Published : 12 Feb 2022, 06:33 PM
বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের আন্দোলন হয়েছিল ১৯৪০ সালে মানভূমে। মানভূম বিভক্ত হয়ে এক অংশ প্রথমে চলে গিয়েছিল বিহারে, পরে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে। অন্য অংশ পুরুলিয়া নামে যোগ হয়েছে পশ্চিম বাংলায়। রাজনৈতিক বিভাজন অথবা সংযোজন সাধারণত প্রতিষ্ঠিত ভাষাকে আহত করলে করতেও পারে, কিন্তু তার মৃত্যু ঘটানো কঠিন কাজ।
মানভূমের উল্লেখের আরও একটি কারণ রয়েছে। কাছেই রয়েছে বীরভূম। এখানে জন্ম হয়েছিল বড়ু চণ্ডীদাসের। আদি বাংলা ভাষার লিখিত নিদর্শন হল চৌদ্দ শতকের বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। ১৯৪০ সালে মানভূমে যখন চলছিল বাংলা ভাষা আন্দোলন। প্রায় একই সময়ে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল অবিভক্ত বাংলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে গঠিত হবে সার্বভৌম দেশ। লাহোর প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন আবু কাসেম ফজলুল হক। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬-৪৭ সালে শরৎ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কিরণ শঙ্কর রায়, ও আবুল হাশেম সার্বভৌম যুক্ত বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। বিবিধ চক্রান্তে তা ভণ্ডুল হয়ে গেল।
রাজনৈতিক বিভাজনের পরও আজ বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ সংলগ্ন আসাম ও মনিপুরের বিস্তৃত অঞ্চল, পশ্চিম বাংলা পার্শ্ববর্তী বিহার ঝাড়খণ্ড ছত্তিশগড় উড়িষ্যার কিছু অংশ, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অভিবাসী বাঙালির হৃদয় জুড়ে বাংলা ভাষার বিজয় ডঙ্কা ধ্বনিত হচ্ছে। এথনোলগ-কে উল্লেখ করে উইকিপিডিয়া প্রাথমিক ভাষায় কথা বলার পরিসংখ্যানে বাংলা ভাষাকে দিয়েছে পঞ্চম স্থান। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ত্রিশ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে।
মানভূম-বাংলা-ভাষা-আন্দোলন এর সাত বছর যেতে না যেতেই পূর্ব বাংলায় শুরু হল ভাষা আন্দোলন। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হল বাঙালির রক্তে। ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ক্ষীণ বহ্নিশিখার জন্ম হয়েছিল সে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ১৯৭১ সালের ৯ মাসের রক্তঝরা স্বাধীনতা যুদ্ধে। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল। বাংলাভাষার প্রতি নিদারুণ মমতা ছিল এই বিজয়ের কেন্দ্রভূমিতে। এই বহমান আন্দোলনের সফল ফল হলো বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এই আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। ভাষা শহীদদের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। যখন শুনতে পেলাম, তখন গর্বে আর অহংকারে নক্ষত্রের রাজ্যে অবগাহন করছিলাম। যে নিভৃতচারী পরবাসী বাঙালিরা সার্থক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের জন্য রইলো আমার অন্তরতম শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাংলাভাষা তুলনামূলক ভাবে একটি তরুণ ভাষা। যার জন্ম ১৩০০ বছর আগে। পূর্ণাঙ্গ বাংলা হরফে উৎকীর্ণ লিপির প্রমাণ মিলেছে ১১৯৬ সালের ডোম্মনপালের সুন্দরবন তাম্রলিপিতে। আধুনিক রূপ অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তরুণ ভাষা। কিন্তু তার বিজয় তুর্য অলৌকিকতাকেও হার মানায়। নবজন্ম লব্ধ শিশু ভাষা ১৯১৩ সালে তুরি মেরে উড়িয়ে দিল পৃথিবীর অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত ভাষার দেশগুলোকে। জাপান, চীন, পর্তুগাল, ইরান, আরবি ভাষার দেশগুলো, পূর্ব ইউরোপ, তুর্কি ভাষাভাষী দেশসমূহ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা- এদের কেউ সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পায়নি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আগে। এই বিজয়ের কথা মনে হলে বর্তমানে আমার প্রার্থিত নির্বাসনের কোভিড জর্জরিত বন্দিদশার নির্জনতায় প্রাণ ভরে শুনি অতুল প্রসাদ সেনের চিরায়ত সংগীত।
মোদের গরব, মোদের আশা,
আ-মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা!
নিদারুণ অহংকারে এতক্ষণ আমার বিচরণ ছিল নক্ষত্রের রাজ্যে। ওই অর্জনগুলো ছিল অতীতে। এখন প্রশ্ন হলো বর্তমানে কি ঘটছে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কি? আজ সীমিত কলবরে আমি কয়েকটি বিষয় স্পর্শ করব সংক্ষিপ্ত আলোচনায়।
ভাষা হলো একটি জীবন্ত প্রাণীর মত। নিয়ত পরিবর্তনে এর অমোঘ বিহার। এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে আহরণ করে শব্দের রত্ন ভাণ্ডার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পৃথিবী থেকে মহানন্দে গ্রহণ করে নব আবিষ্কার। বিবর্তনের ধারায় নব প্রাপ্তিকে আপন করে ঘরে তুলে নিতে থাকে। কবিগুরুর ভাষায় "দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে।" বাংলার উপঢৌকন অন্যের দুয়ারে পৌঁছে দিতে অনুবাদের উপর জোড় দিতে হবে। ভালো অনুবাদ হলে নজরুল, তারাশংকর, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, জয় গোস্বামী সহ আরও অনেকের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের সম্ভাবনার দিকটি উড়িয়ে দেওয়া যেত না।
স্থান কালের অমোঘ ধারায় ভাষার পরিবর্তন এবং বিভিন্নতা অনিবার্য। তবুও ভাষার মানদণ্ড থাকতে হবে। ইংরেজি, ফরাসী ভাষা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু নিয়ম পদ্ধতি মেনে চলছে। তাই উপসংহারে আমার প্রস্তাব: বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, পার্শ্ববর্তী বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল, বাঙালি ডায়াসপোরা মিলে একটি একাডেমি গঠন করা হোক। প্রধান দায়িত্ব হবে হাজারো বিভিন্নতার মাঝেও একটি মানদণ্ড রক্ষা করা।