‘ধর্মরাষ্ট্রের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’র জন্য সংস্কৃতির মোড়লদের দায়ও কম নয়

আনিসুর রহমান
Published : 15 April 2021, 08:04 PM
Updated : 15 April 2021, 08:04 PM

'একটা ধর্মরাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি' শিরোনামে একটি লেখার সূত্র ধরে শুরু করতে চাই। লেখাটি যিনি লিখেছেন, তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এক সময়ের সভাপতি, নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। অধিকন্ত তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লেখাটি গত ২৭ মার্চ ২০২১ তারিখে প্রকাশ করে। 

এর ঠিক আগের দিন ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় ধর্মব্যবসায়ী দেশবিরোধী নব্য দানব শক্তি হেফাজতে ইসলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের প্রতিবাদে মধ্যযুগীয় কায়দায় তাণ্ডব চালায়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ হেফাজত হচ্ছে নতুন মোড়কে পুরনো পণ্য অথবা ১৯৭১ সালের দানবের নতুন নাম হেফাজতে ইসলাম। দেশ ও জাতিকে কী হেফাজত তারা করবেন, তা তো ২০১৩ সাল থেকে সময়ে সময়ে দেখাচ্ছেন। আর আমরা একে একে দেখে যাচ্ছি। এ দেখার এক পর্যায়ে এসে অবশেষে বুঝলাম কী আমরা? অবশেষে কহিলেন কি অরিন্দম?

মান্যবর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে ধন্যবাদ মুখ খোলার জন্য। তার একটি স্বীকারোক্তি আমার ভাল লেগেছে। সেই স্বীকারোক্তিমূলক কথাগুলো এরকম, "উপজেলা চেয়ারম্যান আছেন, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা আছেন যারা কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছেন – আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত … ।"

প্রশ্নটা আমার এখানেই। সবাই যদি ব্যবসায়ী হয়ে যাই, তাহলে কীভাবে কী হবে? আম আর ছালা দুটোই এখন হাতছাড়া। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দিনে দুপুরে মহড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করল- জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত হল না। এত এত সংগঠন, এত এত নেতা, এত এত তোষামোদকারী কোথাও কার্যকর প্রতিরোধ হল না। কেন হল না? আমরা সবাই ব্যবসায়ী হয়ে গেছি। এ প্রতিরোধে ব্যবসায় নাই, বাজেট নাই, ঠিকাদারি নাই, লাভ নাই। কথা যেহেতু ব্যবসা, সেখানে লাভ ক্ষতির প্রশ্ন থাকবেই। জেনে শুনে কে ক্ষতির মুখে যাবে? এমন দশা, যেমন হয়েছে রাজনীতির, তেমন হয়েছে সংস্কৃতির।

শৈশবে পড়া একটি প্রবাদবাক্যের কথা মনে পড়ছে "বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে"। এটা আমাদের ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো। প্রবাদটির মোদ্দা কথা হচ্ছে, যার যে কাজ তাকে সেই কাজ করতে দাও। সংস্কৃতি অঙ্গনের ক্রিয়াশীল একজনের কাছে ব্যবসা যেমন কাম্য নয়, তেমন রাজনৈতিক নেতার ব্যবসায়ী চরিত্র মঙ্গলজনক নয়, একইভাবে আমলার কাজ আমলাগিরি, ব্যবসায়ীর কাজ ব্যবসাপাতি, বিভিন্ন বাহিনীর কাজ রাষ্ট্র ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান। 

কিন্তু আমাদের দেশে কি সে সীমা-পরিসীমা আমরা রক্ষা করতে পেরেছি? এখন যেমন সংস্কৃতির মোড়লরা ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী সেনারা, আমলারা- নামে এবং বেনামে। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবসা, পুলিশের নিজস্ব ব্যবসা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিজস্ব ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদেরও নানা ব্যবসা। ব্যবসার শেষ কোথায়? এমন কি নানা উন্নয়ন সংস্থা সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আড়লে ব্যবসাবাণিজ্য চালাচ্ছে।

আমরা কি কানায় কানায় বেনিয়া জাতি হয়ে গেলাম? তাতেও দোষ ছিল না, কেবল যদি ব্যবসা নিয়েই থাকতেন আমাদের জাতির নানা অঙ্গনের মোড়লরা। এদের আবার অনেকে একের ভেতরে সব হতে চান। এই করতে করতে উগ্রবাদী নানা ধর্মীয় অধর্মীয় গোষ্ঠী খালি মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাকিরা কি ললিপপ মুখে দিয়ে সুবোধ সেজে থাকব? নাকি হাততালি দিব?

এ বিব্রতকর প্রশ্ন মাথায় রেখে, সংস্কৃতির এই অচলায়তনের দিকে নজর দিতে চাই। মূলত সংস্কৃতির এই অচলাবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। সে বিষয়ে অনেক কিছু আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমি সেসব দীর্ঘ ইতিহাসে যাব না। আমি বরং এ শতকের দুই দশককালে সংস্কৃতির বিপর্যয় নিয়ে কথা বলব।

পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, ঘুষ-দুর্নীতি আর উপাসনালয়ের রমরমা সমান্তরালে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের কূপমণ্ডুকতা। অবাক করার বিষয় এই কুপমণ্ডুকতা শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের চেয়ে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বহুগুণে বেশি। যত বড় চুরিচামারি তত বেশি দান-খয়রাত, সৃষ্টিকর্তা বন্দনা! এসবের ব্যাখ্যা কী?

যে হারে ধর্মীয় উপাসনালয়ের ঘণত্ব বেড়েছে সারাদেশে সে অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সুবিধা বেড়েছে? বেশি দূরে যেতে হবে না। খোদ ঢাকা শহরের দিকে নজর দিয়ে দেখুন। সবাই যদি এত পরহেজগার আর ভগবানের পেয়ারের হয়ে থাকি তাহলে তো দুর্নীতি আর দুইনম্বরী থাকার কথা না। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। ঘুষটা পকেটে ভরেই উপাসনালয়ের দিকে যাচ্ছে। আবার ফিরে এসেও একই কাজ। এই যে মন আর মগজের রসায়ন। এ রসায়ন কি কেবল আইন আদালত দিয়ে ঠ্যাঙানো সম্ভব! এর প্রতিরোধ এবং প্রতিষেধক থাকতে হবে গোড়াতেই। তা হতে হবে পরিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আর গলদটা এসব জায়গাতেই। আমি এই লেখায় সংস্কৃতিতে গলদ নিয়ে আলোচনা করব।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আমাদের একটি জাতীয় সংস্কৃতির রূপরেখা ছিল। যা বঙ্গবন্ধুর কথা, কাজ, নীতিনির্ধারণে আমরা খুঁজে পাই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা কি জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রতিফলন দেখাতে পেরেছি? এ পর্যায়ে শওকত ওসমানের একটি কথার শরণ নিতে চাই। তা এরকম, "তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখকের নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে নৈতিকতার দায়টাও নিতে হয়। তাকে ধূপের কারবারিও হতে হয়।" 

এই কথাটা শুধু লেখালেখির বেলায় নয়, সামগ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বেলায় প্রাসঙ্গিক। এখন আমার প্রশ্ন, গত দুই দশকের মাঝে টানা এক যুগ ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। তারপরও দেশের অবস্থা "একটা ধর্মরাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি" কেন? এর দায় কি কেবল রাজনৈতিক দল বা সরকারের? এর জন্যে সংস্কৃতি অঙ্গনে যারা গত এক যুগে নেতৃত্বে ছিলেন, নানা দায়িত্বে ছিলেন তাদের কি কোন দায় নাই? এই বিষয়গুলো আমি একটু খোলাসা করতে চাই।

এই যে অচলাবস্থা, এটা তো একদিনে তৈরি হয়নি। ২০০১ সালে জামাত-বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নির্দেশনা দেওয়া হল- দেশের কোথাও যাত্রা প্রদর্শনী করতে হলে সংশ্লিষ্ট থানায় আয়োজকদের লিখিত দিতে হবে, যাত্রা প্রদর্শনীকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলার কোন রকম অবনতি হলে তারা দায়ী থাকবেন। 

যারা যাত্রা করবেন, তারা এই নাট্যশিল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, নাকি সরকারের পাতানো ছলে পা দিয়ে মামলার আসামী হবেন। যে কারণে জামাত-বিএনপি শাসনামলে যাত্রাশিল্পের জড়িত পেশাজীবীরা বেকার হয়ে গেল। তারা অন্যান্য পেশায় চলে গেল। যাত্রার দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেল। এ  নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ক্রিয়াশীল সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। বিশেষ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কি কোনও উদ্যোগ নিয়েছিল যাত্রাশিল্প রক্ষায়?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে জামাত-বিএনপির যাত্রাবিরোধী নির্দেশনা তুলে নেওয়া হলেও যাত্রাশিল্প ততদিনে আর আর টিকে নাই। তা পুনরুদ্ধার করার জন্যে দরকার ছিল কার্যকর উদ্যোগ যেমন যাত্রা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু আমাদের নগরকেন্দ্রিক এলিট সংস্কৃতির মোড়লরা এই নিয়ে ভাবেননি। যাত্রাশিল্প আজ বিলুপ্ত প্রায়। এক রকম হরেদরে অবস্থা সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে। যদিও সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক মোড়লিয়ানা দায়ী নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ বা আগ্রাসন এবং দূরদর্শন সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবও দায়ী। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব বা কৌশলগত ভুল অবস্থান কি সংস্কৃতির এই  অচলাবস্থানের জন্যে সর্বাংশে দায়ী?

আমি তা মনে করি না। কেননা এই সংসদেও কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন যারা গণমাধ্যম বা সংস্কৃতিক অঙ্গনকে সরাসরি প্রতিনধিত্বি করেন। যেমন আসাদুজ্জামান নূর, মমতাজ বেগম, আকবর হোসেন পাঠান ওরফে ফারুক, সুবর্ণা মুস্তাফা এবং শফিকুর রহমান।

আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মোড়লরা এদের কারো মাধ্যমে সংসদে কি কোন প্রস্তাব উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন? অথবা কোন রূপরেখা প্রণয়ন করে দাবি ও দফা আকারে সরকারকে জানিয়েছেন? যতদূর জানি এর কোনটাই তারা করেননি। প্রকারান্তরে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি ও দফা নানাভাবে তুলে ধরেছে, আদায়ও করেছে। ক্ষমতার রাজনীতি ক্ষমতার ধর্ম মেনেই চলবে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিপদজনক সময়ে জেল খেটেছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আজকে যারা সংস্কৃতির মোড়ল তারা অনেকটা ভোগান্তির বাইরে ছিলেন। এমন কি অনেকে আবার সংস্কারপন্থীও হয়েছিলেন। এরা ব্যবসাবাণিজ্য তখনও ঠিকমতই করেছেন। একটা উদাহরণ দেব, সংস্কৃতির মোড়লদের একজন ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবরটা জানার পরও টেলিভিশনে হাজির হয়েছেন, তার হত্যাকাণ্ডের খবরটা হত্যাকারীদের দেওয়া বয়ানে প্রচার করেছেন। তার কোন অসুবিধা হয়নি। আজ তিনিও সংস্কৃতির মোড়ল। ২০০৭-২০০৮ সালেও এমন কেউ কেউ ছিলেন।

আমাদের সাংস্কৃতির মোড়লরা ব্যবসাটা যতটা বোঝেন, ততটা ভালবেসে সংস্কৃতির মোড়লিয়ানা করলে আজকের এ অচলাবস্থা দেখতে হতো না। দুই-একটা উদাহারণ দিব। লাখো কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীতের মত একটি অনুষ্ঠান নিয়েও ঠিকাদারী হলো! সাহিত্য সম্মেলনের নামেও কি ঠিকাদারী হয়নি? বিষয়গুলো কি আমাদের কাছে পরিস্কার?

আমাদের গোটা সংস্কৃতির অঙ্গন মোটের উপর দুই ডজন মোড়লের কাছে জিম্মি। মোড়লদের এ সিন্ডিকেটে অল্প দুই-একজন বাদে সকলেই কোন কোন ব্যবসা, বিজ্ঞাপন এবং ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা পদ-পদবী আর পদোন্নতির ধান্দায় ব্যতিব্যস্ত। এই দুই ডজন মোড়লের এক ডজনই আবার নাটকের। অথচ নাটকের অবস্থাই সবচেয়ে বেহাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা থেকে সনদ নিয়ে করতে হয় অন্যকিছু, হয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা দূরদর্শন নয় তো অন্যবিধ কাজ। নাট্যকলায় কাজ করার কোন জায়গা তৈরি নাই। অথচ নাটকের লোক যেমন সংসদে আছেন, সরকারের নানা কমিটিতে আছেন, এমন কি মন্ত্রীও ছিলেন পাঁচ বছর। তাহলে কাজের কাজটা করেছেন কী? এমনকি আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি উপকমিটির যিনি সভাপতি তিনিও নাটকের লোক। তাহলে দেখা যায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকলে তো এদের প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা না। আদতে এরা যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করেননি, তা আর লুকোছাপার কিছু নাই। শুনলে অবাক হবেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সংস্কৃতির জন্যে আলাদা কোনও অধ্যায়ই ছিল না। তাহলে সাংস্কৃতির উপকমিটির কাজটা কী! এ কমিটি করলোটা কী! এ কমিটির প্রধান কিন্তু নাটকের মোড়লদেরই একজন। তাহলে দোষটা কাকে দিবেন? এ ইশতেহার প্রকাশের পর সংস্কৃতি অঙ্গনের কোন জায়গা থেকে প্রশ্ন তোলা হল না, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো না।

তারপর সংসদে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র শব্দগুলো বাদ দেওয়া হল। এ নিয়ে সংস্কৃতির মোড়লদের কেউ কোন কথা বললেন না।

ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা যা ইচ্ছে তাই বেফাঁস ওয়াজ করে যাচ্ছে তাদের নামে কোন মামলা হল না। কোন ব্যবস্থা নেওয়া হল না। একবার কেবল মমতাজ বেগম সংসদে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাতেই খালাস? 

আমাদের কবিতার সেমিনারে মোড়লদের কেউ কেউ কবি বা লেখক না হয়েও প্রবন্ধ উপস্থাপন করার কথা থাকলে তা না করেই মাঠের বক্তৃতা করেই খালাস। তাদের সব জায়গায় নাম থাকা চাই, মঞ্চে একটা জায়গা চাই।

২০০৬ সালে জামাত-বিএনপি একটি সংস্কৃতি নীতি প্রণয়ন করে। সেই নীতি দিয়েই আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় চলছে। দোষটা কাকে দেবেন? সংস্কৃতিমন্ত্রীর কাজ কি কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন? তাহলে তো মন্ত্রীর দরকার নাই। সচিবই যথেষ্ট।

গলদ আরও আছে। নগরের এলিটরা ইংরেজি মাধ্যমের দিকে ছুটলেন। গ্রামের পিছিয়ে পড়াদের মাদ্রাসার দিকে ঠেলে দিলেন। দোষ কেবল মাদ্রাসার? মাদ্রাসাকে মূলধারার বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে আত্মীকরণ আর মূলধারার সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত করার জন্যে কোন রকম উল্লেখযোগ্য রূপরেখা কোন মহল থেকে দেওয়া হয়েছে? আর এই সুযোগটাই দেশি বিদেশি ধর্মব্যবসায়ীরা কাজে লাগচ্ছে। মাঠের বক্তৃতা দিয়েই কি খালাস পেতে চান? আপনারা যাবতীয় সুযোগ নিয়ে এলিট হবেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হবেন, পুরস্কার নিবেন, পদবী নিবেন, ব্যবসা করে যাবেন, প্লট নিবেন আর জাতিকে ছবক দিয়ে যাবেন। ময়দান অরক্ষিত রাখবেন, নিগৃহীত অবহেলিত রাখবেন। তার দখল তো কেউ না কেউ নিবে। আর সেটাই ঘটেছে।

আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের গলদগুলো চিহ্নিত করার জন্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। জাতীয় পর্যায়ে ক্রিয়াশীল কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃত্বে যিনি বা যারা তাদের মূল কাজ কি? তারা এ অচলাবস্থা নিয়ে কোন কনভেনশন বা দাবি দফা নিয়ে কোন আয়োজন করেছেন? নাকি তাদের নিজ নিজ ব্যবসাপাতিই সার? গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের যিনি প্রধান, শিল্পকলা একাডেমীরও তিনি মাথা। আবৃত্তি পরিষদের প্রধান যিনি তিনি মন্ত্রীও ছিলেন, সংসদ সদস্য আছেন; কবিতা পরিষদের যিনি, কর্তা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেরও কর্তাদের একজন। তাহলে এদের কারো কি সময় বা মনোযোগ কোন একটা আছে আসল কাজটা করার জন্যে? তাহলে দোষটা কাকে দিবেন?

আমরা যা হারিয়েছি তা আগরে মত করে ফিরে পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। তা আমাদের পুনরুদ্ধার পেতে হবে নতুন করে, নতুন চিন্তায় নতুন রূপরেখায়। আপনারা যে যার জায়গায় আছেন কাজটা করুন অথবা সরে দাঁড়ান। সবকিছু খোলনলচে পাল্টে নতুন বাস্তবতায় নতুন রূপরেখায় হেফাজতি দানব মোকাবিলা করতে হবে, স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে।

আমরা যে সিনেমা হলগুলো হারিয়েছি তা আর পুরঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব না নানা বাস্তবতায়। তাই পৌরসভা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছোট কলবরে সিনেমা, নাটক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে বহুমুখী হল নির্মাণের কথা ভাবা যেতে পারে। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার এবং ক্রিয়াশীল নানা উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করা যেতে পারে।

দেশের ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল বই ও তথ্য কেন্দ্র হিসেবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। এ নিয়ে সংস্কৃতি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করতে পরে। এর জন্যে আলাদা কোন অবকাঠামো নির্মাণের দরকার নাই।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষায় নাটক, চলচ্চিত্র ও সংগীত, চিত্রকলা ও নৃত্যকলার চর্চার সুযোগ অবারিত করা। এজন্যে সহজেই প্রতিটি বিদ্যালয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বয়স উপযোগী ছায়াছবি প্রদর্শনী, প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছোট কলেবরে এক কক্ষবিশিষ্ট গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা, যা স্থানীয় জনগণের জন্যেও বই ধার নেবার সুযোগ দিতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে নিয়মিত মৌসুমী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হতে পারে।

বাংলাদেশ শিশু  একাডেমী তাদের কার্যক্রম দেশের প্রতিটি স্কুল এবং মাদ্রাসা পর্যন্ত কোন না কোনভাবে বিস্তৃত করতে পারে। প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী যুবকমপ্লেক্স নির্মাণ, প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে দখলদারীর পরিবর্তে মূলধারার সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ফিরিয়ে আনা দরকার। সর্বোপরি স্থানীয় সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ধর্মমন্ত্রণালয়, যুব মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়কে সংশ্লিষ্ট রেখে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারাদেশে সর্বপর্যায়ে মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সর্বত্র গঠনমূলক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ও চর্চার জন্যে 'সংস্কৃতি উন্নয়ন বোর্ড' করা যেতে পারে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের ইউনিয়ন থেকে বিভাগীয় এবং জেলা, উপজেলা এবং পৌরসভায় আলাদা সংস্কৃতি বিভাগ ও বাজেট থাকতে হবে। আধুনিক কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এরকম কাঠামো পরিকাঠামোর নজীর রয়েছে। এমন কি পাশের ভারত এবং শ্রীলঙ্কায়ও অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ রয়েছে।

লেখাটি  শেষ করার আগে দুটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। এস ওয়াজেদ আলি তার 'ভবিষ্যতের বাঙালি' প্রবন্ধে জাতিগত ঐক্যের জন্যে চারটি শর্তের কথা বলেছিলেন, যেমন- কৃষ্টিগত ঐক্য, ভাষামূলক ঐক্য, স্বার্থসম্বন্ধীয় ঐক্য এবং আদর্শমূলক ঐক্য। বঙ্গবন্ধু তার জীবন দিয়ে এই চারটি ঐক্যের সমন্বয় করে দেশটা স্বাধীন করে গেলেন। আর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে স্বীকার করতে হচ্ছে 'একটা ধর্ম রাষ্ট্রের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি'। তবে এই পরিস্থিতির জন্যে কার দায় কোথায় কতটুকু তা উপলব্ধি করার জন্যে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কমলাকান্তের জবানবন্দী' গল্পটা আরো একবার পড়ার জন্যে।