Published : 24 May 2021, 10:49 PM
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩ সালে; নিহত হয়েছিলেন এক হাজার ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক। আর আহত হয়েছিলেন দুই হাজার ৬০০ জনেরও বেশি। (তথ্যসূত্র: https://cleanclothes.org/ua/2013/rana-plaza)। বর্তমান সময়ে এটাই হয়তো পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা শুধুই মৃতের সংখ্যা গণনার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, শিল্প নগরী সাভারের একটি আটতলা ভবনের পতন বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে। পাশাপাশি কীভাবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় সে লক্ষে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় জোড় তৎপরতা।
অনিস্বীকার্য যে এ দুর্ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় ছিল মাত্র। দুর্ঘটনার ঠিক আগের দিন ভবনের কাঠামোগুলিতে ফাটল দেখা দেয়। ফলে, নিচতলায় ব্যবসায়িক লেনদেন (দোকান এবং ব্যাংক) বন্ধ করে দেয় তাৎক্ষণাৎ। তবে, অবিশ্বাস্য শোনালেও এটা সত্য, প্লাজার উপরের তলায় অবস্থিত পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানা তাদের শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ২৪ এপ্রিল সকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। ফলে, প্রশাসন বিল্ডিংয়ের উপরে থাকা ডিজেল জেনারেটর চালু করে কাজ অব্যাহত রাখে। এর পরপরই ভবনটি ধসে পড়ে।
সরকারী হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ১৩২ জন। তবে, খালি চোখে এ সংখ্যা যতটা নির্ভুল মনে হয়, মৃতের পরিসংখ্যাটি বাস্তবে ততটা স্বচ্ছ নয়। নওশাদ হাসান হিমুর কথাই ধরুন। একজন স্বেচ্ছাসেবক, যিনি ধসের পর ১৭ দিন উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থেকে ধ্বংসস্তুপ থেকে এক হাজারেরও বেশি আহত শ্রমিককে উদ্ধার করেন। দুঃখজনক যে কারও কারও অঙ্গ কেটেও উদ্ধার করতে হয়। হিমু নিজে কয়েক ডজন জীবিতকে উদ্ধার করে এবং বহু মৃত দেহ সরাতে সাহায্য করে। রানা প্লাজার উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া হিমুই ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে আত্মহত্যা করেন। (তথ্যসূত্র: https://www.nationalheraldindia.com/international/bangladesh-nowshad-hasan-himu-face-of-rana-plaza-rescue-operation-commits-suicide)।
তার মৃত্যু কি মোট মৃত্যের পরিসংখ্যার সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? হয়তো বা না। তাকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। তাকে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
দুই. শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশে উন্নতি
বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন ব্যবসা মার্কিন ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি শিল্প, যেখানে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের প্রায় ৬০ মিলিয়ন শ্রমিক কাজে নিয়োজিত (Safer Conditions for Apparel Workers (ifc.org)। তার মধ্যে প্রায় ৪ মিলিয়ন বাংলাদেশে। দেশটি চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম 'তৈরি পোশাক' রপ্তানিকারক। আজ আট বছর পরও রানা প্লাজার দুর্ঘটনা একটি 'কাল চিহ্ন' হিসেবে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্যবসায়ের তলপেট আঁকড়ে আছে।
ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন (https://cleanclothes.org/about), যা পশ্চিমা বিশ্বের ২৩০ টি ইউনিয়ন, একটি এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমর্থিত একটি সংস্থা। তারা সহ বেশ কয়েকটি অ্যাক্টিভিস্ট সংগঠন ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে জোড় তদবির করে। আহতের অনেকে এখনও ভুগছে – হয় শারিরিক, না হয় মানসিকভাবে (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6651472/) । বলাবাহুল্য, রানা প্লাজার দুর্ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অতীতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা নিয়মিত কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে এবং বহু প্রাণঘাতী বিপদের সম্মুখীন হয়েছে।
কমপক্ষে ২৯টি বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড রানা প্লাজা ভবনের পাঁচটি কারখানার এক বা একাধিক কারখানার সাথে ব্যবসায় জড়িত ছিল, যা চিহ্নিত হয় দুর্ঘটনার পর।
ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন মনে করে, প্রতিটি ব্র্যান্ডই – "কোন না কোনভাবে দায়ী এমন পরিবেশ সৃষ্টিতে যা শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু ও অনিষ্টির দিকে ঠেলে দেয়"।
এটাও সত্য, এমন পরিবেশ সৃষ্টিতে কেবল ব্র্যান্ডগুলো যে দায়ী তা নয়। সমস্যাটি আরও ব্যাপক। এটি একটি সিস্টেমিক সমস্যা। এক অর্থে, সস্তা দামের ভিত্তিতে পোশাক বাছাই করা প্রতিটি ক্রেতা এ জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী।
অবশ্যই রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সাথে সাথে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত পরিবেশ উন্নয়নে অঙ্গীকার বদ্ধ হয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। যেমন, দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে ২২২ টি প্রতিষ্ঠান 'অ্যাকর্ড (ACCORD)- অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি'তে স্বাক্ষর করে, যা গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চয়তা প্রদানের আইনত বাধ্যতামূলক চুক্তি।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত পরিবেশে উন্নতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতিও এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান 'লিড প্লাটিনামে' ভূষিত হয়েছে। তারপরও সার্বিক বিবেচনায় যথেষ্ট নয়। দুর্ঘটনার আট বছর পরেও গ্লোবাল (বৈশ্বিক) সাপ্লাই চেইনের মৌলিক বিষয়গুলি, যেমন, মুনাফা (প্রফিট), জবাবদিহিতা (অ্যাকাউন্টিবিলিটি) এবং দায়িত্বের (রেস্পন্সিবিলিটি) মাঝের সম্পর্ক এখনও বিচ্ছিন্ন।
আমাদের গবেষণার (https://www-emerald-com.ezproxy.lib.rmit.edu.au/insight/content/doi/10.1108/IJPDLM-03-2018-0154/full/html) অংশ হিসেবে আমরা ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের এবং অস্ট্রেলিয়ার রিটেইল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিশদ সাক্ষাৎকার নেই। বিশ্লেষণে মুনাফা-জবাবদিহিতা-দায়িত্বের মাঝের সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
রিটেইলাররা দাবি করে যে তারা তাদের বাধ্যবাধকতা মেনেই বাংলাদেশের কেবল 'অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি' সার্টিফিকেটধারী প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে ক্রয় করে। তবে প্রস্তুতকারকদের মতে, বিষয়টা তেমন স্বচ্ছ বা সবসময় সঠিকও নয়। যেমন একজন প্রস্তুতকার বলেন:
"যদিও আমরা ব্রান্ড ও রিটেইলার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিধি মেনে চলছি, শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যয় ভার বহন করছি, তথাপি, ব্রান্ড ও রিটেইলার থেকে অর্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও শুধু পোশাকের দাম এবং মান গুরুত্ব পায়।"
সম্প্রতি, অক্সফার্মের এক প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যান্ডের দেওয়া প্রতিশ্রুতি যেমন 'জীবিকা মজুরি' (লিভিং ওয়েজেস্), নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। (https://www.oxfam.org.au/wp-content/uploads/2020/11/2020-AC-006-WSM-Research-Report_Digital_FA_Pages.pdf)।
তিন. বস্ত্র শ্রমিক কত পায়?
আমাদের কি কোন ধারণা আছে বাংলাদেশের তৈরি একটি টি–শার্ট বিক্রির সাপ্লাই চেইন অংশীদারের কে কত পায়? বাংলাদেশের তৈরি একটি টি–শার্ট যা অস্ট্রেলিয়ায় ৩০ ডলারে বিক্রি হয়, উদাহরণ হিসেবে সেটাই ধরুন। নিচের ইন্সটোগ্রামটি আঁকা হয়েছে ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে (https://theconversation.com/years-after-the-rana-plaza-tragedy-bangladeshs-garment-workers-are-still-bottom-of-the-pile-159224)।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ ডলার খুচরা মূল্যের একটি টি–শার্টের মাত্র ০.৬% অথবা মাত্র ১৮ সেন্ট শ্রমিকের হাতে যায়। কারখানার মালিক পায় ৪%, আর ব্র্যান্ড পায় ১২%। সেখানে রিটেইল বিক্রেতা পায় ৫৯%।
সাপ্লাই চেইন অংশীদারের শতকরা কে কত পায়, সে সংখ্যাগুলি অবশ্যই গড়ের হিসেবে। এখানে মোটেই দাবি করা হয়নি যে প্রতিটি শার্টের 'লাভ বিভাজন' একইরকম হবে। তবে এ বিশ্লেষণ থেকে লাভ কীভাবে বিন্যস্ত হয় অন্তত তার একটি সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। এরপর আপনি যখন ১০ ডলারেরও কম দামে বাংলাদেশের একটি টি–শার্ট বিশ্ববাজারে বিক্রি হতে দেখবেন, তখন অবশ্যই অনুধাবন করতে পারবেন, বাংলাদেশের একজন গার্মেন্টস শ্রমিক তা থেকে কতটুকু আয় করে!
স্বীকার্য যে, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি অবশ্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শ্রম, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা আইনের সংস্কারের সাথে জড়িত। স্বীকার্য যে, এসব আইনের নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক প্রয়োগের সাথেও জড়িত। তবে এও সত্য যে, তৈরি পোশাকের দাম কমানোর জন্য কারখানার মালিক বা সরবরাহকারীদের ওপর রিটেইলার এবং ব্র্যান্ডগুলোর অবিচ্ছিন্ন চাপ হ্রাস করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেই শেষ নয়। কোভিডের কারণে সমস্যা আরও তীব্র হয় এবং কারখানার মালিক বা সরবরাহকারীদের ওপর যে করেই হোক ব্যয় আরও হ্রাস করার চাপ বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের মার্চ ও জুনের মাঝে, ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি নির্মাতাদের বিলিয়ন ডলারের পোশাক অর্ডার বাতিল করে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশের ৪ মিলিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৩৫৭ হাজারের অধিক শ্রমিক চাকরি হারায় এবং অনেক শ্রমিক আরও কম বেতনে কাজে বাধ্য হয়।
সমাধানের পথ কী?
সমাধানের একটা পন্থা হতে পারে মুনাফা-জবাবদিহিতা-দায়িত্বের চক্রকে একটি ভার্চুয়াস-চক্রে স্থাপন করা। এর জন্য প্রয়োজন ব্র্যান্ড এবং রিটেইলারদের আরও দায়ীত্বশীল হয়ে প্রস্তুতকারকদের সাথে সমন্বয় করে সমাধানের পথ খোঁজা। তবে, এ পন্থায় যে কাজ হচ্ছে না, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারণের জন্য লড়াইটা ক্রেতাদের বাজারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে দ্বিতীয় পন্থা। ব্র্যান্ড এবং রিটেইলারদের বাজারে স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নদের সাথে একত্রে এবং সঙ্গবদ্ধভাবে সভা, সেমিনার এবং শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার মাঝে জনমত গড়ে তোলা এবং ভোক্তাদের সচেতন করা। এ দায়িত্বটা গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-কেই নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আর যাই করুক বা না করুক, ভোক্তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে।