Published : 08 Mar 2021, 06:25 PM
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন ৩০ মার্চের পর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুনরায় ক্লাস চালুর প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টিকার আওতায় এনে স্কুল পুনরায় খোলার সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
দীর্ঘদিন মুখোমুখি ক্লাসে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার বেশকিছু গুরুতর ক্ষতি হয়েছে, আমরা সবাই তা বুঝতে পারছি। তবে এসব ক্ষতির পাশাপাশি বেশ বড় একটা বড় লাভও হয়েছে। এই লেখায় শিক্ষাক্ষেত্রের অনেক ক্ষতির পাশাপাশি সেই লাভের কথাও বলব।
অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘদিন মুখোমুখি ক্লাসের বাইরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি (লার্নিং গ্যাপ) তৈরি হয়েছে। বিগত বছরের অনেক আবশ্যকীয় শিখন দক্ষতা অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গেছে। এই শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে না পারলে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই এই ঘাটতি দূর করার জন্য অবশ্যই সুনির্দষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। এই পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ববর্তী শ্রেণিসহ বর্তমান শ্রেণির শিখন দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা থাকতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু শেখার সাথে সাথে আগে শেখার কথা থাকলেও শিখতে পারেনি এমন বিষয়গুলোও আস্তে আস্তে শিখতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সাথে মানসিক দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ৩০ মার্চের পর থেকে পুনরায় খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত প্রস্ততির সাথে সাথে শিক্ষকরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাবেন, শিখন ঘাটতি কমাতে কীভাবে কাজ করবেন তার জন্য তাদের সুস্পষ্ট ধারণা ও নির্দেশনা থাকা দরকার। কারণ, শিক্ষার্থীদের ভুলে যাওয়া জ্ঞান ও দক্ষতাজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষকদের ভূমিকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। অনেকক্ষেত্রে মহামারী ও কোভিড-১৯ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা মিথ্যা ও ভুল তথ্য জেনে থাকতে পারে, তাদেরকে সঠিক তথ্য জানানোর জন্য ও কুসংস্কারমুক্ত করার জন্য শিক্ষকদের কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন স্কুলে না আসার কারণে রুটিনমাফিক জীবনযাপনেও শিক্ষার্থীরা অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে স্কুলে ও পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনতে ও রুটিনে অভ্যস্ত করতেও শিক্ষকদের প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
অনুমান করা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক বড় অংশ হয়তো আর ক্লাসে ফিরবে না। শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে, বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পরিবারের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে ঐসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে নাও ফিরতে পারে। এমন সব শিক্ষর্থীকে ক্লাসে ফেরানোর জন্য বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য কী কী করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা দরকার।
মুখোমুখি ক্লাসের বিকল্প হিসেবে সংসদ টিভিতে ক্লাস হচ্ছে, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকরা ফেসবুক, জুম, গুগল মিট এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করেছেন। সারাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট না থাকা, স্মার্ট ডিভাইস না থাকা, ইন্টারনেট ডেটার উচ্চমূল্য প্রভৃতি ইস্যুতে সারাদেশে হয়তো অনলাইন ক্লাস সমানভাবে কার্যকর হতে পারেনি, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনার সাথে যে ওরিয়েন্টেশন হয়েছে তার মূল্য খুব কম নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনার সাথে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটাই এই সময়ের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করি। উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস করার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে শিক্ষার ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
নতুন পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে শিক্ষণ কার্যক্রম চালানোর জন্য শিক্ষকদেরও নতুন নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ ফেরানোর জন্য, মানসিক সহায়তা প্রদানের জন্য, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কার্যকর উপায়ে পড়ানোর জন্য অনলাইনে শিক্ষকদের জন্য ফ্রি কোর্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মহামারী সম্পর্কে মিথ্যা ও ভুল ধারণা দূর করা, স্কুলে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস করার নিয়ম, একসাথে ক্লাসে বসেও বন্ধুদের সঙ্গে কীভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যায়, মাস্ক পরার সঠিক নিয়ম প্রভৃতি বিষয়ে সঠিক ধারণা দেওয়ার জন্য শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষেও আইসিটি ব্যবহার করতে পারেন। পাঠে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে ও শ্রেণি কার্যক্রমকে আনন্দদায়ক করতেও শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারেন। আগে এসব বিষয়ে শিক্ষকদের এক ধরনের অনাগ্রহ কাজ করত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় শিক্ষকদেরও আইসিটি ব্যবহারের জড়তা কেটে গেছে বলেই মনে হয়।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক শ্রেণিকে একদিন করে ক্লাসে এনে মুখোমুখি ক্লাসে শিক্ষার্থীর আগের শ্রেণির না শেখা ও ভুলে যাওয়া পড়া শেখানো এবং নতুন শ্রেণির প্রয়োজনীয় শিখন দক্ষতা অর্জন করানো দূরহ হবে বলেই মনে হয়। এতে শিক্ষকদের সময় অনেক বেশি দিতে হবে এবং অবশ্যই পরিশ্রম বাড়বে, তারপরও শিক্ষার্থীদের সবধরনের শিখন চাহিদা হয়তো পূরণ হবে না। তাই মুখোমুখি ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন পাঠদান চালু রাখা অপরিহার্য। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যেতে পারেন। পাশাপাশি ক্লাসের পড়াকে সাপ্লিমেন্ট করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে অতিরিক্ত কন্টেন্টের আয়োজন থাকলে শিখন ঘাটতি কমানো সহজ হবে। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন, ইউটিউব এমন সব প্ল্যাটফর্মকে টার্গেট করে দক্ষতাভিত্তিক বিভিন্ন কোর্স (অডিও বা ভিডিও) তৈরি করা যেতে পারে। এনসিটিবির কারিকুলাম অনুযায়ী ভাষা, গণিত, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য মৌলিক দক্ষতাকে কেন্দ্র করে এসব কোর্স ডিজাইন করা যেতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড এবং এটুআই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিক নির্দেশনা পেলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই কন্টেন্ট নির্মাতা হিসেবে কাজ করতে পারবেন। মানসম্মত কন্টেন্টের এমন একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম থাকলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে।
সরকারের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার জন্য বিদ্যালয় ই-ব্যবস্থাপনা নামক একটি ওয়েবসাইট আছে। একটু উদ্যোগ নিলেই এই ওয়েবসাইটে সকল স্তরের সব শিক্ষার্থীদের তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে। তারপর শিক্ষার্থীদের সমন্বিত ডেটা থেকে ট্র্যাকিং করে কোন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ফিরে আসেছে না তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। তখন পিছিয়ে পড়া সেসব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যাবে।
সর্বোপরি, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থায়ী ও টেকসই পরিবর্তন আনার জন্য অনলাইন মোডে শিক্ষা পরিচালনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্লেন্ডেড মোড চলমান থাকাটাই যৌক্তিক বলে মনে করি। এতে করোনাকালীন ঘাটতি পোষানোর পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মানও বৃদ্ধি পাবে। আর তাতে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিখন-শিক্ষণ অভিজ্ঞতায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে বলেই মনে হয়।