Published : 20 Sep 2020, 06:02 PM
পেঁয়াজ নিয়ে বাজার গরম। গরম রাজনীতিও। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেই কি হয়েছে আসলে? পেঁয়াজ কেন আবারো চলে এলো সংবাদ শিরোনামে? সোমবার যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা এলো, তখন পেট্রাপোল বন্দরে পেঁয়াজবোঝাই পাঁচটি ট্রাক আটকা পড়ে। এসব ট্রাকের গেটপাস থাকলেও এখন আর এপারে আসার অনুমতি দিচ্ছে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বনগাঁয় আরও ৩৯টি ট্রাক এবং রানাঘাট রেলস্টেশনে তিনটি রেল ওয়াগন পেঁয়াজ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত এক সপ্তাহ আগে রেলের এই পেঁয়াজগুলো ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে রানাঘাট স্টেশনে আনা হয়। ওয়াগনগুলো সরাসরি বেনাপোলে আসবে না; সেখান থেকে ট্রাকে তুলে বেনাপোল আনার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর সেগুলো আটকা পড়ে বলে জানান বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান।
তিনি বলেন, "আটকে থাকা এসব পেঁয়াজে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে বলে রপ্তানিকারকরা আমাকে জানিয়েছেন।" (১৮.০৯.২০২০, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
তার মানে এই পেঁয়াজ আসার ব্যাপারটা অনিয়মতান্ত্রিক বা অজানা কিছু ছিল না। ভারত এই কাজটি আগেও একবার করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে কারণেই হোক না কেন আমরা পেঁয়াজে স্বনির্ভর হতে পারছি না। আর সে পরনির্ভরতার সুযোগ নিচ্ছে পাশের দেশ। অথচ আমরা খবরে দেখলাম ইতোমধ্যে পূজার আগেই ইলিশ পৌঁছে গেছে ওপার বাংলায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের মানে আমাদের দেশের এই জাতীয় আচরণের কারণ বুঝি না। সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে বোঝা ভার তারা আসলে কী চান? মাত্র কিছুদিন আগে ভ্যাকসিন নিয়ে দেখলাম নানা নাটক। একবার বলা হচ্ছে বাংলাদেশে চীনের ভ্যাকসিন দিয়ে শুরু হবে কোভিড রোগীদের নিরাময় প্রক্রিয়া। তারপর দেখলাম বদলে গেল দৃশ্যপট। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এলেন, কথার সুরও পাল্টালো। আওয়ামী নেতা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো বলল তারা ভ্যাকসিন নেবে ভারত থেকে। এমন নাটক ও নতুন কিছু না। মনে হয় এ আর কি? মানুষ তো মানুষ না, তারা গিনিপিগ। কোনো এক ভাবে তাদের দিয়ে কিছু একটা করা গেলেই হলো। অন্যদেশকে খুশি করতে গিয়ে কে মরবে কে বাঁচবে তার খবর কে রাখে?
পেঁয়াজ নিয়ে শুরু এবারের রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেবে জানি না। তবে ইতোমধ্যে দেখলাম বিএনপি রাস্তায় না নামলেও তাদের ঘনিষ্ঠজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নেমে পড়েছিলেন। ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে সাবধান করা ভাষণের মেয়াদকাল কত জানেন? মাত্র আড়াই মিনিট। এর ভেতরেই তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। তারপর যা করার বলার সবকিছু চলে যায় মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে। মান্না এখন যা বলেন আর যা করেন তার ভেতর কোনো নতুনত্ব নাই। তাই পেঁয়াজ সংকটে তাদের চিৎকার বা চেঁচামেচির পরিণাম হবে শূণ্য।
সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পেঁয়াজের হাহাকার কমানোর পরিবর্তে রাজনীতি কোনো সমাধান দেবে না। এটা আমরা অতীতের দিকে তাকালেও দেখব। মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা নিয়ে বহুকাল আন্দোলন করেছিলেন। আন্দোলানের নামে আরো কত নাটক, মিছিল কত ধরনের কত কিছু হয়েছিল কিন্তু ফারাক্কা সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং সময়ের চাপে কোথায় যেন তলিয়ে গেছে সে সমস্যা। উঠে এসেছে তিস্তার পানিবন্টন সমস্যা। সমাধান কিন্তু কখনো মেলেনি। ভারতের এই স্বেচ্ছাচারিতা নতুন কিছু না। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে দিল্লিতে ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি এখন তরকারিতে পেঁয়াজ দেন না, পেঁয়াজ ছাড়াই রান্না করেন। এই সতর্কবানী বা হতাশার কারণ আমরা সবাই জানি।
কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি কমানো গেল না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে বাংলাদেশের যে গর্ব তার সাথে পেঁয়াজের যোগ না হওয়াটা বিস্ময়ের। কারণ পেঁয়াজও খাদ্য বৈকি। আমরা এই জায়গায় পরিপূর্ণভাবে একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বসে আছি। আর তার সুযোগ নিচ্ছে পাশের দেশ ভারত। মনে আছে যেবার তারা প্রথম ঘোষণা ছাড়া পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল সেবার বাংলাদেশ অমিত্র বলে পরিচিত পাকিস্তানের কাছ থেকে তড়িঘড়ি করে পেঁয়াজ আনলেও পরে আবার ভারতের কাছে ফিরে গেল। এই আসা-যাওয়া কূটনীতির বেলায় যতটা চমকপ্রদ অর্থনীতির বেলায় ততটাই হতাশাজনক। কারণ এতে পাকিস্তান যেমন বেখুশি তেমনি ভারত ধরে নিল বাংলাদেশকে তার কাছেই ফিরতে হবে। ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে পেঁয়াজের গুরুত্ব অপরিসীম। কংগ্রেসের গদী হারানো নির্বাচনেও এই পেঁয়াজের ঝাঁজ ছিল। এখন মোদী সরকার তার ঝাঁজ ঘাড়ে পড়ার কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ। সাউথ ইন্ডিয়া ও নর্থ ইন্ডিয়ায় প্রচুর মানুষ পেঁয়াজ খান না বটে তবে তাদের জনসংখ্যা অনুপাতে পেঁয়াজ খাবার মানুষও চমক লাগানো। বলাবাহুল্য তারা সে চাহিদা মিটিয়েই আমাদের দেবে। সাথে আছে মোদীর চমক লাগানো রাজনীতি। নোটিশ ছাড়া রপ্তানি বন্ধ তারই উৎকট নমুনা।
কথা হচ্ছে আমরা কিন্তু কিছুতেই বুঝি না। কারণ আমাদের রাজনীতিতে কোনো দৃঢ়তা নাই। নাই কোনো শক্ত অবস্থান। বছর বছর মানুষের দুর্ভোগ বা পেঁয়াজের জ্বালায় চোখের পানি নাকের পানি একাকার হলেও রাজনীতির কিছু যায় আসে না। কারণ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল নাই। একমাত্র সরকারি দল ছাড়া বাকীদের কোনো খবর নাই। তাদের কোনো খবর করার সুযোগও নাই। এহেন পরিস্থিতিতে বিএনপির রিজভি পলিটিক্স যতই মুখে বলুক লাভ হবে না, কাজের বেলায় ঠনঠনে। আওয়ামী লীগের সাফল্য যেমন অনেক তেমনি পেঁয়াজের মতো নানা ইস্যুতে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষ করোনাভাইরাস সমস্যায় জর্জরিত। এর ভেতরে নাকি খিচুড়ি রান্না শিখতে একগাদা লোকের আমাদের অষ্ট্রেলিয়ায় আসার কথা। এরা পারেও বটে। প্রশ্ন করি কী শিখবে এরা? পেঁয়াজ ছাড়া খিচুড়ি রান্না? পেঁয়াজের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে মানুষের কষ্ট লাঘব করার কথা চিন্তা করুন। এইসব উটকো লোককে বিদেশে পাঠিয়ে সরকারি তথা জনগণের টাকার অপচয় করবেন না।
ভারত বিষয়ে আমাদের দুর্বলতা পরিহার করতে হবে। ইলিশ পাঠানোর ভেতর যদি বাণিজ্যিক বুদ্ধির পাশাপাশি কোনো সহানুভূতি বা কৌশল থাকে তো তা ভুল। কারণ ভারতের ব্যবসায়ী তো দূরের কথা বাংলার মমতা দিদিরও মন গলবে না। তারা তাদের দেশের স্বার্থে সবাই এক। আমরাই দ্বিধা বিভক্ত। আমার মতে ভারতকে এ বিষয়ে উপযুক্ত জবাব দেয়ার এটাই সময়। রাজনীতি তা পারবে কি না জানি না। কিন্তু মানুষ পারবে। তাদের সামনে পেঁয়াজের বিকল্প থাকলে বা বিকল্প দেশের যোগান থাকলে তারা ভারতীয় পেঁয়াজের ঝাঁজ কমিয়ে দিতে জানে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?