Published : 16 Apr 2020, 05:43 PM
করোনাভাইরাস বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগের বিষয়। করোনাভাইরাস সমাজে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা জনজীবনে আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে প্রতীয়মান হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা দেশে বা বিদেশে বেড়েই চলেছে। যা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই ভাইরাসের প্রভাব সর্বস্তরে যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, ক্রীড়াঙ্গন, ট্যুরিজম, দাম্পত্য জীবন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানী-রপ্তানী, উৎসব উদযাপন এবং বিনোদন জগত ইত্যাদি। বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার, করোনাভাইরাসে এবার তা ছাড়িয়ে যেতে পারে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্ব এখন হিমশিম খাচ্ছে।
করোনাভাইরাস নিয়ে নানাবিধ তথ্য চলমান। কেউ খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন আবার কেউ অবহেলা করছেন। চারদিকে ভীতি ও মহামারী হওয়ার আশংঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে বাজারে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাস আতঙ্ক মানুষের জীবনকে বেসামাল করে ফেলেছে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা এই আতঙ্ককে ব্যবহার করে অধিক মুনাফার লোভে চড়াদামে বিক্রি করছে মাস্কসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। শুধু তাতেই থেমে নেই, ডাক্তারদের ব্যবহৃত মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পুনরায় ধুয়ে বাজারে বিক্রি করার সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
করোনাভাইরাস নিয়ে সমাজে গুজব লক্ষণীয়। গণমাধ্যমে জানতে পারি কোনো এক উপজেলায় গুজব ছড়িয়েছেন একজন প্রসিদ্ধ পীর সাহেব। তিনি নাকি স্বপ্ন দেখেছেন, থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাসের সংক্রামণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তিনটি থানকুনি পাতা আর এক গ্লাস পানি খেলে করোনাভাইরাস ছুঁতেও পারবে না। সেই গুজবে রাতের আঁধারে মানুষকে পাতা সংগ্রহ করতে দেখা গিয়েছে। যেটা খুবই দুঃখজনক। করোনাভাইরাস নিয়ে আরো নানাবিধ গুজব চলমান যেমন, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, শিশুরা আক্রান্ত হয় না, গরমের দেশে কম ছড়ায়, ইউনিসেফের মতে ভাইরাসটি বড় তাই মাটিতে পড়ে যায়, রসুন গরম পানি খেলে সংক্রমণ কম থাকে ইত্যাদি। এসব তথ্য সঠিক নয়। সবাইকে এসবে পাত্তা না দিয়ে ও অতি আতঙ্কিত না হয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে। গুজব পরিত্যাগ করে সতর্ক হওয়া জরুরি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি অফিস আদালত বন্ধ হলেও বিশেষ কিছু জায়গা যেমন- বাসস্ট্যান্ড, রাস্তাঘাট এবং বাজারে প্রচুর জনসমাগম দেখা যাচ্ছে। যা সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে কাজ করে। আমি নিজে করোনাভাইরাস নিয়ে 'পরিবেশ ও সমাজ সচেতন নাগরিক' নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্তাহিক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, সমাজে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষণীয়। সচেতনতামূলক প্রচারপত্র না পড়ে ফেলে দেওয়া বা ছিঁড়ে ফেলতে দেখতে পেয়েছি। কেউ জানে, কেউ জানে না, কেউ জেনেও করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে অবহেলা করছে, অনেকেই অহেতুক বাজারে ঘোরাঘুরি করছে, অনেকেই খোলা জায়গায় ধূমপান করছে, হাত না ধুয়ে হোটেলের খাবার গ্রহণ করছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসবই ডেকে আনতে পারে সমাজ, পরিবার বা ব্যক্তি জীবনে এক চরম বিপর্যয়।
আতঙ্ক না ছড়াতে সরকারের চেষ্টা চলমান, কিন্তু মানুষের আনাড়িপনা করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এলে এলাকা ফাঁকা, তারা যাওয়ার একটু পরে দেখা যাচ্ছে অনেক লোক রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। শরীয়তপুর জেলায় ইতালি ফেরত এক নাগরিকের অবাধ বিচরণ ছিল লক্ষণীয়। তিনি সরকারের হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম অনুসরণ না করে, আত্মীয় স্বজনসহ অন্যদের সাথে হ্যান্ডশেক করতে দেখা গিয়েছে। দেখুন আমরা কতটুকু সচেতন? আবার কোনো এক শহরে করোনাভাইরাস সন্দেহে ইতালি ফেরত যুবককে পরিবারসহ অবরুদ্ধ করেছিল এলকাবাসী। এলাকাবাসী আবরুদ্ধ করে রাখবে কেন, বিদেশ ফেরতদের স্ব-উদ্যোগে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা উচিত ছিল।
কোয়ারেন্টিনের শর্ত মানছে না অনেকেই, ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সুতরাং বাংলাদেশের সংক্রমণ ব্যাধি প্রতিরোধে প্রচলিত 'সংক্রমণ নিয়ন্ত্রন ও নির্মূল আইন- ২০১৮' বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। কারণ আমরা বাঙালি জাতি, কোনো কিছু ভয় পাই না। সরকার ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কোয়ারেন্টিন বা সরকারের নির্দেশনা না মানলে আর্থিক জরিমানার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে পারে। যদিও পুলিশ কিছু জায়গায় জরিমানা ব্যবস্থা প্রয়োগ করছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও বিদেশ থেকে আসা লোকদের সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। যেখানে অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং সাকিব আল হাসান এর মত লোক স্ব-উদ্যোগে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে পারে, আমরা কেন থাকতে পারব না। তারা করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি এড়াতে স্ব-উদ্যোগে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন।
ভাইরাস সম্পর্কে যা মেনে চলা জরুরি- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করা, ব্যবহারের পর টিস্যু পেপারটি ধ্বংস করে হাত ধুয়ে নিয়ে নেওয়া এবং পানি পান করা, যা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে। ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান কারণ মানুষের সংস্পর্শে আসা। তাই সকলের উচিত জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বাহিরে না যাওয়া। জ্বর, কাশি, হাঁচি এর লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মাছ, মাংস সম্পূর্ণ সিদ্ধ করে খাওয়া, ধূমপান না করা ইত্যাদি।
চীনের একদল গবেষক বলেছেন 'এ' গ্রুপের রক্ত বহনকারীদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেশি এবং রক্তের গ্রুপ 'ও' বহনকারী লোকদের সংক্রমণের ঝুঁকি কম। সুতরাং 'এ' গ্রুপ রক্ত বহনকারী লোকদের বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমী ফ্লুর চেয়ে করোনাভাইরাস অনেকগুণ বেশি মরণঘাতী। যারা ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, ফুসফুসে সমস্যা, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, পাকস্থলীর সমস্যা, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি সমস্যায় ভূগছেন তাদেরকে বেশি সচেতন থাকা এবং শরীর সম্পর্কে আরও বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। সংক্রমণ রোধে বিদেশ ফেরত বা আক্রান্ত লোকদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক ভাবে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিনে থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অধিকতর বিবেচনায় রাখতে হবে। তারা নির্দেশনা না মেনে চললে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সরকার কর্তৃক হোম কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং জেলা বা ক্লাস্টার ভিত্তিক লকডাউন পলিসি গ্রহণের সিদ্ধান্ত খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে সব জেলা সাময়িক সময়ের জন্য লকডাউন করলে আরও বেশি ভাল হতো বলে মনে করি। এছাড়াও করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ মুহূর্তে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতি চীনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সরকারকে চীনের পরিস্থিতির উপর নজর রেখে ভবিষ্যতে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বস্তির বিষয় হলো, চীনে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ৯৪ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ২-৫ শতাংশ। চীনে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ৭ এপ্রিল প্রথম একটি দিন মৃতহীন পার করেছে। ৬ এপ্রিল স্পেনে নতুন সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় ক্রমান্বয়ে লকডাউন তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে দেশটির সরকার। ইতালিতে মৃত্যুর হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে, নুতন রোগীর সংখ্যাও কমছে। কারণ সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন ড্রাকোনিয়ান রুলস অনুসরণ করা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, মৃত্যুর হার ও নতুন সংক্রমণের সংখ্যা কমছে। এই সংখ্যা কমার কারণ হিসাবে সামাজিক দূরত্বের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। আমাদের দেশেও সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার সংখ্যাও কম নয়। তাই আমরা হতাশ না হয়ে সামাজিক দূরত্ব, সরকারের নির্দেশনা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে মুক্ত করি। বাঙালি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেমন দেশ স্বাধীন করেছিল, এবারও আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে স্রষ্টার আশীর্বাদে করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব। সুতরাং 'করোনাভাইরাস নিয়ে নেই কোনো আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি'- এটাই হোক করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় প্রতিপাদ্য বিষয়।