশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও কাজে লাগানোটা জরুরিভাবেই প্রয়োজন হবে। সঙ্গতকারণেই এই কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে।

পরিশেষে, যেসব পুকুর, দিঘি ও জলাশয় ভরাট হয়েছে, ভরাটের পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করে উপযুক্তভাবে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই জন্য এখনই উপযুক্ত গবেষণার দরকার আছে। প্রয়োজন আছে আইনকে সংশোধন ও সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার এবং সুষ্ঠুভাবে আইনগুলোকে প্রয়োগ করার। প্রয়োজনে নীতিমালাগুলোকেও আরও শক্তিশালীভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া সমন্বিত ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষভাবে, এর সাথে যুক্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যেমন, সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনকে সমন্বয়ের মাধ্যমে পুকুর, দিঘি ও জলাশয় রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এর সুফল কিছুটা হলেও আমরা দেখতে পাব।

দিঘি ও পুকুরের কথা মনে হলে অনেক গল্প, রূপকথা, কবিতা ও নানা ধরনের সাহিত্যকর্ম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে অনেক কবির কবিতা ও অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্মের কথা। যেমন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী'র 'কাজলা দিদি' কিংবা রবীন্দ্রনাথের 'পুকুর ধারে' কবিতায় উল্লেখিত পুকুরের অন্যরকম একটি চিত্র আমরা খুঁজে পাই। আমরা দেখতে পাই ছিপ ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য, আমরা দেখতে পাই জোনাকির আলোসহ বৈচিত্র্যময় আরও অনেককিছুই।

উপসংহারে বলতে চাই, হাজার চেষ্টা করলেও আমরা হয়তো আগেকার সাহিত্যকর্মে উল্লেখিত সেইসব বৈশিষ্ট্যসমূহ পুরোপুরিভাবে একটি পুকুরে, দিঘিতে কিংবা জলাশয়ে ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু সার্বিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখে যেভাবেই হোক প্রকৃতি প্রদত্ত পুকুর, দিঘি ও জলাশয়সমূহ এবং মানুষের সৃষ্টি করা প্রাচীন ও বৈশিষ্ট্যসম্বলিত পুকুর, দিঘি ও জলাশয়সমূহ চিহ্নিত করে এখনই সেগুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর সেজন্য, আসুন, বিশেষভাবে সরকার ও সচেতন নাগরিক আমরা সবাই মিলে সাহসী পদক্ষেপ নিই, পুকুর-দিঘি জলাশয় বাঁচাই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, বেঁচে থাকাকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্যই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করি।