Published : 11 Jul 2020, 12:53 PM
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ভারতের রাষ্ট্রকাঠামো দেখে কবি নবারুণ ভট্টাচার্য তার কবিতার মধ্য দিয়ে বলে গিয়েছিলেন,
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
নবারুণ ভট্টাচার্যের সেই কালজয়ী পংক্তিমালার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে সদর্পে চলমান কিছু অসুস্থ সংস্কৃতির নগ্ন উল্লম্ফন দেখে আজ আমারও চিৎকার করে জানান দিতে ইচ্ছে করছে, এই 'হুমকি' উপত্যকা আমার দেশ না। কারণ, পরিস্থিতি এখন এমন দিকে মোড় নিয়েছে যে এই বঙ্গভূমে মেরুদণ্ড সোজা করে বেঁচে থাকতে চাওয়াটা হয়ে উঠেছে এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের নাম।
অমুসলিমদের কী হবে?
আয়মান সাদিক, আমাদের দেশের গুঁড়ো থেকে বুড়ো, সকলের কাছে এক সুপরিচিত মুখ। এটা কোনোভাবে অস্বীকার করার জো নেই যে, দেশের সর্বস্তরে বিনামূল্যে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি আয়মান সাদিক এবং তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান টেন মিনিট স্কুলের ভূমিকা অনবদ্য। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আপাদমস্তকে শহরকেন্দ্রিক। এ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলিতে মানসম্মত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকের সংখ্যা অহরহ, কিন্তু মফস্বল শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে এই সংখ্যাটা ভয়াবহ। এইসব শহরের বাইরের জায়গাগুলিতে না আছে যথাযথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, না আছেন শিক্ষক। এবং, সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য আয়মান সাদিকের ১৭ হাজার ৪৪০টি ভিডিও টিউটোরিয়াল সম্বলিত এই 'টেন মিনিট স্কুল' হলো গভীর অন্ধকারের মাঝে এক ঝাঁক আলো জ্বেলে যাওয়া জোনাকির মতন, যারা বছরের পর বছর ধরে নিরলসভাবে আমাদের দেশের এই পাহাড়সমান শিক্ষা বৈষম্য মুছে দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যদিও এই কাজটা করার কথা সরকারের।
অথচ সেই টেন মিনিট স্কুলকে বয়কট করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা বৃহদাংশ আজ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই আয়মান সাদিককে দেখা যাবে; তাকে হত্যা করা হবে মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখন আয়মান সাদিক এবং টেন মিনিট স্কুলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বুঝে কিংবা না বুঝে। কিন্তু আয়মান সাদিকের অপরাধটা কী? তার অপরাধ হলো-
১. তার দু'জন সাবেক সহকর্মী সমকামিতা সমর্থন করে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করেছিল এবং সেই ভিডিও'র একটা জায়গায় নীরব দর্শক হিসেবে তার উপস্থিতি ছিল।
২. টেন মিনিট স্কুল ঋতুস্রাব এবং সম্মতি নিয়ে দু'টো আলাদা আলাদা ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করেছিল।
৩. সমকামিতার মতো গর্হিত বিষয়কে প্রকাশ্যে সমর্থন ও প্রচার করে, এমন মানুষের সাথে তার বন্ধুত্ব, কর্মসূত্রিতা বা ওঠা-বসা।
উপরোক্ত কারণ তিনটির জন্য বাংলার ফেইসবুককেন্দ্রিক ধর্মপ্রাণ মানষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তারা মনে করছেন, এগুলি অপসংস্কৃতি এবং এগুলি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার মাঝ দিয়ে এখানকার তরুণদের মনে-মগজে ইসলামবিদ্বেষ বপণ করে দেওয়া হচ্ছে। সেজন্য তারা আয়মান সাদিককে হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন, দাবি তুলেছেন- আয়মান সাদিককে ক্ষমা চাইতে হবে। নিজের প্রাণ, ব্যবসা এবং পরিবার বাঁচাতে আয়মান সাদিক ক্ষমা চেয়েছেনও। একবার না, দুইবার না, একে একে তিনবার।
সর্বপ্রথম তিনি গত ২ জুলাই টেন মিনিট স্কুলের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজ থেকে একটা পোস্ট দিয়ে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কিন্তু জনগণের দাবি- এতে হবে না, তাকে প্রকাশ্যে এসে ক্ষমা চাইতে হবে। যেমন দাবি, তেমন কাজ। মানুষের চাওয়া অনুযায়ী তিনি গত ৩ জুলাই এবং তারপর ৫ জুলাই তার ভেরিভাইড পেইজ থেকে পরপর দু'টো ভিডিও পোস্ট করেন। সর্বশেষ ভিডিও-তে আয়মান সাদিককে বলতে দেখা গিয়েছে, "আমি মুসলমান এবং দয়া করে আমায় বাঁচতে দিন।" যদিও এভাবে করজোরে ক্ষমা চেয়েও কোনো আহামরি লাভ হয়নি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনো চলছে তাকে এবং তার মতাদর্শকে ঘিরে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কারো কারো দৃষ্টিতে, আয়মান সাদিক ঠিকভাবে ক্ষমা চাননি, সমকামিতা সম্বন্ধে তার অবস্থান পরিষ্কার করেননি।
তবে পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে প্রাণে বাঁচার জন্য ফেইসবুকে এসে এভাবে কাউকে নিজের ধর্মের হিসেব দিতে হয়েছে কিনা, আমার তা সত্যিই জানা নেই। কিন্তু আয়মান সাদিক দিয়েছেন। তিনি সাচ্চা মুসলমান, এমন স্বীকারোক্তি দেয়ায় আশা করছি এ যাত্রায় তিনি বেঁচে যাবেন। তাছাড়া তিনি সচেতন, বুদ্ধিমান এবং তার চারপাশে রয়েছে প্রায় অভেদ্য এক সুরক্ষা বেষ্টনী যেটাকে অতিক্রম করে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলাটা খুব একটা সহজ কাজ হবে না।
কিন্তু যারা মুসলিম নন, যারা প্রচলিত কোনো ধর্মেরই সমর্থক না, যারা তৃতীয় লিঙ্গেরসহ প্রান্তিক মানুষের অধিকারের জন্য কথা বলে, যাদের কাছে আয়মান সাদিকের মতো ক্ষমা চাওয়ার কোনো জায়গা এবং আবশ্যকতা নেই, যাদের নিজেদেরকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে রাখার সক্ষমতা নেই; তাদের কি বাঁচার অধিকার নেই? আজ বাদে কাল ভিন্নমত প্রকাশের জন্য তাদের দিকে যখন নির্দিষ্ট বিরতিতে ধারালো অস্ত্র তাক করা হবে, তখন কে তাদের রক্ষাকবচ হবে?
রাষ্ট্রের কি কোনো দায়ভার নেই?
আমার দেশের প্রেক্ষাপটে, এই প্রশ্নের উত্তর খুব সম্ভবত 'না'। কারণটা বলছি।
আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে একটা সময় অবধি দেখে আসছি যে আমাদের এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হয়, পত্রিকার পাতা খুললেই খুনের খবর, এটা অনেকটা রোজ তিন বেলা ডাল ভাত খাওয়ার মতো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা। সেই খুনগুলি হতো কখনো মুখোমুখি সংঘর্ষে, কখনো চুপিসারে। আর কারণ হিসেবে থাকত হয় পারিবারিক ঝামেলা, না হয় রাজনৈতিক কোন্দল। কিন্তু আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি যে ইন্টারনেটের এই অবাধ দুনিয়ায় দু'কলম অপ্রথাগত কথা লেখার জন্য কেউ কাউকে দিনে দুপুরে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে মেরে ফেলতে পারে।
আমি ২০১৩ সালের কথা বলছি, তখন আমার কিশোরীবেলা। সেবার হঠাৎ একদিন শুনলাম একজন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে যার জন্য সমগ্র দেশ উত্তাল। কথবার্তা বলার ক্ষেত্রে সবাই সবাইকে সাবধান হতে বলছে। ইন্টারনেটের অবাধ দুনিয়ায় তখনো বৃহৎ পরিসরে প্রবেশ করার সুযোগ হয়নি আমার। তাই আমি তখনও জানতাম না যে ব্লগ বা ব্লগার ব্যাপারটা ঠিক কি জিনিস, ব্লগের সাথে ধর্মের সংঘাতটা কোথায় কিংবা যাকে মেরে ফেলা হয়েছে সেই ব্যক্তিটাই বা কে, কী তার অপরাধ। শুধু বুঝতাম যে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনো বিরোধ থেকে এটা হয়েছে।
তারপর যেটা হলো- যখন ধীরে ধীরে আমার মনের মাঝে ঘুরপাক খাওয়া ওইসব প্রশ্নগুলির উত্তর পেলাম, সাদা এবং কালোর মধ্যকার ধূসর রঙটাকে বুঝতে শুরু করলাম, ততদিনে ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে প্রকাশ্য দিনের আলোয় কুপিয়ে খুন করাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ তল্লাটের এক নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। একজন ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তির খুন কিংবা হয়রানি হওয়াটা যেন তখন এক উদযাপনের বিষয়। তবে ২০১৫ সালটা হলো আমার কাছে এক ভীতিকর সময়। একে একে বেশ কয়েকজন ব্লগার খুন হলো সেবার! অথচ তা নিয়ে খোদ রাষ্ট্রেরও কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
কেউ কেউ তো সুস্পষ্টভাবে বলেই ফেলেছিলেন যে কারোর বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না তারা কিংবা ধর্মানুভূতিতে আঘাতের জন্য কেউ খুন হলে সেই দায় তারা নেবেন না। কি এক ভয়ংকর পরিস্থিতি, ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। অথচ সদিচ্ছা থাকলে ওই টানাপড়েনের সময়টাকে একটু অন্যভাবেও সামাল দেয়া যেত। কিন্তু তা না করে প্রগতির পক্ষে কথা বলা মানুষগুলিকে সেবার খাদের কিনারায় দাঁড় করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের সংখ্যালঘুতার সুযোগ নিয়ে। সেবার পরিচিত জনের অসহায়ত্ব দেখে এত ভয় পেয়েছিলাম যে কিছু না করেও ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। সত্যি বলতে, আমার কৈশোরের সেই দুঃস্বপ্নকে আমি আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আজও আমি ভয়ে নীল হয়ে থাকি, এই ভেবে যে কি দিয়ে কি বলে ফেলব আর সমাজ এবং আইনের রোষানলে পড়ব! অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
এদিকে সেই ২০১৩ থেকে আজ ২০১৯ সাল অবধি অন্তত ১০ জন ব্লগার বা মুক্তচিন্তার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। অগণিত মানুষকে ভয় ভীতি দেখিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের হয়রানি করার কথা তো বাদ-ই দিলাম। আজ এ দেশে বাকস্বাধীনতার জায়গা নেই। আজ মানুষ ধর্মের নাম করে বুঝে কিংবা না বুঝে ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে হত্যা করছে, হত্যার হুমকি দিচ্ছে। অথচ আমাদের সরকার, আমাদের প্রশাসন আজও এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে না। উল্টো এক অদ্ভুত রকমের মৌনতার মাঝ দিয়ে এসব ঘটে যাচ্ছে। তবে এ কথা নিশ্চিত যে এরকমটা যদি চলমান থাকে, তবে গোটা জাতির জন্য অপেক্ষা করছে এক অশনি-সংকেত এবং সেটাকে ভেঙ্গেচুরে গড়বার আর কোনো রাস্তা থাকবে না।
এই অশনী সংকেতের শেষ কোথায়?
এইসব ভাবনার দিনে আমার নজরুলকে খুব মনে পড়ে। তার ভাষায়-
"দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।"
নজরুলের এই কথার সাথে আমি সর্বাঙ্গীনভাবে একমত। ব্লগারদেরকে যখন নির্মমভাবে মেরে ফেলা হলো, আমাদের সমাজের ভালো মানুষেরা তখন 'যদি, কিন্ত, হয়, তবে'- নামক অব্যয়ের সমন্বয়ে সেইসব হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিতে ব্যস্ত ছিল। সেদিনের সেই মৌনতার জন্যই আজ আয়মান সাদিকের মতো প্র্যাকটিসিং মুসলিমকেও হাস্যকর সব কারণে প্রাণনাশের সংশয় নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। সেদিন যদি আমরা ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে ভুলে বৃহত্তর স্বার্থের পরিকল্পনা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে আয়মান সাদিক বা অন্য কাউকে আর আজকের দিনটার মুখোমুখি হতে হতো না।
যে সমাজে পরমতসহিষ্ণুতা নেই, আর যাই হোক সেটা কোনো সুস্থ সমাজ হতে পারে না। যেখানে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করার মতো বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই, সেটা কোনো সুস্থ সমাজ হতে পারে না।
তবে এখনো সময় আছে দেশের সর্বস্তরে যুক্তিনির্ভর আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি করার, এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার, দেশটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঢেলে সাজানোর এবং অতি অবশ্যই মানুষকে এত দ্রুত বিভিন্ন অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত না হওয়ার শিক্ষা প্রদানের। নয়ত বড় বেশি দেরী হয়ে যাবে এবং শুধিতে হইবে ঋণ।