দূষণের উল্লম্ফনে শুরু হলো বায়ুদূষণ মৌসুম

মো. মাসুদ রানা
Published : 9 Dec 2020, 06:12 AM
Updated : 9 Dec 2020, 06:12 AM

নভেম্বর মাস শেষ হলো। বরাবরের মতো এই মাসের শুরু থেকেই বায়ুদূষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে জনউৎকন্ঠা, হৈ-চৈ। তার ওপর আবার নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নিম্ন স্তরে জমা হওয়া কিছু মেঘের কারণে ঢাকা বায়ুদূষণ সূচকে বিশ্বে এক নম্বর স্থান দখল করায় হৈ-চৈ আরো বৃদ্ধি পায়। এসব হৈ-চৈ এর মধ্যেই আমেরিকার হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউট এবং গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ প্রজেক্ট-এর সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার' ২০২০ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়, যেখানে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা-ভার ভিত্তিক পিএম২.৫-এর গড় মানমাত্রা দেখানো হয় ৬৩.৪ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, যা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের উচ্চমাত্রার পিএম২.৫ দ্বারা দূষিত দেশের তালিকায় ৯ নম্বর স্থানে অবস্থান করে। শুধু পিএম২.৫-ই নয়, উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ওজন দূষণেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বে ৪ নম্বর স্থানে; ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বাতাসে ওজন-এর জনসংখ্যা ভার ভিত্তিক ৮ ঘন্টা গড়ের বার্ষিক গড় মানমাত্রা ছিল ৬৪.৬ পিপিবি। উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে মোট মৃত্যু ঘটে প্রায় ৯০ হাজার জনের। তবে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার' ২০২০ রিপোর্টে বাংলাদেশের কিছু অর্জনও প্রতিফলিত হয়েছে – হাউসহোল্ড বায়ুদূষণজনিত কারণে দেশে মৃত্যু সংখ্যা ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে কমেছে প্রায় ২৬,০০০ জন। গত এক দশকে রান্না'র কাজে ব্যবহৃত চুলা (বন্ধু চুলার প্রসার) ও জ্বালানী (এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার)-তে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণেই এই সেক্টরে দূষণজনিত মৃত্যু কমানো সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। এটি অবশ্যই একটি ভাল অর্জন কারণ হাউসহোল্ড বায়ুদূষণে সাধারণত মহিলা ও শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়। মনে রাখতে হবে, বায়ুদূষণ শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে অন্তরায়। এমতাবস্থায়, ঢাকার বায়ুদূষণ হ্রাসে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে প্রদত্ত ৯টি বিশেষ নির্দেশনা প্রতিপালন ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর/কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহিত পদক্ষেপ এক মাসের মধ্যে জানানোর জন্য হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়কালটা বাংলাদেশে অনাবৃষ্টি মৌসুম – আকাশে খুব একটা মেঘও জমে না। নভেম্বরের শুরুর দিক আর মার্চ-এপ্রিলে মাঝেমধ্যে মেঘের আনাগোনা আর বৃষ্টির দেখা মিললেও বাকি সময়টা একেবারেই অনাবৃষ্টিকাল। এই অনাবৃষ্টির সুযোগে দিনের পর দিন বায়ুমন্ডলে জমতে থাকে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকারক অতিসূক্ষ্ণ বস্তুকণা ও গ্যাসীয় উপাদান। এসব দূষিত পদার্থ বাতাসে ভেসে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অন্য স্থানকেও দূষিত করতে পারে।

বছরব্যাপী চলমান দূষক-উৎস যেমন-যানবাহন, কাঠ/গোবর চুলায় রান্না, শিল্প-কারখানা, ইত্যাদির সাথে বছরের এই অনাবৃষ্টিকালে আবার বড় কিছু দূষক উৎসের কার্যকলাপ শুরু হয়, যার মধ্যে রয়েছে ইট-ভাটা, ফসলের উচ্ছিষ্ট/আবর্জনা পোড়ানো, চালকল ইত্যাদি। বৃষ্টিতে নষ্ট না হওয়ার সুবিধায় অনেক নির্মাণ কাজও এসময় গ্রহণ করা হয়। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা কমে যাওয়ায় ও গাছপালা শুকিয়ে যাওয়ায় অনাবৃত জায়গা থেকে ধুলি নিঃসরণও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়ার অতিরিক্ত সহযোগিতায় এতসব উৎস থেকে নিঃসৃত দূষক পদার্থ দীর্ঘ সময় বাতাসে উপস্থিত থেকে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং তীব্র বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে। তবে, এই অনাবৃষ্টিকালেও সময়ভেদে আবহাওয়ার চরিত্রের ভিন্নতার কারণে বায়ুদূষণের তীব্রতা ও চরিত্রে ভিন্নতা ঘটে। যেমন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ ঘটে সবচেয়ে বেশি এবং অনাবৃষ্টিকালের অন্য সময়ের তুলনায় এসময় বাতাসে উপস্থিত বস্তুকণার মধ্যে অতি সূক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম২.৫)'র অনুপাত বেশি থাকে, সাধারণত ৭০%, যেখানে মার্চ-এপ্রিলে এই অনুপাত ৩৫-৪৫ % এ নেমে আসে। বাতাসে বিদ্যমান দূষক পদার্থসমূহের মধ্যে এই পিএম২.৫-ই মানব-স্বাস্থ্যের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর; শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, ব্রঙ্কাইটিস, হার্টের সমস্যা ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মানব-স্বাস্থ্যের বহুবিধ সমস্যার জন্য পিএম২.৫ দায়ী। উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে এ সময়কালটাকে আমরা বায়ুদূষণ মৌসুম হিসেবেও অভিহিত করতে পারি।

ঢাকার বারিধারাস্থ আমেরিকান অ্যাম্বাসি কর্তৃক উৎপাদিত পিএম২.৫-এর মানমাত্রা'র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২০১৯-২০২০ বায়ুদূষণ মৌসুমে ঢাকার গড় পিএম২.৫-এর মানমাত্রা (১২৩.১ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) পুর্ববর্তী মৌসুম ২০১৮-২০১৯ থেকে প্রায় ১১.৫% কমে যায়। দীর্ঘ সময়ের তথ্য বিশ্লেষণে বলা যায় কোনো একটি বায়ুদূষণ মৌসুমের গড় পিএম২.৫-এর মানমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই তার পার্শ্ববর্তী মৌসুমের গড় পিএম২.৫-এর মানমাত্রা'র চেয়ে ১০-১৫ % কম/বেশি হয়ে থাকতে পারে কারণ প্রতি মৌসুমে আবহাওয়ার উপাদানসমূহ হুবহু এক থাকে না। তবে, পরপর দুই-তিন মৌসুম পিএম২.৫-এর মানমাত্রা বৃদ্ধি'র ধারা অব্যাহত থাকাটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে এবং একইভাবে পরপর দুই-তিন মৌসুম পিএম২.৫-এর মানমাত্রা হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকাটা অবশ্যই অর্জন হিসেবে দেখা যেতে পারে। সুতরাং, ২০১৯-২০ মৌসুমে পিএম২.৫-এর মানমাত্রা পূর্ববর্তী মৌসুম থেকে প্রায় ১১.৫% কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক; তার ওপর গত এপ্রিল মাসের "লকডাউন" ও গত মৌসুমে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইট-ভাটার বিরুদ্ধে গৃহীত তৎপরতা'র ভূমিকা থাকতে পারে। তবে, লকডাউনের কারণে আপাতদৃষ্টিতে যেমন দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫-এর মানমাত্রা ততটা হ্রাস পায়নি – বলা যেতে পারে, শুধু লকডাউনের প্রভাবে ২৮ মার্চ-১৬ এপ্রিল'২০২০ পর্যন্ত এই ২০ দিনে পিএম২.৫-এর মানমাত্রা প্রায় ১০% উন্নতি লাভ করে। সুতরাং, চলতি বায়ুদূষণ মৌসুম অর্থাৎ ২০২০-২১ মৌসুমে ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫-এর মানমাত্রার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরি।

বারিধারাস্থ আমেরিকান অ্যাম্বাসি কর্তৃক উৎপাদিত পিএম২.৫-এর নভেম্বর মাসের মানমাত্রা'র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সদ্য সমাপ্ত নভেম্বর মাসে পিএম২.৫-এর গড় মানমাত্রা ৯৭.০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার গত মৌসুমের নভেম্বর মাসের গড় মানমাত্রার তুলনায় ৫.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। চিত্রে দুই মৌসুমের নভেম্বর মাসের পিএম২.৫-এর দৈনিক গড়ের রেখাচিত্রের তুলনা দেখানো হয়েছে যেখানে কালো আনুভূমিক রেখাটি বাংলাদেশের আদর্শ মানমাত্রা (৬৫.০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) নির্দেশ করছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা অতীব জরুরি। তবে, সর্বাগ্রে একটি বিষয় সকলকে বুঝতে হবে যে, "বায়ুদূষণ" আর "ধুলিদূষণ" এক নয়। ঢাকা শহরে ধুলা উড়তে না দেখলে বায়ুদূষণ নিয়ে হৈ-চৈ হয় না, আবার সকল ক্ষেত্রে ধুলিদূষণ যে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে না সেটাও আমাদেরকে বুঝতে হবে। টেকনিক্যাল টার্মে "বায়ুদূষণ" সেই অবস্থা যেখানে বায়ুতে বিদ্যমান কোনো উপাদান মানব স্বাস্থ্য বা জীব-জগতের ওপর বা প্রাকৃতিক সাম্যতা বিধানে যথেষ্ট বিরুদ্ধ-প্রভাব সৃষ্টি করে। সেই অর্থে ধুলিদূষণও এক প্রকার বায়ুদূষণ কারণ এটি খুব বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি না করলেও জীবন মানে যথেষ্ট বিরক্তি ও ঝামেলা সৃষ্টি করে। ধুলার মধ্যে অতি সূক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম২.৫)'র পরিমাণ অত্যন্ত কম অনুপাতে থাকে। পিএম২.৫ চোখে দেখা যায় না; এ ধরনের বস্তুকণার ব্যাস মানুষের একটি চুলের ব্যাসের তুলনায় প্রায় ২৫ বা তারও অধিক ভাগ কম। জীবাশ্ব জ্বালানী পোড়ানো, ধাতু শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, রাসায়নিক বিক্রিয়া, ইত্যাদি থেকে মূলত বায়ুমণ্ডলে পিএম২.৫ এর প্রবেশ ঘটে। সুতরাং একটি কার্যকরী বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে মূলত কোন সমস্ত উৎস থেকে পিএম২.৫ বাতাসে আসছে এবং আবহাওয়ার বিভিন্ন প্যারামিটারের পরিবর্তনের সাথে শহরব্যাপী পিএম২.৫-এর মাত্রার কিরূপ পরিবর্তন হচ্ছে। ঢাকা শহরের জন্য এখন পর্যন্ত বড় পরিসরে কোনো সোর্স অ্যাপোশনমেন্ট সমীক্ষা করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা প্রায় ১০ বছর পূর্বের ডাটা দিয়ে তৈরি করা এবং সমগ্র শুষ্ক মৌসুমভিত্তিক একটি সমীক্ষা, যা একটি কার্যকরী বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়।

ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি আন্তঃবিভাগীয় শক্তিশালী টাস্ক ফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। কারণ ঢাকার বায়ুদূষণের সাথে জড়িত রয়েছে শিল্প, অর্থ, আবহাওয়া, যানবাহন, নগর ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, ইত্যাদি বিষয়; রয়েছে এনফোর্সমেন্ট ও গবেষণা সক্ষমতা'র বিষয়ও। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বায়ুমানের সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও পূর্বাভাস প্রদানে সক্ষম একটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত তথ্য উৎপাদন ও বিশ্লেষণপূর্বক একটি কার্যকরী ও স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়ন করে ধাপে ধাপে ঢাকার বায়ুমানের উন্নতি করা যেতে পারে। বায়ুদূষণের কারণে একদা হিমশিম খাওয়া বেইজিং শহরের পক্ষে সম্ভব হলে আমাদের পক্ষেও বায়ুমান উন্নতি করা সম্ভব বলে আমরা আশা করতে পারি।