Published : 24 Mar 2020, 03:10 PM
গত ১৪ মার্চ ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জনক মহামতি কার্ল মার্কসের প্রয়াণ দিবস। এবার এ দিবসটি অনেকটা নিভৃতেই কেটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কস সম্পর্কে আগ্রহের মাত্রা বিশ্বে এমনিতেই কম। বামপন্থী দলগুলি তারপরেও মার্কসের জন্ম তিথি এবং প্রয়াণ দিবস তাদের সাধ্য অনুযায়ী পালন করে। তবে, সে পালনের ব্যাপারটা এবার ছিল অনেকটাই দায়সারা গোছের।
দায়সারা পালনের কারণ এটা নয় যে, সময়ের প্রেক্ষাপটে মার্কস আরো অপ্রাসঙ্গিক হয়েছেন। বরং ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী নতুন করে আবার মার্কসের প্রতি আগ্রহ জন্ম নিচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক দাবিদার দেশগুলির রাজনৈতিক ব্যবস্থার পতনের পর এমনকি বামপন্থীরাও ভাবতে শুরু করেছিলেন মার্কস বোধহয় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। এখন থেকে মার্কসের স্থান শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়।
সময়টা তখন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আর স্যামুয়েল পি হান্টিংটনদের মত চরম রক্ষণশীল চিন্তাবিদদের জয় জয়কারের যুগ। এ সময় ফুকুয়ামা মার্কসের কমিউনিজমের ইতিহাসের ইতি, এ ধারণাকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে বললেন, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পুঁজিবাদ এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। এটিই মানবজাতির একমাত্র এবং শেষ গন্তব্য। আর হান্টিংটন মার্কসের শ্রেণি দ্বন্দ্বের ধারণাকে প্রতিস্থাপন করলেন সভ্যতার দ্বন্দ্বের ধারণা দিয়ে।
পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ধারণায় বিশ্বাসীরা খুশি হলেন। "ইসলামপন্থীরাও" খুশি হলেন, তবে সেটা হান্টিংটনের বিষয়ে। তারা ভাবলেন সমাজতান্ত্রিক ধারণার চির অবসান ঘটেছে। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মুসলিম বিশ্বের দ্বন্বই এখন মূল দ্বন্দ্ব। তাদের এ ধারণায় তাত্ত্বিক ভিত্তি যোগালেন হান্টিংটন।
সব ঘরানার বামপন্থীরা তখন কমবেশি হতবিহবল। ইতিহাসে মার্কসের ভূমিকা কী হবে এটা নিয়ে অনেকে যখন দ্বিধান্বিত, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের অনেকটা পরপরই উত্তর আধুনিক চিন্তাবিদ জ্যাক দেরিদা লিখলেন তার বিখ্যাত বই, Specters of Marx: The State of the Debt, The Work of Mourning & the New International। এতে তিনি জোর গলায় বললেন, বার্লিনের দেয়াল আর কমিউনিজমের পতনের পর মার্কসের "আত্মা" বিশ্বে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
দেরিদার যুক্তি অনেকের কাছে অতি আশাবাদী, ভাবাবেগ ইত্যাদি মনে হল। কেউ কেউ ভাবলেন, তাই কী? মার্কস কি এখনো প্রাসঙ্গিক? তারপর গঙ্গা, ভলগা, টেমস, মিসিসিপি আর দানিয়ুবের উপর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়ে মানুষের যে প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছিল, সময়ের স্রোতে তার অনেকটাই নির্বাপিত। মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে, বিশেষতঃ তরুণ/তরুণীদের মাঝে "ইসলামপন্থার" রাজনীতিই বিকল্প কিনা, এ নিয়ে যে একটা আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়েছিল, সেটাও এখন নানাবিধ কারণে উবে যাবার পথে।
পুঁজিবাদের অর্থনীতি এবং "ইসলামপন্থার" রাজনীতির ব্যর্থতাই আবার নতুন করে দুনিয়াব্যাপী মার্কসের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা সামনে নিয়ে আসছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, "ইসলামপন্থার" রাজনীতি পুঁজিবাদকে প্রত্যাখান বা বাতিল করে না–কিছু ধর্মীয় প্রত্যয় ব্যবহার করে বজায় রাখতে চায়।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে মার্কস দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারী-পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে একটি সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন। আর এ ধরনের সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন যারা দেশে দেশে বাস্তবায়ন করতে গেলেন, তারা ভাবলেন এর জন্য রাষ্ট্রকে হয়ে উঠতে হবে কর্তৃত্ববাদী। ফলে, মার্কসের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণকারী প্রতিটি রাষ্ট্রই হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী বা একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী। যদিও এর বিপরীতে মার্কসের চিন্তাকে ধারণকারী বামপন্থীদের একটা ক্ষুদ্র অংশ সবসময়ই মনে করে এসেছেন, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা মার্কসের রাষ্ট্র ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
কমিউনিজমে পৌছাতে হলে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের প্রয়োজন কিনা, এ বিষয়ে বামপন্থীদের মাঝে মতভেদ থাকলেও সবাই যে বিষয়টাতে একমত সেটি হল, সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতি দিয়ে এগুনো যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতির। কর্তৃত্বের মাত্রার পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। আর যতদিন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটা পালন করবে রাষ্ট্র। অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া জনগণের কল্যাণ সাধিত হবে না।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মার্কসের দর্শণকে ধারণ করে যে সমস্ত দেশে বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে, তারা সবাই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এতে এক দিকে যেমন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়, তেমনি একই সাথে অর্থনীতিকেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
এ নিয়ন্ত্রণে আনবার মূল লক্ষ্য ছিল সমস্ত জনগণের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং চাকুরির নিশ্চয়তা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদাণ করা। পুঁজিবাদী দর্শনের বিপরীতে সারা দুনিয়ার মার্কসের অনুসারীরা এ চারটি বিষয়কে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে মনে করেন। তাদের মতে রাষ্ট্র এ অধিকার সমূহ পূরণে মুখ্য বা একমাত্র ভূমিকা পালন করবে। মার্কসবাদীরা মনে করেন, এ অধিকারগুলি পূরণ করতে না পারলে, প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের টিকে থাকবার অধিকার নাই।
সমাজতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলি এ অধিকার সমূহ প্রতিষ্ঠায় কতটা সফল বা বিফল তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু এর বাইরে দেখা গেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদে পাশ্চাত্যের অনেক পুঁজিবাদী দেশই শিক্ষা এবং চিকিৎসা পাবার অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকার ধরে তা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলিকে এ দুটো ক্ষেত্রে ব্যবসা করবার সুযোগও সে সব জায়গায় সীমিত করে দেওয়া হয়।
এ সমস্ত রাষ্ট্র পুরোপুরি বাজারের হাতে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা ছেড়ে না দিয়ে আংশিক কর্তৃত্ববাদী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির অনুকরণে সেখানেও অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য যে, বাজার অর্থনীতি আসলে বাজারের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত অর্থনীতি বলে মার্কসের অনুসারীরা মনে করেন।
রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদায় নিলেও প্রায় সবাই শিক্ষা এবং চিকিৎসা এ দুটো খাতকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধারায় ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় রেখে দেয়। ফলে, সে সমস্ত রাষ্ট্রে জনগণ অনেকটা বিনামূল্যেই শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা লাভ করতে পারে সমাজতান্ত্রিক আমলের ন্যায়।
গণচীনও অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব শিথিল করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দেশকে পুঁজিবাদী ধারায় নিয়ে গেলেও শিক্ষা এবং চিকিৎসা এ দুটো খাতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করেনি। অর্থাৎ, আমেরিকার মত এ দুটো খাতকে কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়নি। গণচীনের কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে শিক্ষা এবং চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল সে অধিকারে পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া।
গণচীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে যখন প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চীন যখন সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলির অনেক মিডিয়াতে প্রছন্ন ভাবে একটা চাপা উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। মিডিয়াতে তখন নানা ভাবে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান যে আসলে দুর্বল ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে, সে কথা বলা হতে থাকে।
কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এ কথাও বলতে থাকেন যে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীনের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিবে এবং পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। কিন্তু চীন প্রাথমিক কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।
করোনা মোকাবেলায় চীন যে পদক্ষেপ নেয় তাহলো, এ ভাইরাস অন্য জায়গায় ছড়িয়ে যাবার আগেই উহান শহরকে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করে ফেলা। এর ফলে উহানের বাইরে অন্যান্য শহরে তেমন করে করোনাভাইরাসের বিস্তার লাভ ঘটেনি।
যেহেতু এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি, ফলে চীনের এ মডেলটি আজকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। চীন একদিকে তার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ প্রয়োগ করে উহানের জনগণকে দ্রুত অবরুদ্ধ অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদ নীতির মাধ্যমে সেখানকার মানুষের খাবার, চাকুরি এবং বেতনের নিশ্চয়তা বজায় রাখে।
অবরুদ্ধ হলেও উহানের জনসাধারণ খাবার, বেতন, চাকুরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়নি। কেননা, জনগণ সেখানে জানে এসবের নিশ্চয়তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। আর এ উদ্বিগ্নতা না থাকবার ফলেই, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের ঘরে থাকবার হুকুম তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হয়।
অপরদিকে, মূলত একটা অঞ্চলের মধ্যে সংক্রামণকে আটকে রাখতে পারবার ফলে সারা দেশ থেকে ৪২ হাজার ডাক্তার নার্সসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য কর্মীদের ওই অঞ্চলে পাঠানো সম্ভব হয়। এছাড়া প্রশাসনের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির স্বেচ্ছাসেবকরা নিবিড়ভাবে মনিটর করে, যাতে জনগণ ঘরে থাকে।
চীনের পর করোনাভাইরাস নানা কারণে ছড়াতে শুরু করে পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে। এ সমস্ত দেশও দ্রুত চীনের মডেল অনুসরণ করে ভাইরাস সংক্রমণকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়। এ সমস্ত রাষ্ট্রের কোনো কোনোটি কর্তৃত্ববাদী আবার কোনো কোনোটি গণতান্ত্রিক হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কমবেশি কর্তৃত্ববাদীতা বা নিয়ন্ত্রণ সেসব দেশে রয়েছে। ফিলিপাইন ছাড়া অন্য রাষ্ট্রসমূহে কমবেশি জনগণের চিকিৎসা এবং অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও রয়েছে।
এ সমস্ত রাষ্ট্র বাজার এবং মুনাফার দিকে না তাকিয়ে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদের উপর নির্ভর করে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলার উদ্যোগ নেয়। এতে তারা সফলতাও পায়। এছাড়া সেখানকার পুরো অঞ্চল জুড়ে কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ, লাওবাদ, সিন্টো এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ সমস্ত চিন্তাধারা/দর্শনের মধ্যে প্রছন্ন ভাবে সামাজিক কর্তৃত্ববাদের ছায়া রয়েছে। এটা তাদেরকে প্রশ্ন না করে হুকুম বা আইন মেনে নেবার সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়। এ বিষয়টা সরকারগুলিকে সাহায্য করেছে, আক্রান্ত হওয়া মাত্র জনসাধারণকে দ্রুত লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যেতে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদের সাথে যে বিষয়টা পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেটা হল সরকারসমূহের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবার সক্ষমতা। তারা বাংলাদেশ, আমেরিকা এবং ইউরোপের মত "অপেক্ষা করি এবং দেখির" ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি।
ইতালি, স্পেন, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা প্রথম থেকেই ছিল "অপেক্ষা করি এবং দেখির"। তদুপরি সমাজতান্ত্রিক গণচীন এবং এশিয়া সম্পর্কে কমবেশি একটা উন্নাসিক ধারণা পোষণ করবার কারণে, উহান মডেল গ্রহণ করা নিয়ে তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কালক্ষেপণ করবার বিষয় ছিল। ফলে সংক্রমণ দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে, এ সমস্ত দেশকে আজ করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সময় নেবার ফলে একই অবস্থা হয়েছে ইরানেরও।
পশ্চিম ইউরোপ বা আমেরিকার মত চীনের প্রতিবেশি, পুনরুত্থিত রাশিয়া কালক্ষেপণ করে সময় নষ্ট করেনি। এর ফলে চীনের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত এবং অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক ইত্যাদি নানা সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ ভাবে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সেখানে করোনা বিস্তারের হার তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। রাশিয়ার মত সাবেক সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবার ফলে পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করোনার মোকাবেলায় নিমজ্জিত হয়েছে নজিরবিহীন সঙ্কটে।
মার্কিন জাতির দেশের অভ্যন্তরে বহিঃশক্তির সাথে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি মোকাবেলার অভিজ্ঞতা নেই। তদুপরি অব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদির লক্ষণ প্রকট। আমেরিকা মহাদেশের (উত্তর ও দক্ষিণ) করোনাভাইরাস সংক্রমণের এপিসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দু এখন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির অবস্থা খুব সহসাই ইতালির মত হতে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রটির করোনা রোগীদের সেবা দেবার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠাম নেই। নেই পর্যাপ্ত টেস্টিং কিটও। হাসপাতালে মাথাপিছু বিছানার সংখ্যা গণচীনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চারগুণ বেশি অথচ গণচীনের জনসংখ্যা আমেরিকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
গতবছর আমেরিকার সামরিক বাজেট ছিল ৭৩০ বিলিয়ন ডলার। এটি সারা বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের সম্মিলিত সামরিক ব্যয়ের চেয়েও বেশি। যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে বিপুল ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্ব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত থেকেছে। দেশটির স্বাস্থ্যখাত ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলির হাতে জিম্মি। মানুষের রোগ, শোক, ব্যাধি তাদের মুনাফার উৎস। মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্যখাত আর তার সাথে সরকারের চরম অব্যবস্থাপনার বলি হচ্ছেন আজকে মার্কিন জনগণ। ফলে সঙ্কট মোকাবেলায় প্রথম দিকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও, সেই কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপই নিতে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
উহান মডেলকে অনুসরণ করে একদিকে যেমন নানা শহর অবরুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি পাশাপাশি বিনা পয়সায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। কেননা, কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মার্কিন হাসপাতালগুলিতে করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা এত ব্যয়বহুল যে তা সাধারণ জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে, এ পদক্ষেপটি নিতেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেরি করে ফেলে। ততদিনে সংক্রমণটি ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকার সমস্ত অঙ্গরাজ্যে। সিয়াটল শহরে যখন প্রথম সংক্রমণ দেখা যায়, তখন উহান মডেল অনুসরণ করলে এটির এত বিস্তার ঘটত না বলেই অনেকে এখন মনে করছেন।
সংক্রমণের সাথে সাথে মার্কিন পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির প্রবল দুর্বলতাও ফুটে উঠছে। শেয়ার বাজারে ধস নেমে বাংলাদেশের মত অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। লোকজন চাকুরি হারাবার ভয়ে আছে। ২০ শতাংশ মানুষ চাকুরি হারাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সঙ্কট মোকাবেলায় সেই রাষ্ট্রকেই আবার অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে, জনগণের পাশে রাষ্ট্রকেই দাঁড়াতে হচ্ছে। অ্যাডাম স্মিথের বাজারের অদৃশ্য হাত জনগণকে রক্ষা করতে পারছে না।
জনগণকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতে না পারলে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলিতে প্রয়োজনে জনগণকে লকডাউন করে রাখা যাবে না। জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা হলো, এক বেলা কাজ করতে না পারলে এখনো বহু মানুষের পেটের ভাত যোগার হয় না। এ অবস্থায় সরকার লকডাউন করতে চাইলে সেটি তখনই সফল হবে, যদি রাষ্ট্র নিম্নবিত্ত মেহনতি মানুষের অবরুদ্ধ থাকাকালীন সময়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারে। কমিউনিস্ট গণচীন থেকে পাশ্চাত্যের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, সবাই এ সঙ্কটকালীন সময়ে জনগণকে নানা সুবিধা প্রদান করেই তাদের লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকর করেছে।
উন্নয়নের বাগাড়ম্বিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রের একার পক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একই সাথে এটিও সত্য যে, এ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অনেকেই গত ১০-১২ বছরে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়েছেন। এ বটগাছদের বড় অংশটাই ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত। এখন ক্ষমতাসীনদের নিজের স্বার্থেই উচিৎ, এ দুর্বৃত্তদের একটি বড় অঙ্কের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিতে বাধ্য করা যাতে সরকার লকডাউন চলাকালীন সময়ে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য ব্যয় করতে পারে। রাষ্ট্র সেটি করতে ব্যর্থ হলে–বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের জনগণকে প্রয়োজন পড়লে দুই সপ্তাহ বা এক মাস লকডাউন করে রাখা যাবে না–যার মাশুল সাধারণ জনগণ থেকে শাসক শ্রেণি, সবাইকে দিতে হবে।
লকডাউন যে সমস্ত রাষ্ট্র করেছে সেখানে বাম বা ডান যে ধরনের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদেরকে জনগণকে অবরুদ্ধ করবার আগে, অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করে জনগণের ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে। কোনো রাষ্ট্রই পুরোপুরি বাজারের উপর নির্ভর করে জনগণকে লকডাউন করেনি অথবা করোনা আক্রান্তদের সেবার দায়িত্ব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেনি। অর্থাৎ, করোনা মোকাবেলায় সব রাষ্ট্রকেই কমবেশি অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
তবে দেখা গেছে, এ মোকাবেলায় বর্তমান বা সাবেক সমাজতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলির পাশাপাশি সামাজিক কর্তৃত্ববাদী এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইরান বাদে ডান এবং দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো তুলনামূলক বিচারে ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে কানাডা এবং ইসরাইলের উদাহারণ থেকে বোঝা যায় যে, সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদ প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ জরুরি নয়।
মার্কসের সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজে পৌঁছাবার প্রক্রিয়ায়, এ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ অন্তরায় বলেই অনেক মার্কসবাদীর ধারণা। তারা মনে করেন, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সাথে প্রয়োজন হল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিজ্ঞানের ক্রমাগত বিকাশ।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন, রাশিয়া থেকে শুরু করে ভারত, থাইল্যান্ড, ইসরাইলের মত দেশগুলিকে।
কিন্তু, বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের একটির নামও এ তালিকায় দেখা যাচ্ছে না, যদিও কিছু কিছু দেশ মাথা পিছু আয়ের নিরিখে বিশ্বের প্রথম কয়েকটি ধনী রাষ্ট্রের অন্তর্গত। তারা নিজেরা কোনো উদ্যোগ না নিয়ে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলি কবে ভ্যাকসিন তৈরি করবে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
ধর্মীয় নেতৃত্বও, যাদেরকে বাংলাদেশে প্রচলিত ভাষায় আলেম সমাজ বলা হয়, তারাও শুধুমাত্র দোয়ার উপর জোর দেবার কথা বলছেন। ইসলামে যে দাওয়ার উপরও জোর দিতে বলা হয়েছে, সে কথা তারা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। এ আলেম সমাজ সবসময় অতীতের ইসলামের গৌরবের কথা বলেন। বর্তমানের মুসলমানদের গৌরবজনক ভূমিকা পালন করতে বলেন না। অতীতের ইবনে সিনাকে নিয়ে তারা গর্ব করেন, কিন্তু বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে নতুন কোনো "ইবনে সিনাকে" করোনা মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে "দাওয়া" আবিষ্কার করবার আহবান জানান না।
বস্তুবাদী দার্শনিক মার্কসের পুরো নির্ভরতা আবার শুধুমাত্র "দাওয়ার" উপরেই। তিনি মনে করেন বিজ্ঞানের ক্রমাগত বিকাশ যেমন মানুষের মাঝে সমস্ত ভেদাভেদ ঘুচিয়ে উন্নত সমাজ বিনির্মাণ করবে, তেমনি নতুন নতুন "দাওয়ার" আবিষ্কার মানুষকে রোগ, ব্যধি, জরা জয় করতে সাহায্য করবে। আজ সারা বিশ্ব তেমনি তাকিয়ে আছে নতুন দাওয়ার দিকে, বিজ্ঞানের আরেক ধাপ অগ্রগতির দিকে। একবিংশ শতাব্দীতে কার্ল মার্কসের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা এ জায়গাটিতেই।