Published : 11 Mar 2020, 04:05 PM
আমাদের দেশে ছোটদের পাঠ অভ্যাস তৈরিতে যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা মাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে বা করে যাচ্ছে তার মধ্যে খেলাঘর, কচি-কাঁচার আসর, উদীচী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি পত্রপত্রিকা, বেতার বা দূরদর্শনেরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
দূরদর্শনের কর্পোরেট মাজেজায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমায় উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ভূমিকাও দৃশ্যত সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পাড়ামহল্লা ভিত্তিক একসময় বড় ছোট শহরে যে গ্রন্থাগার ও পাঠাভ্যাস ও পাঠচক্রের ঐতিহ্য ছিল তাও বিলুপ্তির পথে।
পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কচি-কাঁচার আসর বা খেলাঘর আসরও আগের অবস্থানে নাই। সে জায়গা দখল করেছে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার পাঠক ফোরাম বা বন্ধুসভা ধরনের কার্যক্রম। উপরে উপরে পত্রিকাগোষ্ঠীগুলো যাই বলুক ভেতরে ভেতরে তাদের উদ্দেশ্য বাজার তৈরি করা বা বাজার ধরে রাখা। এই বাস্তবতা নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার আগে অন্যান্য সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে পাঠ অভ্যাস তৈরিতে যেসব উদ্যোগ বিদ্যমান সেসবে আলোকপাত করতে চাই।
প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই, ওইসব দেশে ছোট হোক বড় হোক– বইমেলাগুলোতে বিষয়ভিত্তিক বইয়ের জন্যে নানারকম আয়োজন থাকে। আলাদা আলাদা অনেকগুলো মঞ্চও থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ছোটদের বইয়ের জন্য মঞ্চ। এরকমভাবে রান্নাবান্নার বইয়ের জন্যে, বাগান বিষয়ক বইয়ের জন্যে, প্রবন্ধ–নিবন্ধের বইয়ের জন্যে, অপরাধ কল্পকাহিনীর জন্যে, কবিতার জন্যে, গল্পের বইয়ের জন্যে স্বতন্ত্র মঞ্চ থাকে। এসব জায়গায় লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক সংলাপ ও বিতর্কে অংশ নেন। এসব বিতর্ক অনেক সময় পত্রিকায়, অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, দূরদর্শনে, বেতারে প্রচারও করা হয়।
এমনকি ওইসব দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও মানবতাবাদী সমাজকল্যাণমূলক ন্যায়ভিত্তিক জনপদ তৈরিতে পাঠচক্রসহ নানা কর্মসূচি নিয়মিত পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ভেদাভেদকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। গ্রন্থাগারগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গ্রাম মহল্লা পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষ এসব গ্রন্থাগারে বই সরবরাহ করে দায়িত্ব শেষ করে না। পাঠ অভ্যাস তৈরিতে গ্রন্থাগারগুলো সারাবছর ধরে নানা কর্মযজ্ঞের আয়োজন করে।
এর বাইরে সারাদেশব্যাপী একাধিক পাঠ্যক্রমিক সংগঠন বা স্টাডি অর্গানাইজেশন পাঠ অভ্যাস তৈরির জন্যে পাঠচক্রসহ নানা কর্মশালা, কোর্স, সভা-সেমিনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যার সংখ্যা মিলিয়ন মিলিয়ন। আর এ ধরনের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এসবের অর্থের যোগান আসে কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকার এবং জেলা পরিষদ থেকে। এসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোও পাঠচক্রের আয়োজন করে নিজেদের কর্মী সমর্থকদের জন্যে।
এর বিপরীতে আমাদের বাস্তবতা কি? আমাদের এখনো গ্রন্থাগার বলতে জেলাশহর পর্যন্তই আটকে আছে–উপজেলাগুলোও এখনো গ্রন্থাগারসমৃদ্ধ হতে পারেনি। পাঠ্যক্রমিক সংগঠনের চিত্র নিয়ে লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি। এরকম সংগঠনের কার্যক্রম গ্রাম মহল্লা পর্যন্ত আমাদের বিস্তৃত করার দরকার ছিল। কেন দরকার? এ প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা কথা স্মরণ করব। তিনি একবার বলেছিলেন– বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি ছেলেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যোগ দেয়নি।
এবার সমাজিক যোগাযোগ বলয় বা সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক নিয়ে কথা বলব। কার্যকর দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে আইন করে বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে চেয়ে– ডিজিটাল অপরাধ আদালত করে দিয়ে বসে থাকেনি। সেসব দেশে সমাজিক যোগযোগ মাধ্যম নিয়ে রীতিমতো গবেষণার ব্যবস্থা রয়েছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠ্যক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি বিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের সম্যক ধারণা বা সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। এমনকি অভিভাবক সমাবেশ করে ফি বছরে এসব বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়। নানা পেশাদারি পর্যায়ে তাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ে বিধি, রীতি-নীতি ও অগ্রপশ্চাৎ বিষয়ে হাতে কলমে ধারণা দেয়া হয়।
এর বিপরীতে আমাদের প্রস্তুতি কী? আমাদের আয়োজন কী?
এবার অন্য একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করব। সম্প্রতি "এখন কী বই পড়ছো" শিরোনামে মুহম্মদ জাফর ইকবাল কয়েকটি পত্রিকায় একটি লেখা ছেপেছেন। এই লেখার এক জায়গায় একজন সাংবাদিকের একটা প্রশ্নের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি লাইনগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি:
"… ফেসবুক সেলিব্রেটিদের লেখা বই হঠাৎ করে বেস্টসেলার হয়ে যাচ্ছে সেটা সম্পর্কে আমার মতামত কী। … আমি বলেছি, নেটওয়ার্ক সেলিব্রেটি হওয়ার কারণে একজনের লেখার যদি হঠাৎ করে বেস্টসেলার হয়ে যায় তাতে সমস্যা কোথায়?"
সমস্যা মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক না দেখলেও সমস্যা রয়ে গেছে বিস্তর। প্রথমত, গোটা একটা প্রজন্মের বড় অংশ একটা ক্ষতিকর একপর্যায়ে বিরক্তিকর লেখাজোখার সঙ্গে পরিচিত বা অভ্যস্ত হলে সমূহ নানা ঝুঁকি থাকে। একটা দৃশ্য নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি এই নেটওয়ার্ক আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ বুকে পিঠে 'আমি রাজাকার লিখে' গণমাধ্যমের খবর হয়েছিল। একই নেটওয়ার্কের কারণে জামায়াতি উপাদানে ভরপুর লেখাজোখাও বেস্টসেলার হয়ে গেছে। এসব কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বা অধ্যাপক পণ্ডিতরা জানেন? বা খোঁজখবর রাখেন? এসব নেটওয়ার্ক বা ফিল্টারে যদি মওদুদী সাহিত্য বা জঙ্গিবাদও একদিন তরুণদের একটা বড় অংশের মগজধোলাই হয়ে যায় তখন মুহম্মদ জাফর ইকবালরা কী বলবেন?
শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়–গোটা পাঠ অভ্যাস তৈরির প্রজাতন্ত্রে যদি ফিল্টারিং-এ গলদ থাকে তাহলে বিদেশি চলচ্চিত্রের কাহিনী নকল করে লিখে কেউ কেউ জনপ্রিয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক হয়ে যায়। এরকম উদাহরণও যেমন আছে, তেমনি অন্যদিকে হিন্দি ছবির কাহিনী নকল করে করে লিখে মুখরোচক কথাসহিত্যের জনপ্রিয় লেখকের দৃষ্টান্তও আছে।
আমাদের দরকার কার্যকর বাস্তবসম্মত গঠনমূলক ফিল্টারিং ব্যবস্থা। এর জন্যে দরকার উল্লিখিত সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য বিষয়ে সংস্কার ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এর শুরুটা হতে হবে ঘর থেকে; বিদ্যালয় থেকে। এজন্যে দরকার প্রতিটি ঘরে ঘরে যেমন বই পড়ার অভ্যাস, তেমনি প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার। ছোট হোক বড় হোক একটা বিদ্যালয় একটা গ্রন্থাগার, ডিজিটাল ও ছাপানো বই ব্যবস্থাপনায় সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।
এই বিষয়ে আরো কিছু কথা বলার আগে এবার ফেব্রুয়ারির গ্রন্থমেলা শেষে কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই। তাদের তথ্যমতে ২০২০ সালের মেলায় মোট বই প্রকাশিত হয়েছে চার হাজার ৯১৯টি। এর মধ্যে মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা ৭৫১টি। এখন আমার প্রশ্ন মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথা মত আমরা যদি নেটওয়ার্ক ফিল্টারিং মেনে নি-ই তাহলে বইমেলা কর্তৃপক্ষের আবার মানসম্মত বইয়ের তালিকা করার তাৎপর্য কী? আরো একটি প্রশ্ন– এরকম মানসম্মত বইয়ের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াটা কী?
বইপড়ুয়া ছোটদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখায় আশা প্রকাশ করেছেন ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন– "তুমি এখন কী পড়ছো?"
আমি বলব অন্য কথা। আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই ছেলেমেয়েরা একজন লেখককে উল্টো প্রশ্ন করবে– আপনি এখন কী পড়ছেন? মেলা থেকে কী কী বই কিনলেন? ছেলেমেয়েরা একজন জনপ্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেয়া বা সেলফি শিকার করে তা ফেসবুকে দেয়ার চেয়ে তারা বরং লেখককে প্রশ্ন করবে, চ্যালেঞ্চ ছুড়ে দেবে– আপনি এটা কেন লিখলেন? আমরা চাই ডিজিটাল বা ডিজিটাল নয় সব পর্যায়ে এরকম আত্মবিশ্বাসী প্রজন্ম গড়ে তোলার ফিল্টারিং ব্যবস্থা। তার প্রভাব পড়বে গণমাধ্যম, প্রশাসন, রাজনীতি আর শিক্ষাব্যবস্থায়।
বাসার ছেলেমেয়েরা তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করবে– কী বই পড়ছো?
শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে প্রশ্ন করবে স্যার কী বই পড়ছেন?
সংসদে মন্ত্রী সংসদ সদস্যরা বই পড়া নিয়ে বিতর্ক করবেন। মঙ্গলবারের প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে বই পড়া নিয়ে প্রশ্ন করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের আর সরকারি গুরত্বপূর্ণ দফতরের আমলাদের আমাদের গণমাধ্যমের ভাইবোনেরা প্রশ্ন করবেন, উপাচার্য মহোদয়, সচিব সাহেব আপনি কী বই পড়ছেন?
শেষে প্রশ্নটা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকেও "স্যার, এখন কী বই পড়ছেন?"