Published : 07 Mar 2022, 06:19 PM
৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক লিখেছি। প্রায় ১২/১৩ বছর গবেষণার পর একটি গ্রন্থও রচনা করেছি। সেখানে চেষ্টা করেছি সবকিছু বিস্তারিত বিশ্লেষণের এবং করেছিও। তারপরও এ ভাষণ এমন এক সম্পদ যা নিয়ে লেখা শেষ হয় না। শেষ কথাটি বলে ফেলা যায় না। গত ২২শে ফেব্রুয়ারি রাতে আমার ফেইসবুকের ইনবক্সের মেসেজ রিকোয়েস্ট বক্সে গবেষক এ কে এম মিজানুর রহমানের একটি ডিজিটাল চিরকূট চোখে পড়লো।
সেই চিরকূটটি তিনি আমাকে প্রায় বছর দেড়েক আগে, ২০২০ সালের ২৮ জুলাই পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, "আমি একেএম মিজানুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি গবেষণা কাজে সহযোগিতা লাভের প্রত্যাশায় যোগাযোগ করতে চাই।"
অনেক বিলম্বে হলেও মেসেজটি পড়ার সাথে সাথেই আমি একটু অপরাধবোধ নিয়ে তাকে লিখলাম, "কী সহযোগিতা করতে পারি জানাবেন, সম্ভব হলে অবশ্যই সহযোগিতা করবো।" তখন বাংলাদেশে রাত ১টা ৫৬ মিনিট। এর ঠিক পনের মিনিট পর তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, "আমি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ এর উপর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য কাজ করছি টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে।
১. আপনার বইখানা কিভাবে পেতে পারি?
২. অনুগ্রহ পূর্বক আপনার একটি সাক্ষাৎকার যদি অনলাইনে নিতে পারতাম, ভালো হতো।
৩. আমি মূলত কোয়ালিটেটিভ গবেষণা পদ্ধতিতে কাজ করছি। আমি Rhetoric এবং Discourse Analysis দুটোই সম্পাদন করতে চাই। আপনার পরামর্শ একান্ত প্রয়োজন। শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা অফুরান।"
সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তারপরও আমি তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সম্বরণ করতে পারিনি। সাথে সাথে ফোন করে বসলাম তাকে, কারণ তিনি তখনও জেগেছিলেন। প্রথমেই আমি তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি দেরিতে।
তার সঙ্গে কথা বলে খুবই আনন্দিত হলাম। আমি তার চেয়ে বয়সে ছোট বিধায় অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে 'তুমি' করে সম্বোধনের জন্য। তিনি অবশ্য সে অনুরোধ রেখেছেন। সেদিন কথা আমরা দীর্ঘায়িত করিনি। তবে পরদিন তাকে আমার বইটি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম।
৭ই মার্চ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আমার কাছে একটি তথ্য বিস্তারিত ছিল না। তাহলে কিভাবে ভাষণটি ইউনেসকোর 'মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল' রেজিস্টারে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। এব্যাপারে জানতে আমি তাদেরকে ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। অবশ্য সেই সময়ে ইউনেসকোর স্বীকৃতি আমার গবেষণার বিষয়ও ছিল না।
তবে জনাব এ কে এম মিজানুর রহমানের সাথে পরে যখন কথা হলো তখন জানতে পারলাম, তার একজন বন্ধু এম. শহিদুল ইসলাম যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ইউনেসকোতে কর্মরত ছিলেন, তিনি আবেদন করেছিলেন। এ বিষয়ক ১৫ পৃষ্ঠার একটি নথি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। নতুন তথ্য জানতে পারলাম। এম শহিদুল ইসলাম যেসব তথ্য দিয়েছেন তাৎক্ষণিকভাবে তা যথেষ্ট। যার কারণেই ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। আমি যতদূর জানি তিনি একজন সৎ কর্মকর্তা, যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন ভাষণটির ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায়ে। যেসব তথ্য তিনি সেখানে উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো যে আমার গবেষণার সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে একশ ভাগ মেলে তাও নেই। তবে এ কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে, তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ে যে কাজ করেছেন তাতে পুরোপুরি সঠিক ইতিহাস সেখানে তুলে ধরা অসম্ভব ছিল।
এখন একটু পর্যালোচনা করবো 'নমিনেশন ফর্ম ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার' এর উল্লেখযোগ্য তথ্যগুলো নিয়ে:
৩ ও ৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে:
"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কিত প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে:
i) মূল অসম্পাদিত অডিও রেকর্ডিং,
ii) আসল 45 RPM রেকর্ড (সম্পাদিত সংস্করণ),
iii) মূল 35 মিমি ফিল্ম ফুটেজ,
iv) পরবর্তী সম্পাদিত এবং সংরক্ষণ এবং অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে মানসম্মত অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং এবং
v) প্রতিলিপি।
i), iii), iv), এবং v) উপরে উল্লিখিত ডকুমেন্টারি হেরিটেজের উপাদানগুলো বাংলাদেশ সরকারের সম্পত্তি।
ii) উপরে উল্লিখিত প্রামাণ্য ঐতিহ্যের উপাদানটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত একটি অলাভজনক সংস্থা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সম্পত্তি।
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে।
৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে:
"ক) ৭ই মার্চের ভাষণের মূল অসম্পাদিত অডিও রেকর্ডিং যা ১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান দ্বারা সম্প্রচারিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ বেতারের (রাষ্ট্রায়ত্ত রেডিও পরিষেবা) হেফাজতে রাখা হয়েছিল। বক্তৃতার এই অসম্পাদিত মূল সংস্করণটি 19 মিনিট দীর্ঘ।
খ) বক্তৃতার অডিও রেকর্ড, একটি সম্পাদিত সংস্করণে, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম কর্পোরেশন লিমিটেড 1971 সালে 45 RPM রেকর্ডকৃত, যা এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের হেফাজতে সংরক্ষিত। বক্তৃতার বিষয়বস্তু উপরের ক) অনুরূপ, কিন্তু সম্পাদনার কারণে দৈর্ঘ্য 15 মিনিটে নেমে এসেছে।
গ) মূল 35 মিমি ফিল্ম ফুটেজ এবং ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিভাগ (ডিএফপি) দ্বারা প্রস্তুত বক্তৃতার মানসম্মত অডিও-ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টারি 1972 সালে, এখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের হেফাজতে সংরক্ষিত।"
ক ও খ তে যা বলা হয়েছে তাতে একটি অডিও ১৯ মিনিটের আর একটি সম্পাদনার কারণে ১৫ মিনিটের। দেখা যাচ্ছে, একটি মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি অক্ষত আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ ভাষণটিকে উন্মুক্ত করা হয়নি, এমনকি জনগণকে শোনানো হয়নি ১৯৭১ এর ৮-ই মার্চের পর। কিন্তু জনগণ অধিকার রাখে তাদের নেতার বিশ্বসেরা ভাষণটি শোনার ও তা সম্পর্কে জানার। জনাব এম শহিদুল ইসলাম ১৯ মিনিটের বলে ভাষণটিকে উল্লেখ করেছেন, সেটি ভুল নয়, তবে নির্ভুল হলো ভাষণটি ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের।
এক্ষেত্রে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আমার লেখা গ্রন্থ '৭ই মার্চের ভাষণ: জানা অজানা তথ্য'- এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ৭ই ডিসেম্বর ২০১৯-এ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, "তিনি তার ঘড়িকে বিশ্বাস করতে পারেন তিনি সেদিন ঘড়ি দেখেছিলেন এবং ভাষণটি ছিল ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের।"
তবে আমি এখনো অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে একমত হতে পারিনি, এই কারণে ভাষণের অডিও রেকর্ড পরিষ্কার বলছে ভাষণটি ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। তবে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন অন্যান্য তথ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেননি বরং প্রশংসা করেছেন।
আমার গ্রন্থে পরিষ্কার বলা আছে সংবিধানে ভাষণটি সংযোজন সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। সেখানে পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি তো নয়ই এমনকি সম্পাদিত ১৫ মিনিটের ভাষণও নেই। সংবিধানে যে অংশটুকু সংযোজন করা হয়েছে সেটা ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের, যে সম্পাদিত সংস্করণটি বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত। সেই অংশটুকুই সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে, আর সেখানে একশ-র কাছাকাছি ভুল আছে। আমার গ্রন্থে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। ২৪শে মার্চ ২০২১-এ বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভির একটা অনুষ্ঠানেও সেগুলোর উল্লেখ আছে। সেই অনুষ্ঠানে এই ভাষণের একজন গবেষক হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং আমি অংশ নিয়েছিলাম।
সংবিধানে থাকা এ ভাষণটির যে ব্যাপার দুইটা খুব বেশি দৃষ্টিকটূ লেগেছে, সেগুলো তুলে ধরছি।
এর প্রথমটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।" কিন্তু সংবিধানে 'খুলনা' শব্দটি নেই। অথচ সংবিধানের ইংরেজি অনুবাদে আবার 'Khulna' শব্দটি আছে।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি চলবে, রেল চলবে।" কিন্তু সংবিধানে লেখা হয়েছে, 'গরুর গাড়ি'। আবার একইভাবে ইংরেজি অনুবাদে লেখা হয়েছে 'horse carriages'। এ ভুল দুটো ইচ্ছাকৃত তা মনে হয় না। তবে সংবিধানের মতো পবিত্র সম্পদের ক্ষেত্রে এমন ভুল গ্রহণযোগ্য নয়। বিভিন্নভাবে বিকৃতি ও তথ্য বিভ্রাট ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য দালালেরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাপটি মেরে আছে। এটি তারই অংশ কিনা খতিয়ে দেখা উচিৎ। এসব ত্রুটি দ্রুত সংশোধনের বিকল্প নেই।
৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে:
"অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং: জনাব মহিবুর রহমান খয়ের, চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের, বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সহানুভূতিশীল, তিনি সমগ্র ভাষণের ফিল্ম-রেকর্ডিং ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন যে অ্যানালগ প্রযুক্তি ছিল তাতে ভয়েস এবং দৃশ্য একই সময়ে রেকর্ড করা সম্ভব ছিল না। তাই ARRI সিনেমাটোগ্রাফ ক্যামেরাটি ৩৫ মিমি ফিল্মের ভিজ্যুয়াল কাভারেজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং বক্তৃতার অডিও কাভারেজের জন্য একটি উচ্চ মানের নাগ্রা রেকর্ডার ব্যবহার করা হয়েছিল। বিরতি ছাড়াই ভাষণটি টেপ রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল। তবে ক্যামেরাম্যানকে প্রতি চার মিনিটে ফিল্মের ম্যাগাজিন বদলাতে হয় বলে বিরতি ছাড়া প্রথম বক্তৃতার শুটিং করা সম্ভব হয়নি। এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিটের ভিজ্যুয়াল হারিয়ে গেছে। ক্যামেরাম্যান জনাব এম এ মবিন এখনো বেঁচে আছেন।"
এম শহিদুল ইসলামের এসব তথ্যের কয়েকটি আমার প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে ঠিক মেলেনা।
যেমন আমার অনুসন্ধান অনুযায়ী, সেদিন বর্তমানে প্রয়াত এম এ মবিন ক্যামেরায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন সার্বিক তত্ত্বাবধানে। ক্যামেরায় ছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার। তিনি আমার সঙ্গে একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রত্যেকটি ব্যাপার পরিষ্কার করেছেন। জনাব খন্দকার পরিষ্কার জানিয়েছেন বিরতিহীনভাবেই তিনি ভাষণটির চলচ্চিত্র ধারণ করেছেন, সেখানে কোনও অংশ বাদ যাওয়ার কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারেনা। তিনি যে ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন সেখানে বারবার ফিল্ম পরিবর্তন করার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। সরকারের ফিল্ম আর্কাইভের কোথাও না কোথাও সেগুলো থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন তিনি মঞ্চের উপরে থেকে বিরামহীন রেকর্ড করেছিলেন। আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। আমজাদ আলী খন্দকার সাহেব এখনো জীবিত। তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপর বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণের চলচ্চিত্র সংরক্ষণে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১-এ জীবনের বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি কাজটি করেছিলেন। জাতির ইতিহাস সংরক্ষণে তার মহান ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিলম্বে হলেও সরকার এবছর তাকে মূল্যায়ন করেছে একুশে পদক দেওয়ার মাধ্যমে।
৪ ও ৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে:
"৭ই মার্চের ভাষণে কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট ছিল না। ভাষণটির অডিও রেকর্ডিং এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সংরক্ষণ করা হয়েছিল সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে, কারণ পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকরা রেডিও পাকিস্তানের কর্মীদের বক্তৃতা রেকর্ড না করার নির্দেশ দিয়েছিল। এই সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, কিছু পাকিস্তান বেতার ও চলচ্চিত্র বিভাগের ঢাকা স্টেশনের সাহসী বাঙালি কর্মীরা, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পাশাপাশি কিছু সাংবাদিক সাউন্ড রেকর্ডিং এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল ফুটেজের মাধ্যমে ভাষণটির বেঁচে থাকা নিশ্চিত করেছিলেন।
মূল অডিও রেকর্ডিং: ভাষণটি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের সরাসরি সম্প্রচার করার কথা ছিল। রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রে তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রস্তুত ছিল কিন্তু সামরিক শাসকরা শেষ মুহূর্তে ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দেয়নি এবং ভাষণ রেকর্ড করার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রেডিও পাকিস্তান ঢাকা স্টেশনের বাংলা অনুষ্ঠান সংগঠক জনাব নাসার আহমেদ চৌধুরী বক্তৃতাটি সম্পূর্ণভাবে রেকর্ড করেন। বক্তৃতার সরাসরি সম্প্রচার বাতিলের প্রতিবাদে রেডিও স্টেশনের সকল বাঙালি কর্মী ও প্রযুক্তিবিদরা তাদের কাজ ছেড়ে দেন এবং নিয়মিত বেতার সম্প্রচার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের হুমকি দেন। অবশেষে, পাকিস্তান সরকারকে মাথা নত করতে হয়েছিল এবং পরে রেকর্ড করা ভাষণটি সম্প্রচারের অনুমতি দেয় ৮ই মার্চ ১৯৭১।"
নাসার আহমেদ চৌধুরী কর্তৃক রেকর্ডকৃত ভাষণটি আমি সর্বসাধারণের জন্য ২রা এপ্রিল ২০২১ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। নিচে তার লিংকটি দেওয়া হলো:
https://www.facebook.com/100008396536862/videos/2644401859183006
একথা বলার অপেক্ষা রাখে যে, জনাব নাসার আহমেদ চৌধুরীর সাহসিকতায় ৭ই মার্চের ভাষণটি বেঁচে যায় এবং এখনও অক্ষত আছে বাংলাদেশ বেতারে। সেদিন তিনি ব্যর্থ হলে আমারা পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি আর শুনতে পারতাম না। নাসার আহমেদ চৌধুরী শুধু ভাষণটি রেকর্ড করেছিলেন তাই নয়, তিনি বাংলাদেশের মধ্যে থেকে রেডিও স্টেশন থেকে গোপনে দেশাত্মবোধক গানের অডিও তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে ও তার সহকর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সে খবর সেসময়ের পত্রিকায় ছিল। কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত কোন মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি। এমনকি তার কর্মের কোনও স্বীকৃতিও পাননি। যদিও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই ভাষণ সারাবিশ্বে প্রচারের ক্ষেত্রে তার অবদান সর্বাপেক্ষা বেশি। কারণ তখন বাংলাদেশের মানুষের ভিডিও দেখার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। অধিকাংশের কোন রেডিও ছিল না। পুরো গ্রামে হয়তো একটা রেডিও ছিল। অতএব রেডিও এবং অডিও মাধ্যমে সারাবিশ্বে এ ভাষণটি সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত নাসার আহমেদ চৌধুরীকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। কেবল একজন সরকারি আমলা আন্তর্জাতিক একটি নথিতে তার নামটি উল্লেখ করেছেন।
আমি একজন নগণ্য মানুষ। আমার কোনো ক্ষমতা নেই, অধিকার নেই কোন পুরস্কারের জন্য নাসার আহমেদ চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করার, যদি থাকতো তাহলে আমি স্বাধীনতা ও একুশে দুটো পুরস্কারের জন্য তার নাম প্রস্তাব করতাম। আমি জনাব এম শহিদুল ইসলামের কাছে অনুরোধ রাখছি, তিনি হয়তো নাসার ভাইয়ের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
পরিশেষে বলবো ,১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের ভাষণ শত্রু নিধন এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিল। এই ভাষণটির গুরুত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে কোনদিনই শেষ হবেনা। অতএব সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের উচিত ভাষণটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং এর গুরুত্ব ও মহাত্ম্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া।
জয় বাংলা