Published : 16 Nov 2020, 01:49 PM
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত (১৯ অক্টোবর, ২০২০) বৈঠকের সূত্রে পাওয়া পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, দেশের ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এই অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। তথ্যটি সত্যিই আঁতকে ওঠার মতো, কারণ বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়াটা সত্যিই চরম উদ্বেগের বিষয়। প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে প্রশ্নের জন্ম নেয়- বাংলাদেশের বনভূমি তদারকি ও সংরক্ষণ করার দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষের তাদের কি এদিকে যথাযথ দৃষ্টি ও মনোযোগ নেই? এই বিপুল পরিমাণ বনভূমি কি রাতারাতি বেদখল হয়ে গেছে? যারা এগুলি দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন সেইসব কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে এগুলো কীভাবে ঘটল? আর বনভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে আদৌ কি আইনি কোন পদেক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? নাকি আইনি পদক্ষেপ নিলেও তা কাজ করছে না? বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, সেটা কি আদৌ আমরা অনুভব করতে পারছি?
এটা নিশ্চয়ই সাধারণভাবে বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদসমৃদ্ধ একটি বনাঞ্চল কিংবা বনভূমি গড়ে উঠতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। এক জাতীয় গাছ বেশি কেটে ফেলা হলে ঐ বনভূমিতে একই বন কখনোই আর গড়ে ওঠে না। অনেক উদ্ভিদ আর জন্মায়ও না। যেসব প্রাণী সেই বন ছেড়ে চলে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। পরিবেশ চিরদিনের জন্য রীতিমতো পাল্টে যায়।
ছোটবেলায় একথা আমরা নিশ্চয়ই পড়েছি, এখনকার প্রজন্মও পড়ছে যে, মাটি থেকে গাছ- জল ও অন্যান্য পুষ্টি সংগ্রহ করে, আর সূর্য থেকে গ্রহণ করে শক্তি। গাছ এগুলো খাদ্যবস্তুতে রূপান্তরিত করে এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গাছ বাতাসকে অক্সিজেন দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলে, মানুষ আমরা সেই অক্সিজেনই গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকে গাছ যাতে প্রাকৃতিক শক্তি তাকে নড়বড় করে তুলতে বা দিতে না পারে। মানুষকে ছায়া, জ্বালানী, সৌন্দর্য, ফলফলারি, বিনোদনসহ অনেককিছুই উজাড় করে দেয় গাছ। ফলে শুধু একটি গাছকে লক্ষ্য করলে এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা হলেই পরিবেশ সংক্রান্ত অনেক জরুরি বিষয়ের আলোচনা করা সম্ভব।
আরও একটু বিশদভাবে ভেবে দেখুন তো, অনেক ধরনের পাখি এবং ছোট ছোট প্রজাতির প্রাণীর জন্য সুবিধাজনক আশ্রয়স্থল এবং অনেকটা প্রহরা হিসেবে কাজ করে যেন একটি গাছ। অন্যদিকে মানুষসহ অনেক প্রাণীর সাথে গাছের যে সম্পর্ক তা পরস্পরের পরিপূরক ও সহায়ক। ফলে গাছ কেটে ফেলা মানে পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় সামিল হওয়া। কারণ তাহলে গাছের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়াশীল পরিবেশের সব উপাদান বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আশ্রয় খোঁজা পাখি, পোকামাকড় ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণীরা গৃহহীন হয়ে পড়ে। মূল গাছের সাথে সংশ্লেষিত ছোট ছোট উদ্ভিদও মারা যায়। ফলে একটি গাছ কেটে ফেলা অর্থ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রচনায় সজীব ও নির্জীব সবকিছু ক্ষতিগ্রস্থ করা।
সজীব ও নির্জীবের বিষয়টা প্রসঙ্গত একটু ভেঙে বলাটা জরুরি। কারণ এই দু'টি বিষয় সরাসরি পরিবেশ ব্যবস্থার ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। পরিবেশ ব্যবস্থা বলতে শুধু পরিবেশের উপাদানসমূহকেই বোঝায় না, সেই উপাদানসমূহের পরস্পরের ক্রিয়া ও নির্ভরশীলতাকেও বোঝায়। তাই আমাদের চারপাশে বাস্তব জীবন থেকে দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে বুঝতে প্রয়াসী হতে হবে যে, কেমন করে পরিবেশের সজীব ও নির্জীব পদার্থ মিলে পরস্পর ক্রিয়াশীল হয়ে পরিবেশ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই বাস্তবসম্মত ধারণাগত ঘাটতি থাকার কারণেও আমরা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছি।
কখনো কখনো হয়তো কেউ লক্ষ্য করে থাকবেন, একটা পাথরের আশেপাশে ছোটছোট পোকা-মাকড় ছুটোছুটি করছে। দেখে মনে হবে পাথরখণ্ডটি যেন এইসব ছোটছোট প্রাণীদেরকে অনেকটা মায়ের মতো আগলে রাখছে, আশ্রয় দিচ্ছে। এইসব প্রাণীর ক্রিয়াকর্মে ও জলবায়ুর প্রাকৃতিক চাপে স্বাভাবিকভাবেই পাথর ক্রমে ক্ষয়ে যায়। ফলে এই পাথর থেকে যে খনিজ বের হয়ে আসে, সেটাই আবার মাটি থেকে গাছপালা তাদের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে থাকে। এরকম আরও অনেক উদাহরণই হয়তো দেয়া যেতে পারে। আর এভাবেই পরিবেশের সজীব ও নির্জীব উপাদান মিলেমিশে পরিবেশ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
পরিবেশ ব্যবস্থায় সজীব ও নির্জীব বস্তু প্রকৃতির প্রবহমান শক্তি ও পুষ্টি চক্রের সাথে সম্পৃক্ত। যে সজীব উপাদানের ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে একটি পরিবেশ ব্যবস্থায় শক্তি ও খাদ্য একে থেকে অন্যে সঞ্চারিত হয়, তাকেই আমরা খাদ্যশিকল বা পুষ্টিচক্র হিসেবে জানি। সকল জীব পদার্থ একটি খাদ্য শিকলের অন্তর্গত এবং একের অধিক বৃহৎ শিকলের অংশের সাথে যুক্ত। খাদ্য শিকলে জড়িয়ে আছে উৎপাদন ও ভোগকারী। খাদ্যের জন্য কিংবা খাদ্যের উৎসের জন্য উৎপাদনকারীর ওপর ভোগকারী স্বাভাবিকভাবেই নির্ভরশীল থাকে, যদিও তারা একই পরিবেশেই বসবাস করে থাকে।
উদ্ভিদ হচ্ছে উৎপাদনকারীর মাঝে অন্যতম। কারণ উদ্ভিদই একমাত্র সজীব প্রাণী যারা সরাসরি সূর্যকিরণ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম। এই যে প্রক্রিয়া তার নাম সালোকসংশ্লেষণ, যে প্রক্রিয়াটির কথা আমাদের নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটে থাকে। তাহলো, এই প্রক্রিয়া বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে আর প্রাণীর শরীর থেকে ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড উদ্ভিদ গ্রহণ করে থাকে। খাদ্য শিকলের মাধ্যমে খাদ্যের রূপে এই শক্তি অর্থাৎ অক্সিজেন কিন্তু অন্যান্য জীবও পায়।
ফলে উদ্ভিদের এই গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যমে অন্যান্য জীবের কাছে সৌরশক্তি যদি না পৌঁছাত, তাহলে কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যেতে না। ফলে এখানে প্রাণীরা হলো ভোগকারী। এর মধ্যে মানুষসহ তৃণভোজী এবং মাংসাশী প্রাণীরাও রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পরগাছা ও লতাপাতা।
চক্রের বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে আরও বলতে হয়, মৃতদেহ আবর্জনা পচে সবুজ খাদ্যের পুষ্টি আবার বিভিন্ন ধরনের জীবাণু, গলা ও পচা পাতা, ঝুরঝুরে মাটি, ছত্রাক ইত্যাদি হিসেবে মাটিতে ফিরে যায়। এগুলোই নির্জীব পদার্থের মূল উপাদান। খাদ্যের পুষ্টি এভাবেই যেন চক্রাকারে ফিরে আসে। আর এই শিকলে এ সবই কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ বা উপাদান।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কোন একটি মাঠে ঘাসই হয়তো খাদ্য শিকল যোগানোর কাজ করতে পারে। ঝিঁঝিঁ পোকা কিন্তু ঘাস খায়, ব্যাঙ আবার ঝিঁঝিঁ পোকাকে খেয়ে ফেলে, সাপ আবার ব্যাঙকে খায়। অন্যদিকে একটি বাজপাখি সাপ ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। মরা-পচা জীবকে আবার শুকুন খেয়ে ফেলে। এইরকম খাদ্য শিকলের মাঝেই কিন্তু মাটিতে ও বাতাসে মূল উপাদানসমূহ ফিরে ফিরে আসে, আর ভোগকারী সেসব ব্যবহার করে থাকে।
এত আলোচনার অবতারণা এই জন্যে যে, পরিবেশের এই খাদ্যশিকল বিপর্যস্ত হওয়ার ফলাফল কিন্তু খুব ভয়াবহ হতে পারে। সেই ভয়াবহতাটাকেই আবারও সবার সামনে নিয়ে আসা। প্রাণী জগতে এক শ্রেণির সাথে অন্য শ্রেণির সুষম বৃদ্ধি ব্যহত হলে পুরো পরিবেশ ব্যবস্থাই ভেঙে যেতে পারে। আমরা জানি ব্যাঙ সাধারণত পোকামাকড় খেয়ে ফেলে। ফলে কোন এলাকায় ব্যাঙের যদি ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তখন অন্যান্য পোকামাকড় বেড়ে যাবে। একইভাবে কুকুর ও বিড়ালের কথা বলা যেতে পারে। এসব প্রাণীরা যদি কোন নির্দিষ্ট এলাকায় কমে যায় কিংবা না রাখার ব্যবস্থা ও পরিবেশ গড়ে তোলা হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ইঁদুরের প্রকোপ বেড়ে গিয়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিতে পারে। সুতরাং স্বাভাবিক এই শৃঙ্খলা রক্ষা না হলে বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়, ফসল উৎপাদনও কমে যায়। ফলে পরিবেশের এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, প্রত্যেককে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে, আমাদের কোন কার্যকলাপ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না তো?
আমাদের নিজ এলাকা, আমাদের চারপাশকে ভালোভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের স্থানীয় পরিবেশ সুরক্ষা করাটা আমাদের জন্য সবচাইতে জরুরি। এটাও মনে রাখতে হবে যে, এর সাথে বৃহৎ বিশ্বপরিবেশেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সবার আচরণ পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। পরিবেশ গড়ে ওঠার বিষয়টি এবং বদলে যাবার কিংবা নষ্ট করার বিষয়টিও আমাদের তাই সচেতনভাবে খেয়াল করতে হবে, অনুভব করতে হবে।
পরিবেশের পরিবর্তন আনা মানুষের দ্বারাও সম্ভব আবার প্রকৃতির দ্বারাও সেটা হতে পারে। বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় নিমেষে যেমন মাটির বড় পরিবর্তন করে দিতে পারে। অন্যদিকে উন্নয়নের নামে গাছ কেটে বনভূমি ধ্বংস করে ছায়াশীতলতা, মনোরম পরিবেশ, প্রাণীর আবাসভূমি নষ্ট করছি এবং মানুষের জীবনধারণকেও আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলছি, ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। মানুষের দ্বারা সম্ভব ক্ষতিসমূহ বেশি হলে তা প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে দেয়।
ফলে, একটা বিষয় আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে, সেটা হলো পরিবেশের অনেক ধরনের পরিবর্তন কিন্তু সহজে ঠিক করা যায় না। গাছ কেটে বনভূমিতে নতুন গাছ লাগালেই পরিবেশের যে নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হলো, তা সহসাই ঠিক করে ফেলা যায় না। প্রসঙ্গত তাই বলতেই হয়, দেশের উন্নয়নের সাথে পরিবেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জড়িত। আর পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও দরকার। জাতিসংঘের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারেই মোট বনভূমির পরিমাণ এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
বনভূমি দখল ও গাছপালা কেটে ফেলার এই প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলে আসছে। এটি থামার কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। বরং বনভূমি উজাড় হয়ে যাবার প্রবণতা কয়েক বছর ধরে অনেক বেড়ে গেছে। ফরেস্ট ওয়াচ নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরেই উজাড় হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার একর বনভূমি। অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত ১৩ বছরে যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ উজাড় হয়েছে সর্বশেষ পাঁচ বছরে। এই হারে বনভূমি শেষ হয়ে যেতে থাকলে দেশের বনভূমির পরিমাণ আরও অনেক কমে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু বনভূমি কমে যাওয়া তো নয়। এর সাথে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল প্রত্যেকটি বিষয় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। আমরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি কিন্তু টের পাচ্ছি না, দেখতে পাচ্ছি না।
আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বড় ধরনের ক্ষতি চোখের সামনে আসা ছাড়া, চলমান ক্ষতি আমরা উপলব্ধিতে আনতে পারি না। কিন্তু চারপাশে এতসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ এত প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যার সামনে আসছে, তারপরও আমরা কেন উপলব্ধিতে আনতে পারছি না?
প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট-২০২০-এর কথা। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের সেই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ৫০ বছরেরও কম সময়ে দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ প্রাণী হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যে প্রাণী, পাখি এবং মাছও রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রসঙ্গে এটাও বলেছেন যে, বনভূমি উজাড়ের কারণে মানুষের ওপর যে প্রভাবগুলো পড়ছে, তার অন্যতম হলো প্রাণীর শরীর থেকে বিভিন্ন অসুখ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া। বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, এই বনভূমি উজাড়ের কারণেই ইবোলা, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়া অসুখ বাড়ছে। এসব অসুখ ছড়িয়ে পড়া রোধে সত্যিকার অর্থেই ভূমিকা রাখে বনভূমি (সূত্র: প্রথম আলো ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)।
সত্যিই বিপর্যস্ত একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। এই সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে নিজেরা রক্ষা পাবো না, ভবিষ্যতও প্রজন্মকেও সুরক্ষিত রাখা এবং সুস্থ ও সুন্দরভাবে তাদেরকে গড়ে তোলাটা সম্ভব হবে না।
তাই বলাবাহুল্য যে, বনভূমির তদারকি ব্যবস্থা জোরদার ও কার্যকরী করাটা খুবই জরুরি। যতই রাজনৈতিক প্রভাব থাকুক ও ক্ষমতাশালী হোক না কেন, অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদেরকে দমন করতে হবে, বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের যে কোন ধরনের অসাধু আচরণ শক্তহাতে বন্ধ করতে হবে। আর সবচাইতে জরুরি হবে- বেদখলে থাকা ও চলে যাওয়া বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সাহসের সাথে পরিচালনা করা এবং যারা ঐ সকল বনভূমি বেআইনিভাবে দখল করেছে, তাদের দিয়ে তাদেরই খরচে ঐ ধ্বংসপ্রায় বনভূমিতে পুনর্বনায়ন ও পুনরুদ্ধারের জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা নিশ্চিত করা।
পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করতে আমরা দেখেছি। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বদলে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আমরা অনেকসময় শুধু অভিযান পরিচালনা করতে এবং পরিবেশ আদালতে মামলা করতেই দেখেছি। যা সত্যিই দুঃখজনক।
ফলে এই রচনার মধ্য দিয়ে বনভূমি রক্ষার জন্য সুস্পষ্টভাবে কিছু প্রস্তাবও আমি রাখতে চাই। সেই প্রস্তাবগুলো হলো:
১) পাহাড়ের গা সম্পূর্ণ অনাবৃত করে ফসল আবাদের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে এবং বনভূমি থেকে টেকসইভাবে সম্পদ আহরণকে উৎসাহিত করতে হবে। অবৈধ বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে, যেসব এলাকায় বন ও আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার ভিত্তি, সেসব এলাকায় তা জরুরিভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে;
২) সকল বনভূমি এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের অনুমতি প্রদান বন্ধ করতে হবে এবং পূর্বে স্থাপিত শিল্প কারখানাগুলোকে অন্যত্র স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে; গৃহস্থালী ও সামাজিক বনায়নকে উৎসাহিত করতে হবে,
৩) রাস্তা ও বড় সড়কের দুই পাশে, নদীর দুই পাড়ে গাছ লাগাতে হবে; বিশেষত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় গাছ রোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে, যাতে তা ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে;
৪) গৃহস্থালী ও সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রজাতির গাছের উপর নির্ভর করতে হবে। বিদেশী প্রজাতির গাছ যেমন: একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি মারাত্মক ক্ষতিসৃষ্টিকারী গাছ লাগানো চিরতরে বন্ধ করাতে হবে এবং স্থানীয় প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যেসব গাছ পূর্বে লাগানো হয়েছে সেগুলো তুলে ফেলতে হবে;
৫) সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। সে লক্ষ্যে বন-দখল, অবৈধ এবং অতিরিক্ত গাছ নিধন এবং কাঠ আহরণ, চোরাইভাবে পশুপাশি নিধন, চিংড়ি ঘের তৈরি ও অন্যান্য ক্ষতিকর বনভূমি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বন্ধ করতে হবে এবং সুন্দরবনকে পূর্বের সীমানায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সুন্দরবনে সব ধরনের কলকারাখানা স্থাপন বন্ধ রাখতে হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বড় যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে।
এসবের পাশাপাশি সবার জন্য পরিবেশ শিক্ষা প্রয়োজন হবে। জনসাধারণকে এসব বিষয়ে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন হবে। ছোট ছোট প্রয়োজন মেটাতে কীভাবে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে তা করতে হবে তা ছোটবেলা থেকেই সবাইকে জানাতে হবে।
সর্বোপরি, বনভূমি রক্ষা, পরিচর্যা ও প্রসারের লক্ষ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যে সকল এলাকায় আদিবাসীরা বসবাস করেন, সেসব এলাকায় তাদের উপরই বন রক্ষার মূল দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। সামাজিক বনায়নের সুরক্ষা এবং পরিচর্যায় স্থানীয় ভূমিহীন ও দরিদ্রদের এমনভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে যাতে তারা সামাজিক বনায়নের সুফলের ভাগিদার হতে পারেন।
এমনসব জরুরি বিষয়সমূহ যদি আমরা পরিকল্পিতভাবে গুরুত্ব সহকারে নিশ্চিত করতে পারি, তাহলেই হয়তো আমাদেরকে বনভূমির হ্রাস এবং অবক্ষয়ের প্রবণতা কিছুটা হলেও রোধ হবে। আর সেই প্রবণতা রোধ করেই দেশের মোট ভূমির নূন্যতম ২৫ শতাংশকে বনের আওতায় আনার লক্ষ্যের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়াটাই আমাদের এই সময়ের সবচাইতে বড় অগ্রাধিকার হোক!