Published : 15 Nov 2021, 06:11 PM
বাংলাদেশে 'আইনের ফাঁকফোকর' শব্দটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে৷ আইনের ফাঁক গলিয়ে এ দেশে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে৷ বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে জেল খাটারও অভিযোগ আছে ৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
বাংলাদেশে মোটাদাগে আইন দু-ধরনের, ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইনে শাস্তির বিধান আছে৷ ফৌজদারি আইনের দর্শন হলো౼ এ আইনের অধীনে কোনও মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়। কোনও সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। আসামিরা সব সময়ই 'বেনিফিট অব ডাউট'- এর সুযোগ পেয়ে থাকেন। কারণ এ আইনের বিচারে কোনও আসামির মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তাই ন্যূনতম সন্দেহ রেখেও কাউকে মুত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। এখানে অপরাধ প্রমাণ মানে শতভাগ প্রমাণ। অন্যদিকে দেওয়ানি মামলা যেহেতু শাস্তি নয় অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় থাকে, তাই কোনও পক্ষ তার দাবি শতকরা ৫০ ভাগের বেশি প্রমাণ করতে পারলেই তার পক্ষে রায় পেয়ে যান।
বাংলাদেশে আইনের ফাঁকফোকর হিসেবে যেসব ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হয়, সেইসব মামলা বা অপরাধ সাধারণত ফৌজদারি আইনের। আর ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার এবং রায় কার্যকর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে। মামলা দায়ের, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র (চার্জশিট) এই তিনটি স্তর যথাযথভাবে সঠিকভাবে সম্পন্ন হলেই কেবল পরবর্তীসময়ে ন্যায়বিচার আশা করা যায়। যদি শুরুতেই গলদ থাকে তাহলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে আইনে যেমন ত্রুটি আছে, আছে সাক্ষ্য আইনে দুর্বলতাও৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর এসংক্রান্ত সংঘবদ্ধ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এ আইনে শাস্তি দিতে হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়। প্রয়োজন হয় চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদসহ অন্যান্য দালিলিক সাক্ষ্য৷ সঠিক সময় ডাক্তারি ও ডিএনএ পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না৷ বহুল আলোচিত ঢাকার বনানী ধর্ষণ মামলা যার প্রমাণ। এছাড়া আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীকেই ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে হয়, যা একটি কঠিন এবং জটিল প্রক্রিয়া। ফলে ধর্ষণের শাস্তি অনেকক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায় না৷
অথচ নারী নির্যাতনের নিষ্ঠুরতম রূপ হলো ধর্ষণ। ধর্ষণ সবসময় মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। কেননা যে ধর্ষণের শিকার হয়, তার মধ্যে যন্ত্রণার স্মৃতি বা ট্রমা কাজ করে সর্বক্ষণ। ওই দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণা তাদের জীবনভর তাড়িয়ে ফেরে। আমাদের দেশে মেয়েদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা ঘরে-বাইরে উভয় ক্ষেত্রে ঘটে। এর কিছু মানসিক; কিছু শারীরিক। রাস্তায় পথ চলতে মেয়েরা অনবরত শিকার হয় বিভিন্ন যৌনতাসূচক মন্তব্য আর ধর্ষণের দৃষ্টির। সব বয়সী মেয়েদেরই শুনতে হয় তাদের প্রতি পুরুষের ছুড়ে দেওয়া অশালীন কথা। তা ছাড়া ভিড়ভাট্টায়, গণপরিবহনে চড়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তাদের সবাইকে কম-বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত স্পর্শের শিকার হতে হয়।
আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়েই পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ, চাহনি, মন্তব্য প্রকাশ করার মতো সাহস বা সুযোগ পায় না। সবাইকে বলা হয়, 'চুপ, চুপ, একদম চুপ। এ বড় লজ্জার কথা। এসব প্রকাশ করতে নেই। লোকে জানলে বাইরে মুখ দেখানো যাবে না।' তাই ঘরে ঘরে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী। আর সসম্মানে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে নির্যাতক, ধর্ষক!
অনেক বাসাবাড়িতেই খেটে খাওয়া কিশোরী বা বয়সী নারীটি ধর্ষিত হয় বিনা বাক্যব্যয়ে। কারণ, সেখানে তার রুটি-রোজগার, মাথার ওপরে আচ্ছাদনের প্রশ্ন জড়িত। বিশাল অট্টালিকা বা বস্তির ঘর, সেখানেও ধর্ষিত হয় নারী; স্বামীর প্রবল কর্তৃত্বের কাছে, কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা প্রভাবশালী সহকর্মীটির কাছে।
আমাদের সমাজে মেয়েদের বিষ খেয়ে বিষ হজম করার বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে বেঁচে থাকার তালিম দেওয়া হয়। শেখানো হয় অপমান লুকিয়ে স্বাভাবিক থাকার কত শত অভিনয়। এভাবেই নারীদের আত্মসম্মান, ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা, মেধা, প্রজ্ঞা পদে পদে ধর্ষিত হয়; হয়ে আসছে। মেয়েরা অনবরত এসব মানসিক ধর্ষণ মুখ বুজে হাসিমুখে মেনে নেয়। সংসারে, কর্মক্ষেত্রে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে। এই লাঞ্ছনার রক্তক্ষরণ তাই কখনো কেউ জানে না, দেখেও না।
কিন্তু শারীরিক ধর্ষণ লুকানো কঠিন। এদেশের মেয়েরা তবুও চেষ্টা করে এসব চেপে যেতে। যতক্ষণ লুকিয়ে রাখা সম্ভব, লুকিয়ে রাখতে। এরপরও কোনো কোনো ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষতের কথা মানুষ জেনে যায়। তখন শুরু হয় আইন-আদালত। শুরু হয় মেয়েটির ওপর উপর্যুপরি আরও ধর্ষণ। মেয়েটি ধর্ষিত হয় পুলিশের কাছে, সাক্ষীদের কাছে, উকিলের কাছে, বিচারকের কাছে, সমাজের কাছে। এই ধর্ষণ সন্দেহের, এই ধর্ষণ ঘৃণার, এই ধর্ষণ ঘটনা প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে গড়ায়।
ধর্ষণের শিকার একজন নারী এই সমাজে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়, তার উৎস কোথায়? অবশ্যই সমাজ এবং সমাজের সেই সব প্রতিষ্ঠান, যাদের দায়িত্ব ছিল এ ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে ধর্ষিতাকে নিক্ষেপ না করে তার পাশে দাঁড়ানো। পুলিশ প্রশাসন এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যার কাছে নির্যাতিতা নারী সর্বাগ্রে প্রতিকার আশা করে, সেই প্রত্যাশা থেকে থানায় অভিযোগ জানাতে যায়। আর পুলিশ কী করে? উত্তর সর্বজনবিদিত। বারংবার থানায় হাজিরা দেওয়া, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করাতে উপর্যুপরি পীড়াপীড়ি, পুলিশের হাজার প্রশ্নের (যেগুলো খুব শালীন প্রশ্ন নয়) জবাব দিতে-দিতে ক্লান্ত ধর্ষিতারা নতুন করে নিত্য প্রকাশ্যে ধর্ষিতা হতে থাকেন। তাদের সঙ্গে সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো এমন আচরণ করে, যা ধর্ষণের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। পুরো সমাজই তাকে আত্মবিনাশে প্ররোচনা দেয়।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যখন ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক-আশাক, 'স্বভাব-চরিত্র', একাকি, 'অসময়ে' পথে চলার দুঃসাহস নিয়ে কটাক্ষ করে কার্যত ধর্ষকদের অপরাধ লঘু করে দিতে সচেষ্ট হন, তখন তাতে ধর্ষিতা নারীর মর্যাদা ও সম্মান কেবল ভূলুণ্ঠিতই হয়। পুলিশ যখন ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তের সঙ্গে ধর্ষিতা নারীর 'আগে থেকেই সম্পর্ক থাকা'র অজুহাত দেয়, তখনও দুষ্কৃতকারী-দমন অপেক্ষা তার শিকারদের দোষ ধরার কদর্য চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বসমক্ষে, উৎসুক প্রতিবেশীদের ভিড়ে, অভিভাবকদের প্রশ্নবাণে, পুলিশের উপর্যুপরি জেরায় এবং আদালতে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ ও সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়ায় বারংবার সেই ধর্ষণের যন্ত্রণা ও গ্লানিই ফিরে-ফিরে আসে। মনের ক্ষত নিরাময়ের মতো কোনও করুণাধারা সমাজ বর্ষণ করে না, সেই ক্ষতস্থান থেকে নিয়ত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। পুলিশ, আদালত, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা, এমনকী গণমাধ্যমও তা ভুলতে দেয় না। বরং ধর্ষিতার পুনর্বাসনের পথ রুদ্ধ করে প্রত্যেকেই নিজের মতো, নিজের ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ধর্ষণকাণ্ডের কাটা-ছেঁড়া করতে ব্যগ্র হয়ে পড়ে।
অথচ আইনকে যুগোপযোগী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ১৩০ বছরের পুরনো ব্রিটিশ আমলের আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা ছিল, এখনও সেটাই ভিত্তি ধরে বিচার করা হয়। যদিও ২০০০ সালে কঠোর অনেক ব্যবস্থা রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের যে সংজ্ঞা সেটি খুঁজতে ঠিকই দ্বারস্থ হতে হয় ১৮৯০ সালের দণ্ডবিধির। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো যে সংজ্ঞা সেটি যে কেবল বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বেমানান তাই নয় এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যৌন অপরাধের যে সংজ্ঞা তার সঙ্গেও যায় না।
পুরনো সংজ্ঞার কারণে ভিকটিমের মেডিকেল রিপোর্টের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে দেখা যায় যদি নারীর শরীরে কোনও ইনজুরি না থাকে কিংবা এমন কোনও চিহ্ন না থাকে যাতে বোঝা যায় যে নারী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে নারী ভয়ে জ্ঞান হারান অথবা ঘটনার আকস্মিকতায় বাধা দেওয়ার অবস্থাতেও থাকেন না। সেসব ক্ষেত্রে মামলা প্রমাণ বাদীর জন্য আরও অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পুরো বিষয়টির সঙ্গে 'ইজ্জত ট্যাবু' এমনভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে ভিকটিম ঘটনা ঘটার দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোসল করে যেটি তার মেডিক্যাল রিপোর্টকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে এবং ভিকটিমের জন্য নেগেটিভ হিসাবে কাজ করে।
শুধু ধর্ষণের সংজ্ঞাই নয়, বিপত্তি আছে সাক্ষ্য আইনেও। এই আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ধর্ষণের শিকার নারীকে 'দুশ্চরিত্রা' প্রমাণের চেষ্টা করে থাকে। এরও অনেক নেতিবাচক প্রভাব আছে। এ ধারা বহু নারীকে এমন ভীতির মুখোমুখি দাঁড় করায় যে বহু নারী মানসিকভাবে মামলা চালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। 'দুশ্চরিত্রা' প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারে।
এই আইনের সুযোগ গ্রহণ করে মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক এমন অনেক প্রশ্ন করা হয়, যার সঙ্গে বিচারাধীন মামলার কোনও সম্পর্ক নেই। এতে নির্যাতনের শিকার নারী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়।
আইনের ফাঁকফোকর বাদ দিলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। কারণ, কোথাও দেখা যাচ্ছে পুলিশি তদন্তে ত্রুটি থাকছে আবার কোথাও পাবলিক প্রসিকিউটর ঠিকভাবে ভূমিকা রাখছেন না। অনেক ক্ষেত্রে মামলা দিনের পর দিন পড়ে থাকছে।
ধর্ষণ ভয়ঙ্কর ফৌজদারি অপরাধ। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হোক কিংবা যাবজ্জীবন, যদি তদন্ত সঠিক না হয়, নির্যাতনের শিকার নারীকে বিচার চাইতে এসে দ্বিতীয়বার নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়, সাজার হার যদি ৩-৪ শতাংশেই আটকে থাকে, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা যদি না কাটানো যায় তাহলে কখনোই ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু ধর্ষণ নয়, যেকোনও অপরাধের দ্রুত, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন, আইন এবং বিচারিক কাঠামোটিকে শুদ্ধ করার জন্য কাজ করতে হবে।