Published : 19 May 2020, 12:51 PM
করোনাকাল কবে শেষ হবে কেউ তা বলতে পারছেন না। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আভাস দিয়েছে, পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস চিরতরে দূর হবে না। বিশ্ববাসীকে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়েই বেঁচে থাকা শিখতে হবে। করোনা এমন এক ভাইরাস যা পৃথবীব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন থেকে সুখ, স্বস্তি এবং আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। দুনিয়াজুড়ে খবরদারি করতে অভ্যস্ত দেশগুলো সমরশক্তিতে বলীয়ান হলেও নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে অতি দুর্বল সেটা প্রমাণ হয়েছে। সমরশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব রোগ-শোকে মানুষের জীবন রক্ষায় কত ভঙ্গুর তা স্পষ্ট হয়েছে। ছোট দেশ কিউবা যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে সেটা কি কোনো শিক্ষণীয় বিষয় হলো বিশ্ববাসীর জন্য? ইউরোপ-আমেরিকা তাদের অর্থ-সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত বড়াই সত্ত্বেও যখন করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত হলো, তখন আমেরিকা বছরের বছর যুদ্ধ চালিয়ে যে দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ভিয়েতনাম কী সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করল কোনো প্রাণহানি ছাড়াই। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবীর জন্য কোনো বিশেষ বার্তা বহন করবে? করোনাভাইরাস বৈশ্বিক সমস্যা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পথ-পদ্ধতি নিয়েও তাই পৃথিবীর সব দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো ঐক্যচেষ্টা কী লক্ষ করা যাচ্ছে?
করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবী হবে বিপন্নতার, বিষণ্ণতার। মানুষ বেঁচে থাকবে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে। জীবন ও জীবিকার উদ্বেগ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডেভোরা কেসটেল বলেছেন, 'আইসোলেশন, ভয়, অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা – এসব বিষয় মানসিক সমস্যার বড় কারণ হতে পারে'। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস সংকটের কারণে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিভিন্ন দিক বেশ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে বলা হয়েছে, করোনার কারণে শিশু ও তরুণেরা বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন, স্কুলেও যেতে পারছে না। ফলে তাদের মনে এক ধরনের বিষণ্ণতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের চোখের সামনেই শত শত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। এটা তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক এবং নার্সদের একটি দল সাক্ষাৎকারে বলেছেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে তারা এবং তাদের সহকর্মীদের একরাশ আতঙ্ক, উদ্বেগ, অসারতা, বিরক্তি অনিদ্রা এবং দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এই বিষয়গুলো স্বাভাবিক জীবনপথের মারাত্মক অন্তরায়। যেকোনো সুখের স্মৃতি মানুষের মন থেকে হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফেরে অনেক সময়। ফলে একটি অস্বাভাবিক পৃথিবীই হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আগামীর পৃথিবীটা যেন অশান্তিময় না হয়, প্রতিহিংসা এবং ক্রুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেন মেতে না ওঠে শক্তিধর দেশগুলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন ক্ষমতামদমত্ত না হয়ে অধিকতর মানবিক হয়ে ওঠেন, সে প্রত্যাশাই এখন বিশ্ববাসীর। সম্পদ কুক্ষিগত নয়, সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার নয়, সম্পদের সুষম বণ্টনে কি আগ্রহী হবে বিশ্ব নেতৃত্ব?
দুই.
বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কেমন এক কথায় তার জবাব দেওয়া যাবে না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সম্ভাব্য উপায়গুলো কঠোরভাবে প্রতিপালন না করায় বাংলাদেশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মৃতের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাধারণের মানুষের অসচেতনতা, উদাসীনতা এবং অবহেলার কারণে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণও করছেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যসব ফ্রণ্টযোদ্ধাদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ বিলম্বিত হওয়ায় যথেষ্ট এলোমেলো অবস্থার তৈরি হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতা, সরকার প্রধানকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রদানে গাফিলতি ইত্যাদি কারণে মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পরামর্শ, দিকনির্দেশনা এবং তদারকির কারণে অব্যবস্থাপনা কমে আসছে। তবে সকল পর্যায়ের গণপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমান দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা আশা করা যায় না। তাই ত্রাণ বিতরণ বিতর্কের উর্ধ্বে থাকছে না। তবে ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি ও পক্ষপাতের অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। সরকার দলীয় কেউ ত্রাণ নিয়ে অনিমের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ত্রাণ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান অব্যাহত থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন যে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি মহল সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টুইস্ট করে অপপ্রচার তথা গুজব ছড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অভিযোগ ভিত্তিহীন সেটা বলা যাবে না। যারা সত্যি অপপ্রচার চালাচ্ছে, যারা 'টুইস্ট' করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষণীয়। আবার কিছু গণমাধ্যম কর্মী ও সোশ্যাল অ্যাক্টভিস্টের বিরুদ্ধে অতিতৎপরতাও লক্ষ করা যায়। সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা আর তথ্য বিকৃত করা কিংবা গুজব ছাড়ানো কিন্তু এক বিষয় নয়। ১৯৭৪ সালে বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হয়েছিল। ওটা ছিল একটি বানোয়াট ছবি। কিন্তু তখন যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছি্ল, সেটা সত্যি। দুর্ভিক্ষের কথা বলা অন্যায় বা অপরাধ নয়। অপরাধ হলো সাজানো ছবি তোলা এবং তা প্রচার করা।
গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, মানুষ কখন গুজবে বিশ্বাস করে? মানুষের চোখে দেখা সত্যের সঙ্গে সরকারি তথ্যের গরমিল দেখলেই সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়। সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের পরিবেশই গুজব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করে। গুজব যারা ছড়ায় তাদের ছাড় দেওয়া যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে গুজবে বিশ্বাস করার পরিবেশও দূর করতে হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কেউ যাতে অনাহারে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৪ মে পর্যন্ত সারা দেশে এক কোটির বেশি পরিবারের পৌনে পাঁচ কোটি মানুষকে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। চাল বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। এতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ ৫৫ হাজার। তার মানে পরিবার প্রতি চাল দেওয়া হয়েছে ১১ কেজি। অন্যদিকে নগদ বরাদ্দ দেওয়ার পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা। ৪ কোটি ৭১ লাখ মানুষকে এই টাকা ভাগ করে দিলে একজনের ভাগে পড়ে ১৮ টাকা। পরিবার প্রতি ১১ কেজি চাল এবং মাথা পিছু ১৮ টাকা কত দিনের জন্য দেওয়া হচ্ছে, সে তথ্য কিন্তু নেই। এটা প্রতিমাসে দেওয়া হবে, নাকি মাঝে মাঝে? এই বিষয়টি পরিষ্কার নয়। পরিসংখ্যানও কখনও কখনও মানুষকে বিভ্রান্ত করে। চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য কতটুকু সাহায্য দিলে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে না, সেটা আগে নির্ধারণ করা দরকার। একই সঙ্গে ত্রাণ সহায়তা দরকার এমন পরিবার বা মানুষেরও একটি হিসাব থাকা দরকার। লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বললে বিষয়টি ছলচাতুরির মতো শোনাবে। মহৎ উদ্যোগও ভণ্ডুল হতে পারে অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতার কারণে।
ঈদের আগে ৫০ লক্ষ পরিবারের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাও প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রশংসনীয় মানবিক উদ্যোগ। সরকারের ভুল ধরার জন্য যারা ঈগল চোখে নজর রাখছেন, তারা সরকারের আন্তরিক জনবান্ধব উদ্যোগগুলোর দিকেও নজর দিলে ভালো করবেন।
করোনাভাইরাসের আঘাত সারা বিশ্বেই বড় ধরনের ওলটপালট ঘটিয়েছে, ঘটিয়ে চলেছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনাভাইরাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তার প্রকৃত হিসাব বের করা এখনই সম্ভব নয়। কীভাবে এই ক্ষতি পোষাণো হবে তা-ও অজানা। অর্থনীতিবিদরা অংক কষছেন। পথ বের করার চিন্তাভাবনা চলছে। মাসের পর মাস মানুষকে ঘরবন্দী করে রাখা যাবে না। ব্যক্তির স্বাধীনতা সরকার কতদিন নিয়ন্ত্রণ করবে? আবার ব্যক্তিকেও মনে রাখতে হবে, বেপরোয়া মনোভাবকে সাহসিকতা বলে না, সেটা অপরিণামদর্শিতা। আগের অভ্যস্ত জীবনে ফেরার ছাড়পত্র আর কবে পাওয়া যাবে, বলা মুশকিল। এখন করোনাভাইরাস নিয়ে বসবাস করার জন্য সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। ব্যক্তির সচেতনতাই করোনামুক্তির আনন্দ উপভোগের পরিবেশ তৈরি করতে পারে।