Published : 27 Apr 2020, 09:28 PM
'কোয়ারেন্টিন' শব্দটা বহু আগে থেকে মানুষের শব্দ তালিকায় ছিল। শরৎচন্দ্র তার 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে কোয়ারেন্টিন শব্দটা ব্যবহারও করেছিলেন। হাল আমলের বাংলাটাও সুন্দর-'অন্তরীণ'। এরসাথে মিলিয়ে কেউ কেউ বলছেন– অন্তরীণ/মানে নিজগৃহে চিল্লায় যান/প্রয়োজনে চল্লিশ দিন।
করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশ দুঃসময়ের চল্লিশ দিন পার করে ফেলেছে। জীবনযাপনে, চলাফেরায়, বাজারে, দোকানে, অন্তরীণে – ভয়, দুশ্চিন্তা, সাবধানতার পাশাপাশি আনন্দ কিংবা মজার ঘটনাও ঘটছে। হাসতে হাসতে মানুষ জানছে অনেক কিছু, শিখছে অনেক কিছু! যেমন খবরে প্রচার হলো (আগেও লিখেছিলাম) – গত তিন দশকের ভেতর এবারই প্রথম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডলফিনদের আনাগোনা আর 'আনন্দ ঝাপাঝাপি' দেখা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে একজন তার স্ট্যাটাসে লিখলেন– এই কয়দিনে দূষণের মাত্রা কমে গেছে এবং ঢাকার হাতিরঝিলে কুমির ও ডলফিনদের সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। আরেকজন এর উত্তরে লিখেছেন– ভাই দিয়াবাড়ির দিকে আসেন। ওখানে ডাইনোসর পাবেন! একজন লিখেছেন– হাতিরঝিলে ডলফিন, রাস্তায় ময়ূর আর দিয়াবাড়িতে শুধু ডাইনোসরই ফেরত আসেনি, বিটিভিতে কোথাও কেউ নেই কিংবা বহুব্রীহির মতো নাটকও ফিরে এসেছে!
নেতা মন্ত্রীরাও স্বরূপে ফিরেছিলেন, তাদের কথাবার্তাও ভাইরাল হয়েছিল- যা পরবর্তীতে খবর হিসেবেও প্রচারিত হয়েছে। তাদের কথা বা বাণীগুলো মানুষের মনে চিরদিন জাগরুক থাকবে। যেমন, করোনার চেয়ে আওয়ামী লীগের শক্তি অনেক বড়! অথবা, করোনা প্রতিরোধে আমেরিকা ইতালির চেয়ে বেশি সফল বাংলাদেশ! কিংবা, শেখ হাসিনা থাকতে করোনাভাইরাস কিছুই করতে পারবে না। কেউ অবশ্য করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চীনের মতো হাসপাতাল বানাতে চেয়েছেন, কেউ বলেছেন- আমরা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোতে বিএনপির হাত আছে! কেউ আবার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, করোনা প্রতিরোধে ঢাকা এয়ারপোর্টের মতো ব্যবস্থা উন্নত দেশেও নেই!
এসব আসলে বলা হয়েছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য, সচেতন হয়ে ঘরবন্দি থাকার জন্য। হাসতে হাসতে সচেতন হয়ে বাঁচার জন্য! অনেক মানুষ এসব সংবাদের পাশাপাশি নিজ স্ত্রী অনেকে যাদেরকে বলে থাকেন– 'হোম মিনিস্টার', তাদের মুখ বন্ধ রাখা নিয়েও সরব হয়েছেন। কেউ ট্রল করেছেন, কেউবা কৌতুক ছড়িয়ে দিয়েছেন এমন;
এক পীর সাহেবের মেজাজ খারাপ। তার কাছে এসে প্রতিদিন এক ভদ্র মহিলা কান্নাকাটি করেন। বিরক্ত হয়ে পীর সাহেব জানতে চাইলেন– কী সমস্যা? ভদ্র মহিলা জানালেন তার স্বামী প্রতিদিন তার গায়ে হাত তোলে। তার বেঁচে থাকার সাধ মিটে গেছে। একটা তাবিজ যদি পীর সাহেব দিতেন!
পীর সাহেব একটা তাবিজ দিয়ে বললেন, এটা গলায় কিংবা বাহুতে পরা যাবে না। এটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখতে হবে। সাতদিন পর ভদ্রমহিলা মিষ্টি আর উপহার নিয়ে এলেন পীর সাহেবের জন্য। বললেন– হুজুর আমার স্বামী খুব ভালো হয়ে গেছে। আপনার তাবিজের কেরামতিতে সে আর আমার গায়ে হাত তোলেনি।
পীর সাহেব বললেন– এটা তাবিজের কেরামতি না। আপনি যে বাধ্য হয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন এটা তার কেরামতি!
কেউ কেউ একারণে অন্তরীণে বাধ্য হয়ে বাসায় থাকার কারণে স্ত্রীর বকবক নিয়েও কথা বলেছেন। যে যেভাবে পারছেন হয়তো তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খানিকটা অতিরঞ্জন হয়তো আছে কিন্তু এক ছাদের নীচে একরকম বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতাও মানুষের জন্য নতুন। যেমন ফেসবুকে একজনের সরল স্বীকারোক্তি-
'ঘরবন্দি হইছি ২৩ মার্চ। এরপর একমাসের বেশি গেল। প্রথম তিন চারদিন ভালই ছিলাম। এরপর শুরু হইল যন্ত্রণা। বসে থাকলে বউ বলে শুধু শুধু বসে থাকো কেন? ঘুমাইলে বলে এত বেশি ঘুমাও কেন? মোটা হয়ে যাবা তো। বাধ্য হয়ে ব্যায়াম শুরু করলাম। দশদিনের মাথায় ব্যায়াম করা শরীরের ছবি দিলাম ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে। দুই মেয়ে লাইক দিল। এরপর আমার খাওয়া বন্ধ, ব্যায়ামও বন্ধ। বউ শুধু জানতে চায় লাইক দেয়া ঐ দুই মেয়ের সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি বলি ব্যক্তিগত বা ফেসবুক পর্যায়েও কোনো সম্পর্ক নাই। এরপর বউ আমারে দিয়া থালাবাটি বাসন সব মাজায়, মোবাইলটা বেশিক্ষণ হাতে নিতে দেয় না। আমার বউয়ের দৃঢ় বিশ্বাস ফেসবুকে আমার অন্য আইডিও আছে যা নাকি সে জানে না। আমার ছেলেটা এখন আমার দামি মোবাইল দিয়া গেম খেলে। তাও ভালো। মোবাইলটা আমার বউ আছাড় মাইরা ভাঙ্গেনি!'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এইসব অভিজ্ঞতার শেয়ারিংই বেশি। কেউ কেউ কৌতুক ছড়াচ্ছেন-
বস: আমি এপর্যন্ত তিনবার রিং দিয়েছি। তুমি ধরোনি কেন?
কর্মচারী: স্যার প্রথমবার যখন ফোন দেন তখন আমি আমার ছোট ছেলের 'পটি' পরিষ্কার করছিলাম। তাই মোবাইল ধরার অবস্থায় ছিলাম না। দ্বিতীয়বার স্যার আপনি যখন রিং দেন তখন আমি আমার বউয়ের কাপড়চোপড় ধুয়ে দিচ্ছিলাম। তৃতীয়বার যখন রিং দেন তখন আমি স্যার ঘর মুছছিলাম। আমি কিন্তু স্যার খানিক আগে আপনাকে রিং ব্যাক করেছিলাম।
বস: হুম, দেখেছি। তুমি যখন কল ব্যাক করেছিলে আমি অবশ্য তখন বাসন মাজছিলাম!
আসলে যে যার মতো বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। আগামী ঈদ পর্যন্ত কী এভাবেই কাটবে? তখন অনেক ভীড়ের ভেতর মার্কেটে যেতে খারাপ লাগবে না? অথবা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটতে বা বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে করে যেতে আসতে খারাপ লাগবে না? খারাপ লাগবে না যদি সেই অসহ্য জ্যাম ফিরে আসে? মানুষ কেন তবু আসতে চাচ্ছে ঘরের বাইরে? যে মিথ্যে কথা বলত সে কী করছে বাসায় বসে? ঘরোয়া ভাবে মিথ্যে বলছে? যে চুরি করত সে কী এখন চালচোর চক্রের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে? যার ঘুষ না খেলে চলত না সে কী করছে? পারিবারিক ঘুষ আদান প্রদান কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছে? যে রাজনীতি করত সে কী এখন বাসায় বসে চেয়ার বা টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার প্র্যাকটিস করছে? যে একাধিক প্রেম করত তার কী অবস্থা? সেও কি এখন আরো বেশি মোবাইল নির্ভর? একারণে হয়তো এমন গল্প ছড়াচ্ছে;
বন্ধু: দোস্ত করোনার লক্ষণ কী? তেষ্টা পাওয়া, শরীরে ঘাম? দুর্বলতা, পেটে ব্যথা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, কাশি আসা? ঘন ঘন টয়লেটে যাবার প্রবণতা?
ডাক্তার বন্ধুর উত্তর: হুম কিছু লক্ষণ তো এমনই। তোর কী এমন হয়েছে নাকি?
বন্ধু: হ্যারে দোস্ত। আমার মোবাইলে তো তিন বান্ধবীর সাথে রিলেশানের সব হিস্ট্রি আছে। বউ এখন আমার মোবাইল চেক করা শুরু করেছে আর আমার গলা শুকিয়ে আসছে… তেষ্টা পাচ্ছে… ঘাম ছুটে যাচ্ছে… টয়লেটের ভাব হচ্ছে… দোস্ত। তোর ভাবিরে কাইন্ডলি রিং দিয়ে বল যে আমার শরীরে করোনাভাইরাস পজিটিভ হতে পারে, তাই আমার মোবাইল ধরাটা তার ঠিক হবে না!
বৃদ্ধ যারা তাদের ব্যস্ত ছেলে-মেয়ে বা নাতিদের আগে মিস করতেন তারা হয়তো করোনাকালে খানিক আনন্দে আছেন। তারা ছেলে মেয়ে নাতি-নাতনি সবাইকে বাসায় পাচ্ছেন। কিন্তু গৃহবন্দিকালীন সব কাজ কি ঠিকঠাক করা যাচ্ছে? নিচের গল্পটা খেয়াল করুন;
বাবা তার ছয় বছরের ছেলেকে বললেন– বাবা যাও তো বারান্দায় গিয়ে যা দেখতে পাবে সেটার ধারা বিবরণী দাও যেমন ধারা বিবরণী দেয়া হয় ক্রিকেট খেলায়। ছেলেটা বাবা-মার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বারান্দায় গেল। ধারা বিবরণী দেয়া শুরু করল– নিচের গার্ড বাঁশি বাজিয়ে মুরগিওয়ালাকে তাড়াচ্ছে। হাকিম চাচা গাড়ি বের করছেন। তার গাড়ি রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। একটা কাক এসে বসেছে কারেন্টের তারের ওপর। আমাদের বাসার উল্টো দিকে যে মোখলেস চাচা থাকেন সেই চাচাও মনে হয় তোমাদের মতো আদরের কাজ শুরু করেছেন। ভেতর থেকে বাবা জানতে চাইলেন– মোখলেস সাহেব যে আদর শুরু করেছেন এটা কী করে বুঝলে? ছেলে উত্তর দিল– মোখলেস চাচার ছেলেও আমার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধারা বিবরণী দিচ্ছে!
মানুষ আসলে জন্মগতভাবেই চিন্তাশীল এবং সৃষ্টিশীল। যেকোনো পরিস্থিতিতেই তার সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকে না। মানুষ যখন বদ্ধ থাকে তখনও তার সৃষ্টিশীলতা বদ্ধ থাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন যে কৌতুকগুলো সৃষ্টি হতো মানের দিক থেকে তা আজও উৎকৃষ্টতর। একারণে করোনাভাইরাসের এ সময়ে এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে যে, যেসব রাষ্ট্র সারা পৃথিবী থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন সেখানে করোনাভাইরাস পৌঁছাতে পারেনি। যেমন, কিউবা বা উত্তর কোরিয়া বা বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপরাষ্ট্র। বিচ্ছিন্ন থাকলেও চীনের কারণে রেহাই পায়নি মিয়ানমার। কিন্তু উত্তর কোরিয়া? সেখানে কি করোনাভাইরাসে মারা গেছে কেউ? সেখানে কি সরকার যা বলে তার বিপক্ষে কথা বলতে পারে কেউ? এমন কী কিম জং উন মরে গেছেন না বেঁচে আছেন তাই কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তাহলে? বদ্ধ রাষ্ট্রে কেউ মুখ খুলতে পারে? উত্তর না দিয়ে সোভিয়েট রাশিয়ার স্বর্ণসময়ের একটা কৌতুক শুনে বিদায় নেই;
স্ট্যালিন মারা গিয়েছেন। ক্রুশ্চেভ তার ক্ষমতা সংহত করছেন। পার্টির সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে মিটিং ডেকেছেন ক্রুশ্চেভ। স্ট্যালিনের নামে তুমুল বিষোদগার করছেন। পেছন থেকে একজন মিনমিনে কণ্ঠে বললো স্ট্যালিন বেঁচে থাকার সময়ে বলেননি কেন? ভয়াবহ রেগে গেলেন ক্রুশ্চেভ। চিৎকার করে জানতে চাইলেন– কে? কে কথা বলল? এখন মুখ বন্ধ কেন? সাহস থাকলে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলুন। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো মিটিংয়ে। ক্রুশ্চেভ হুংকার দিয়ে বললেন, এখন যে কারণে আপনি মুখ বন্ধ রেখেছেন তখন আমিও একই কারণে মুখ বন্ধ রাখতাম!
আপনার মুখ বন্ধ করে রাখার দরকার নেই। আপনি প্রাণ খুলে হাসুন। যদি কারও মনে হয় যে আপনি হাসতে হাসতে জীবাণু ছড়াচ্ছেন তাহলে মাস্ক পরে নিন! দয়া করে হাসি থামাবেন না!