Published : 04 Apr 2021, 08:00 AM
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুইদিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তা্কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন এবং দুইদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ২৭ মার্চ তিনি দিল্লি ফিরে গেছেন। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এর আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। এর আগে তার আসার বিরোধিতা করে কোনও ধর্মভিত্তিক সংগঠন বা ভারতবিরোধী বলে পরিচিত কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন কোনো কর্মসূচি দিয়েছিল বলে মনে পড়ে না।
কিন্তু এবার মোদীর সফরের বিরোধিতা করে মাঠ গরম করে তোলে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে হেফাজত অন্য সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সমর্থন পেয়েছে। বামপন্থি কিছু ছোট সংগঠনও মোদীবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। বাম এবং ডানপন্থিদের এক অবস্থান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা লক্ষ করেছি। চীনপন্থি বামেরা এবং জামায়াত-মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ভারতবিরোধিতার নামে কার্যত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই বিরোধিতা করেছে। সাম্প্রদায়িক দলগুলো রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠন করে বাঙালি নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। চীনপন্থি বামেরা রাজাকার বাহিনীতে নাম না লেখালেও মুক্তিযুদ্ধকে 'দুই কুকুরের লড়াই' হিসেবে চিহ্নিত করে অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরই হত্যার চেষ্টা করেছে। তাদের ভূমিকা পাকিস্তানি বাহিনীকেই নৈতিক বল জুগিয়েছে। এবার মোদিবিরোধিতার ক্ষেত্রেও কিছু সাবেক চীনা বাম এবং হেফাজতসহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে এক ভাষায় কথা বলতে দেখা গেছে। একই রকম প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, হেফাজতসহ যারা মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করলেন, তারা কি আসলে মোদির মুসলিমবিরোধী বা সাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে এটা করলেন, না এর পেছনে অন্য কারণ বা রহস্য আছে? যদি গুজরাট দাঙ্গা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে নাগরিকত্ব আইনের নামে কৌশলে মুসলিমবিরোধিতার দায় মোদীর ঘাড়ে চাপিয়ে তার বাংলাদেশে আসার বিরোধিতা করা হয়ে থাকে তাহলে বিষয়টিকে একভাবে দেখতে হয়, আর যদি এই বিরোধিতার অন্য অপ্রকাশ্য এজেন্ডা থাকে তাহলে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা ও গুরুত্ব পেয়ে যায়।
মোদী কোন ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন সেটা আমাদের নিশ্চয়ই অনেক আগে থেকেই জানা। তিনি নতুন করে গায়ে রাজনীতির কোনো রঙ লাগাননি। আগে যা ছিলেন, এখনও তাই আছেন। কট্টর আরএসএস কর্মী থেকেই তিনি বিজেপির রাজনীতিতে এসেছেন। তার গায়ে হিন্দুত্ববাদের চিহ্ন নববধূর হাতে লাগানো মেহেদির মতো নয়। তাহলে আগে মোদির বাংলাদেশে আসার বিরোধিতা না করলেও এবার কেন করা হলো? মোদী আগে ভালো ছিলেন, এখন খারাপ হয়েছেন – ব্যাপারটি তেমন নয়।
এবার মোদী এসেছিলেন বাংলাদেশের আগ্রহে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বা অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, কারো সঙ্গে তুলনীয় নয়। এককোটি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা, জীবন দেওয়া – সবকিছুর জন্যই ভারত আমাদের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হয়েছে। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশীও। ইচ্ছে করলেই আমরা প্রতিবেশী বদল করতে পারবো না।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে তাই ভারতের সরকার প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তার উপস্থিতি বিতর্কের কারণ হতে পারে না। তাছাড়া সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আরও কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তারা এসেওছিলেন। করোনাকাল না হলে হয়তো চীনের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিও প্রত্যাশা করা হতো। চীনা প্রেসিডেন্ট এলে কি তার বিরোধিতায় হেফাজত বা অন্য কেউ মাঠে নামতো? চীন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে ছিল, পাকিস্তানের জানি দোস্ত ছিল। এখনও চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিগৃহ চলছে। চীনের মুসলিমবিদ্বেষী নীতির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের ইসলাম পছন্দওয়ালা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে আর ভারতের ব্যাপারে খই ফোটায় কেন?
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মোদী ছাড়াও আরও এসেছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মু. সালেহ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারী এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। তাদের উপস্থিতি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়িয়েছে। এছাড়া আরও অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বার্তা পাঠিয়েছেন, যার মধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্এিন ট্রডো, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং স্যু কয়েন, পোপ ফ্রান্সিসসহ অনেকেই আছেন।
অন্য কারও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস বা অবস্থান নিয়ে কারো মাথা ব্যথা দেখা গেল না, যত আপত্তি নরেন্দ্র মোদীতে কেন– এটা সাধারণ প্রশ্ন নয়। যদি মোদীর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অবস্থানই প্রতিবাদের মুখ্য কারণ হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন আসে, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী কি তার দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা করছেন? সে দেশে তো হিজাব পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কই, রাজাপাকসের বিরুদ্ধ তো টুঁ শব্দটি কেউ করলেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা মোদীর বিরোধিতায় মাঠে নামা প্রধান সংগঠন হেফাজতে ইসলাম কি অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাস করে? নিজ দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম করবেন, আর ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা চাইবেন, এটা স্ববিরোধী অবস্থান নয়?
কথা আরও আছে। নরেন্দ্র মোদী গায়ের জোরে ভারতের শাসন ক্ষমতা কব্জা করেননি। তিনি নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধর্মনিরপক্ষতায় বিশ্বাসী ভারতে হিন্দুত্ববাদ কেন, কীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তা নিশ্চয়ই একটি বড় আলোচনার বিষয় হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে মোদীকে কেউ অপছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রিত্ব করার বৈধতা নিয়ে তো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন শাসক দল বিজেপির প্রতিনিধি হিসেবে নয়, ১৩০ কোটি ভারতবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে।
নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের বিরোধীরাই সুযোগ নিয়েছে, মাঠে নেমেছে। এরা যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেটা তারা প্রকাশ্যেই বলেছে, তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি শুধু দেয়নি, কয়েক জায়গায় বাস্তবেও তারা ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে। সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের বিরুদ্ধে সময়মতো কঠোর আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় এদের দুঃসাহস সীমা ছাড়িয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম যে একটি ভয়ঙ্কর অপশক্তি, তারা যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তাদের পেছনে যে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন আছে– সেটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। তারা এর আগে নারী নীতির বিরোধিতা করেছে। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়ে তাদের শক্তি দেখিয়েছে। কারা তাদের মদদদাতা তা-ও তখন দেখা গেছে। তখন শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে বিতাড়িত করে সরকার যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল, পরে আর তার ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে ক্ষমতার রাজনীতির বিপজ্জনক হিসাব-নিকাশের সমীকরণে সরকার এক পর্যায়ে হেফাজতকে কোলে নেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। যে আদর্শ এবং মূল্যবোধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, হেফাজতে ইসলাম সেসবের বিরুদ্ধে। তারা এমনকি গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে। তারা আধুনিক সব কিছুরই বিরুদ্ধে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান -সব কিছুতেই তারা পশ্চাৎমুখী চিন্তার ধারক-বাহক। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে প্রশ্রয় পেয়ে এখন তারা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য শক্তি মনে করছে। তারা ইচ্ছে করলে যে সব ওলটপালট বা লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে তার প্রমাণ মোদিবিরোধিতার নামে তারা হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ২৬-২৮ মার্চ দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি প্রশাসন তাদের ঠিকসময়ে নিবৃত্ত না করার ভুল পথ অনুসরণ করার পরিণতিতে কমপক্ষে ১৪ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় প্রথমত হেফাজতের হলেও সরকারও দায়মুক্ত থাকতে পারে না, এজন্য যে সময় থাকতে সরকার সতর্ক হয়নি। হেফাজতকে আস্কারা দেওয়ার দায় সরকার এড়াতে পারবে না।
আমাদের সমাজ চরমভাবে বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু আমাদের ঐক্যসূত্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি । আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে আমরা অনেকেই এক ধরনের তৃপ্তি ও স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরেও যে আদর্শিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তা দেশের সামনে এক ভয়াবহ বিপদ তৈরি করেছে। ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরে এখন হেফাজতি চিন্তার মানুষের সংখ্যাই বেশি বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা। আদর্শের জায়গায় একবার আপস করলে আর দৃঢ়তা দেখানো যায় না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি সাফল্যের কথা কি এখন আলাদা তাৎপর্য হিসেবে উল্লেখ করা যায়, যখন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল এবং বাঙালির গৌরব করার মতো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আক্রান্ত হয় এবং আক্রমণকারীরা চিহ্নিত হওয়া সত্বেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে?
'২০ জন বিশিষ্ট নাগরিক' এক বিবৃতিতে গত কয়েক দিনের হেফাজতি তাণ্ডবের জন্য হেফাজতের কোনো নিন্দামন্দ না করে সব দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে এক ধরনের শুদ্ধ বিবেকের ভূমিকা নিয়ে কারো কারো কাছে প্রশংসিত হচ্ছেন। এই বিবৃতিদাতারা দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের বিপদ সম্পর্কে কিংবা রামু নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। তারা এবার হেফাজত-কাণ্ডের পর বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সরকার সংকীর্ণভাবে ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উদযাপন করেছে।
প্রশ্ন হলো, উদার ও অ-দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের রাজনৈতিক বাস্তবতা কি দেশে আছে? আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী দুই ধারার মধ্যে কীভাবে একটি সমন্বয় সাধন ঘটতে পারে? বিএনপি কি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার সামান্য কোনো সুযোগ রেখেছে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে অবদান তার স্বীকৃতি কি বিএনপি দেয় বা দেবে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় যদি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকতো তাহলে কি সংকীর্ণতামুক্ত ও অ-দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই উদযাপন হতো?
'২০ বিশিষ্ট নাগরিক' বিবৃতিতে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিতর্ক থাকায় তাকে বাদ দিয়ে ভারতের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানো সঙ্গত হতো।
এই সুবোধ-সুশীল বক্তব্য দিয়ে তারা নিজেদের মনের উদারতার প্রমাণ দিয়েছেন হয়তো, কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ কি নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে আলাদা রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী? গুজরাট দাঙ্গার সময় তিনি কি নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করেছিলেন? তিনিও তো আরএসএস হয়ে বিজেপি করা মানুষ। তাকে আমন্ত্রণ জানালে হেফাজত তা সানন্দচিত্তে মেনে নিতো এটা এই ২০ নাগরিক নিশ্চিত হলেন কোন তথ্যের ভিত্তিতে?
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড-বক্তব্যের অভিযোগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আসার প্রতিবাদ করার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের রয়েছে।
নিশ্চয়ই। বাংলাদেশের স্বার্থ তো বাংলাদেশের নাগরিকের কাছে অগ্রাধিকারের বিষয়। তাছাড়া 'হ্যাঁ' বলার চেয়ে 'না' বলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, হাটহাজারীতে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ যে সব প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে তার সঙ্গে মোদির সংশ্লিষ্টতা কোথায়? মোদীর কুশপুতুল দাহ করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে শামিল হলে প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। কিন্তু তারা তো আক্রোশ মোদীর বিরুদ্ধে না দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেখিয়েছে।
হেফাজতের উত্থান নিয়ে আমাদের 'বিশিষ্ট ২০ নাগরিকে'র কোনো উদ্বেগ নেই। জাতির পতাকা যে পুরনো শকুনেরা খামচে ধরছে তাতেও তাদের উদ্বেগ নেই। তাদের উদ্বেগ নরেন্দ্র মোদীতে, তাদের উদ্বেগ আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকায়। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে শেখ হাসিনার সমস্যা হবে ধরে নিয়ে বাংলাদেশে যারা উল্লসিত হয়েছিলেন তারা পরে মোদীর ভূমিকায় নাখোশ হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর আমলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বে টান না পড়ায় এখন তারা ক্ষুব্ধ। এখন তাই মোদীবিরোধিতা, যা আসলে শেখ হাসিনাবিরোধিতা।
রবি ঠাকুরের সেই কবিতার কথা মনে পড়ছে – যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা ব্যাটাই চোর!
শেখ হাসিনা দিল্লির কাছ থেকে কী আদায় করতে পেরেছেন তা না বলে, কী আদায় করতে পারেননি তা বড় করে দেখার মধ্যে এক ধরনের অসততা আছে। বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরবর্তী ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা তো ভারতপ্রেমী ছিলেন না, তারা বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কি সুবিধা আদায় করতে পেরেছিলেন, তা সবাই একবার ভেবে দেখলে ভালো হয়।
বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছ থেকে গৎবাঁধা ভারত এবং আওয়ামী লীগবিরোধী বিবৃতির বদলে দিকনির্দেশনামূলক এবং নতুন ভাবনা জাগানিয়া বক্তব্য আশা করেছিলাম। তারা আমার মতো অনেককে হতাশ করেছেন।