Published : 27 Jul 2020, 01:20 PM
একটা পুরোনো গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। সে অনেক দিন আগের কথা। হরেনবাবু নিজের গ্রাম ছেড়ে দূরে এক শহরে চাকরি করেন। একদিন হঠাৎ দেখলেন অফিসে বাড়ির কাজের লোক পঞ্চানন তথা পচা এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলেন, কী রে তুই হঠাৎ?
মাথা চুলকোতে চুলকোতে সে উত্তর দিল, বাড়ির পশ্চিমে দুটি শিরীষগাছ কাটতে হয়েছে। হরেনবাবু অবাক- এই খবরটা দিতে তুই এত দূর এসেছিস! তা কাটতে হলো কেন?
সে আরও মাথা নিচু করে উত্তর দিল, জি আজ্ঞে, বুড়ো হাড় কি কম কাঠে পোড়ে?
হরেনবাবু একটু চমকে গিয়ে বললেন, বুড়ো হাড়, মানে?
আজ্ঞে আপনার মা তো বুড়োই ছিলেন, তাই তাকে পোড়াতে অনেক কাঠ লাগল।
সে কী! আমার মা মারা গেছেন?
তা আজ্ঞে কচি নাতির শোক বুড়ো মানুষ সইতে পারলেন না।
সে কী রে! আমার ছেলে বেঁচে নেই…!
কচি ছেলে, মায়ের দুধ না পেলে আর বাঁচবে কী করে?
হরেনবাবু চিৎকার করে ওঠেন, আমার স্ত্রীও মারা গেছে?
এই তিনটি সংবাদ গ্রামের পচা তার মনিবের কাছে নিরুত্তাপ কণ্ঠে পৌঁছে দিয়েছিল! গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ দেশের কাছে, দলের কাছে অনেক সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ এমনই নির্বিকার ভঙ্গিতে পৌঁছে দেয়! আমাদের দেশের শাসকরাও বর্তমানে নির্লিপ্ত ও নির্বিকার ভঙ্গিতে বিভিন্ন দুঃসংবাদের নিদান দিচ্ছেন। যেন দেশে কিছুই হয়নি বা কিছুই হচ্ছে না! অথচ দেশে বর্তমানে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। একদিকে চলছে করোনাভাইরাস মহামারী। সংক্রমিত মানষের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে তো বাড়ছেই। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেমে এসেছে স্থবিরতা। আয়-উপার্জনহীন মানুষের হাহাকার বাড়ছে। মানুষের হাতে কাজ নেই। খাবার নেই। এর মধ্যে চলছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ২১ জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন পানিবন্দী। অগাস্ট পর্যন্ত বন্যার পানি থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ইতোমধ্যে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে বিপদ হয়ে হাজির হয়েছে রোগবালাই। সরকারি হিসাবেই গত তিন সপ্তাহে বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে ৮৬ জন মারা গেছে। পানিবাহিত নানা রোগে অন্তত সাড়ে ৬ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রসের এশিয়া কার্যালয় থেকে সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বন্যায় বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৯৬ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে তিন মাস ধরে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে থাকা এসব মানুষ এখন দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়েছে। এতে গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র্য আরও বেড়ে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে রেডক্রস।
তবে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসিন বলেছেন, 'এটি একটি স্বাভাবিক বন্যা। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা সব বন্যার্ত মানুষের পাশে আছি। নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। ফলে মানবিক বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই।' অথচ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল মনে করছে, বাংলাদেশের বন্যার পানি নামতে অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তার মানে এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে দেশের ২১টি জেলায় বন্যা চলছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। এসব জেলার নদীতে পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে: মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জমালাপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং নওগাঁ। এসব জেলার কয়েক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। আশ্রয়, ত্রাণ ও খাবার পানির জন্য চলছে হাহাকার। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে ফসলি জমি, মাছের খামার।
খাবার ও পর্যাপ্ত ত্রাণ-সহায়তা না পাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা পানিবাহিত রোগে। চরাঞ্চলগুলোতে গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। নদী বিশেষজ্ঞ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যার পানি নামতে শুরু করলে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে ভাঙন বেশি হতে পারে। সরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাসেও এই জেলাগুলোতে নদীভাঙন বেশি হওয়ার পূর্বাভাস ছিল। এবার বন্যার পানি বেশি দিন ওই এলাকায় অবস্থান করায় ভাঙন পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি হতে পারে বলে সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা মনে করেছেন।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চলতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা আছে। চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও কি সমস্যার সমাধান হবে? বাস্তবে মানুষের সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করবে। কারণ, বন্যায় আক্রান্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়েছে। বাড়িঘর হারানো কৃষকরা এখন ঘরবাড়ি ঠিক করবে কীভাবে, পরবর্তী চাষের প্রস্তুতি কীভাবে নেবে আবার এরই মধ্যে যে ঋণ তাদের আছে, সেগুলো শোধই-বা কী করে দেবে- এই ভয়ংকর সংকটে তারা পড়েছে। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের সংকটের সমাধান না করতে পেরে একটা বড় সংখ্যার কৃষক গ্রামে যতটুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে কাজের আশায় শহরে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। শহরেও কাজ নেই। শহরের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা কাজ হারিয়ে অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন এবং যাচ্ছেন। এরা সংখ্যায় এক-দুজন নয়, হাজার হাজার। এখন গ্রামেও কাজ নেই। ফলে একদিকে শ্রম সস্তা হবে, অন্যদিকে সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে ভীষণভাবে। এর সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একটা বিরাটসংখ্যক কর্মক্ষম লোক বেকার হয়ে যাওয়া, ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়া, এক একটা জনপদ ধরে ধরে লোকরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামা- এটা শুধু ওই মানুষগুলোর বিষয় আর থাকে না শেষ পর্যন্ত। ওই এলাকার অর্থনীতির ওপরও তার প্রভাব পড়ে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের একটা অংশ উচ্ছেদ হবে। কাজ হারাবে ওইসব ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মচারী, দিনমজুররা। সবমিলিয়ে এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।
আবার বন্যার পানি নামার সময় নানা রকম পানিবাহিত রোগ মহামারী আকারে দেখা দেবে অথচ এই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ-আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে নেই। একেবারেই মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে বন্যায় আক্রান্ত মানুষরা। কবি সুকান্ত বলেছিলেন, 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।' ক্ষুধা লাগলে সবকিছুকে খাবার মনে হয়। অন্যদিকে কবি নজরুল লিখেছিলেন, 'ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক' বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।' অর্থাৎ ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য হচ্ছে মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন। বিশেষ করে আর্ত-দুর্গত মানুষের। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছাতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 'সব ঠিক আছে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে' এই আপ্তবাক্য না আউড়িয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপিদের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকদের সব ধরনের কৃষিঋণ, এনজিওর ঋণ মওকুফ অথবা তারা পরে সুবিধাজনক সময়ে শোধ দিতে পারে- তেমন উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করতে হবে। ছাত্রদের বেতন ও অন্যান্য ফি আগামী এক বছরের জন্য মওকুফ করে দিতে হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। একেবারে ভেতরের এলাকাগুলোতেও মেডিকেল টিম পাঠাতে হবে। বন্যা-পরবর্তী মহামারী প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের সামার্থ্যবান মানুষকেও দুর্গতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নিজের দৈনন্দিন ব্যয়ে কিছুটা লাগাম টেনে গরিবদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে।
নির্লিপ্ত-নির্বিকার ভূমিকার পরিবর্তে সরকার সক্রিয়ভাবে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াক, লোক-দেখানো উদ্যোগের পরিবর্তে বাস্তবমুখী কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক-এ মুহূর্তে বানভাসি মানুষের এটাই প্রত্যাশা।