Published : 03 Apr 2020, 07:47 PM
১. মানব সৃষ্ট দুর্গন্ধ
টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম যেখানে জনৈক ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে, "আপনাকে আমার ফ্রিজে রাখা দরকার, পচে যাচ্ছেন তো।" আসলেই তো তাই! আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেমন গরম করে, ঠান্ডা রেখে, শুকিয়ে, নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ করে খাবারের গুণাগুণ ঠিক রাখার চেষ্টা করি। খাবারের মান ভাল রাখার জন্য বা খাবারের পচন রোধ করার জন্য বা খাবারের সেলফ লাইফ অর্থাৎ ভাল থাকার সময়কাল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আদিমকাল হতেই ব্যবহার হয়ে আসছে।
খাবার তো আমরা চাইলে ভেজালমুক্ত, স্বাস্থ্যকর করতে পারি। কিন্তু এই খাবার ভোজনকারী প্রাণি "মানুষকে" আমরা কিভাবে ভেজালমুক্ত করতে পারি, পচন থেকে বাঁচাতে পারি? ব্যাগের ভেতর কাঁচামাল ভাল রাখতে হলে তো ব্যাগের মানও ভালো থাকা দরকার। তাই নয় কি?
ইদানীং আমরা দেখছি যেসব জায়গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোনোর কথা না সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই দুর্গন্ধ আসলে কেমন? খাবারের দুর্গন্ধ আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারি, বুঝতে পারি, দেখতে পারি। কিন্তু একজন মানুষের মনে পচন ধরলে তার দুর্গন্ধ আসলে কেমন হয়? এসব দুর্গন্ধ আসলে প্রকাশ পায় তার কথায় এবং কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
এই যেমন বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ছে। সরকারি কর্মচারী তার মনের মতো করে ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। দেশের জনগণ যেন সরকারি কর্মচারীদের ভোগ্যপণ্য! তাদেরকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করা যায়। কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপদস্ত করে, কখনো আসল ঘটনা উদঘাটন না করে সম্মানহানি করে। এ যেন বিনোদনের এক নতুন মাত্রা। চলছে এভাবেই অনেকটা। একজন নারী হিসেবে আমার লিখতে খারাপ লাগছে কারণ আমরা জানি নারী বস হিসাবে মাইক্রোবসিং করে না, নারীর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাগুণ অনেক অনুকরণীয়। যখন দেখি একজন ক্ষমতাবান (empowered) নারীকে মানুষ কটাক্ষ করে বলে এরা ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার বা প্রয়োগ জানে না তখন আসলেই কষ্ট লাগে।
অতিমাত্রায় খাবারে রাসায়নিক প্রয়োগ যেমন খাবারের গুণাগুণ নষ্ট করে দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তেমনই নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহারের পরিবর্তে যদি অতিমাত্রায় ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয় তখনই আসলে ক্ষমতা অপব্যবহারকারীর মানসিক পচন শুরু হয়ে যায়, শুরু হয়ে যায় চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়ানো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যেমনটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হচ্ছে। তাই পচন সারা শরীরে ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের সঠিক মাত্রায় সঠিক জায়গায় সঠিক প্রতিষেধক ব্যবহার করতে হবে যাতে করে মানব সৃষ্ট দুর্গন্ধ আমাদের পরিবেশকে, সমাজকে দূষিত না করতে পারে।
২. ভাল কাজগুলো হোক ভাইরাসের মত
যেকোনো দুর্যোগে হোক সেটা প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট সবার আগে সদর্পে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামনে সোচ্চার হয়, সক্রিয় থাকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীবৃন্দ। যেকোনো বয়সের যেকোনো মানুষ আসলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দেশের প্রতি ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তরুণ সমাজই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সবসময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যখন দেখি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা সময়ের চাহিদা বুঝে মানুষের কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে তখন আসলে নতুনভাবে নিজেরাও আলোড়িত হই, উদ্বুদ্ধ হই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাজকে বেগবান করতে। আসলেই শুধু দুর্যোগের সময় না বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যাতে স্বেচ্ছাসেবীগণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সক্রিয় থাকতে পারে, উদ্বুদ্ধ থাকতে পারে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আসলে আমাদের এই সমাজের মানুষকে ভেজালমুক্ত করতে হলে, পচন ধরা বন্ধ করতে হলে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে বিভিন্ন ভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে করে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে, মানুষের মননে ভালো কাজের বীজ বপন করতে পারে, মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে প্রতিষেধকের মতো কাজ করতে পারে। যত বেশি স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব মানুষের মধ্যে তৈরি হবে, যত বেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সক্রিয় থাকবে মানুষের সংকীর্ণতা তত বেশি কমে যাবে, মানুষ তত বেশি উদার হবে, মানুষের পরোপকারী মনোভাব তত বেশি বাড়বে। এ যেন এক সংক্রামক চক্র। ভালোর চক্র। এ ভালোর চক্র ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে, এ চক্র ছুঁয়ে যাক সবাইকে, পরিশুদ্ধ হোক সবাই।
৩. সংবাদ যেন ক্ষতির কারণ না হয়
আমরা দেখি যখনই সমাজে কোনো দুর্যোগ বা ক্রান্তিকাল দেখা দেয় তখনই কিছু মানুষ যেন হঠাৎ করেই বিশেষজ্ঞ হয়ে যায়! রাতারাতি টাকার পাহাড়ের মালিক হয়ে যাওয়া যেমন মানুষের জন্য বড় একটা আতঙ্কের বিষয় (টাকা চোষা মানুষরুপী টাকাখেকো তো মানুষকে ক্ষত করেই বা ছিদ্র করে এমন অবস্থানে যায়!) তেমনি রাতারাতি বিশেষজ্ঞ বনে যাওয়া চরিত্রগুলোও মানুষের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। কারণ কোনো তথ্য না জানা ভালো কিন্তু বেশি খারাপ যদি সেই জানাটা ভুল জানা হয় কারণ যতক্ষণ সে বিষয়গুলো জানত না ততক্ষণ তো সে সেটা মানত না কিন্তু যখন সে ভুলটা জেনে যায় তখন সে ভুলটাই মানতে শুরু করে এবং তখনই সেটা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই শুরু হয়ে ভুল জানার চক্র, ভুল মানার চক্র! তাই আমাদের যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক্সপার্টিজ না থাকে তাহলে সে বিষয়ে তথ্য দেয়া এবং মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কারণ আমার একটি ভুল কথা, ভুল মতামত বা ভুল তথ্য অন্য কারোর বিপদের কারণ হতে পারে। কারণ যে ব্যক্তি জানে না বা যার জানার ক্ষুধা আছে সে এলোমেলোভাবে তথ্য গ্রহণ করতে পারে তাই এসকল বিষয়ে সবারই সজাগ হওয়া প্রয়োজন। তথ্য প্রদানে এবং তথ্য গ্রহণে আমাদের সকলের আরো বেশি বিচক্ষণ হওয়া উচিত। এই যেমন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই বিভিন্ন ভুল তথ্য গ্রহণ করে নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যেমন কোথাও কোথাও বলা যাচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরের জানলা দরজা বন্ধ রাখতে হবে। এতে আসলে হচ্ছে কী?
এর ফলে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইনেট ইমিউনিটি) আরো কমে যেতে পারে যা কিনা মানুষের প্রথম অস্ত্র এবং মানুষ চাইলে ভালো খাদ্যাভ্যাস এবং সঠিক জীবন ব্যবস্থার মাধ্যমে তা ধারাল এবং শক্তিশালী রাখতে পারে। এই ক্রান্তিকালে এমনিতেই যেহেতু মানুষের সান এক্সপোজার কম হচ্ছে এই ভুল তথ্যের ফলে মানুষ আরো বেশি ভালনারেবল হয়ে যেতে পারে। তাই ঘরে অবস্থানকালীন সময়ে আমাদের প্রয়োজন মতো ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার যেমন চর্বিযুক্ত মাছ, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, ডিমের কুসুম, গরুর কলিজা, কমলা ইত্যাদি খেতে হবে প্রয়োজনে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নেয়া যেতে পারে। এই ভাল খাদ্যাভাস চলতে থাকুক সবসময় যাতে করে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ বাইরের শক্তিশালী জীবাণুকে রুখে দেওয়ার মতো ক্ষমতা শরীরে প্রস্তুত থাকে সবসময়। নিজস্ব অস্ত্রই অর্থাৎ নিজের শরীরই প্রথম হাতিয়ার তাই তা সবসময় শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করতে হবে। বিদ্যমান প্রতিষেধকমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি গুরুত্বসহকারে পরিকল্পনামাফিক প্রতিরোধমূলক খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক জীবন ব্যবস্থার সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার।
৪. গরিবেরাই আসলে আসল ধনী
এ দৃশ্যও মাঝে মাঝে দেখা যায় যে ঘরে মানুষ থাকার কথা সে ঘরে শুধু টাকা আর টাকা মানুষ থাকার আর জায়গা নেই কিন্তু যখন কোনো খারাপ সময়ের প্রাদুর্ভাব হয় তখন এই টাকাওয়ালা মানুষগুলো কোথায় যায়? আর কত দীনতা আমরা দেখব! আমাদের দেশে তো এরকম টাকাওয়ালা মানুষ কম নেই তাহলে কেনো দৈন্য সেজে আমরা অন্য কাউকে সুযোগ দেই? দেখলাম চাইনিজ ব্যবসায়ী টাইকুন জ্যাক মা বেশ কিছু দেশের জন্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি আমাদের দেশীয় কিছু কোম্পানি, গুটিকয়েক ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসছেন। যা নিঃসন্দেহে অনেক অনুকরণীয় এবং প্রশংসনীয়। মানব চরিত্র তো এমনই হওয়া উচিত। তবে যখন দেখি একজন স্বল্পআয়ের মানুষ তার আয়ের অনুপাতে বেশি দান করতে এগিয়ে আসে সে অনুযায়ী যাদের অঢেল সম্পদ রয়েছে তাদের দানের অনুপাত অপ্রতুল তখন আসলে মনে হয় স্বল্প আয়ের মানুষেরাই (ঘরভর্তি টাকাওয়ালা মানুষের তুলনায় এরা তো গরিবই) আসলে আসল ধনী।
আসুন ঘরভর্তি টাকা না জমিয়ে মানুষের জন্য বুক ভর্তি ভালোবাসা তৈরি করি এবং এই সুগন্ধ ছড়িয়ে দেই সবার মাঝে।