ধর্ম-প্রতীক-আইন-রাষ্ট্র-রাজনীতি-বাজার-অর্থনীতি

কামরুল আহসান
Published : 15 April 2021, 06:27 PM
Updated : 15 April 2021, 06:27 PM

আপনি যে কোনও ধর্ম বিশ্বাস করছেন মানে কিছু প্রতীক বিশ্বাস করছেন। প্রতীক মানে ন্যারেটিভ- ন্যারেটিভ মানে গল্প। হিন্দুরা যে অসংখ্য দেবদেবীর পূজা করেন, তার মানে কিছু মূর্তির মধ্যে তারা প্রতীকের ন্যারেটিভ গুজে দেন। আপনি যদি খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করেন আপনারও একটা প্রতীক আছে বটেই, সেটা শুধু ক্রুশ না, যিশুর জন্ম-মৃত্যু-পুনরুত্থান আপনার মস্তিষ্কে প্রতীকরূপী গল্পের মতোই কাজ করে। তবে, খ্রিস্টধর্ম যে মূর্তিপূজা থেকে বেরিয়ে নিরাকার পিতার আরাধনা করে এর পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস আছে। মূসা বা মোজেশ যখন মিশর থেকে ইসরায়েল আসেন নিজের ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ফারাওদের সূর্যদেবতাকে বাতিল করে তাকে নিরাকার এক ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখন ঈশ্বর যে সাকার থেকে নিরাকার হয়েছেন এতে দর্শনের একটা ক্ষতি হয়েছে। ভাষাদ্বারা আর সেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কারণ ভাষাও তো একটা প্রতীক। প্রতীক যেহেতু একান্তই বস্তুগত তার কিছু সীমাবদ্ধাতাও আছে। সসীম ভাষাদ্বারা অসীম ঈশ্বরকে আপনি ধরবেন কী করে! তাই দেখা যায় ধর্মীয়গুরু বা পুরোহিতরা ঈশ্বরের চেয়ে বেশি আলোচনা করেন ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষদের নিয়ে। 

প্রাচীনকালে যখন রাষ্ট্রীয় আইন সুসংহত ছিল না তখন ধর্মীয় প্রতীক খুব দরকার ছিল মানুষকে পাপাচার থেকে মুক্ত রাখার জন্য। প্রতীকই ছিল তখন আইন। আর তখন আইনও তেমন শক্তিশালী ছিল না কারণ রাষ্ট্রেরই ঠিক ছিল না, আর মানুষের অন্যায় করার প্রবণতা এত বেশি ছিল না এখনকার মতো। অন্যায় করার প্রবণতা ছিল না কারণ প্রথমত সম্পদের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন যেমন চা দোকানদারও মন্ত্রী হতে পারেন, পাতি মাস্তানও রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন, এবং রাজনৈতিক নেতা মানেই টাকার পাহাড়, সুতরাং অপরাধ জন্ম নেবার বীজ এই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। দ্বিতীয়ত মানুষের তখন এতো স্থানান্তর ছিল না। বেশির ভাগ মানুষ নির্দিষ্ট একটা স্থানেই সারাজীবন কাটিয়ে দিত। আপন গণ্ডির ভেতর সাধারণত মানুষের অপরাধ করার প্রবণতা কম দেখা যায়, কারণ, তাতে সম্মানহানি হয়। আর তা ছাড়া পরিচিত পরিমণ্ডলে অন্যায় করে পার পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। 

দু শ বছর আগেও এ ভারতবর্ষেও অপরাধ বিচার করার ভার একমাত্র রাষ্ট্রের হাতে ন্যাস্ত ছিল না। পঞ্চায়েত ছিল, সমাজ-অধিপতি ছিল। বাংলাদেশে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। পঞ্চায়েত বিচারব্যবস্থা সামাজিক রীতি-নীতি-ঐতিহ্যনির্ভর। পঞ্চায়েতের বিচারব্যবস্থা বেশির ভাগই ফতোয়ানির্ভর। গ্রামের মোড়লশ্রেণির কারো বিচারবুদ্ধির ওপর ভরসা রাখাই ছিল একমাত্র উপায়। তাতে অনেক ব্যক্তিগত রোষও প্রকাশ পেত। শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসে ফুলমতির বিচার যেমন।  

আইনহীন সমাজে ন্যায় ও নৈতিকতার প্রতীকদ্বারাই মানুষ চালিত হত। এটা শুধু সভ্যসমাজেই নয়, আশ্চর্য ব্যাপার এই, আদিম জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রতীকগত বিশ্বাসদ্বারা জীবন অতিবাহিত করার নজির আছে।

যখন ভাষা লিখিতরূপে সহজলভ্য ছিল না, তখন একটা জনগোষ্ঠীর সমস্ত নীতি-নৈতিকতা-বীরত্বের গল্প একটা-দুটা প্রতীকের মধ্যেই আবদ্ধ করার বিষয় ছিল। ধরে নেওয়া যেতে পারে মূর্তি-ভাস্কর্য এর থেকেই শুরু। বছর বছর, কোনো নির্দিষ্ট দিনে মূর্তিপূজা করা আর গোষ্ঠীর পিতৃপুরুষের, যে কোনো বীর, যার নামে এখনো সাহস ও শক্তিসঞ্চয় করে ওই জনগোষ্ঠী, তার বেদিতে ফুলঅর্পণ করা মূলত ভজনারই শামিল। মূর্তিপূজার শুরু ভক্তিপ্রকাশ থেকেই। তা শুধু ব্যক্তির প্রতি নয়, প্রকৃতির প্রতিও। আদিতে প্রকৃতিই প্রধান, পরবর্তীতে প্রকৃতির স্থান দখল করে ব্যক্তি। সেই ব্যক্তি যিনি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। 

এখন মূর্তি শুধু মূর্তি নয়, ভাস্কর্যও শুধু সৌন্দর্যপ্রকাশ নয়, এটা একটা প্রতীক, অলিখিত আইন আসলে। এর পেছনে গল্প আছে, গল্পটা এই, তুমি এই প্রতীককে মান্য করো, ভক্তি করো, এবং আমার দলভুক্ত হও। আমার দলভুক্ত হও মানে আমাকে শক্তিশালী করো, আমার প্রদানকৃত সমস্ত নিয়ম মেনে চলো, এমন কোনো নিয়ম ভঙ্গ করো না যাতে আমার দলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। 

আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় আইন অকার্যকর। যেহেতু বহু মানুষের বহুরকম বিশ্বাস, এবং রাষ্ট্র তার উৎপাদনব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বহুবিশ্বাস নিয়েই বাঁচতে চায়, তাই সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানোর জন্য রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ফেলেছে। রাষ্ট্র মূলত একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, একটা মুদির দোকানদারের কাছে যেমন কে হিন্দু কে মুসলমান এটা মুখ্য নয়, তার পণ্য বিক্রিই আসল ব্যাপার, রাষ্ট্রের কাছেও বড় ব্যাপার কে ক্রেতা, কে বিক্রেতা, কে বেশি উৎপাদনকারী। মুদি দোকানদার ও ক্রেতার মধ্যেও একটা আইন থাকে বটে, পণ্যের নির্দিষ্ট মূল্য ধার্য থাকে, মাপে কম বেশি দেওয়া যায় না। দাড়িপাল্লা তাই শুধু মাপজোকের যন্ত্র নয়, ন্যায় ও সমতার প্রতীক।  রাষ্ট্র নির্দিষ্ট দুচারটে প্রতীক থেকে বেরিয়ে অসংখ্য লিখিত আইন বলবৎ করেছে। কারণ রাষ্ট্রের পরিমণ্ডল বিশাল। রাষ্ট্র এখন বাজার পর্যন্ত সীমিত না, রাষ্ট্র ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, কারণ বাজার ঘরে ঢুকে পড়েছে; কিংবা, বলা যায় ঘর থেকেই বাজারের যাত্রা শুরু! সুতরাং, আপনার সন্তানের ওপর এখন শুধু একমাত্র আপনারই অধিকার নয়, রাষ্ট্রেরও অধিকার আছে, তার ভালো মন্দ অনেকক্ষেত্রে আপনার চেয়ে রাষ্ট্রই বেশি বুঝে নেয়। কারণ, একদিন সে পরিণত হবে রাষ্ট্রীয়যন্ত্রে, উৎপাদনশীল কর্মীতে। তাই ধার্য হয়েছে পারিবারিক আইন- নারী আইন, শিশু আইন, আইনের অভাব নাই। 

এখন যেমন ঘন ঘন আইন পরিবর্তন হয় প্রাচীনকালে সেরকম ছিল না। সোলোনের আইনগুলো শতবর্ষব্যাপী পালনীয় ছিল। সোলোন আইনগুলো লিখে রেখেছিলেন পাথরে বা কাঠে খোদাই করে, সেগুলোর কয়েকটা রাজ দরবারে শোভা পেত জনগণকে বিধিনিষেধ শেখাতে। 

ধর্মীয় প্রতীক থেকে রাষ্ট্রীয় আইনের যাত্রার ইতিহাস মজার। এর পেছনে আছে লোহার আবিষ্কার। গ্রিকরা যখন প্রথম লোহা আবিষ্কার করতে শিখল তখন তারা নানারকম কৃষি যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করলো। এটা তাদের কৃষিতে বিরাট অবদান রাখল। বাড়তি ফসল নিয়ে তারা তখন কী করবে? গ্রিস ছিল অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র। তার প্রধান নগর ছিল এথেন্স। বাড়তি ফসলগুলো তারা এথেন্সে বিক্রি করতে আসতো। ফসল বিক্রি করে নগদ অর্থ বাড়ি নিয়ে যাওয়াটা অনেকের জন্যই ভয়ের ব্যাপার ছিল। পথে চোর-ডাকাত থাকতো। তখন তারা কিছু অর্থ জমা রাখত নগরের বিশ্বস্ত কারো কাছে। নদীর তীরে বে  নিয়ে অনেকেই তখন বসে থাকতো টাকা জমা রাখার জন্য। এভাবেই গড়ে ওঠে ব্যাংক ব্যবস্থা। সম্পদ যখন বাড়ছে, এক দ্বীপের সঙ্গে অন্য দ্বীপের যাতায়াত যখন সহজলভ্য হচ্ছে অনিবার্যভাবেই তখন অন্যায়-অনাচারও বাড়তে শুরু করলো। তখন কিছু মানুষ নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানোর জন্য রাস্তায় হেঁটে হেঁটে নীতিবাক্য প্রচার করতে নামলেন, তারা হলেন দার্শনিক!

তারা বললেন, গায়ের জোরে তো সমাজ চলতে পারে না, আসো, সবার মতামত নেই, এর নাম তারা দিলেন গণতন্ত্র!  সেই গণতন্ত্রে ক্রীতদাসদের কোনো জায়গা ছিল না, সমাজের উঁচুশ্রেণিরই ছিল সেখানে স্থান। নয়চোর মিলে সবচেয়ে বড় চোরটাকে সমাজের অধিপতি বানিয়ে দিতো, আর বলতো এই হলো আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি! বাকি নব্বইজন নারী-শিশু-দাসের কোনো মতামত ছিল না। আধুনিক সমাজেও বিষয়টা আসলে তাই রয়ে গেছে, কতো শতাংশ মানুষ ভোট দেয়, এবং তারা কারা, কারাই-বা হন জনপ্রতিনিধি দেখলেই বোঝা যাবে। 

সে যাই হোক, তারা কিছু খেলা খেলা আইন বানালেন। সক্রেটিস যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে হেমলক পান করলেন এটা তার একটা বোকামিই ছিল আসলে, আবার নৈতিকতা কোন পর্যন্ত বিস্তৃত হলে কেউ আইন মেনে নিয়ে আত্মহুতি দিতে পারে এটা তারও একটা অনন্য নজির। 

নৈরাজ্যবাদীরা তাই রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে বলেন, আমার হৃদয়ই আমার আদালত!

রোমানরা শুধু নিজেদের ও গ্রিক আইনগুলো সংরক্ষণ করল না, তারা ব্যক্তিমানুষের কিছু অধিকারও দিল, তারা বোঝালো জনগণকে, তোমাকে রক্ষা করার জন্যই তো এ আইন! 

আইন যে সাধারণ জনগণের কোনো কাজে লাগে না তা আমরা জানি। আইন সরকারকে বৈধতা দেয়। কালে কালে লুটেরারাই সরকার। অর্থাৎ আইন শেষ পর্যন্ত সম্পদশালীদের নিরাপত্তার একটা বিধান। কালের বিবর্তনে ধর্মীয়প্রতীক রূপ নিয়েছে ক্ষমতাবানের আইনিরক্ষাকবচে। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কোনো সরকারের আলটিমেট লক্ষ্য না। কারণ, সমাজ পুরো সুশৃঙ্খল হয়ে গেলে আইন ও সরকারের দরকার হবে না। আবার বিশৃঙ্খলা বেড়ে গেলে এক সরকার হটিয়ে আরেক সরকার আসবে। তাই সব সরকারেরই লক্ষ্য থাকে বিশৃঙ্খলা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়। অর্থাৎ আইনিব্যবস্থা বলবতের মাধ্যমেই প্রত্যেক সরকার কিছু নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার তখন নিজের খবরদারি বা অস্তিত্ব প্রকাশের পথ পায়। জনগণকে বোঝায়, দেখো, আমি আছি, আমি কতো উপকারী বন্ধু তোমার! 

আইন যে জনগণের একেবারে কাজে লাগেনি তা না। আইনের মারপ্যাঁচ বুঝলে কিছু আইনি অধিকার সাধারণ জনগণ আদায় করে নিতে পারে। রাষ্ট্রের সাথে না হলেও অন্তত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির অধিকার বুঝে নিতে কিছু আইন সহায়ক। হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তত এটুকু কথা জনগণ আদায় করতে পেরেছে যে রাষ্ট্রটা জনগণেরই, সরকার সেখানে জনগণের সেবক। খালি কথায় চিড়ে না ভিজলেও অন্তত এটুকু তো জনগণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে যে ওইসব রাষ্ট্রীয় নেতানেত্রীরা কেউ ঈশ্বরের প্রতিনিধি না, তারা জনগণেরই নির্র্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণ চাইলে ক্ষমতার পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু, জনগণ চায় কিনা, কিংবা সেটা জানে কিনা সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়। 

সাধারণত দেখা যায় অস্থির সমাজে আইনের প্রয়োগ বেশি। সমাজ অস্থির হয় অর্থনৈতিক অসম বণ্টনের কারণে। যাকে আমরা মতাদর্শগত লড়াই বলি তা তো আসলে কোনো না কোনো শ্রেণির লড়াই। কিন্তু, অর্থনৈতিক এই বিষয়টা আড়ালে চলে গিয়ে মতাদর্শগত বিষয়টাই সামনে চলে আসে প্রায় সময়।

যে- কোনও রাজনৈতিক দলেরই একটা প্রতীক লাগে। এমন কোনো নেতা লাগে যিনি বীরত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। ন্যায়ের নির্দেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুর্ভাগ্য তো এই, বর্তমানে আমাদের সামনে এমন কোনো নেতা নেই যিনি আমাদের পথ দেখাবেন, তাই আমাদের বারবার চোখ রাখতে হয় অতীতের দিকেই, পশ্চাৎগামীতার এও এক নজির। এ কথা কেবলমাত্র মুজিব-ভাসানী-গান্ধী-নেহেরু-জিন্নাহ-ম্যান্ডেলা-লেনিন-মাও সে তুং পর্যন্ত সত্য তা না, এ-কথা সত্য অতীতের সমস্ত পৌরাণিক নায়ক, ঈশ্বরপ্রেরিত মহাপুরুষ পর্যন্ত। প্রতীক মাত্রই অতীতনির্ভর। প্রতীকের টানে মানুষ একটা অতীতচক্রে আবদ্ধ হয়ে যায়, কিংবা, অতীতের মোহ ছাড়তে না পেরেই নির্মাণ করে প্রতীকের। এর কারণ হয়তো ভবিষ্যতে পা বাড়াতে সে ভয় পায়, কারণ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত আর বিপদসংকুল। প্রতীক শুধু ধর্ম-রাজনীতি না, মনস্তত্বেরও একটা জটিল বিষয়। 

বাঙালির মধ্যে অতীতপ্রীতি একটু বেশিই। কারণ বর্তমানে তার গর্ব করার মতো কিছু নাই। রাজনীতি মানে মুজিব-ভাসানী, ধর্ম মানে কোনো পীর, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মানেও ও-ই, অতীত থেকে কাউকে খুঁজে আনা, কারো মধ্যে প্রতীকের মাহাত্ম্য আরোপ, লানন-রবীন্দ্রনাথও এখানে প্রতীকের মর্যাদা পান। ঘরে একটা রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝুলিয়ে অনেকেই মনে করেন বেশ সংস্কৃতিবান হলাম!

প্রতীক অনেক সময় আপনাকে একটা পূর্ণ গল্প, ইতিহাস বা ঘটনা জানার হাত থেকে মুক্তি দেয়। একটা কোম্পানি সুনাম অর্জন করলে যেমন একটা লগোতেই তার পুরো পরিচিতি প্রকাশ পায় সেরকম। 

যারা মনে করেন আমি কারো ছবিও ঝুলাই নাই, ভাস্কর্যও বানাই নাই, আমি কোনো প্রতীকের মধ্যে নাই, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। মানুষ হয়ে বাঁচতে হলে প্রতীকের হাত থেকে মুক্তি নাই। প্রতীকের হাত থেকে মুক্তি মানে আপনি ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন। আপনি বড়জোর একটা প্রতীকের হাত থেকে পালিয়ে অন্য প্রতীকের ফাঁদে পা দিবেন।

আমাদের সমাজ যে অস্থির এর কারণ আমাদের চারপাশে অসংখ্য প্রতীক, এবং আমরা কেবল একটা প্রতীক থেকে অন্য প্রতীকে খাবি খাই। আমাদের ভাষাগত প্রতীক খুব অস্থির। এর ফলে আমাদের রাজনীতিও অস্থির। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যে আসলে মুহুর্মুহু অস্থির এর কারণ এদেশের বাজার অস্থির। কাঁচাবাজার ছাড়া এ দেশে আর কোনো বাজার গড়ে ওঠে নাই। নিজস্ব বাজার গড়ে উঠার আগেই এখানে আন্তর্জাতিক বাজার হাজির। একটা সাইকেলের পার্টস পর্যন্ত এদেশে উৎপাদন হয় না। বাজার বলতে এ দেশে আছে কেবল শ্রমবাজার। নিজস্ব শিল্পের বিকাশ হয় নাই। গায়ের রক্ত ও ঘাম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে এদেশের শ্রমিকরা। আরেকদল আছে কেবল বিক্রেতা। বিদেশ থেকে জিনিশ আনে আর বেচে। 

বাজার অবশ্য একটু সুস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটগুলো ঠিক হচ্ছে। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, বাংলাদেশ কতো পিছিয়ে পড়া একটা দেশ, এখানকার হাইওয়েগুলো হলো মাত্র সবে, প্রধান প্রধান নদীর ওপর ব্রিজ হলো কিছুদিন। আশা করা যায় আর দশ-বিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটা সুস্থির বাজারের দিকে যাত্রা করবে, বাজার সুস্থির হলে কিছু রাজনৈতিক সুস্থিরতাও আসবে, তবে, তার আগ পর্যন্ত আগামী কয়েক বছর আমাদের খবর আছে! 

শেষ পর্যন্ত দুনিয়া এক আনন্দের বাজার!