Published : 18 Mar 2021, 06:24 PM
কয়েকদিন আগে কয়েক বন্ধু মিলে আড্ডা হচ্ছিল চায়ের দোকানে, প্রায়ই হয়। কয়েক কাপ চা আর ধুম্রশলাকা ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে সেখানে চলে দেশ-কাল-জাতি উদ্ধারের চেষ্টা। সেদিনও হচ্ছিল। চায়ের দোকানে একটা মজার বিষয় আছে। কথা বলার লোকের অভাব হয় না। যেকোনও একটা বিষয় তুলে দিলেই হলো, আর দেখতে হবে না। টকশোতে অতিথির অভাব হবে না।
ওইদিনও তাই হল। সেদিনই উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু। আলোচনার সূত্রপাত ওই সেতু নিয়েই। পেশাগত কারণেই সেদিন এ সংক্রান্ত খবরে চোখ রাখতে হয়েছে। সেসব নিয়েই নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ করেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন, "ভালোই হইছে, এইবার বর্ডার তুইলা দিয়া পুরা দ্যাশটাই দিয়া দিলে অয়"। আমরা চায়ের কাপে মনোযোগ দিই।
সেই ৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অসহায় মানুষের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া, লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয়, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করা আর সবশেষে বাংলাদেশের হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন বোধকরি ছিটমহল বিনিময়, যার মধ্যে দিয়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন এসব ছিটমহলের বাসিন্দারা। তাদের এখন একটি দেশ আছে, আছে পরিচয়।
এরপর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে ধীরে ধীরে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও বেড়েছে যোগযোগ। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অর্জন অভূতপূর্ব। যার সবশেষ সংযোজন খাগড়াছড়ির রামগড়ে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে ফেনী নদীর ওপর প্রথম মৈত্রী সেতু।
১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুমকে যুক্ত করেছে। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরামসহ পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এ সেতু করা হয়েছে। সেতুটি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে বন্দর থেকে ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হয়ে যাবে। দু্ই দেশের প্রধানমন্ত্রী এই সেতুকে দেখছেন অর্থনীতির 'লাইফলাইন' হিসেবে।
আগের জায়গায় ফিরে আসি, ভারত না দিলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা কেজিতে উঠে যায়, মোটরসাইকেল কিনতে গেলে আমরা নিজেদের উৎপাদিত গাড়ি না কিনে ঘুরফিরে সেই ভারতীয়টিই বেছে নিই। অসুখ-বিসুখে আমরা নিকটজনদের পরামর্শ দিই, 'ভাই, এখানে টাকা ঢেলে লাভ নেই, ইন্ডিাতে চলে যাও'। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আমাদের এখানে দর্শকরা গোগ্রাসে গেলেন। শুনেছি সিরিয়াল দেখা নিয়ে বিবাদে অনেকের সংসারও নাকি ভেঙ্গেছে। তারপরও কেন ক্ষোভ?
কারণ অবশ্যই আছে। ভারত বিভিন্ন সময় এদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু ঝুলে থাকা তিস্তা সমস্যা, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, এমন আরও অনেক অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বড় ধরনের 'কাইজা' না হলেও সম্পর্কে 'শীতলতা' দেখা দিয়েছে অনেকবারই। যদিও দুই দেশের সরকার সবসময় 'উষ্ণ সম্পর্কের' কথাই বলে আসছে।
দুই বছর আগে অন্তত দুইটি ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। একটি ভারতের নাগরিকত্ব আইন, যা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও অস্বস্তি প্রকাশ পেয়েছিল বলে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
দ্বিতীয়টি হল, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করা। পরপর দুই বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রাখে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সমস্যার তীব্রতা বাড়ে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের পুরনো এলসির পেঁয়াজ সীমান্তে আটকে দেওয়ায়। পরে সেসব ছেড়ে দেওয়া হলেও ততদিনে অনেক পেঁয়াজ পঁচে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হয়।
তবে এই পেঁয়াজকাণ্ডে আদতে বাংলাদেশেরই লাভ হয়েছে। প্রথমবারের নিষেধাজ্ঞায় কেজিপ্রতি দাম ২৫০-৩০০ টাকায় উঠে গেলেও এখন পেঁয়াজ আমদানির অনেকগুলো উৎস আমরা পেয়েছি। ফলে ভারতের দ্বিতীয় দফা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার খুব একটা আঁচ লাগেনি। বিদেশ নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টাও হচ্ছে। এরপর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগে বেশ ভাটা পড়ে। তবে অনেকে দুই দেশের সম্পর্কে ভাটার টান দেখতে পেলেও ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, তার নজির আবারও দেখা যায় এই মহামারীর মধ্যেই।
গত বছর মহামারীর মধ্যেই আকস্মিক সফরে আসেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার পর শ্রিংলা ওই বছরের মার্চে একবার ঢাকায় এলেও অগাস্টে তার ঝটিকা সফরটি যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা গণমাধ্যমের বিভিন্ন খবরে এসেছে। দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি 'বিশেষ বার্তা' বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দিতেই শ্রিংলা ঢাকায় এসেছিলেন বলে গণমাধ্যমের খবর।ওই সফরেই শ্রিংলা বার্তা দেন করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। বোঝা গেল 'উষ্ণায়ন' প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এরপর দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। অক্টোবরে ভারতের নতুন হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ঢাকায় যোগ দেওয়ার পর তা আরও গতি পায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে 'এয়ার বাবল' চালু। মহামারীর কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ থাকার প্রেক্ষাপটে অক্টোবরে চালু হয় এ বিশেষ বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা।
দীর্ঘ ৫৫ বছর পর মহামারীর মধ্যেই ১৭ ডিসেম্বর চালু হয় দুই দেশের মধ্যে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ। ওইদিন দুই প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ সাতটি বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে সাতটি কাঠামো চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয় ওইদিন। আগামী ২৬শে মার্চ চালুর কথা রয়েছে ঢাকা-জলপাইগুড়ি রেলপথও।
বিভিন্ন দেশ যখন করোনাভাইরাসের টিকার জন্য হাপিত্যেশ করছে, তখন ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী করোনাভাইরাসের টিকাও ভারত থেকে আসে নির্ধারিত সময়ে। উপরি হিসেবে চুক্তির বাইরে ভালো পরিমাণে টিকা উপহারও মিলল, যা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। বন্ধুত্বের সম্পর্কে আমরা এমন 'সারপ্রাইজ' প্রায়ই দিয়ে থাকি।
সম্পর্ক মেরামতের এতসব আয়োজন চূড়ান্ত রূপ পেতে যাচ্ছে এ মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে সফরের মধ্যে দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আয়োজনে যোগ দেওয়া ছাড়াও টু্ঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি, গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরায় দুইটি মন্দিরও পরিদর্শন করার কথা রয়েছে তার।
ডিসেম্বরের ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ভারতের 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বাংলাদেশ। সেই কথার ভালো প্রমাণ হতে পারে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তার বাংলাদেশ সফর। কারণ মহামারী শুরুর পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বাংলাদেশকেই বেছে নিয়েছেন মোদী। এতেই বোঝা যায় বাংলাদেশকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মোদীর সফরের চূড়ান্ত করতে এই তো কয়েকদিন আগে ঢাকা ঘুরে যাওয়ার সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুইটি কথা বলেছেন।
প্রথমটি- "আমাদের সম্পর্ক গৎবাঁধা অংশীদারিত্বের ঊর্ধ্বে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের বন্ধন শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু। তার দ্বিতীয় উক্তিটি ছিল- "আমরা বাংলাদেশকে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও একটি মূল প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করি।"
তার এ দুই উক্তির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব। কিন্তু ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দুই ধরনের কথায়। প্রথমবার তিনি বললেন, নরেন্দ্র মোদীর এবারের সফরটি শুধুই হবে উদযাপনের। সেখানে থাকবে না কোনো দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। একদিন পরেই তিনি বললেন, "ভারতসহ যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আসবেন তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও বিভিন্ন চুক্তি হতে পারে।"
সফর যেমনই হোক, একটা কথা পরিষ্কার করেই বলা যায়, বন্ধুত্বে যেমন সবসময় স্বার্থের হিসাব মেলালে চলে না আবার দেশের স্বার্থই যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সেটাও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় থাকবে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অন্তত সেটাই চাইবে।