Published : 07 Jan 2020, 12:24 PM
রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। সহপাঠী ধর্ষণের শিকার হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।
কে ধর্ষণ করল মেয়েটিকে? কি তার পরিচয়? কেন ধর্ষণ করল? কী তার অপরাধ? এসব প্রশ্নের মীমাংসা হয়তো কোনোদিনই হবে না। তবে আমাদের সমাজে ধর্ষিত-অপমানিত-লাঞ্ছিত হওয়া মেয়েদের একটা বড় 'অপরাধ' আছে। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার 'অপরাধ'। মেয়ে হলে সে ধর্ষিত হতেই পারে। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত হচ্ছেও তাই। যে যখন সুযোগ পাচ্ছে, হামলে পড়ছে মেয়েদের ওপর। পিশাচ-কবলিত এই সমাজে ধর্ষণ থেকে যেন মেয়েদের মুক্তি নেই!
বল প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মা এবং দেহের ক্ষতিই নাকি বলাৎকার, ধর্ষণ। সমাজে এটা বেশ ভালোভাবেই চলছে। যে যখন সুযোগ পাচ্ছে, বলাৎকার করছে। রাজধানীর কুর্মিটোলায়ও তাই-ই হয়েছে। তবু ভালো যে 'শ্রেণি-চেতনা' থেকে হোক, কিংবা অজ্ঞাত পরিচয় ধর্ষকের হাতে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর অপমানে 'মর্যাদায়' আঘাত লাগার কারণেই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। এ জন্য তাদের অভিনন্দন জানাতে হয়! এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তো কত কত মেয়ে তাদেরই সহপাঠী, কর্মচারী, ছাত্রনেতা, মান্যবর শিক্ষকদের দ্বারা নির্যাতিত হন। সেসব ঘটনার খুব একটা প্রতিবাদ হয় না। যে যার মতো গা বাঁচিয়ে চলেন। এবার অন্তত প্রতিবাদটা হচ্ছে!
আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কারও কোনো বিকার নেই। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। আর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন মোট ২৫৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৪৪ জন পুরুষ। এছাড়াও ২০১৯ সালে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন ১৭ জন নারী ও পুরুষ। এসব পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে নীরব। আমাদের রাজনীতিবিদরা নীরব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নীরব। জাতির বিবেক নীরব!
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অম্লান দত্ত লিখেছিলেন, 'অন্তর্ঘাতী হিংসায় মানুষ অন্য বহু জীবকেই ছাড়িয়ে যায়। কোলকাতার যেখানে আমার বাস, সেখানে মানুষে মানুষে খুনোখুনি লেগেই আছে। আমাদের বাড়ির পিছনে ধানখেত। রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। পাড়ার কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের মাঝে মাঝে লড়াই লাগে। এক-আধটা শেয়াল কখনও কখনও মারা যায়। কিন্তু কোনও কুকুর অন্য কুকুরকে খুন করেছে এমন চোখে পড়েনি। মানুষ যদি পারস্পরিক হিংসায় কুকুরের স্তরে উন্নত হতে পারত তা হলে আমাদের অঞ্চলে শান্তি বৃদ্ধি পেত।'
সত্যি আমরা পারস্পরিক হিংসায় এখনও কুকুরের স্তরে পৌঁছতে পারিনি। তা না হলে আমাদের দেশে শিশু ও নারী ধর্ষণ এবং হত্যার এমন মহোৎসব চলতে পারে? আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার রাজনীতির দাপটে প্রতিনিয়ত শিশু ও নারী যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হচ্ছে। অথচ এর কোনো জোরালো প্রতিবাদ, প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধান হচ্ছে না।
ধর্ষণপ্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত রাজনীতি, সংস্কৃতি, আধুনিক যন্ত্রপ্রযুক্তি, পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে। সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতাবোধ লোপ পায়, আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, পারস্পরিক সম্মান-মর্যাদা কমে যায়, তখন নানা ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণসহ নান অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে এবং সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে।
আমাদের সমাজে এখন পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। আইন না মানার, গায়ের জোরে নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ধর্ষণ এবং খুনের মতো নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বৃদ্ধি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব ঘটনার সাথে প্রধানত নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রভাবশালী চক্র জড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরাই সমাজের চালক হয়ে আছে। অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তি ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে। একজন ধর্ষিতার ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আরও বেশি অবমাননাকর এবং কঠিন। এমনও দেখা গেছে, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের জন্য এটা মোটেও অনুকূল নয়।
শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মধ্যে ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
না, এর কোনো সহজ সমাধান আছে বলে মনে হয় না। সামাজিক জাগরণ ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা কম। আইনের কঠোর প্রয়োগ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ইত্যাদি অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রয়োজন আরও অনেক কিছু। যেমন নারীর প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারী একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মানব সত্তা, এই বোধ সবার মধ্যে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবাইকে ভাবতে এবং ভাবাতে হবে যে, নারীকে কোনো অবস্থাতেই অমর্যাদা করা চলবে না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো নারীকে স্পর্শ করা যাবে না, অপমান বা অপদস্থ করা যাবে না। এটা অপরাধ, অন্যায়।
যৌন হয়রানি বা যে কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি নারী নির্যাতন করে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা। রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। কোনো নির্যাতনকারী যেন দলে স্থান না পায় সে ঘোষণা থাকতে হবে। সেই ঘোষণার বাস্তব প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে সরকারি-বেসরকারি ফরমাল-ইনফরমাল কোনো ধরনের কাজে নিয়োগ করা চলবে না। এ ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে।
আরেকটি কথা, নারীকে হেয় করে, যৌনতাকে উস্কে দেয়, এমন সব ধরনের নাটক-বিজ্ঞাপন-সিনেমা-গান নিষিদ্ধ করতে হবে। যে কোনো ধরনের পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এ জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।
পরিবারে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা, সম্মান করা, অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকার চিরায়ত মূল্যবোধ মেনে চলতে প্রত্যেককে উৎসাহী করে তুলতে হবে। আধুনিকতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা বা নৈতিকতা হারানো নয়, বরং নিজেকে আরও সভ্য করে তোলার উপায়, এ মানসিকতা সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।
ধর্ষণের মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো গতি নেই। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়াতে অপরাধীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তারা যা খুশি তাই করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক প্রতিরোধ কোনোটাই জোরদার হচ্ছে না। ফলে দেশটা ক্রমেই অপরাধীরদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ যদি নিরাপদে থাকতে না-ই পারে তাহলে আমাদের এই পোশাকি গণতন্ত্র আর উন্নয়ন দিয়ে কী হবে?
যৌন হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই ধর্ষিত হয় না, ধর্ষিত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, নারীর অসম্মান, মানবতার অসম্মান, পুরো সভ্যতার জন্যই মানহানিকার। খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই৷ অপরাধ স্বীকার করলে খুনিকে ক্ষমা করা যেতে পারে৷ তার সংশোধনের সুযোগও গ্রাহ্য৷ ধর্ষণকারীর বেলায় সেটা খাটে না৷ কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হবে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে৷
অথচ আমাদের দেশে এক দল মানুষ ধর্ষণ করছে, আরেক দল মানুষ চুপ থেকে ধর্ষণকারীদেরই সমর্থন যোগাচ্ছে। এর ফলে ধর্ষিত হচ্ছে আমাদের সামাজিক নীতিবোধ। ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে যখন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না, একজন ধর্ষণ করে আর অন্যরা যখন নীরব থাকে কিংবা ধর্ষকের পক্ষে যাবতীয় যুক্তি আর সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তখন তাকে সামাজিক ধর্ষণ ছাড়া কী বলা যায়? এটাই এখন আমাদের দেশে বেশি বেশি ঘটছে!
নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ করে পুরুষরা। কাজেই এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই। সংশোধিত হতে হবে আগে তাদেরকেই। মানুষ হতে হলে 'মনুষ্যত্ব'কেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে, লাম্পট্য কিংবা বিকৃতিকে নয়। এটা মানবতার দায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সারা দেশ গর্জে উঠুক: স্টপ রেপ! উই ওয়ান্ট জাস্টিস!