আগুনের রকমফের

Published : 1 Dec 2021, 02:34 AM
Updated : 1 Dec 2021, 02:34 AM

১.

গত ২৯ নভেম্বর রামপুরার রাস্তায় ঝরে যাওয়া ১৯ বছর বয়সী তরুণটির নাম মাইনুল ইসলাম। ওই দিনই ছিল তার জন্মদিন। দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবার না হলে হয়তো সেদিন রাতে তার ঘরেও জ্বলতো মোমবাতি। হয়তো ছোট্ট একটা সস্তাদরের কেইক কেটে, সেমাই কিংবা পায়েস চেটেপুটে খেয়ে একটু আনন্দ-উৎসবও হত। কিন্তু সব শেষ দুই বেপরোয়া বাসের পাল্লা দেওয়ার 'আগুনে খেলায়'। জন্মদিনের মোমবাতি জ্বলেনি, বরং তার জীবন প্রদীপটিই নিভে গেল চিরতরে। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যে কুঁড়িটির আগামীতে ফুল হয়ে ফোটার কথা ছিল, অভাবে পিষ্ট হয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর কথা ছিল, একদিন বড় হয়ত দেশকে কিছু দেওয়ারও ছিল, সব স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ঝরে গেল অকালে। ক্ষোভের আগুনে পুড়লো বাস। দেখছি অনেকেই ব্যস্ত বাস পোড়ার ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কষতে। জীবন পড়ে গেছে খরচের খাতায়; মূল্যহীন।

২.

'মশার কয়েলের' আগুনে ছারখার টঙ্গীর মাজার বস্তি'- দিন চারেক আগে এ শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মশার যন্ত্রণায় অতীষ্ট জীবন। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া কত রোগের যে ভয়! এসব থেকে বাঁচতে সিটি করপোরেশনের উপর ভরসা করে লাভ নেই; ভরসা ওই কয়েলই। কিন্তু সেই কয়েলের আগুনই কেড়ে নিল টঙ্গীর সেনা কল্যাণ ভবনের পাশে মাজার বস্তিবাসীর সবকিছু। টঙ্গী ছাড়াও ঢাকার কুর্মিটোলা ও উত্তরার ফায়ার স্টেশনের নয়টি ইউনিটের কর্মীরা দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ভোরে আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনলো ঠিকই, কিন্তু বস্তির পাঁচশর বেশি ঘরের স্বপ্ন ততক্ষণে পুড়ে ছাই। এই মশা নিধনের উদ্যোগের শেষ নেই। সরকারের খরচও কোটি-কোটি টাকা, অথচ ওই দরিদ্র, অভাবী, নিষ্পেষিত মানুষগুলোর হিসাবের খেরোখাতায় থাকল শুধু ছাই-ভষ্ম। বাকিদের হিসাব আলাদা।

৩.

গত ২২ নভেম্বর দেশের সব গণমাধ্যমের আলোচিত সংবাদ- বাস চালক ও হেল্পারের ভাড়ার জন্য এক ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সকালে ওই শিক্ষার্থী শনির আখড়া থেকে বাসে করে বদরুন্নেসা কলেজের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। বাসে চালকের সহকারীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। সেই জের ধরে ধর্ষণের হুমকি দেয় চালকের সহকারী। কী বিশ্রী, জঘন্য ব্যাপার। এত মানুষের সামনে কত সহজে সর্বনাশের হুমকি দেওয়া যায়। ঘরে, অফিসে, অলিতে-গলিতে কোথাও যেন নারীদের নিরাপত্তা নেই। সবখানেই কামের আগুনে ধাওয়া করে চলেছে! অথচ 'হাফ-ভাড়া' দিয়ে বাসে যাতায়াত করেননি এমন মন্ত্রী, আমলা হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। উঁচুতলায় উঠে নিচুতলার খোঁজ এখন কে রাখে? 

৪.

দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। চারদিকে উন্নয়নের জোয়ার চলছে বলে দাবি সরকারের। আকাশের পানে তাকালে মেট্রোরেল দেখা যায়, মাটিতে চলছে উন্নয়নের খোঁড়াখুড়ি। কিন্তু প্রতিদিন রাজপথে এক কোনায় টিসিবির পণ্য কেনার জন্য লম্বা লাইন যেন ভিন্ন কিছু দেখায়। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, এমনকি অন্তঃস্বত্তা মহিলারাও আছেন সেই লাইনে। সস্তাদরে কিছু পণ্য কেনার আশায়। প্রচণ্ড রোদে ঠেলাঠেলি-ধাক্কাধাক্কি করে টিকে তাকার পর দিগন্ত বিস্তৃত সে স্বর্পিল লাইন পেরিয়ে সবসময় স্বপ্নের তেল-ডাল-চাল যে মিলছে, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু পেটের আগুণ ঠিকই জ্বলছে। মায়ের আচঁল ধরে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ছোট্ট শিশুটি দেখছে, ক্ষুধার এই আগুন নেভানোর কেউ নেই। এসব দেখে সে কী শিখছে?

৫.

আগুন আসলে সবদিকেই। আজ কাঁচা মরিচে আগুন, তো কাল আদায়। পরদিন চাল-ডালে, তো এরপর শিমে-বেগুনে। বাসে কিংবা বাসা ভাড়ায়, কিন্তু কোথাও নেই দ্রোহের আগুন! ক্ষোভ-দ্রোহের আগুনের ফুলকি যা একটু দেখা যাচ্ছে, তা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। শোষিত হয়ে পুরোপুরি নেতিয়ে পড়ছে না তারা; ক্ষমতাসীনদের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে, লাঠিপেটা সয়ে ঠিকই লড়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধ করছে। উন্নয়নের মহাসড়কে থাকা দেশের জ্বালানি হয়ে উঠুক রাজপথে থাকা এই 'আগুণে তারুণ্য'। এই ঘোর দুঃসময়ে ভরসা এই তরুণরাই।

বয়সে ও অর্থ-বিত্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আড্ডা তাই আর জমে না প্রাণখোলা হাসিতে। নানা রঙের আগুনে পুড়ে যাওয়া মুখগুলো থেকে শুধু কয়লা বের হয়। আড্ডায় যা একটু প্রাণের সঞ্চার করে আমাদের ভ্যাবলা। এত আগুনে ইস্যুরে আলাপ শুনে ক্লান্ত ভ্যাবলার প্রশ্ন, এই দেশে না কিছু বিরোধীদল ছিল!