Published : 06 Apr 2022, 01:37 AM
'নিরাপদ সড়ক আন্দোলন'– তারপর যা ছিল তাই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া আমার ছাত্রী মাইশা মমতাজ নিজেই জীবন দিলেন এক সড়ক দুর্ঘটনায়। গত শুক্রবার সকালে উত্তরা থেকে নিজের স্কুটিতে বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। খিলক্ষেত উড়ালসড়কে একটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় গুরুতর আহত ও পরে মৃত্যুবরণ করেন মাইশা। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগেও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গিয়েছে, তার ১১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী। এ সময় প্রতিবছর গড়ে ৮০০ শিক্ষার্থী মারা গিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
অনেক চাঞ্চল্যকর খুনের আসামী ধরে প্রশংসার দাবিদার বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় এই অকাল মৃত্যুগুলি নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এগুলো যেন বিচারের বাইরে– নিয়তি! অথচ, দুটিই অনাকাঙ্খিত, অপরিণত মৃত্যু, কিংবা পঙ্গুত্ব। একটি পরিবারের কান্না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। শুধু নিয়তিকে দোষ দিয়ে একটিকে মেনে নেয়ার কোনও অবকাশ নেই। একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু মানে একটি সম্ভাবনার মৃত্যু। জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি!
সভ্য দেশে নাগরিক ভব্যতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ট্রাফিক আইন মেনে চলা। আর এর মূল কারণ দুর্ঘটনা এড়ানো। সবকিছুর ওপরে সতর্কতা– জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। দুর্ঘটনা উন্নত দেশেও ঘটে, কিন্তু সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। চালকের যথোপযুক্ত গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল কিনা, মাতাল ছিল কিনা, লেন মেনে গাড়ি চালচ্ছিল কিনা, গতি সীমার ভেতরে ছিল কিনা, পথচারীর দোষ ছিল কিনা– প্রায় সব ধরনের বিষয়গুলোকেই আমলে নেওয়া হয়। প্রায় আট বছর উচ্চশিক্ষার্থে পৃথিবীর কয়েকটি উন্নত দেশে অবস্থানের প্রেক্ষিতে, এ বিষয়টি বরাবরই আমাকে বিমোহিত করেছে। ১৯৯৯ সালে প্রথম যখন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর (এনিউএস) এ পড়তে গেলাম, একবার একটি 'পেডেস্ট্রিয়ান প্রাওরিটি' রোড পার হবার জন্য জেব্রা ক্রসিংয়ে এক পা রেখেও পিছিয়ে গেলাম, বেশ দূর থেকে একটি গাড়ি দেখতে পেয়ে। আর যায় কোথায়। হার্ড ব্রেক কষে সেই গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা– আমি কবে পার হব! নতুন বিদেশে আসা এক বাংলাদেশির জন্য এ এক বিরল ঘটনা। আরেকবার, বাসের হাতল ভেঙে যাত্রী আহত, অতঃপর প্যরালাইজড। সেই যাত্রীর বাকি জীবনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ত্ব নিতে হয়েছিল বাস কোম্পানিকে। কানাডার রাস্তায়, খানা-খন্দে পড়ে আপনার গাড়ির ক্ষতি হলে, কোর্টে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে পারেন সড়ক বিভাগ থেকে।
কিন্তু বাংলাদেশে এই ট্রাফিক আইনটি যেন একেবারেই উপেক্ষিত। জেব্রা ক্রসিং থাকা না থাকা এখানে একেবারেই অর্থহীন, অর্থহীন লাল-নীল বাতিও। পথচারীরাও কম যান না! অনেক এলাকায় দেখা যায় ফুটওভার ব্রিজগুলো সব খা খা করছে। আর এর নীচ দিয়েই ১০০ মিটার স্প্রিন্টার এর গতিতে দৌড় কিংবা সুউচ্চ রোড ডিভাইডার চরম কসরত করে পার হবার চেষ্টা ! আবার অনেক ক্ষেত্রেই নেই পর্যাপ্ত দূরত্বে ফুটওভার ব্রিজ। ফলে, সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, এর সবই কি শুধুই দুর্ঘটনা? শুধু পত্রিকার খবর অনুযায়ী, যতগুলি বড় দুর্ঘটনার খবর আলোচনায় আসে, তার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় চালক নয় হেল্পার গাড়ি চালাচ্ছিলেন, লাইসেন্সহীন অপরিণত চালক, মোবাইল ফোনে কথা বলা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, পাল্লা দিয়ে ওভারটেক ইত্যাদি তো রয়েছেই। সড়ক আইন অনুযায়ী এর প্রতিটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের কোনও কারণে কারও মৃত্যু হলে, চালককে প্রায় খুনের মতো শাস্তির মুখোমুখি হবার কথা। উন্নত দেশে তাই হয়। কোনওভাবেই, তুচ্ছ জ্ঞানে এগুলিকে পাশে ফেলে রাখার জো নেই। বিচারের আওতায় আনার কথা গুরুত্ত্ব সহকারে।
তবে বাস্তবে তারা কি করছেন? বাংলাদেশের প্রতিটি থানার সামনে শত শত দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি আর মোটর সাইকেলের স্তূপ অনুসন্ধান করলে দেখবেন, এর কোনও কোনওটি প্রায় ২০ বছর আগের মামলায় আটক। মরিচা ধরে প্রায় মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। সম্ভবত প্রতিবছর প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের এ ধরনের আটক গাড়ি নষ্ট হচ্ছে থানার চত্বরে। দশ-বারো বয়সী শিশু লাইসেন্স ছাড়া খোদ ঢাকা শহরের বড় রাস্তার ওপর পুলিশের অনেক বড়কর্তার চোখের সামনে দিয়ে লেগুনা বা ভ্যান জাতীয় গাড়ি চালাচ্ছে। তেমনি একটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মারা গিয়েছে মাইশা। মানুষ মারার জন্য এই খুদে গাড়িগুলি ট্রাকের চাইতে কোনও অংশেই কম পারঙ্গম নয়। প্রতিদিনই উত্তরা কিংবা ফার্মগেটের মতো এলাকায় এদের দেখছি। দু-একবার নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে পুলিশ ডেকে সুরাহার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, শোনা যায় পুলিশ নাকি এই নাবালাক চালকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় প্রতিনিয়ত। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এই আয়োজনে অন্তত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হয়ে কোনওভাবে অংশ নেবেন না। পুলিশের উর্ধ্বতন পদে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু আছেন যারা সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আশা করব, এ বিষয়টিতে অন্তত একটু নজর দেবেন তারা। জীবন-মরণ প্রশ্ন!
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি আমার পড়াশোনার অংশও বটে। আর এক্ষেত্রে আমার জ্ঞাতি ভাই, অর্থাৎ সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের দায়দায়িত্বও কোনও অংশে কম নয়। দুর্ঘটনা রোধে সড়কে কী করা উচিত, এ ব্যাপারে বিস্তারিত নিয়ম-কানুন বলা আছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই-পুস্তকে। এ নিয়ে আরেকদিন না-হয় আলোচনা করা যাবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন থাকার পরও মানছেন না চালক কিংবা পথচারী। অজুহাত হচ্ছে– গরীব দেশ, সবকিছু সম্ভব না । অথচ, খোদ ঢাকা শহরেই এর ব্যতিক্রম আছে। ক্যান্টনমেন্টে এলাকার ভেতর দিয়ে আমার একটি 'পাশ' আছে। একই ড্রাইভার আর পথচারী, এখানে একেবারে সোজা।
দেশ আর এখন গরীব নয়। স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শুধু টাকার অংকে নয়– আচার-আচরণ, সভ্যতা-ভব্যতারও উন্নতি প্রয়োজন। কিছু সভ্য আচরণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ট্রাফিক আইন মেনে চলা তথা সড়কে শৃঙ্খলা। সর্বোপরি মানুষের জীবন সংহারি এ বিষয়টিকে আইনের আওতায় গুরুত্বের সাথে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামানো যাবে না।