Published : 27 Feb 2022, 05:43 PM
যে হারে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত হানা শুরু হয়েছে, যে সময়ে মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে শহরের রাজপথ থেকে দার্শনিক লালন ফকিরের ভাস্কর্য সরাতে হয়েছে, এই সময়ে লালনের জন্ম হলে তাকেই বুঝি সরিয়ে ছাড়ত অনুভূতির ঠিকদারগণ। আর ললিপপ মুখে পুরে আমাদের লেখকগোষ্ঠী চুপটি মেরেই থাকতেন!
লালন যুগের আগে ইতালির একটা উদাহরণ দিতে চাই। জর্দানো ব্রুনো ছিলেন ষোড়শ শতকের একজন ইতালীয় দার্শনিক, ধর্মযাজক এবং বিশ্বতত্ত্ব বিশারদ। তিনি ছিলেন গূঢ় রহস্যাদিতেও বিশ্বাসী। তিনি মতবাদ প্রচার করেছিলেন মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোনো কেন্দ্র নেই। আর এজন্য প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার অপরাধে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
এবার আমাদের সময়ের দিকে চোখ ফেরাই, আমরা কি ব্রুনোর সময়ের চেয়ে কোনো অনুকূল সময় পার করছি? অগ্রসর চিন্তা বা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বা সমাজ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেবল কথার কথা নয়। এগুলো কোনো বায়বীয় ধারণা না। এর বাস্তবিক কার্যকরণ ভিত্তি থাকতে হবে। একই সঙ্গে লেখালেখির জন্যে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ কল্পনা করার অবকাশ নেই। পুঁজিবাদের কুৎসিত এবং লাগামছাড়া খপ্পরে সমাজ ও রাষ্ট্র মুনাফার ভাগবাটোয়ারায় পড়ে গেছে। তবে রাষ্ট্রের অবস্থা যাই থাকুক সমাজের আলোটুকু থাকা চাই। এই আলোর ফেরিওয়ালা দৃশ্যে বা অদৃশ্যে একজন লেখকের থাকার কথা। যে কারণে লেখক করুণ সহায় সম্বলহীন একাকী একজন নির্জন ব্যক্তি হবার পরেও ক্ষমতা ও সুবিধাভিভোগী মানুষগুলো একজন লেখকের ভয়েই তটস্থ থাকেন। কারণ কী? ওই যে, দিন শেষে কেউ যদি সত্যটি উচ্চারণ করেন তিনি একজন লেখক।
লেখকের কাজ পাণ্ডিত্য জাহির করা নয়, দেখানোও নয়, শেখানোও নয়। লেখকের কাজ দেখা আর নিজের কথা নিজের মতো করেই বলে যাওয়া। যা দেখবেন আর হৃদয়ে ধারণ করবেন ঠিক সেই সত্যকে করবেন প্রকাশ। সত্য আগুনের মতো। আগুন কে না ভয় পায়?
লেখক চলেন আগুনের উৎস বুকে বহন করে। লেখক সব দেবেন কিন্তু সত্যটাকে বন্ধক দেবেন না। তাই লেখক থাকেন দৃঢ় উদাসীন কখনোবা অহংকারী আপাতদৃষ্টে। কলম যদি তিনি বন্ধক না দেন তাহলে দেমাক তো একটু প্রকাশ পাবেই। তবে তা যতটা কলমে প্রকাশ পাবে ততটাই লেখকসুলভ। এর বাইরেরটুকু নয়।
উপরের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমাদের সময়ের সংযোগ যদি ঘটাতে চাই কী দেখতে পাবো? আমাদের সময়কে দেখার মতো লেখকীয় চোখ আর সত্য প্রকাশের মতো বোকাপ্রজ সাহস দেখানো মানুষগুলো কারা? আমি অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীর মতো। 'মার কাছা, দে দৌড়ে'-এর মতো হুট্ হাট ব্লগ একখান খুলে শুরু করে দিলাম লেখালেখি এরকম দৃষ্টান্তকে পেশাদারি লেখালেখি হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছি না।
একজন লেখকের জন্যে কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়, চিন্তা ও কল্পনার স্বাধীনতাও জরুরী। এই কথাটা মাথায় রেখে আমরা আমাদের সময়কে আমাদের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি।
এবার লেখকের পেশাদারিত্ব বা বেঁচে থাকার অবলম্বন নিয়ে কথা বলতে চাই। পেটে যদি ভাত না জোটে, হাতের কলম চলবে না। কল্পনাও থাকবে না, চিন্তাও মাঠে মারা যাবে। যদিও সুকান্ত ভট্টাচার্য বলে গিয়েছেন, 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।'
আমাদের দেশে বর্তমান বাস্তবতায় লেখালেখিতে পেশাদারিত্ব কি সম্ভব? বা প্রশ্নটা এভাবেও হতে পারে, আমাদের লেখালেখিতে কি পেশাদারিত্ব আছে? অথবা আমাদের কি পেশাদার লেখক আছেন? আমি প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর দেবো না। তারচেয়ে বরং এভাবে বলতে চাই, আমাদের দেশে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাই, না পরিবারে, না সমাজে। বহু বলা কথাটা এখানেও বলা সঙ্গত
আপনি কী করেন ভাই?
– আমি ভাই লেখালেখি করি।
সেটি জানি ভাই, আমি তো আপনার লেখা পড়ি। কিন্তু আপনি করেন কী?
– বললাম তো লেখালেখি করি।
আরে ভাই, লেখালেখি তো করেন, মানলাম। কিন্তু আপনার রুটিরুজি কেমনে চলে?
সংলাপের ইতি এখানেই টানি। এই সংলাপ থেকেই সারাদেশের লেখালেখি জগতের নির্মম সত্য আঁচ করা যায়। লেখালেখি করে যে এই বঙ্গসমাজে পেট চলবে না, সেটা এই আদমের এক প্রশ্নেই পরিষ্কার হয়েছে। এই সংলাপের মাজেজা বুঝে একদল চালাক-চতুর প্রজাতির মানুষ রুটিরুজি নিয়ে বাক্যবানের মুখে ছাই দেওয়ার জন্যে হয়ে গেছেন নানা পদধারী বা লেজধারী লেখক। তার কয়েকটি উদাহরণ এমন হতে পারে:
ডক্টর কবি আবুল আবুল; সিনিয়র সচিব কবি মালুম মালুম; প্রকৌশলী কথাসাহিত্যিক হক হক; জেনারেল কবি আমান আমান; আমেরিকা প্রবাসী কবি বাকুম বাকুম; মন্ত্রীর পেয়াদা কবি ডালিম ডালিম। এই তালিকা দীর্ঘ হতে পারে।
তবে এর বাইরে কেউ কেউ অদৃশ্যে পেশাদারিত্ব রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। এই জগতে বিশেষ করে ভূবঙ্গে পেশাদার লেখক হবার চেয়ে বোকা কোনো চাওয়া জীবনে আছে কিনা আমি জানি না। এই বোকামোটা আরো চমকপ্রদভাবে আমাদের সময়ের গণমাধ্যম একেবারে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পেশাদার কোনো লেখকের সংবাদ-গুরুত্বসম্পন্ন প্রতিবেদনও গড়পড়তা উপেক্ষা করা হয় বা এড়িয়ে চলা হয়। অন্যদিকে সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্র একজন উঠতি নায়িকার মধ্যরাতে মাওয়া ঘটে পদ্মার ইলিশ খেতে যাওয়ার খবর প্রথম পাতায় ছেপেছে। গণমাধ্যমের এই আক্কেল থেকেই ধরে নিতে পারি আমরা কেমনতরো সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের মৃত্যুর খবরটা ভেতরের পাতায় থাকে বা গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে।
সারাবছর পত্রিকাগুলোতে বইয়ের খবর বা লেখালেখির খবর উল্লেখ করার মতো থাকে না। আবার দুয়েকটা থাকলেও পদধারী ঝাড়িঝুড়ি কিসিমের লেখকদের খবরগুলোই বেশি থাকে। বই আলোচনা বা সমালোচনা সাহিত্য বলতে আমাদের দেশে এখন আর তেমন কিছু নাই। সমালোচনা সাহিত্য না থাকলে সাহিত্যের রঞ্জনরশ্মি বা এক্সরে বলতে যা বোঝায় তার দৃষ্টান্ত এখন খুব একটা নাই। দুই একজন যারা লেখার চেষ্টা করেন তাতে বেশির ভাগ মৃতলেখকদের গুণকীর্তন বা জীবিত পদধারীদের তৈলমর্দনেই সীমাবদ্ধ। এটাকে সাহিত্য সমালোচনা বলতে আমি নারাজ।
বই আলোচনা নিয়েও আমার কথা আছে। পেশাদারি বই আলোচনা বা লেখালেখির উদ্দেশ্য কেবল ভালো লেখাকে তুলে ধরা নয়, খারাপ বা নিম্নমানের লেখাকেও চিহ্নিত করা। একই সঙ্গে নতুন কণ্ঠস্বরের অভিষেকের দায়িত্বও গণমাধ্যমের বা সমালোচনা সাহিত্যের। এই জায়গায় কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি বড় একটা মার খেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে এই সময়ে এসে চরম আকার ধারণ করেছে। এই ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রায় ডজনখানেক সাহিত্য পুরস্কার থাকলেও, কেবল সমালোচনা সাহিত্যের ওপর কোনো পুরস্কার নাই কেন? অথচ এই বিষয়ের ওপর সাহিত্যের পুরস্কার থাকলে লেখালেখির মর্যাদা ও কদর বাড়তে পারত।
এবার বইমেলা নিয়ে কথা বলি। ২৮ দিনের মেলায় আটাশটা উপজীব্য বিষয় ধরে বিতর্ক, সংলাপ, সেমিনার, আলোচনা, এমনকি প্রামাণ্য উপস্থাপনা, গবেষণা উপাত্ত তুলে ধরার সুযোগ ছিল প্রতিবছর। অথচ সেটা না করে যুগ যুগ ধরে আমরা একই ধরনের গৎবাঁধা সেমিনার দেখে আসছি। কাঠামোটা এরকম- একজন সভাপতি, দুইজন বা তিনজন আলোচক, একজন প্রবন্ধকার। আর সামনে প্রায় দর্শকশূন্য চেয়ারগুলো।
এভাবে আর কতদিন? এই সমস্ত অনুষ্ঠান বা সেমিনারগুলো পুনর্গঠন করে পেশাদার লেখকদের জায়গা ছেড়ে দিলে এগুলোতে প্রাণ ফেরানো সম্ভব এবং মানুষের আগ্রহ এতে বাড়বে। কিন্তু তাতে সমস্যা হলো পদধারীদের দৌরাত্ম্য কমবে। যে কারণে এর পেছনের কুশীলবরা বিকল্প ভাবতে নারাজ বা অক্ষম।
লেখালেখিতে পেশাদারিত্বকে উৎসাহিত করার জন্যে এই বইমেলা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। লেখালেখির যত বিভাগ আছে প্রতিটির জন্যে আলাদা আলাদা ছোট বা মাঝারি আকারের মঞ্চ থাকতে পারে, যেমন প্রবন্ধ মঞ্চ, কবিতা মঞ্চ, অনুবাদ মঞ্চ, সমালোচনা মঞ্চ, শিশুসাহিত্য মঞ্চ, গল্পের মঞ্চ, উপন্যাস মঞ্চ, নাটক মঞ্চ এরকম। তাতে পেশাদার এবং অপেশাদার লেখকদের একটা ছাঁকনি হয়ে যাবে।
অপেশাদারি সাংবাদিকতাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে লেখালেখির পেশাদারির ক্ষেত্রে। একটা চিত্র তুলে ধরতে চাই। একটা স্টাইল বা ফ্যাশন চালু হয়েছে প্রায় সব কাগজে বা গণমাধ্যমে।
সব লেখকের জন্যে সাধারণ প্রশ্ন:
এবার মেলা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আপনার কতটি বই বের হচ্ছে?
এবারের মেলা নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
প্রকাশকদের উদ্দেশে প্রশ্নগুলো এরকম:
এবার মেলা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আপনার প্রকাশনী থেকে কী কী বই বের হচ্ছে?
এবারের মেলা নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
এগুলো কোনো প্রশ্ন হলো? একজন শিশুকে প্রশ্ন করতে দিলেও এরচেয়ে ভালো প্রশ্ন করতে পারবে। এই তথ্যগুলো আগেই জেনে নিয়ে একজন সাংবাদিক একজন লেখকের বা প্রকাশকের মুখোমুখি হবেন। প্রয়োজনে লেখকের প্রকাশিতব্য বই সম্পর্কে ধারণা নিয়ে রাখবেন অথবা প্রকাশিত হয়ে থাকলে পুরো পড়তে না পারলেও পাতাগুলো উল্টিয়ে দেখবেন আগে। তারপর প্রশ্ন:
আপনি এই বই কেন লিখলেন?
এই বই কারা পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
পাঠক কেন এই বই কিনবে এবং কেন পড়বে?
অন্য কোনো লেখকের প্রকাশিত নতুন বই কিনেছেন বা কিনবেন?
তরুণদের কোন বইগুলো আপনি কিনবেন বলে ভেবেছেন?
এবার বই সম্পাদনা নিয়ে কথা বলতে চাই। একজন লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দেবেন। তারপর সেটি বই আকারে প্রকাশ হবার আগে একাধিকবার প্রয়োজনে একাধিক পেশাদারি সম্পাদকের হাত দিয়ে সম্পাদিত হতে হবে। সম্পাদনা কেবল ভাষাগত সংশোধনী নয়, বিষয়গত দিকগুলো নিয়েও চুলচেরা বোঝাপড়া এবং লেখকের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদনার কোনো বালাই নাই। সময়টা এখন এমন পেশাদার লেখকদের অবস্থা ভাতে মরা, পেশাদার সম্পদকরাও চাকরি ছাড়া। তাহলে এত এত উন্নয়নের ভাগ কোথায় যায়? এখানেই নীতিনির্ধারণী নিয়ে ভাবার বিষয়।
প্রবাসী লেখক নামে নতুন এক মূর্খামি শুরু হয়েছে। লেখক তো লেখকই। সেখানে প্রবাসী লেজ জুড়ে দিতে হবে কেন? বিদেশ বিভুঁইয়ে যেসব বাঙালি থাকেন আদতে তেমন কেউ পেশাদারি লেখালেখিতে টিকতে পারেন না অথবা আদতে লেখক না হয়েই লেখালেখির জন্যে মৌসুমী চেষ্টা-তদবির করে থাকেন। পেশাদার লেখক বা জাতলেখক যারা বিদেশে গিয়েছেন নিকট বা দূর অতীতে তারাও সে দেশের মূলধারার লেখালেখি জগতে জায়গা করে নিতে পারেননি। তাদের লেখালেখির পরিমাণও প্রত্যাশিত পর্যায়ে ছিল না শেষের দিকে, যেমন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বা শহীদ কাদরীর কথা উল্লেখ করতে পারি এই পর্যায়ে। বাকি যারা আছেন, তাদের অবস্থান নিজ দেশেও নাই, পরের দেশেও নাই। সত্যটা বলে দিলাম । যা বোঝার বুঝে নিন। এইসব পরদেশী অপেশাদারি লেখকদের উল্লেখ করার মতো তেমন সাহিত্যকর্মের উদাহরণও আমার কাছে নাই। বিদেশ থাকার ঝাড়িঝুড়িটুকুই সার। ভূবঙ্গে যেসব অপেশাদার বা সেমি-অপেশাদার পদধারী মোড়ল কিসিমের কেউ কেউ বিদেশ ভ্রমণের খতিয়ানকে পুঁজি করতে চান, তাদের জীবনীফর্দ, দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, ওই নিউ ইয়র্কের বাঙালির বইয়ের দোকান পর্যন্ত।
বাঙালির পেশাদারির লেখালেখি বা বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ডের বড় বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে। সেই ক্ষত বাঙালি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার বড় একটি কারণ ১৯৭৫ সালের ট্রাজেডি।
দিনে দিনে বেড়েছে যন্ত্রণা অপার। সাহিত্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়েছে অপেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। আবার সাহিত্য সংগঠনগুলোও ব্যবহৃত হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপেশাদার স্বার্থপর কর্তৃত্বপরায়ণ কিছু মানুষের সুযোগ সুবিধা বা পুরস্কার জিতে নেবার সিঁড়ি হিসেবে। আদতে পেশাদারি লেখালেখির অনুকূলে তো নয়ই তারা বরং এর বিপরীতে গণশত্রুর ভূমিকা পালন করেছেন তারা। এখানে নামগুলো বলে কাউকে বিব্রত করতে চাই না।
অপেশাদার লেখালেখির কয়েকটা নমুনা তুলে ধরতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে একজন সোনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথভাবে একটি বই সম্পাদনা করেছেন। ওই ব্যবসায়ী না একজন লেখক বা সম্পাদক। আর উপাচার্যও আদতে সম্পাদক বা লেখক নন। তাহলে? ওই যে অপেশাদারী খায়েশ বলে একটা কথা থাকে, নাম ফাটানো।
উদাহরণ আরো আছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে এক মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ের সম্পাদনার ভার দিয়েছেন তার স্ত্রীকে আদতে যিনি না একজন লেখক বা সম্পাদক। এই কাজগুলো প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিয়ে পেশাদার সম্পাদকদের দিয়ে করানো সঙ্গত ছিল কি না?
অবস্থা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে পেশাদার লেখকরা ভাতে মারা যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আবার কেউ কেউ যদি পেশাদারি লেখালেখি করে রুটিরুজি জোগাবার চেষ্টা করেন তাদের দম নেবার সময়টুকু থাকে না– আখেরে তাদের নিজের লেখা আর পড়ার সময়টুকুও হারিয়ে যায় টিকে থাকার সংগ্রামে।
আমাদের তেলতেলে উজ্জ্বল অপেশাদার, সেমি-অপেশাদার লেখকরা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। তারা নিজের লেখার প্রেমে পড়েন, নিজের রূপে মুগ্ধ থাকেন, তাই গণমানুষের মুখ ও জীবনের ছবিগুলো তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ওই দিকে তাদের তাকাবার সময় নাই। দিনমান চলে তাদের সেলফির বহর।
লেখকযশপ্রার্থী বিদেশবিভুঁইয়ের মানুষগুলোকে ঠকিয়ে বা ভুলিয়ে অনেক চতুর প্রকাশক প্রচুর টাকা বা অন্যসব আবদার হাসিল করে বই প্রকাশ করেন। এভাবে কিছুদিন চলে একটা পর্যায়ে এইসব হতভাগা যশপ্রার্থীরা হারিয়ে যান লেখালেখির জগৎ থেকে।
অপেশাদার লেখালেখির দৃষ্টান্ত আরো অনেক। এক রাজস্ব কর্মকর্তা লেখক চলচ্চিত্রের পোস্টারের মতো করে দৈনিক পত্রিকায় তার বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপেন বইমেলা চলাকালীন পুরো মাসজুড়ে। এর আগেও একাধিক রাজস্ব কর্মকর্তা ওই রকম কাজ করেছেন।
এখন প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হলে পেশাদার লেখক হবার চেয়ে লেজধারী অপেশাদার লেখক হতে পারলে কদর বেশি। কপর্দকহীন তেলচরবিহীন লেখকের দিকে মনোযোগ দিয়ে বড়কর্তাদের বা গণমাধ্যমের মুঘলদের কী লাভ? একজন অপেশাদার লেখকের লেজসম্পন্ন প্রকাশ এরকম: অধ্যাপক ও কবি, সিইও ও কবি, সম্পাদক ও কবি, ডক্টর ও কবি, সচিব ও কবি, উকিল ও কবি, ব্যাংকার ও কবি। এরকম হরেক কিসিমের লেখক ও কবি আজ আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। এতে দোষের কিছু না।
পাঠক হিসেবে আমি খুব অপেক্ষা করি পুলিশ বাহিনীর ভেতরের গল্পগুলো শঙ্করের 'কত অজানারে' বইয়ের মতো করে পুলিশ বাহিনীর ভেতরের কেউ লিখুন। একইভাবে মানবিক চোখ দিয়ে দেখুক আমলাতন্ত্রের ভেতরের জগৎ আর তার গল্প উঠে আসুক তার কলমে। আইনি জগতের মানবিক গল্পগুলো কোনো আইনজ্ঞের লেখালেখিতে চোখে পড়ে কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট ও রুগ্নদশার কথা কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কলমে উঠে আসে কখনো? ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের নিয়ে যতটা চামচামি আর তৈলমর্দন থাকে তাদের লেখা ও কথায়, এর বিপরীতে পেশাদারি প্রকাশের ছিটেফোঁটাও থাকে না তাদের কথা ও লেখা, না মাস্টার হিসেবে, না লেখক হিসেবে।
কোনো মন্ত্রীর কলমে তো দেখি না মন্ত্রিত্ব করতে গিয়ে বা মানুষের সেবায় জীবনের সময় উৎসর্গ করতে গিয়ে কতটা পথ পেরোতে হয়েছে, মানুষের দুর্ভোগে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। শেষে না পেরে নিজের যন্ত্রণা কিছুটা কমাতে হাতে কলম নিয়েছেন। আমাদের আছে যত সব ফুরফুরে মেজাজের লেখকদল। লেখালেখিতে পেশাদারি বলে যে কল্পদৃশ্য সেটা কল্পনাতেই আছে, বাস্তবে নাই। পেশাদার লেখক আজ বিলুপ্তপ্রায় প্রান্তিক আদিবাসী আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে।
এই পর্যায়ে আমাদের বইমেলার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। বইমেলায় 'লেখক বলছি' বলে একটা নতুন অনুষ্ঠান চালু হয়েছে প্রয়াত শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক থাকার সময়ে। ভালো উদ্যাগ। তবে এই নামটি নিয়ে আমার একটু মৃদু আপত্তি আছে। নামটি হতে পারতো 'লেখকের মুখোমুখি'।
বইমেলা ঘিরে গণমাধ্যম দৃষ্টিকটুরকম অপেশাদারি এবং আনাড়ি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গণমাধ্যমগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেশাদার লেখকদের অনুসন্ধান না করে নামধারী, পদধারী মৌসুমীলেখক বা সেমি-অপেশাদার লেখকদের দিকে ছোটাছুটি করে। অমুক মন্ত্রী এসেছে, দে দৌড়? অমুক নায়িকা এসেছে মেলায়, দে দৌড়। অমুক ব্যবসায়ী এসেছে মেলায়, দে দৌড়? অমুক রাষ্ট্রদূত এসেছে, মেলায়, দে দৌড়। অমুক খেলোয়াড় এসেছে, মেলায় দে দৌড়? এরকম দৌড় প্রতিযোগিতায় থাকে আমাদের গণমাধ্যমগুলো। ওই প্রশ্ন একই, 'স্যার, এবারকার মেলা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? আপনার কি কোনো বই বের হয়েছে এবারকার মেলায়?'
গণমাধ্যমের কর্মী যখন একজন পদধারী কাউকে প্রশ্ন করবেন সেখানেই পেশাদারি জায়গা থেকে করবেন, সম্বোধন এরকমভাবে হতে পারে, মন্ত্রী মহোদয় বা সচিব মহোদয় বা মান্যবর রাষ্ট্রদূত, জেনারেল মহোদয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক মহোদয়, মহাপরিচালক মহোদয়।
আমাদের গণমাধ্যমের আরো একটা আত্মঘাতী প্রবণতা খেয়াল করা যায়। কার লেখা ছাপলে লাইক বেশি পড়বে। এইটা যদি বিবেচনার বিষয় হয় তাহলে আমরা আর নাই। পর্নোগ্রাফি ছেপে দেখুন মাঝে মাঝে, লাইকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেন। সম্পাদকের চোখ এবং বিবেক বলে একটা কথা আছে। এই কথাটা ভুলে যাবেন না আমাদের অপেশাদার লেখালেখি যুগের বেশিরভাগ অপেশাদার সম্পাদকেরা।
লেখালেখি অঙ্গনে আরেকটা বাতিক শুরু হয়েছে। লেখকের জন্মদিন পালন বা ঘটা করে পঞ্চাশ বছর পূর্তি, ষাট বছর পূর্তি, পঁচাত্তর বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করা। বাঙালি লেখকদের জন্মদিন পালনের রেওয়াজ আমাদের গুরু রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই। যদিও এ উদ্যোগ তার ছিল না। তার এক দিদি পারিবারিকভাবে একবার জন্মদিন পালনের আয়োজন করেন। এরপরে আর পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
রবীন্দ্রনাথ আরেকটা প্রবণতা বাঙালি লেখালেখির জগতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। লেখাজোকা ছাপার ক্ষেত্রে একধরনের রাষ্ট্রাচার মেনে চলা। তার সময়ে বিশেষ করে তিনি যখন লেখালেখিতে প্রতিষ্ঠার তুঙ্গে তখন তার কোনো লেখা কোনো পত্রিকায় বা প্রকাশনায় ছাপার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ এবং অন্যদের থেকে আলাদা গুরুত্ব প্রত্যাশা করতেন। এক পর্যায়ে এটা একটা প্রচলিত রীতি হয়ে গিয়েছিল।
তার শতবর্ষ পরে এসেও বাঙালি এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসেনি। দুনিয়ার অন্যান্য দেশের লেখালেখি পরিমণ্ডলে লেখকদের এরকম জন্মদিন পালনের ধুম আর রাষ্ট্রাচার চর্চার নমুনা দেখা যায় না বললেই চলে।
আমাদের দেশে লেখালেখি অঙ্গনে যেসব ব্যক্তি ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন, ফেইসবুক ভরিয়ে তুলেন ছবি আর সেলফিতে। উনাদের জন্ম না হলে আমাদের এমন কি ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? কেউ যদি বাতলে দিতে পারতেন। তারপর জীবিত অবস্থায় নিজের সম্পর্কে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের নতুন এক বাতিক শুরু হয়েছে। ভাবখানা এরকম মরার আগেই কুলখানি কেমন হবে সেটা দেখে যেতে চান। আদতে নিজেদের উপর উনাদের বিশ্বাসের বড় এক ঘাটতি রয়েছে। উনারা ভরসা পান না মৃত্যুর পর তাদের নিয়ে কেউ যদি আর না লেখে! আমাদের এক জাঁদরেল পণ্ডিত ও লেখক এপিটাফ লেখা শ্বেতপাথর কাপড়ে মুড়ে বিছানার পাশে রেখে ঘুমান। কেননা মৃত্যুর পর এপিটাফটা যদি কেউ ঠিক মতো না লেখে!
যে নগরে পা বাড়ালেই অভুক্ত মানুষ, একের পর এক সাহায্যপ্রার্থীর হাত, বেকারের দীর্ঘলাইন, হাজারো মানুষ রাতে রাজপথে খোলা রাস্তায় ঘুমায়, লাখো মানুষ বস্তিবাসী। এহেন অবস্থায় একজন লেখক ঘটা করে জন্মদিন পালনের আক্কেলটা কোথায় পান?
একজন লেখক হচ্ছেন একাকী পদযাত্ৰী নির্জন আঁধারে দূরপথের রানার। কিন্তু তার টিকে থাকার দেশভূমি থাকা চাই। জাতলেখক স্বভূমেই পরবাসী। এই পরবাস আরো স্পষ্ট এবং দুর্বহ হয় তার পিতৃভূমির যদি কোনো সাহিত্য রাজনীতি বলে কিছু না থাকে। সাহিত্য রাজনীতির বড় একটা জায়গায় থাকার কথা। অনেক বিপ্লব, জাতিগত পুনর্গঠন প্রক্রিয়াগুলোর দিকে নজর বুলিয়ে দেখুন সাহিত্য বা লেখালেখি কতটা মর্যাদার এবং কেন্দ্রের বিবেচনায় ছিল। এমনকি আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালেও মনে পড়ে যাবে, নিদেনপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের দিকটা একটু দেখে নিন, তাহলে পরিষ্কার হবে রাষ্ট্র আর সমাজের জন্য ঢাল আর তলোয়ারই শেষ কথা নয়, সেখানে লেখালেখির জন্যও মর্যাদার জায়গা থাকতে হবে। সেটা হতে হবে পেশাদারি লেখালেখির আলো ছড়ানো আবহ।
এখানে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, লেখালেখিতে 'স্তুতি' বা 'জ্বি হুজুর'ই যদি সব হয় তাহলে তো লেখালেখির দরকার নাই। লেখালেখির উদ্দেশ্যের একটি হচ্ছে প্রশ্ন তোলা বা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া।
লেখালেখির আদি ও চিরন্তন উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে উন্মোচন করা। আমাদের চারপাশের লেখক নামধারীদের অনেকের নিজেদের জীবনেই সত্য নাই। তারা সত্য প্রকাশ করবেন কীভাবে?
পশ্চিমা সাহেবি ঢঙ নকল বা অনুকরণ করে ক্লাবে ক্লাবে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেওয়া, পশ্চিমা সাহিত্যের সূত্র উল্লেখ করা, ইংরেজি বাংলার মিশেলে আর টাই-স্যুট পরে স্মার্ট হবার খায়েশে আর যাই হোক বাঙালিত্ব বা নিজস্বতা প্রকাশ পায় না। এসব নিয়ে শামসুর রাহমান এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও কখনও খেদ ঝেড়েছেন। পেশাদার লেখকের পা থাকবে মাটিতে, কল্পনা আকাশে যাবে আপত্তি নাই। অন্যের দুর্ভোগে যে পীড়িত হবে না বা হতে পারে না, সে আবার কিসের লেখক, কিসের কবি! আমাদের চারপাশে এত এত সফল অলরাউন্ডার আমলা, মাস্টার, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ব্যাংকার– এত নির্মম সুখ আর নির্লজ্জ ফূর্তি আর ভয়াবহ সমৃদ্ধি নিয়েও লেখেন সুখের কবিতা, দুঃখের কবিতা। পুরস্কার জেতেন, জনগণের করের টাকায় বিদেশে ছোটেন, ছবি আর সেলফিতে ফেইসবুক ভরেন। আদতে পুরোটাই প্রহসন, আপাদমস্তক ভণ্ডামি। পেশাদারি লেখালেখিতে আখেরে ভণ্ডামির জায়গা নাই।
আমাদের অপেশাদার লেখকদের অনেকে শুরু করেন নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে কতগুলো খুচরা পুরস্কার গ্রহণ করেন। চোখ থাকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের দিকে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেলে একুশে পদকের জন্য পদলেহন শুরু হয়ে যায়। সেটা পেয়ে গেলে আখেরি লক্ষ্য হলো স্বাধীনতা পদক। একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখক পুরস্কার উপেক্ষা করার হিম্মত রাখেন। উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে। কবি জসিম উদদীন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখান করেছিলেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের মতো পুরস্কারকেও প্রত্যাখ্যান করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। একজন দায়বদ্ধ সৎ পেশাদার লেখকের অবস্থান এরকম দেমাগি এবং দৃঢ়।
আমাদের অপেশাদারি লেখালেখি সময়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীন রচিত একটু শিশুতোষ ছড়ার আশ্রয় নিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই।
কানা বগীর ছা
ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ।
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।
ও বগী তুই খাস কি?
পানতা ভাত চাস কি?
পানতা আমি খাই না
পুঁটি মাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।
আমাদের চারপাশের অপেশাদার লেখকদের অনেকের অবস্থা অনেকটা কানাবগীর ছা-র মতন।