Published : 13 Sep 2020, 01:34 PM
নিকট অতীতেও শরৎ ছিল অবকাশ যাপন, তালের পিঠা ও পাগলা হাওয়ার ঢেউ খেলানো কাশবনের ঋতু। পাকা তালের মোহনীয় ঘ্রাণ যেনো পূর্বাহ্ণেই এর আগমনী বার্তা সগৌরবে প্রচার করে। আহ্নিক গতির প্রভাবে বাংলা-প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চের ভোরের পর্দা সরিয়ে সূর্যোদয়ের মতোই হাজির হলো বঙ্গাব্দের পঞ্চম তনয়া। লোকজ ভাষায় যার আরেক নাম 'ভাদ্দর।'
'তালপাকা গরম আর মোলায়েম সফেদ কাশফুল এ মাসের সমার্থক। সময়ের আবর্তে আশ্বিনের অগ্রজের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি। এর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য কালিমাখা মেঘ নীল আকাশের সীমানা থেকে পালাই পালাই করে। পানিহারা পেঁজা পেঁজা মেঘের টুকরো ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। অবিরাম বর্ষণের ঝম্ ঝম্ শব্দ থাকে না। সূর্য রশ্মির খরতায় অসহনীয় গরম বিরাজ করে সর্বত্র। বৃক্ষমুণ্ডের তালগুলো পেকে কালচে লাল রং ধারণ করে। জর্দা রঙ্গা শিউলি ফুল ফোটে দেহে স্নিগ্ধতার আমেজ মেখে। নদীর কূলে কূলে কাশবনের মায়াবী আমন্ত্রণ। দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দস্যিপনায় মেতে ওঠে। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণেই কিনা জানি না, কাশবনও যেনো অন্যরকম অভিমান করেছে!
তবে অসহনীয় ভ্যাঁপসা গরম ভাদ্র মাসের চরিত্রে যেন স্থায়ী কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপির, বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগের যেমন অভিযোগের কোনো শেষ নেই, ভাদ্রকে নিয়ে আধুনিক মানুষেরও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। কথায় আছে ভাদ্রের গরমে তাল পাকে। তাল নিয়ে আধুনিক মানুষের অবশ্য খুব একটা আগ্রহ নেই। তালের পিঠার বাজার দরও খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। তবে এই গরমে সবার বেতাল অবস্থা। ভাদ্রমাস শুরু হবার পর থেকেই প্রচণ্ড গরমে জনজীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রখর রৌদ্রের উত্তাপ দেশবাসীকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
ভাদ্রমাসের গরম প্রাচীন কাল থেকেই সুবিখ্যাত। এই গরমে মানুষ তো বটেই, কুকুর পর্যন্ত বেতাল হয়ে পড়ে। কুকুরের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। এ মাসে কুকুর সমাজের একটা বড় অংশই গরমে দিশেহারা হয়ে যায়। মানুষ সতর্ক হয়। গ্রামগঞ্জে এখনো কুকুর দেখে গরমের তীব্রতা অনুমান করা হয়। মাঝেমাঝে দেখা যায় কোনো জলাশয়ে কুকুর নেমে পড়লে ছেলেমেয়েরা সেই জলাশয়ে গোসল করতে নামতে ভয় পায়। তখন দুষ্ট বালক-বালিকার দল ঢিল ছুঁড়ে মেরে কুকুরটাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কুকুর অনমনীয়। নড়াচড়ার কোনো নামই নেয় না! ভাদ্রের গরম বলে কথা!
ভাদ্রমাসটা আসলে বিরক্তিকর একটা কাল। ভাদ্র মানেই বেড়াজাল শুভ কাজ নাস্তি, পায়ে পায়ে বাধা-বারণ। কবিরা পর্যন্ত এই মাসটাকে উপেক্ষা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবু এর অন্য রূপও আছে। ভাদ্র বাদ দিয়ে যখন আমরা ভাদর উচ্চারণ করি তখনই ছলোছলো একাকীত্ব, টইটম্বুর বিরহ আর অব্যক্ত ছটফটানি এসে ভিড় করে। এমন ধারা কেন?
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর…। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী এক ঝড়বৃষ্টির দিনে তাঁর অন্তরঙ্গ দেবর রবিকে বিদ্যাপতির এই লাইনটিতে সুর বসাতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিক ভাবে তাতে মিশ্র মল্লারের সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেন। বিদ্যাপতির প্রভাবে রবি তখন হয়েছেন ভানুসিংহ, রচিত হচ্ছে অপূর্ব সুন্দর ভানুসিংহের পদাবলী। আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে এ এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
আমরা আগে শুনতাম, 'ধারার শ্রাবণ, পচা ভাদ্র', অর্থাৎ শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয় জোরালো, ভাদ্র মাসে টিপ টিপ, সেই জন্য ভ্যাপসা গরমও চলে। কিন্তু আবহাওয়া এখন অনেক পালটেছে, কোনও কোনও ভাদ্র মাসেও প্রবল বৃষ্টির তোড়ে নদীনালা উপচে ওঠে, কোথাও কোথাও বন্যা হয়। আমাদের দেশেও কোথাও কোথাও হচ্ছে।
খুব সম্ভবত এমন 'চরিত্র-দোষের' কারণেই শরৎকাল হিসেবে আশ্বিন যতটা মান্যতা পেয়েছে, ভাদ্র তেমন পায়নি। নামটাও কেমন কর্কশ। এ কারণেই কী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছোটভাইয়ের স্ত্রীকে ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দর-বউ বলে? কবিরাও এই মাসের উল্লেখ এড়িয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ অজস্র বর্ষার গান লিখেছেন, আষাঢ় ও শ্রাবণের উল্লেখ অজস্র, তার পরই ভাদ্রকে টপকে চলে গেছেন আশ্বিনে। যেন তিনি এই মাসের ভাসুর! যত দূর মনে পড়ে, তার একটিমাত্র গানে এই রকম আছে, 'আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা ভাদরে।' এখানেও তিনি বিদ্যাপতির মতন ভাদ্রকে ভেঙে ভাদর করেছেন। তিনি ওই মাসটির প্রতি সেই প্রথম যৌবনের পর আর তেমন মন দেননি, এ কথা বলা যেতেই পারে।
এদিকে ভাদ্র মাসের প্রাকৃতিক উত্তাপ বাজারেও ছড়িয়েও পড়েছে। বন্যার ধাক্কায় দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের শাক-সবজি। রাজধানীতে প্রতি কেজি ৬০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজি নেই। কিছু কিছু সবজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকায়। যে পুঁইশাক ২০ টাকার বেশি বিক্রি হত না, তার দাম এখন ৪০ টাকা বা তার বেশি। ৫-১০ টাকার লাল শাকের আঁটি এখন ১৫-২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
শাক-সবজির এই দামের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে চালের বাড়তি দাম। ঈদের পরে কেজিতে অন্তত দুই টাকা করে বেড়েছে সরু ও মোটা চালের দাম।
প্রায় এক মাস ধরে দাম এভাবে ঘোরাফেরা করছে। কোনো কোনো দিন কেজিতে ১০ টাকা এদিক সেদিক হচ্ছে। এদিকে কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়ছে পেঁয়াজ, রসুন, আদার। আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে দেশে উৎপাদিত এসব পণ্যের দামও বাড়ছে। অথচ দেশি এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির তেমন কোনো কারণ নেই। এক হিসেব মতে, দেশের চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ হয় দেশি পেঁয়াজ দিয়ে। ৪০ শতাংশ আনতে হয় আমদানি করে, যার বেশির ভাগ আসে ভারত থেকে। সে হিসাবে দাম বাড়ার কথা শুধু আমদানি করা পেঁয়াজের, কিন্তু দাম বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের। অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বাজার শাসন করছে ৬০ শতাংশের বাজারকে।
আমাদের দেশে অবশ্য দাম বাড়ার জন্য কোনো কারণ দরকার হয় না। জিনিসপত্রের দাম বাজেটের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। ঝড়, বৃষ্টি হলে বাড়ে, না হলেও বাড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বাড়লেও বাড়ে। রমজানের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমলেও আমাদের দেশে দাম কমে না। এমনকি দেশে বাম্পার ফলন হলেও খাদ্যশস্যের দাম কমে না। মানুষের বয়সের মতো, আমাদের জীবনের সামগ্রিক হতাশার মতো জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে।
দাম আপনা-আপনি বাড়ে না, বাড়ানো হয়। বলা বাহুল্য, এ দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতির ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও বড় বেশি ক্ষোভ নেই। এরও অবশ্য কারণ আছে। আমাদের দেশের শাসকরা নানা কৌশলে মানুষের সহ্যশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে যদি একটু একটু করে নির্যাতন করা হয়, আঘাত করা হয়, তাহলে এক সময় তা সয়ে যায়। এরপর আঘাতের মাত্রা বাড়ালেও খুব একটা ভাবান্তর হয় না। আমাদের দেশের মানুষকেও একটু একটু করে আঘাত ও নির্যাতন চালিয়ে সর্বংসহা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন মানুষ ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেও খুব একটা বিক্ষুব্ধ হয় না।
বিক্ষুব্ধ হয়েই বা লাভ কি? বিক্ষোভেই কি আর প্রতিকার মেলে? করোনাভাইরাস আমাদের জীবনে এত সর্বনাশ করলেও এর বিরুদ্ধে কোথাও কেউ কি বিক্ষোভ করেছে? বরং যে যেভাবে পারছে, মানিয়ে নিচ্ছে। সরকার এবং তাল-পাকা-গরমটাকেও আমরা তো মেনেই নিয়েছি!
নিশ্চয়ই গরম শেষে একদিন শীত আসবে!