আদালতে ছয়টি কারণ দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা; শুনানি নিয়ে বিচারক তিন দিন মঞ্জুর করেন।
Published : 02 May 2024, 05:03 PM
আশ্রমের বাসিন্দাদের জাল মৃত্যু সনদ তৈরির অভিযোগে মিরপুর মডেল থানার মামলায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশনের’ প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগরক হাকিম তোফাজ্জল হোসেন রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালতে ছয়টি কারণ দেখিয়ে সাত দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক কামাল হোসেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে রিমান্ড নাকচ ও জামিনের আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে বিচারক তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু। আসামিপক্ষে আইনজীবী আব্দুস সালাম শিকদারসহ আরো কয়েকজন আইনজীবী ছিলেন।
সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ কিংবা শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করার ছবি-ভিডিও শেয়ার করে আলোচনায় আসা মিল্টন সমাদ্দারকে বুধবার সন্ধ্যায় মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গত কয়েকদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্রের নামে তার অনিয়মের খবর প্রকাশ হতে থাকলে ফের তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপরই তৎপর হয় পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিজের আশ্রমের মারা যাওয়া ব্যক্তিদের সিটি করপোরেশনের সনদ ছাড়াই রাতের বেলায় দাফন করতেন মিল্টন। এক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সিটি করপোরেশনের নকল সিল দিয়ে মৃত্যু সনদ তৈরি করে রাখতেন।
সিটি করপোরেশনের সিল ও স্বাক্ষর নকল করে মৃত্যু সনদ তৈরির এ অভিযোগেই মিরপুর মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর আদালতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। মিল্টনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ছয়টি কারণ উল্লেখ করেন তিনি।
এগুলো হল- ১. ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টার’ নামে সেবা প্রতিষ্ঠান খুলে মানবতার ফেরিওয়ালা পরিচয়ে অজ্ঞাত, ওয়ারিশহীন ব্যক্তি, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও সেবার কথা বললেও ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া সংক্রান্ত সঠিক তথ্য উদঘাটন প্রয়োজন।
২. আসামি দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০টি মৃত্যু সনদ দিয়েছেন। এতে আসামির অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আছে কি না? মৃত্যুর সঠিক কারণ ও তার তথ্য-উপাত্ত উদঘাটন প্রয়োজন।
৩. আসামি নিজে ডাক্তার না হয়ে ডাক্তার হিসাবে পরিচয় দিতেন। আদৌ তার ডাক্তারি সনদ আছে কি না, যাচাই প্রয়োজন।
৪. আসামির সহযোগী অন্যান্য আসামিদের শনাক্তসহ নাম, ঠিকানা সংগ্রহ এবং গ্রেপ্তারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।
৫. চিকিৎসা সেবার নাম করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে কোনো ভুক্তভোগী হত্যা এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করেছেন কিনা, সেই তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন।
৬. অজ্ঞাত শিশুদের আইনানুগ অভিভাবকদের না জানিয়ে পাচার করেছে কি না, সেটি জিজ্ঞাসাবাদে জানা প্রয়োজন।
শুনানিতে যা হল
রিমান্ড শুনানিতে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, “মিল্টনের ফেইসবুক ফলোয়ার বিপুল। তিনি নিজে ডাক্তার না হয়েও ভূয়া মৃত্যু সনদ দিতেন। বিভিন্ন মিডিয়াসহ কালবেলা পত্রিকায় আসামির প্রতারণা, জালিয়াতির ঘটনাটি প্রচার হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”
মিল্টনের আইনজীবী আব্দুস ছালাম সিকদার তখন বলেন, “মিল্টন চিটিং কার সঙ্গে করেছে? পুলিশের সঙ্গে? প্রসিকিউশনতো চিটিংয়ের বিষয়ে কোনো কাগজ, কোনো প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারল না। আমরা যদি বিষয়টি পজিটিভলি দেখি, তাহলে দেখাব মিল্টন রাস্তা থেকে দুঃস্থ, অসহায়কে তুলে নিয়ে তার হোমসে নিয়ে শেল্টার দিতেন।
“অসহায় মানুষকে যিনি একমুঠো ভাত তুলে দিতেন, তাকে কি মানবতার ফেরিওয়ালা বলা যাবে না? ইয়োর অনার, এখানে এখানো মন্দের থেকে ভালো লোক বেশি রয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থের উপরে উঠে তিনি এসব কাজ করেছেন। তাতে যদি তার কোনো ভুল ত্রুটি হয়, তার জন্য মামলা কেন? ভালো কাজকে সবার অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিৎ। প্রতারণা জালিয়াতির অভিযাগ ডাহা মিথ্যা। এটা জলজ্যান্ত হয়রানি। কি করে তার সমাজকর্ম দণ্ডবিধির ৪০৬/ ৪৬৭/ ৪৬৮/ ৪৭১ ধারার অপরাধ হল? আর যদি তাই হয়, তবে এতদিন পুলিশ কোথায় ছিল?”
তদন্ত সংস্থা ডিবিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে মিল্টনের আইনজীবী বলেন, “৫০টির বেশি লাশের মৃত্যু সনদ দিযেছেন মিল্টন। কোনো সনদ কি রাষ্ট্রপক্ষ বা তদন্ত কর্তা দেখাতে পারবেন? তিনি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিতেন এ কথা কি কেউ বলতে পরেবে? আজ পর্যন্ত তিনি নিজেকে ডাক্তার বলেননি। জালিয়াতি করেছেন– এই ভৌতিক কথাবার্তার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি মাদার তেরেসাকে অনুসরণ করতেন। এখানে ক্রিমিনাল মোটিভ ছিল না।”
এ আইনজীবী দাবি করেন, রাস্তায় জায়গা নিয়ে এক লোকের সঙ্গে মিল্টনের দ্বন্দ্ব ছিল। তার জেরে সেই লোকের পক্ষ হয়ে একটি পত্রিকা মিল্টনের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ লিখেছে।
বিচারক তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীর কাছে জনতে চান, “এই মামলার সঙ্গে ওই মামলার সম্পর্ক কী?”
মিল্টনের আইনজীবীর তখন বার বার অন্য মামলার বিবরণ দিয়ে বলেন, অন্য আদালতে ওই মামলার শুনানি চলছে।
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মিল্টনকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি যে মানুষের চিকিৎসা দিতেন, আপনার প্রতিষ্ঠানে তার কোনো ইনফাস্ট্রাকচার ছিল? আপনাদের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক ছিল?”
তদন্ত কর্মকতার জমা দেওয়া কিছু ছবি দেখিয়ে বিচারক বলেন, “এই যে ছবিগুলো ফেইসবুকে আপলোড করা হযেছে। সেগুলো তো মারাত্মক ছবি। আপনার ওখানে কতজন মৃত্যুবরণ করেছেন?”
মিল্টন উত্তর দেন, “আমরা হাসপাতালে নিয়ে দুঃস্থ রাস্তার মানুষদের চিকিৎসা দিই। ১৩৫ জন মারা গেছেন। কবরের সার্টিফিকেট আছে। আমি কখানোই ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ডাক্তার হিসাবে ওইসব সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর দিইনি।”
বিচারক প্রশ্ন করেন, “আপনার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে? আগে কতজন লোককে সেবা দিতেন?”
উত্তর আসে, “সমজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন রয়েছে। রাস্তার লোকদের যাদের কেউ দায়ত্ব নেয় না, আমরা দায়িত্ব নিই। হাইকোর্টেও আমরা একই কথা বলেছি। আগে সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল। এখন বেশি।”
বিচারক প্রশ্ন করেন, যে ‘কাগুজে’ মৃত্যু সনদ পুলিশ উদ্ধার করেছে সেখানে কার স্বাক্ষর আছে?
মিল্টন বলেন, “আমাদের ডাক্তার ইবনে সিনা হাসপাতালের। আমরা তার সঙ্গে রেগুলার যোগাযোগ রাখতাম। তিনি ডায়াগনসিস করতেন, চিকিৎসা করতেন। ডেথ সার্টিফিকেট আমি দিতাম না।”
এক সময় মিল্টনের আইনজীবীরা সমস্বরে বলে ওঠেন, কাজ করতে গেলে ‘ভুল ত্রুটি থাকবেই’।
এর পর বিচারক মিল্টনের প্রতিষ্ঠানের আয় ও ব্যায় সম্পর্কে জানতে চান। মিল্টন বলেন, “আমাদের বার্ষিক অডিট হয়। সমাজ ক্যালাণ মন্ত্রণালয় অডিট করে থাকে।”
এ পর্যায়ে বিচারক বলেন, “ঘটনাটি খুব সিরিয়াস। বিষয়টি নিবিড় তদন্তের দাবি রাখে।”
এই কথা বলার পর বিচারক মিল্টনের জামিন আবেদন নাকচ করে দেন এবং হাই কোর্টের বিধান অনুযায়ী সতর্কতার সঙ্গে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।
আরো পড়ুন-
মিল্টন মরদেহ দাফন করতেন রাতে, দিতেন ভুয়া সনদ: ডিবি
গ্রেপ্তার মিল্টন সমাদ্দার, 'অনিয়ম-অভিযোগ' নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি