ফেইসবুক লাইভে আত্মহত্যা ও আমাদের সাম্প্রতিক উপলব্ধি 

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 18 Feb 2022, 04:49 PM
Updated : 18 Feb 2022, 04:49 PM

ফেইসবুকে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মহননের বিষয়টি আমাদেরকে বেশ নাড়া দিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্রুত পরিবর্তনশীল ইস্যুর ডামাডোলেও এখনও মহসিন খানের আত্মহত্যা পুরোপুরি ভুলতে পারেননি অনেকেই। অনেকেই পরবর্তীতে স্ট্যাটাসে লিখেছেন-  এ ধরনের মৃত্যু দেখে তাদের মনে একধরনের দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতা ভর করেছে, ট্রমাটাইজড অনুভব করছেন কেউ কেউ।    

ওই আত্মহত্যার ঘটনার তুলনায় এই সমাজে অন্যঅনেকের বেদনা বোঝার গভীর সহানুভূতি অবশ্য কমই দেখা যায় মহসিন খান একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন সেটা মোটাদাগে উচ্চবিত্তের  যদিও মহসিন খানের আত্মহত্যার সময়কার মানসিক পরিস্থিতির প্রতি পরিপূর্ণ সহানূভূতি জানাচ্ছি অন্তত এখনও যারা সমাজে তার মতো জীবন অতিবাহিত করছেনতাদের জন্যও। এদের অনেকেই হয়তো নিজেদের মানসিক অবস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা অন্য কোথাও মহসিন খানের মতো প্রকাশ করছেন না 

জনে জনে আমরা নানা মানসিক সংকট নিয়ে ঘোরাফেরা করি অনেকের মতো সেগুলো আমরা একেঅপরকে বলাবলি করি, ঘনিষ্ঠ মহলে কিন্তু সেখান থেকে কি সমাধানটা আসে? এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্যান্য মাধ্যম থেকেও? চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর মহসিন খান আর্থিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার খুব কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে এটা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন নিজের অনুমোদিত অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যার আগে 

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলছে, এখানে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি। যাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল কিন্তু আবু মহসিন খানের বয়স ছিল ৫৮ বছর তাহলে তিনি অন্যদের মতো না করেও কেন ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করলেন? তিনি নেই কাজেই আজ তাকে মানসিক শুশ্রুষা দেওয়ার কোনও উপায় নেই এমনি যারা আত্মহত্যা করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের জন্য কারও কিছু করার থাকে না কিন্তু যারা আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের জন্য কিছু করার থাকে  

যেহেতু ফেইসবুক লাইভে আত্মহত্যার বিষয়টা নতুনভাবে সামনে আসছে সেহেতু সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুবুর রহমান তাদের কার্যালয়ে আয়োজিত গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক সভায় মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন ব্যাপারে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকের কাছে জবাবদিহিতা চাইতে গিয়ে কথাটা নিয়ে এসেছেন (কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এই সমাজের জবাবদিহিতা কী?) ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশ্নের জবাবে বলেছে, শুরুতে ঘটনাটা তারা বুঝতে পারেনি লাইভের শুরুতে মহসিন খানের কথা, আচরণ স্বাভাবিক ছিল তিনি আত্মহত্যা করবেন বলেও ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে মনে হয়নি

যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে চাই সেটার জবাব সিআইডি প্রধান ওই অনুষ্ঠানে দিয়েছেন তিনি বলেছেন, "ওই ব্যক্তি প্রায় ১৬ মিনিট লাইভে ছিলেন, ওই ঘটনা কেন সিআইডি জানতে পারল না আমাদের কেউ দোষারোপ করেনি কিন্তু আমাদের কি দায়িত্ব নেই?"

একজন পেশাদার মানুষ হিসেবে এটা সাধুবাদ পাবার মতো কথা তিনি তার দায়িত্ব নিয়ে যথেষ্ট সচেতন আমাদের সেটা বুঝতে আর বাকি থাকে না 

কিন্তু দেশে আত্মহত্যার দিন দিন বাড়ছে নতুনভাবে বলা হচ্ছেইদানিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আত্মহত্যা বাড়ার ওপর প্রভাব ফেলছে সব মিলিয়ে আমাদের করণীয় কী? কার কী দায়িত্ব? 

একজন মহসিন খান ফেইসবকু লাইভে এসে আত্মহত্যা করলে সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে সিআইডি প্রধানের পর্যন্ত সহানুভূতি পান। কিন্তু অনলাইনের বাইরে বাস্তব জীবনে যারা আত্মহননের পথ বেছে নেন তাদের ক্ষেত্রে কি আমরা সেভাবে সরব কিংবা সহানুভুতিশীল? 

আবু মহসীন খানের সাধারণ আত্মহত্যাকারীদের গড় বয়সের চেয়ে অনেক বেশি সেক্ষেত্রে তার মৃত্যুর ব্যাপারে সামাজিক সহনশীলতার মাত্রাও অনেক বেশি হওয়ার কথা কিন্তু আমরা আসলে আবু মহসিন খানের আত্নহননের ব্যাপারে অন্য আত্মহননের ঘটনার তুলনায় বেশি ব্যথিত ঠিক কোন্‌ কারণে? সেটি কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা চাক্ষুস অভিজ্ঞতার জন্য নাকি তার অর্থনৈতিক বা শ্রেণিগত অবস্থানের বিবেচনায় তার অসহায়ত্ব ভেবে? আবার এ প্রশ্নও করা যায় তার শ্রেণির মানুষের মধ্যে আহাজারি বেশি বলেই এ ধরনের ঘটনা গুরুত্ব বেশি পাচ্ছে কিনা?  

বিভিন্ন জরিপ বলছে, মহামারী শুরু হওয়ার আগের বছরেই ২০১৮ সালে এদেশে আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল ১১ হাজারের বেশি বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করছেন দেশে দিনে ৪০ জনের মতো  করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় ৪৪ শতাংশ আত্মহত্যা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ে এই হার ২৮ শতাংশের কাছাকাছি বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, আচঁল নামে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা উঠে এসেছে ২০২১ সালে ১০১ জন  বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৯ জন, তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ  পুরুষ যদিও সামগ্রিক নারীপুরুষের আত্মহত্যার হিসাবটা যথাক্রমে ৫৭  ৪৩ শতাংশ (আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য২০২১ সালের ১৩ মার্চের সংবাদমাধ্যম) 

এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, আমাদের মহসিন খানের আত্মহত্যার মতো অন্য সব আত্মহত্যার ব্যাপারেও বিচলিত হওয়া দরকার আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ব্যাপারটি যেহেতু তার মতো উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপর সাড়া ফেলেছে, নীতি নির্ধারকদের হৃদয়ে সাড়া ফেলেছে- সেক্ষেত্রে সকল আত্মহত্যার পথ বন্ধ করতে একটি প্লাটফর্ম সৃষ্টির সময় এসেছে। কেননা, এই শ্রেণি থেকেই সংকট সমাধানে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়।     

এ ধরনের প্লাটফর্ম মানসিক ও ইমার্জেন্সি সাপোর্ট দিবে। তাহলে আত্মহত্যার পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব বলেই আমার মনে হয়।   

মহসিন খান প্রায় সাড়ে ১৬ মিনিট লাইভে ছিলেন আবার দরজাও খোলা রেখেছিলেন যারা ১৬ মিনিট লাইভ দেখেছেন তারা অনেকটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন আমরা একবারও হয়তো এটা ভাবিনি, মহসিন খান শুধু লাশ নিয়ে আসার জন্য হয়তো দরজা খোলা রাখেননি। হয়তো কেউ আত্মহননের পথ থেকে ফিরিয়ে আনবেসেই আশাও উনার ছিল! আত্মহননের আগে তিনি কি সমাজের সহানুভূতির পরীক্ষা নিলেন! 

সিআইডি প্রধান একটি কথা বলেছেন, যারা লাইভটা দেখেছে তাদের ডাকবেন তাদের কী করণীয় ছিল সেটা বোঝাবেন অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনা যে হৃদয়বিদারক, সে পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি না করার মতো অসংবেদনশীল অবস্থায় পৌঁছেছে আমাদের সমাজ। 

যাদের আত্মহত্যা লাইভে দেখছি না, শুধু কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে খবরে দেখছিতাদের নিয়ে ভাববার সময় আমাদের না হবারই কথা এতোটাই ব্যস্ত আমরা ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে না এসেই অজান্তে, অপ্রকাশ্যে আরও গভীর দুঃখকষ্টে যারা আত্মহত্যা করছেন, তাদের ব্যাপারে কেন আমরা সমন্বিতভাবে কিছু করিনি আজও?

শুধু বছরের একদিন আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে হলেই হবে না আত্মহত্যাপ্রবণতা নিয়ে যারা ঘুরছেন- শ্রেণি, অর্থনৈতিক সার্মথ্য, সামাজিক অবস্থা, লিঙ্গ- নির্বিশেষে সকলের কথা আমাদের একই সহানুভূতি নিয়ে বলতে হবে। তাদের শ্রেণিগত লিঙ্গগত অবস্থান ভিন্ন হতে পারে, মনের দিক থেকে ব্যথাবেদনা একই    

মহসিন খানের পুরো আত্মহত্যার নেপথ্যে সামাজিক, মানসিক, মানবিক সংকট ছিল, যেখানে অপরাধের যোগ আছে অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষের ভাত-কাপড়ের সংকটও থাকে কর্মহীনতা, বেকারত্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নানা ক্ষয়ক্ষতির কারণে মানসিক পীড়ণ সহ্য করতে না পারা- থাকে। করোনাকালে নতুন সংকট, নতুন উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে সেখান থেকে হতাশার মাত্রা আরও বেড়েছে  এখানে রাষ্ট্র সমাজ যে যার জায়গা থেকে দায়িত্বগুলো পালন করলে, আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব আর এসব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সহমর্মী সমব্যথি হওয়ার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এই মানবিক গুণগুলোর চর্চা বাড়ানোর উপায় ও উদ্যোগ খুঁজতে হবে। 

আজকের দিনে আত্মহত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো একটা আকর্ষণীয় প্লাটফর্ম হয়ে উঠছে বলে গবেষকরা বলছেন অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে,ত্মহত্যাকারীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত অন্যদের সফলতার সাথে নিজেদের তুলনা করতে গিয়ে হতাশ হয়ে নিজেকে হত্যার রাস্তা বেছে নিচ্ছেন  এটাকে নেতিবাচক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি বলা হচ্ছে। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্র করে এই নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির বদলে ফেলা যায়। সমন্বিত আত্মপর্যালোচনা এবং তা থেকে ইতিবাচক ফলাফল বের করার কৌশল নিয়ে ক্যাম্পেইন চালানোর মাধ্যমেই হয়তো আত্মহননের প্রবণতা কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।