Published : 07 May 2020, 04:30 PM
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আরোপ করা লকডাউন শিথিল করে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ তারিখ থেকে শপিং মলগুলো খুলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা এসেছে। ফ্যাশন হাউস বা বিউটি পার্লারগুলোও খোলার চিন্তাভাবনা চলছে। বাংলাদেশে কি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে? পত্রিকা দেখে একদিকে মনে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে, আরেকদিকে যেন চলছে উৎসব। শপিং মল, ফ্যাশন হাউস, বিউটি পার্লার, ঈদের কেনাকাটা! সোশ্যাল মিডিয়া, পত্র-পত্রিকা বা বেসরকারিভাবে পাওয়া তথ্য বাদ দিয়ে যদি শুধু সরকারি হিসেবের দিকেও তাকাই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার এখনো উর্দ্ধগামী। যদিও এটা অবধারিত ছিল যে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় লকডাউন খুব বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না, কিন্তু লকডাউন শিথিল করা নিয়ে একটা পরিকল্পনা তো প্রয়োজন। আর সে পরিকল্পনায় কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন?
রোগের লক্ষণ আছে এমন একজন আক্রান্ত ব্যক্তির ৬ ফুটের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় কাটালে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস এক্সপোজার হয়েছে বলে ধরা হয়। এ ভাইরাস কিভাবে মানুষের মাঝে ছড়ায় ও সংক্রমিত হয়, এনিয়ে অনেক আলোচনা ও প্রচারণা হয়েছে। কাজেই এ সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের নিশ্চয়ই অজানা থাকার কথা না। কিন্তু সবার আগে শিথিল করে দেওয়া হলো গার্মেন্টসগুলো, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি পেশা। যেখানে হাজার হাজার কর্মী বদ্ধ ঘরে ভিড় করে কাজ করে ঘন্টার পর ঘন্টা। তাও সবাইকে ডাকা হয়েছে এক সাথেই , ভাগে ভাগে নয়, বিভিন্ন শিফটে ভাগ করে নয়। দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অংকের রেভিনিউ নিয়ে আসা এই কর্মীগুলো যেন মানুষ নয়, একদল পাপেট। এক ঘোষণায় বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন, ওরাও বাসে, ট্রেনে, স্টিমারে ভিড় করে বাড়ি গেল। আবার ডাক দিলেন, চাকরি হারানোর ভয়ে লাখে লাখে হাঁটা ধরল শত মাইল। ডাক দিয়ে বুঝলেন ভুল হয়েছে তাই আবারো তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আর এখন অর্ডার হারানোর কথা বলে খুলে দিলেন সব গার্মেন্টস, আবারো সব একসাথে, সবাইকে একসাথে ডেকে। এসব সিদ্ধান্তে একদিকে যেমন স্থান নেই কোনো স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের, তেমনি নেই স্থান সঠিক ও টেকসই অর্থনীতিরও। গার্মেন্টসের মালিকেরা বলছেন ওদের অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে। তাহলে এসব গার্মেন্টস কর্মীরা যদি সব একসাথে অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে কী করে চালাবেন গার্মেন্টস? কাজেই এভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে, উচিত ছিল না ধাপে ধাপে কর্মীদের ফিরিয়ে আনা? কর্মীদের কাজের জায়গায় ভিড় এড়াতে কর্মীদের বিভিন্ন শিফটে ভাগ করে দেওয়া? উচিত ছিল না যেকোনো পরিস্থিতিতে কর্মীদের বেতন সুবিধা বজায় রাখা? যাতে তারা বেপরোয়া হয়ে কাজে না ছুটে? না হয় কয়েকটা মাসের জন্য লাভের খাতাটা বন্ধই থাকত। ব্যবসাটাও তো শুধুই কয়েক মাসের নয় তাই না?
গার্মেন্টসগুলোর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে খুলে দেওয়া হচ্ছে শপিং মলগুলো। কি বিবেচনায়? শপিং মল খুলে দিলে সেখানে মানুষের ভিড় কি করে সামলানো যাবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশটা কাপড় ব্যবসায়ীদের দখলেই চলে যাচ্ছে। তা না হলে লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়া এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলো বাদ দিয়ে, জরুরি প্রয়োজন নেই এমন সব ফ্যাসিলিটি দেওয়া হচ্ছে কেন? বরং রিকশাওয়ালাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। ছেড়ে দেওয়া হোক দিনমজুর বা চাষিদের বা যে কোনো অন্য পেশার লোকদের যাদের বদ্ধ ঘরে কাজ করতে হয় না। যারা একের সাথে অন্যের দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারবে। আবার যাদের অর্ধাহারে অনাহারে মরার সম্ভাবনা আছে। বেপরোয়া হয়ে চুরি-ডাকাতি বা ছিনতাইয়ে নেমে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
আর যারাই কাজে ফিরছেন, তাদের বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহারের আইন প্রয়োগ করুন। মাস্ক কিনতে পাওয়া না গেলে বা কেনার সামর্থ্য না থাকলে ঘরে বানানো মাস্ক, এমনকি গামছা বা ওড়না পেঁচিয়েও ভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনা যায়। কারণ এসব ব্যবহারের মাধ্যমে অন্তত যেসব রোগী জেনে বা না জেনে আক্রান্ত হয়ে আছেন তারা ভাইরাসটি কম ছড়াবেন। বাংলাদেশের বাইরে যেসব দেশে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে, সেসব দেশে সংক্রমণের মাত্রা সর্বোচ্চ সীমা পেরিয়ে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসার পর নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে সংক্রমণের মাত্রা এখনো বাড়ছে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে লকডাউন শিথিল করা আত্মহত্যাস্বরূপ। লকডাউন শিথিল করা হতে হবে পেশার ধরনের উপর ভিত্তি করে, সংক্রমণের ঝুঁকি মূল্যায়ন করে, প্রয়োজনের ভিত্তিতে, এবং ধাপে ধাপে। তা না হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।