Published : 06 Apr 2020, 11:15 PM
সারা পৃথিবীতে কোথাও মানুষের আর মানুষ মারা হচ্ছে না এখন। খুন ও ধর্ষণ অবিশ্বাস্য রকম ভাবে বন্ধ আছে। মানুষ নামে একটা প্রজাতির অসুখ করেছে। সবাই একযোগে সার্স-কোভ-২ মলিকিউলটাকেই কেবল মারতে চাইছেন।
সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১,২৫৪,৪৪৩ জন মানুষ কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। অণুজীবের সংক্রমণে সন্ত্রস্ত হোমোসেপিয়েন্স প্রজাতিরা ঘরবন্দী। জনশূন্য লোকালয়ের রাস্তায়, রাজপথে, খেলার পার্কে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন হরিণ শিশুরা, দু'সপ্তাহ আগের জনাকীর্ণ সৈকতে আজ নিশ্চিন্তে খেলে বেড়াচ্ছেন উধাও হয়ে যাওয়া ডলফিনের ঝাঁক।
আপাত জনশূন্য এ গ্রহে'র নিরাপদ আস্তানায় বসে অধিকাংশ ঘরবন্দী পৃথিবীর মানুষ জানলা দিয়ে এক দৃশ্য দেখে ফেলেছেন – এ গ্রহের কিছু মানুষ হঠাৎই এক জনশূন্য রাজপথে মিছিল করে পথ হাঁটছেন। লংমার্চে। ঘনিয়ে উঠছে স্পেক্টাক্যাল যা কালেক্টিভ, যা সংহত- সমবেত দর্শনে। যা ব্যাপ্ত, টেলিভিশন সেটে। ইন্টেরনেটে।
'মৃত্যু এবং সুযোগ- মানে মৃত্যু এবং জীবন'। "সময়ের স্তব"-এ পড়ছিলাম উরসুলা লে-গ্যিনকে। বলছিলেন তিনি, মৃত্যু এবং সুযোগ কীভাবে খেলা করে মহাশূন্য ও গ্যালাক্সির মধ্যে।
মৃত্যুর চেতনার মধ্যে স্পেক্টাক্যাল কখনও হয়ে ওঠে জীবন হারানোর একটা রিলে রেস। মন্থর সে দৃশ্য-গতি।
পৃথিবীর এই কালান্তক সময়ে সমবেত দেখে যাওয়া এই লঙ মার্চের স্পেক্টাক্যাল অতএব আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে থাকল।
আমরা দক্ষিণ এশিয়ার কথা বলছি।
দৃশ্যগুলি ভারত দেশের ও বাংলাদেশের।
যেখানে সারা রাজপথে, নগরের রাস্তায়, হাইওয়ে জুড়ে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। খুব দ্রুতই কিছু দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে।
আমরা সাক্ষী থাকছি। মন্থর দিনাবলী, স্লো ক্যামেরা, এপিক্যাল প্লট, দার্শনিকের কথামালা এবং খন্ড স্পেক্টাক্যাল-এর।
খণ্ড স্পেক্টাক্যাল
দৃশ্য এক
গত গ্রীষ্মে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন, ভারত চাঁদে যাচ্ছে।
ঠিক যেভাবে, ট্রাম্প বিশ্বাস করিয়েছিলেন আমেরিকা আবার গ্রেট হবে। গ্রেট হবে আবার।
আজ ২০২০-এর মার্চ মাসের শেষে আমেরিকা এক গ্রেট মৃত্যুপুরী। মারণান্তক ভাইরাসের মোকাবিলায় ব্যর্থ গ্রেট ধনকুবেরদের দেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আর ভারতে মোদীর নির্দেশে থালা-বাসন বাজিয়ে লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় নাগরিকগণ নিশ্চিন্তে গৃহবন্দী হয়েছেন। রাস্তা, পথ-ঘাট শুনশান। মানুষ জানালায় বসে পাখির গান শুনছেন। পাহাড়ের পাতা ভেজানো দামী চা খাচ্ছেন। এমন সময় ভারত দেশের রাজপথে, হাইওয়েতে হাজার হাজার পিলপিলে পিঁপড়ের মত, মানুষের মত মাটি ফুঁড়ে কিছু সারি সারি অবয়ব, এরা কারা?
রাত হয় আমাদের, হয় দিন। দৃশ্য দুই
ঘরে রুটি নেই, সাথে জল নেই। ঘাসের বয়সী কচি শিশুরা ঘাস ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। কাব্যিক না। সাই-ফাই না। ঘটমান স্পেক্টাক্যাল। কেউ কেউ মাঝে মাঝে ফুঁকে নিচ্ছেন বিড়ি। এতে নাকি খিদে কম পায়। বলছেন- সাতানববই বছরের কাজরী বাঈ। উনিও পথ হাঁটছেন।
দৃশ্য তিন
গাড়ী নেই, ঘোড়া নেই, পরিবহবনের ব্যবস্থা নেই, সরকারের অনুদান নেই, এখনও নেই রিলিফএর ডাল ভাত।
সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রে চক্ষু রাখলেই দেখা যাচ্ছে ভারতে দল বেঁধে পিঁপড়ের মত মানুষ হাঁটছে, মাথায় বোঝা, কোলে বাচ্চা। অপরিচ্ছন্ন পোশাক।
মারণান্তক জীবাণুর থেকে বাঁচতে ঘরে দোর দিয়েছি আমরা। আর আমাদের ঘর-দরজা, শহর, বাথরুম, পায়খানা, সেলফি তোলার জানালা বানিয়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন এরা। রাস্তায় স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছেন। কাজ, খাদ্য, ঘরবিহীন ভারতভূমির রাজপথে, দেশ সমাজের উদ্বৃত্ত, বাড়তি এরা কারা? কারা এরা? ছবির মত। সিনেমার মত। টেলিভিশনের পর্দার মত এই চলমান স্পেক্ট্যাকল।
কাজের থেকে উৎখাত হওয়া এই শ্রেণিরা মূলত ভারত দেশের মজুরদের সারি। এ তাদেরই মিছিল।
একদিন কাজের খোঁজে যারা গাঁও-গেরাম থেকে এসেছিলেন এই শহরে, ঝুপড়িতে, কল কারখানায়, বস্তিতে।
আজ তারা রিভার্স মাইগ্রেশনে। শহরের কাজ হারিয়ে, আশ্রয় হারিয়ে, খাবার-সঞ্চয় ফুরিয়ে ফেলে ফের গ্রামের দিকে শরণার্থী।
ওপরের এই চিত্রকর্মটি চোখে পড়ল আর মনে পড়ল এক দলিত কবির লেখা এই লাইন-
'All the wealth has been created by Nature and working people.'
দৃশ্য চার
আবার রাত হয়, ফুটে ওঠে আমাদের দিন। আমরা ইন্টারনেট খুলে বসি। দেখি মজুররা সেই হাঁটছেন।
আমরা খবর পড়ছি ও জানতে পারছি- এরা কাজ হারিয়েছেন। এদের মালিক কিম্বা ম্যানেজার এদের পরিত্যাগ করে গিয়াছেন। এই দুনিয়াভর লকডাউনের সময় রাস্তায় শুয়ে থাকার আস্তানাও তাই বাতিল। এদের কারোর কোথাও কোন গাঁও আছে, সেখানে আরও কিছু বুভুক্ষু মুখ আছে। বাচ্চা, বস্তা মাথায় মাইল মাইল হেঁটে পৌঁছতে হবে সেখানে।
মজুররা তাই পথ হাঁটছেন। তারা জীবাণুর কথা বলছেন না। খিদে, পথ হাঁটা, আর বাড়িতে থাকা খালি পেটগুলোর কথা বলছেন। আর তা বলতে গিয়ে আমরা কৌতুক ভরা চোখে আরও একটি নতুন দৃশ্যের জন্ম হতে দেখছি। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- দিন রাত এক করে রাস্তা হাঁটতে থাকা এই অপরিচ্ছন্ন, রুগ্ন, পথশ্রান্ত মানুষগুলো কাফকার গল্পের মত কখন নিজেরাই পরিবর্তিত হয়ে ভাইরাস হয়ে গেছেন। রাজপথে সমবেত উবু করে বসিয়ে উকুনের মত স্প্রে করা হচ্ছে তাদের গায়ে ব্লিচ মিশ্রিত জীবাণুনাশক।
দৃশ্য পাঁচ
কিছু শ্রমিক এক গন্তব্যে পৌঁছছেন। গায়ে জীবাণুর মত, গবাদীপশুর মত ব্লিচিং দিয়ে মজুরদের গা ধুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার সপক্ষে কিছু মানুষ গলা মেলাচ্ছেন। শুনলাম- এতো বাচ্চা দেয় কেন ওরা- এ প্রশ্নে বেস্ট ক্যাটিগরিতে আদারাইজড "ওদের" মরতে দেওয়াও জায়েজ আছে। ঘুমচোখে দেখছি- আমার ফেইসবুকের কমেন্ট-বক্সে কে যেন বিনীত স্বরে লিখে গেছে- কদিন, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, আসলে সরকার সঠিক কাজটিই করেছেন।
দৃশ্য ছয়
কদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পর। মোট সাইতিরিশ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের চারজন অবশ্য লরিচাপা পড়েছেন। একজন পথশ্রম ও ক্ষুধায় সন্তান হারিয়েছেন। আপাতত বইছেন শিশুমানবের লাশ। কিন্তু লংমার্চে আছেন। দেশে পৌঁছে লাশটিকে দাহ করবেন।
আর আমার তিন বন্ধু মারা গেছেন নিউইয়র্ক শহরে। সার্স কোভিড-২ এর সংক্রমণে। ভাত-ডাল রান্না করে চামচ কেবলই মুখ অবধি না গিয়ে হাত থেকে টেবিলে পড়ে যাচ্ছে। ঘোর লেগে গেলে এরকম হয়। ঘোর লাগা চোখেও এই বিনয়টাকে ভীষণই চেনা চেনা লাগছে। কালেক্টিভ মেমরির থেকে মনে পড়ে যাচ্ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় পর্যন্ত ইওরোপ জুড়ে এই বিনয় আমাদের দৈনন্দিন দেখতে হয়েছে। ওরা ও ওদেরকে মারার এ এক পুরাতন আখ্যান।
দৃশ্য সাত
মজুরদের লং-মার্চ চলছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতিকে ইয়োগা'র ভিডিও করিয়া পোস্টাইতে বলেছেন।
দৃশ্য আট
বিশ্বের পরিবর্তন হচ্ছে। নানা জীবজন্তু, প্রাণী নির্ভয়ে লোকালয়ে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছেন।
অনেকে দার্শনিক ভাবে প্রত্যক্ষ করে ফেলেছেন- মানুষ ক্রমে উদার ও দরদী হয়ে পড়ছেন। বিশ্বজুড়ে বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহানুভূতির হাত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সর্বাধিক বৃহৎ এ সংকটে এখনও পর্যন্ত মানুষ মানুষকে বাঁচাতে চাইছেন।
শুধু অন্ত্যজ, শ্রমিক মালিকের লাভ খতিয়ানের সম্পর্ক ধ্রুবকের মত অক্ষুন্ন রহিয়া গিয়াছে।
দৃশ্য নয়
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা হাঁটতে শুরু করেছেন। তবে এ অভিমুখ কর্মস্থলের রিভার্স নয়। কর্মস্থলের অভিমুখে। লকডাউন মধ্যবর্তী পরিবহনহীন বাংলাদেশে কারখানা খুলে উৎপাদন চালু রাখার প্রকল্পে আপাতত লাখো লাখো শ্রমিক রাস্তায়।
অতএব সেই পেন্সিল। সেই শ্রমিক মালিক দ্বন্দ্ব সমাস। মালিক পক্ষ এই পংগপাল শ্রমিকের পালন করেন বলিয়াছেন। কিন্তু পিতার মত, মাতার মত নাকি গবাদীপশুর মত, এ প্রশ্নে মৌনই আশাকরি থেকেছেন।
শ্রমিক মালিক দ্বন্দ্ব সমাস: গরীবের আন্ডা–বাচ্চা: দৃশ্য দশ
গরিবই যদি হয় যখন, এত বাচ্চাই বা দ্যায় কেন ওরা–এ প্রশ্ন কেউ কেউ করে ফেলেছেন। কথা হল- হায়ারার্কি প্রাসাদ থেকে ঝাড়া দিয়ে উঠলে কেক-রুটির তফাত গুলিয়ে যায়। আর এই দুনিয়াব্যপী অণুজীব সন্ত্রাসের দিনে পালকের প্রতিশ্রুতি আর খাদ্য-সন্ধান গুলিয়ে যাচ্ছে। এই মহামারীর দিনে সরকার, স্বাস্থ্য কর্মীরা সচেতন করছেন, বলছেন হাত ধুয়ে জীবাণু মুক্ত থাকতে। এর জন্য কেউ কেউ বিনা পয়সায় গরীবদের সাবানও দেবেন বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোমবাতি জ্বালানোর কথা ঘোষণা করেছেন। প্রফেট সুকুমার রায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সাবানের সুপ আর মোমবাতি খাওয়ার কথা বলেছিলেন। এতদসত্বেও শ্রমিকরা রাস্তায় কেন এই প্রশ্নে অতএব তারা আন্ডা-বাচ্চার কথাটিও তুলে ফেলেছেন। অতএব কালেক্টিভ মেমরি। আবার হলোকাস্ট। অতএব মনে পড়ে যাবে- নাৎসিরা ইহদীদের ইঁদুর বলেছিল, রুয়ান্ডা জেনোসাইডের সময় হুতুরা টুটুদের বলেছিল আরশোলার জাত। আমেরিকার স্লেভওনাররা আফ্রিকানদের বরাবর অব-মানুষ ভেবেছেন। ঠিক নাৎসিদের মতই- Untermenschen — subhumans- অব-মানুষ।
ডেভিড লিভিংস্টোন বলছেন- এই যে অবমূল্যায়ন ও শ্রেণি বা বর্গকরণ করা, তা আসলে খুব জরুরি। কারণ এর ফলেই দ্রুত হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় একটি লক্ষ্য-গোষ্ঠীর দিকে।
একই কথা বলবেন, অধ্যাপক চমস্কিও। বলেছেন- দোষারোপ চলবে। কারণ এতে নিজের শ্রেণি সাতন্ত্র্যটা বজায় রাখতে সুবিধে হয়। তফাত গড়ে তোলা যায়। আর দোষ চাপানোর একটা ক্ষেত্র ভালো মতো তৈরি রাখতে পারা যায়। আর সর্বোপরি নিজেদেরই লাভ হয়। লাভের ভাগ এতে করে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য ছোটলোক শ্রেণি এসে খেয়ে যেতে পারে না। নিজেরা বেশ সভ্য জাতি/শ্রেণি হিসেবে নিজেদের লাভের ভাগ ধরে রাখতে পারবেন। না হলে তাদের সভ্য জীবনে লাভের ভাগ কম হয়ে যেতে পারে।
যেমন ভাবেন নিও-লিবেরালরা; বলেন চমস্কি- "Any deviation from this moral obligation would shatter the foundations of "civilized life."
আসলে সারা পৃথিবীতে মানুষ যত ভুখা থাকবেন, ততই প্রচরণশীল হবেন। এই-ই মাইগ্রেশনের ধরণ। আসলে 'নাগরিক খিদে 'একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা হলেও তাই। মানুষ যখন ভাত পান না এবং বদলে মানচিত্রও চিবিয়ে খান না তখন ঠিক কী ঘটে এবং কারা তা ঘটানোর জন্য দায়ী থাকেন? দায়ী থাকে মুনাফা-ভোগী মালিক আর কর্পোরেট পালনকারী সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, ইচ্ছাকৃত অবহেলা এসবই হাঙ্গার-ইনডেক্স জারী রাখে।
মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে ভারতে লকডাউন করা হল। মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকরা যথেষ্ঠ সময়ই পেলেন না, তার আগেই কাজ খোয়ালেন, আস্তানা খোয়ালেন ও পরিবহনহীন দেশে ভুখা পেটে মাইল, মাইল হাঁটতে বাধ্য হলেন। একই চিত্র বাংলাদেশেও। আগাম সতর্কতা, পরিকল্পনা ছাড়াই লকডাউনে হঠাৎ চালু হয়ে গেল কারখানা।
অথচ আগাম সতর্কতা, আপদকালীন খাদ্য ব্যাঙ্ক, রিস্ক ইন্সিওরেন্স, এম্প্লয়মেন্ট স্কীম, টিপিডিএস ( টারগেটেড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম), দিন মজুরদের সরাসরি ভাতা, এসবই সমাধান এবং তা করে ফেলাও কঠিন নয় বলে মনে করেন জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞরা। চাইলেই দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধ, মহামারী বা মানুষের হঠাৎ কর্মহীনতার জন্য যে ক্ষুধার নির্মাণ হচ্ছে তা রুখে দেওয়া যায় বলে ভাবেন অর্থনীতিবিদ ও ক্ষুধা নির্ণয় বিশেষজ্ঞরা। শুধু চাই পরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন স্টোরেজে জমানো খাদ্যশস্যের আপদকালীন বন্টন। খাদ্যশস্যের বণ্টনের সঙ্গে দিনমজুরদের হাতে তুলে দিতে হবে নগদ অর্থ। দুর্ভিক্ষের ইতিহাস বলছে- দেশে দেশে ধরিত্রীর ভাঁড়ারে খাদ্য মজুদ থাকে যথেষ্ঠই, শুধু ক্ষুধার্তের ঘরে তা পৌঁছে যায় না।
ঘরে খাবার না থাকলে মানুষ রাস্তায় নামবে। নামবেই। কখনও তার অভিমুখ চেহারা নেবে রিভার্স মাইগ্রেশনের। কখনও তা হবে মিস-ইনফর্মেশনের, ব্যর্থ পরিকল্পনার ফলশ্রুতি। যেমন ঢাকায়। শত শত মানুষ জীবনের নিরাপত্তা ভেঙে কারখানার কাজ বজায় রাখতে পথে নামলেন। আসলে জীবনের নিরাপত্তা ভাঙলেন জীবনের নিরাপত্তা বজায় রাখতেই। এ এক মজার পরিহাস। আসলে চাকরি বজায় রাখতে যাত্রা হোক বা গ্রাম থেকে শহর আসতে বা উলটোপথে বা খিদে মেটাতে, বা মাথা গোজার আস্তানা পেতে, কথা হলো আসলে তিনি শেষমেশ ডিসপ্নেসডই হবেন। এই পথ হাঁটা তাই এক যুদ্ধ। টিকে থাকার জন্য। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং মানবতার হুঁশ ফেরানোর জন্য। অর্থনীতিক কৌশিক বসু'র ভাষায়- জীবনের বিরুদ্ধে জীবনের যুদ্ধ।
অমর্ত্য সেনও বলবেন তাই- সরকারি ব্যবস্থা, যা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, তারাই দায়ী থাকবেন। "governance systems that are held to account by the people they represent—through a free press, democratic participation, and transparent leadership—are much less likely to allow hunger to develop on their watch, lest they find themselves removed from power by their constituents (Sen 2001)."
অতএব তর্ক, তত্ত্ব জারী থাকবে।
অতএব মানুষ হাঁটবেন। তা সে খিদেয় হোক, জলবায়ু বা যুদ্ধ বা হিংসার কারণে। আসলে তা শ্রমিক বনাম মালিক রাজনীতিরই বিষয়। আমরা সুবিধাভোগীরা নিজ নিজ বারান্দা ও জানলা থেকে সে পদচারণা দেখব, তা ঠিক না, আসলে দেখতে বাধ্য থাকব কেননা আমরা সবাই সে মুনাফার রাজনীতি নির্মাণের অংশীদার।
কেন বিদ্রোহ করেননি এরা। কেন ফুঁসে উঠছেন না রাগে? সম্প্রতি জঁ দ্রেজ এককথায় চমৎকার উত্তর দিয়েছেন এর- "When people are hungry and feeble, they are not well placed to revolt "
হাজার বছর ধরে, দেশে দেশে ভুখা মানুষ পথ হাঁটবেন তাই। সময়ের ব্যবধানে তারা কখনও ভারত ভুমির বদলি শ্রমিক, কখনও বাংলাদেশের সস্তা গার্মেন্টস শ্রমিক।
—-
মৃত্যু এবং সুযোগ মানে মৃত্যু এবং জীবন। বলেছেন উরসুলা। শুরুতেই স্মরণ করেছি আমরা।
ধনতন্ত্রের এই রূপটি নিয়ে সচেতন না হলে আজ ভারত, কাল বাংলাদেশ- কেবলই এই দৃশ্যের জন্ম হইবে। হতেই থাকবে। আমরা বিনাপয়সায় এক অভূতপূর্ব স্পেক্টাক্যাল দেখিতে থাকিব। যেমন বলপূর্বক এই মাইগ্রেশন, এই উৎখাত, তেমনই বলপূর্বক এই দৃশ্য দেখতে বাধ্য থাকা।
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তেই তাই ছড়িয়ে পড়েছেন তারাও। অন্দরের থেকে বাহিরে। বৃহৎ থেকে প্রত্যন্তের দিকে। মাইগ্রেশনের পথের উলটো-পিঠে, উলটো পথে। একেই আমরা গবেষণাপত্রে রিভার্স-মাইগ্রেশন বলব। আর, সামগ্রিক ভাবে এই মানুষদের পোষাকী ভালো নাম দেব- ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল।
যে ভাইরাস ঘাতক, জীবন নিয়ে নেয়, সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ, চলচ্ছক্তিহীন করে রেখে দেয়, সেই ভাইরাসকে তুচ্ছ করে দিতে পারে এমন পাল্টা ভাইরাস এর খোঁজ চলছে দেশ-দুনিয়ার ল্যাবরেটরি জুড়ে।
আর ভারতে, বাংলাদেশে এইসব মজুরেরা সকলে মিলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন কোভিড-১৯ নহে, সোয়াইন ফ্লু নহে, কর্কট রোগও নহে- সকল জীবাণু আর অসুখ অপেক্ষা ক্ষুধাই অতিশয় ঘাতক ভাইরাস।
রেশনহীন, পানীয়হীন, শয়ন-শয্যাহীন রাজপথে সেই ক্ষুধাই একমাত্র লংমার্চ। মৃত্যু ভয়ও তার কাছে তুচ্ছ।
মনে রাখব আমরা- প্রতি বছর ৯ মিলিওন সংখ্যক মানুষ এই ক্ষুধা ভাইরাসেই মারা যান। তারা স্থায়ী বা অস্থায়ী, কারখানার শ্রমিক বা মাটি কাটার মজুর, অঙ্ক একই।
অতএব জেগে থাকে মিনার্ভার পেঁচা
অতএব রাজপথে রাতভর জেগে থাকে কে? ইঁদুর, আরশোলা আর মজুরেরা। স্থায়ী বা অস্থায়ী। হোক তিনি কারখানার মজুর বা মাটি কোপানোর। এমনি একজন- কলকাতার সেই মাটি কোপানো মানুষটি যিনি ইদানীং বাঙালির সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের অজান্তেই কাল্ট হয়ে উঠেছেন- অজস্র খিল্লীর লক্ষ্য এক চূড়ামণি হয়ে গেছেন- সেই সরল প্রশ্নটি করে আমরা চা খাবো না, চা খাবো না আমরা?
করোনার লকডাউনের দিনে আরামে গৃহকোণে থাকার সুযোগ ছিল না তার, ঘরবাড়ি ফেলে মাটি কোপাতে আসা সেই অস্থায়ী মজুরটির। ছিল না গৃহকোণ, হেঁসেল, রান্নাঘর, চুলা ও হাঁড়ি পাতিল। চা করে দেওয়ার অন্য কেউ। চা খেতে এসেছিলেন পাড়ার দোকানে। আরো অনেকের জটলার একজন হয়ে। কারণ ফেসবুকের ফিডে "স্টে দ্য ফাকিং হোম' পড়ার ও জানার সুযোগ হয়নি তার। ভাইরাস সচেতনতা তাকে স্পর্শ করেনি দেখে এক সচেতন নাগরিক তাদের সতর্ক করতে খানিক পুলিশি করেন, ভালোই করেন কিন্তু এ পুলিশির হেতু তাকে স্পর্শ করেছে বলে বোধ হয় না।
যেমন- এই মানুষগুলিরও। সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ির লেখায় পড়লাম- পুলিশ রিকশা ভেঙে দেওয়ায় ঘরহারা বস্তির কাগজহীন শ্রমিকের হাল। রিকশা না চললে সে খাবে কী, রাস্তায় না শুলে সে শোবে কোথায়? তাই মৃত্যু ভয় তাকে স্পর্শ করেছে বলে বোধ হয় না।
এই বোধহীনতার অংশীদার আমিও। কেমন করে গরীব না খেয়ে, মৃত্যুকে ভয় না করে, মাইগ্রেট করতে বাধ্য হয়, পরিবারের টানে পথ হাঁটে, কে কাকে দুটি খেতে দেবে, কার নুন ফুরিয়েছে, কার অন্ধ মা বসে আছে, আধাবস্তা চালে তার মাসাধিক কেটেছে, অপার অন্ধ জননীটি বসে আছেন- ছেলে তার মাটি কেটে চাল নিয়ে আসছে। সে তো পথ হাঁটবেই। তাকে তো ভুখা পেট, নাঙ্গা পায়ে পথ হাঁটতেই হবে। এই রাজপথে রাতে শুয়ে থেকে আবার সকালে পথ চলতে হবে। পথের ক্লন্তিতে মৃত সন্তানের দেহ দাহ করতে তাকে গ্রামের শ্মশানটি পর্যন্ত হাঁটতেই হবে।
শেষ করার আগে একটা গল্প বলি। যেমন ছিল সেই সংলাপ। বিখ্যাত এক অর্থনীতিবিদ পরীক্ষা চালাচ্ছেন- বিশ্ব দারিদ্র নিয়ে। দিল্লীর বস্তি অঞ্চলে। এক দরিদ্র নারী, যিনি একক মা, তাকে সামান্য ঋণ দিয়ে ব্যবসার কাজে লাগাতে বলেছেন গবেষক। কিছু মাস বাদে ফিরে আসবেন, ডেটা সংগ্রহ করতে- ঋণ এর সাফল্য প্রমাণে। ফিরে এলেনও। দেখলেন- কিছুই লগ্নী করেননি ওই নারী তার ব্যবসায়। টাকা জলে গেছে। হতাশ, বিরক্ত অর্থনীতিবিদ। ফিরে যাচ্ছেন- এমন সময় ওই নারী বললেন 'কিন্তু টাকাটা আমি কাজে লাগিয়েছি।' ঘুরে দাঁড়ালেন অর্থনীতিক, নারীটি বললেন ঋণের টাকায় তিনি একটি টেলিভিশন খরিদ করেছেন। হতভম্ব ও বাকরুদ্ধ গবেষক কিছু বোঝার আগে তিনি আরও বলে উঠলেন- টিভিটি কেনায় ব্যবসায় সত্যিই উন্নতি হয়েছে ওর। বাচ্চাগুলো আগে রাস্তায় খেলত, গাড়ী চাপা পড়ার ভয় থাকত। ব্যবসায় মন দিতে ব্যাঘাত হত। এখন বাচ্চারা টিভি দেখে। ব্যবসায় মন দিতে পারেন তিনি।
গবেষণায় লিখলেন তিনি- "গরিবী কী বস্তু, তা আমি সত্যিই বুঝিনি। "
বলেছেন- অভিজিত বিনায়ক, সদ্য নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদ, তার প্রখ্যাত গ্রন্থ- 'গরীব অর্থনীতি' তে।
মনে পড়ল যে, হেগেল যখন লিখেছিলেন- সন্ধ্যার অবকাশে ওড়া মিনার্ভার পেঁচাটির কথা, তিনি আসলে বলেছিলেন- দর্শন কাজ করে তখন, যখন শব্দেরা বাস্তবের জন্ম দিয়ে ফেলেছে।
বিগ ব্যাং এর সময়, ম্যাটার-এর চেয়ে আ্যন্টি ম্যাটার এর যদি আরেকটু বেশি মন্থন হত, যদি হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম এর রেশিও আরেকটুখানি পাল্টে যেত, ভাবুন তবে কী হতে পারত।
আমিও ভাবছি।
এইটুকুই।