Published : 23 May 2021, 03:06 PM
দেশে মহাধ্বংসযজ্ঞ চলছে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরাতন সব জঞ্জাল দুর করতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলাসহ অন্যান্য ভাস্কর্যগুলো। সংস্কৃতি বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী আগামী সপ্তাহে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় স্থাপিত ভাস্কর্যটি ভাঙ্গার কাজের শুভ উদ্ধোধন করতে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর জেলা শহরগুলোতে স্থাপিত ভাস্কর্যগুলোর তালিকা প্রণয়নের জন্য। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম একশ দিনের মধ্যেই দেশকে ভাস্কর্যমুক্ত করে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বদ্ধপরিকর সরকার। বাধ সেধেছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধটি। ওটি ভাঙার কাজ কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে সমস্যা নেই। এরই মধ্যে এ জন্য বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে আসছেন বুমিয়ানের বুদ্ধের ভাস্কর্যটি গুড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত তালেবানদের দলনেতা। শোনা যাচ্ছে ইরাকের বসরা আর মসুলে ইসলামী স্থাপত্যগুলো গুড়িয়ে দেয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ইসলামিক স্টেটের বিশেষজ্ঞরাও আসতে পারেন এ কাজে সহযোগিতার জন্য। নতুন সরকারের একাধিক মন্ত্রী আফগানিস্তানে তালেবানদের হয়ে জেহাদে অংশ নিয়েছেন। ইসলামিক স্টেটের নেতৃবৃন্দের সাথেও তাদের ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। তাছাড়া পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-ও সহযোগিতা করছে। কাজেই আশা করা যায় সবকিছু ঠিকঠাক মতই ধ্বংস করা সম্ভব হবে।
দুই
জাতীয় সংগীত আর জাতীয় পতাকাও বাতিল করা হয়েছে এরই মধ্যে। বিধর্মীর লেখা জাতীয় সংগীত বাজবে মুসলিম দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে এর চেয়ে বড় বেদাতি বিষয় আর কী হতে পারে? নতুন সরকার তাই দায়িত্ব নিয়েই প্রজ্ঞাপন জারি করে বাতিল করেছেন জাতীয় সংগীত। একই প্রজ্ঞাপনে বাতিল করা হয়েছে জাতীয় পতাকাও। মুসলিমদের দেশে পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রক্তের প্রতীক বাংলাদেশের পতাকায় সবুজের পটভূমিতে লাল বৃত্ত- এমন পতাকা কিভাবে দেশের পতাকা হয়? পতকার রঙ হবে ইসলামিক স্টেটের পতাকার মত কালো আর তাতে থাকবে পাকিস্তানি পতাকার চাঁদ-তারা। আইএসআই-এর পরামর্শও তেমনটাই। আপত্তি নেই এতে নতুন সরকারেরও। তবে বিষয়টিকে হালাল করে নেয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটিটির বাড়তি দায়িত্ব হচ্ছে আগের জাতীয় সংগীতোর সুরে একটি ইসলামিক জাতীয় সংগীত রচনা করা। হাজার হোক দেশের মানুষ পঞ্চাশটি বছর ধরে ওই এক জাতীয় সংগীতইতো শুনে এসেছে। কাজেই কথা আর সুর দুই-ই যদি রাতারাতি পাল্টে যায় তাহলে সেই নতুন জাতীয় সঙ্গীতটি মানুষের কাছে খুব তাড়তাড়ি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
তিন
প্রাইমারি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পযন্ত সব পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লেখার কাজ শুরু হয়েছে। এ কাজে আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মত ভুল করতে চায় না নতুন সরকার। বিড়াল মারতে হলে যে তা প্রথম রাতেই মারতে হয়, এ কথা নতুন সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা খুব ভালো করেই বোঝেন। পাশাপাশি আইনগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কাজও চলছে জোড়েশোরেই। এরই মাঝে সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে। বাতিল যে হয়ে যাচ্ছে নারী নীতি, শিক্ষা নীতি ইত্যাদি এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। শরিয়া আইনও খুব দ্রুতই চালু হতে যাচ্ছে বলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে।
চার
একটা জায়গায় খানিকটা বেকায়দায় নতুন সরকার। মরহুম হুজুরের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মাঝে মহিলাদের জন্য গান-বাজনা আর খেলাধুলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। মহিলারা খেললেই কি আর না খেললেই বা কি? আজ পর্যন্ত কয়টা মহিলা খেলে কয়টা সোনার পদক জিতে এনেছে তা সরকার ভালই জানেন। সমস্যা হয়েছে গার্মেন্টসগুলো নিয়ে। সেখানেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে মহিলাদের চাকরি। এখন এত লাখ লাখ পুরুষ কর্মী কোথা থেকে আনা যায় তাই নিয়ে গলদঘর্ম প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। এরই মাঝে অবশ্য মোহাম্মদপুর আর সৈয়দপুরের বিহারী ক্যাম্পগুলো থেকে বিহারীদের নিয়ে এসে গার্মেন্টসগুলোয় নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একাত্তরে দেশটাকে জঞ্জালমুক্ত করার চেষ্টায় রাজাকার-আল বদর-আল শামস-মুজাহিদ বাহিনীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করেছে এ বিহারীরা। তাদের সেই অবদানের কথা ভুলে যাবেন এত অকৃতজ্ঞ নন নতুন সরকার। প্রয়োজনে পাকিস্তান থেকেও গার্মেন্টস কর্মি আনার চিন্তাভাবনা আছে সরকারের।
পাঁচ
নতুন সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল পুনঃগঠন। এরই মধ্যে আগের ট্রাইবুনালের রায়ে যাদের মনবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়ে গেছে তাদের নতুন সরকার জাতীয় বীর ঘোষণা করেছেন। আর যারা জেলে ছিলেন তারা ছাড়া পেয়ে গেছেন। এদের একজনতো নতুন সরকারের মন্ত্রী সভায় যোগও দিয়েছেন। একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়ে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছে এরই মধ্যে। বলাই বাহুল্য আসামীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগ নেতা। আগের সরকারের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন নতুন সরকার। দেশের ফৌজদারী আইন সংশোধন করে মরোনত্তর বিচারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে সামনেই মরণোত্তর বিচারের মুখোমুখি করা হবে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা আর সাত বীরশ্রেষ্ঠকে।
ছয়
উপরের দৃশ্যপটগুলো অবশ্যই কাল্পনিক। আজকের বাস্তবতায় এসব আমাদের কাছে যতই গাজাখুরি গল্প বলে মনে হোক না কেন, একদল মানুষ কিন্তু আজকের এই বাংলাদেশে বসে তেমন স্বপ্নেই বুঁদ হয়ে আছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে দেশকে অশান্ত করায় যে হেফাজতি তাণ্ডব আমরা দেখেছি, এখন সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব পুলিশ হেফাজতে স্বীকার করছেন যে এর পিছনে ছিল পাকিস্তানের অর্থায়ন। তবে তাদের মূল লক্ষ্যটা ছিল অন্যখানে। গত রোজার মাসেই ২০১৩-এর ৫ মে স্টাইলে বড় ধরনের আরেকটা অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই ছিল মৌলবাদীদের মূল লক্ষ্য। দেশ বিরোধী এসব ষড়যন্ত্রে তাদের মদদ জুগিয়েছে বিএনপি আর জামাতিরাও।
সাত
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ঈর্ষণীয় সাফল্য নানা কারণেই অনেকের অপছন্দনীয়। এ লম্বা তালিকায় যেমন আছেন দেশের ভেতরে একাত্তরে পরাজিতদের উত্তরাধিকার, আছে তেমনি আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক নানা পক্ষ যাদের সরাসরি স্বার্থ এখানে সংশ্লিষ্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেদিন চোখে পড়লো ড্রোন থেকে ধারণ করা ইসলামাবাদের মিনিট পাঁচেকের চমৎকার একটি এরিয়াল ভিডিও। অদ্ভুুত সুন্দর একটি শহর- চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা, এক্সপ্রেসওয়ে আর ফ্লাইওভারে ভরা সাথে ছিম-ছাম সাজানো বাড়িঘর আর মাঝে মাঝে সুউচ্চ দালান। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ভিতরে ভিতরে কতটা ফাঁপা ইসলামাবাদের এতসব অর্থহীন অবকাঠামো। ২০৪১-এ আমরা যদি তেমন একটা ফাঁপা ঢাকা আর চোরাবালির উপর দাঁড়িয়ে থাকা উন্নত বাংলাদেশ দেখতে না চাই, তাহলে যা কিছু করার তা করার সময়টা কিন্তু এখনই। ইদানিং চেম্বারের ফাঁকে ফাঁকে টিভি দেখে মনে হয় আমরা বিষয়টা ঠিকঠাক মতই ধরতে পেরেছি। তবে মাঝেসাঝেই মাননীয়দের দরবারে হেফাজতিদের ধরনায় যে এ নিয়ে একটু হলেও যে সংশয় জাগেনা, তাও কিন্তু না।