Published : 01 Dec 2019, 02:22 PM
এইচআইভির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিশেষত মাদক ব্যবহারকারীদের নিয়ে ৯০ এর দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে এইচআইভি প্রতিরোধে যে কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে আসছে বাস্তব পরিস্থিতি ও বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের কারণে তার পরিসর ও অংশীদারিত্ব নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। সরকার, উন্নয়ন সহযোগী ও এনজিও এক হয়ে টেকসই এইচআইভি কর্মসূচির জন্য সরকারের সরাসরি অংশগ্রহণকে আরো কীভাবে কার্যকর করা যায়? সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এইচআইভি সেবাসমূহকে আরো কীভাবে সমন্বিত করা সম্ভব? এইচআইভি প্রতিরোধ সেবাকে মাল্টি-সেক্টোরাল-অ্যাপ্রোচ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার সরকারের যে প্রতিশ্রুতি তাকে কীভাবে আরো তরান্বিত করা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই এই লেখার উদ্দেশ্য। আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত মাদক ব্যবহারকারীদের নিয়ে পরিচালিত কর্মসূচিতে কারণ এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার বেশি। এই হার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই এদের মাধ্যমে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি ছড়ানোর আশংকা হ্রাস পাবে।
আমরা জানি যে, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের পূর্ব পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্তদের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেবা প্রদান করা হতো বেসরকারি সংস্থাসমূহের মাধ্যমে, বর্তমানে যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম (এএসপি) এর আওতায় ১১টি সরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। এর বাইরেও উচ্চ এইচআইভি হার বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী (NASP, 2017) সুঁই এর মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য সেভ দ্য চিলড্রেন ও সহযোগী সংস্থার ৬টি কমপ্রিহেনসিভ ড্রপ-ইন-সেন্টার (ডিআইসি) থেকে সরাসরি অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ (এআরভি) প্রদান করা হচ্ছে। বাস্তবায়নযোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে এনজিওদের কাজের অংশীদার করার এটি একটি ভাল উদাহরণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঠিক এই মুহূর্তে এইচআইভিতে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীসমূহকে (মাদক ব্যবহারকারী, পুরুষ ও মহিলা যৌনকর্মী, হিজড়া ইত্যাদি) পরিপূর্ণভাবে এইচআইভি সেবা প্রদানে (বিশেষত যৌনরোগ ইত্যাদি) সরকারি সেবাকেন্দ্রসমূহ পুরোপুরি তৈরি না, যে জন্য তাদের যথাযথ সংবেদনশীলতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন (Gourab G et al, 2019)। ইতোপূর্বে সরকারি সেবাকেন্দ্রে এআরটি ক্লিনিকসমূহকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে এনজিও ও সরকার যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন করেছে। একইভাবে কিছু সরকারি সেবাকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে ডিআইসিতে বিদ্যমান সেবাসমূহকে বর্তমান সহযোগী সংস্থা দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিচালিত করে একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এই প্রচেষ্টা সফল হলে তবেই এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া ভাল হবে, তার আগে নয়।
সুঁই এর মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য প্রচলিত এইচআইভি সেবা
গ্লোবাল ফান্ড এর অর্থায়নে, এএসপির তত্ত্বাবধানে সেভ দ্য চিলড্রেন নিজে এবং সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ৯,৫০০ সুঁই এর মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীকে ছয়টি জেলায় ২১টি ড্রপ-ইন সেন্টার এর মাধ্যমে সেবা প্রদান করে। এর মধ্যে ১২০০ জন মুখে সেবনযোগ্য ওএসটি সেবার অন্তর্ভুক্ত, যারা ৬টি সেন্টার থেকে এই সেবা নেয়। আইসিডিডিআরবি'ও একই দাতা সংস্থার অর্থায়নে তিনটি কেন্দ্রের মাধ্যমে ৫০০ জনকে ওএসটি সেবা দেয়। এইচআইভিতে আক্রান্ত সুঁইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত পাঁচটি কমপ্রিহেনসিভ ডিআইসি থেকে সরকার থেকে প্রাপ্ত এআরটি চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে সরকারের চতুর্থ স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচির মাধ্যমে ১০,০০০ জন সুঁই এর মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীর জন্য এইচআইভি সেবা (১৫০০ জনের ওএসটিসহ)। এর বাইরেও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিজস্ব তিনটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী) এবং ৩ শতাধিক অনুমোদিত বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে। যদিও ওইসব নিরাময় কেন্দ্র শুধু সুঁইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য না, বরং সব ধরণের মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য। তবে কিছু কেন্দ্রে সীমিত পর্যায়ে এইচআইভি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সামনের দিনগুলোতে সরকারি এবং বেসরকারি এই সব সেবা কেন্দ্রগুলোকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সেবা কার্যক্রম কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।
আমাদের এইচআইভি সেবা এখনও অনেকাংশে বাইরের সাহায্য নির্ভর। সেজন্য আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত, ক্রমশ কিভাবে এই সেবার সাথে বিদ্যমান সরকারি সমস্ত সুবিধাসমূহ সন্নিবেশিত করে এর ব্যপ্তি বাড়ানো যায়। এএসপি'র নেতৃত্বে সেভ দ্য চিলড্রেন একটি ওএসটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নে কাজ করছে, যেখানে দিকনির্দেশনা থাকবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব সেবা কেন্দ্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক নিরাময় কেন্দ্র এটি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, যাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সরকার এটি পরিচালনা করতে পারে।
এইচআইভি পরীক্ষার সম্প্রসারণ ও এইচআইভি কর্মসূচির বাস্তবায়নে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সরাসরি অংশগ্রহণ
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এইডস নির্মূলে সরকারের অঙ্গীকার পূরণে সেভ দ্য চিলড্রেন ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রয়াস নিয়েছে, যাতে বেশি বেশি করে মাদক ব্যবহারকারীদের এইচআইভি পরীক্ষার আওতায় আনা যায়। ডিআইসি'র বাইরেও ডিএনসির কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, কিছু বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র যেমন:ঢাকা আহছানিয়া মিশন, বারাকা ইত্যাদি চিকিৎসা কেন্দ্রেও এইচআইভি পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু জায়গায় নতুন করে এইচআইভি শনাক্ত হচ্ছে এবং যারা সরকারি বিদ্যমান সেবায় যুক্ত হচ্ছে। এই উদ্যোগ থেকে অর্জিত ফলাফল সামনের দিনগুলোতে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা করবে যাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদিত বেসরকারি ৩ শতাধিক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এইচআইভি সেবা সম্প্রসারণ করা যায়। বেসরকারি উদ্যোগের সাথে সাথে ২৩টি এইচআইভি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জেলায় সরকারি হাসপাতালে চতুর্থ স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচির আওতায় সাধারণ জনগণের জন্য এইচআইভি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছে এএসপি। যেসব কেন্দ্র মাদক ব্যবহারকারীসহ সব এইচআইভি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্যও উন্মুক্ত।
সাম্প্রতিক একাধিক অ্যাডভোকেসি সভায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে এইচআইভি কর্মসূচিতে সরাসরি অংশগ্রহণ বিষয়ে। যেহেতু মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণের হার বেশি এবং নিরাময় কেন্দ্রসমূহ তাদের আওতাধীন সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এএসপি ভাবতে পারে কিভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। এতে এইচআইভি কর্মসূচি দু'ভাবে লাভবান হবে। প্রথমত: এইচআইভি সেবার ব্যাপ্তী বাড়বে। যেসব জেলায় এএসপির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এইচআইভি প্রোগ্রামের ডিআইসি নাই সেখানে এই নিরাময় কেন্দ্রসমূহ ভূমিকা রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত: কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এইচআইভি কর্মসূচি বা মাদক ব্যবহারকারীদের নিয়ে যে কর্মকাণ্ড তা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নাই তারা তা জানতে পারবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের যে ধারা সমূহ মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য প্রচলিত কর্মসূচির সাথে সাংঘর্ষিক, তা পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। বর্তমান সময়ে মাদক ব্যবহারকারী ও মাদকব্যবসায়ী এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন টানা প্রায় অসম্ভব। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনার উপর এটি অনেকাংশে নির্ভর করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি ইতিবাচক পরিবেশের জন্য সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে যদি অগ্রসর হতে পারি তবে ভবিষ্যতে মাদক এবং এর সাথে সম্পর্কিত এইচআইভিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
ঝুঁকি হ্রাসের কমপ্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচে যুগোপযোগী পরিবর্তন
ঝুঁকি হ্রাসের যে কম্প্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচ ২০০৯ এ প্রণীত হয়েছে (WHO, UNAIDS, UNODC, 2012) তাতে উন্নত বিশ্বে অনেক সংযোজন ঘটেছে। এর অর্ন্তগত আটটি কার্যক্রম মোটামুটিভাবে অনুসরণ করতে পারছি, যদিও ভাইরাল হেপাটাইটিস-এর প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার জন্য আমাদের উদ্যোগ খুবই সীমিত। অদূর ভবিষ্যতে এটি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে সুঁইয়ের মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের হার ঢাকা শহরে ৩৯.৬% এবং প্রায় ১০টি এলাকায় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি শতকরা ৩০ ভাগের বেশি (NASP, 2011)। কিভাবে এই সেবাকে ঝুঁকি হ্রাসের কর্মসূচিতে সমন্বয় করা যায় সেটি এখন বিবেচ্য। হেপাটাইটিস বিষয়টি দেখভাল করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) কিন্তু এইচআইভি/এসটিডি'র দায়িত্ব এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম বা এএসপি'র। ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচির হেপাটাইটিস সম্পর্কিত সেবাটির জন্য সিডিসিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যেটি কার্যকরভাবে এখনো করা যায়নি। এএসপি কিংবা সিডিসি কারো অগ্রাধিকার লিস্টে সুঁইয়ের মাধম্যে মাদক ব্যবহারকারীদের হেপাটাইটিস সি সংক্রান্ত সেবা যেমন: শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নাই। সুঁইয়ের মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে যেহেতু এইচআইভি সংক্রমণ উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, তাদের হেপাটাইটিস সি'র বিষয়টিও গুরত্ব দিয়ে দেখা উচিত। সিডিসি'র অপারেশন প্ল্যান পরিমার্জনের সুযোগ আসলে এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের নতুন প্রকল্পেও বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সাধারণ জনগোষ্ঠীর হেপাটাইটিস সি এর প্রবণতা খুবই কম যা শতকরা হারে এক ভাগেরও নীচে (Mahtab MA et al, 2009), তাই মাদক ব্যবহারকারীকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাথে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না। হেপাটাইটিস সি গাইডলাইন প্রণয়ন এবং মাদকব্যবহারকারীদের প্রয়োজনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সন্নিবেশিত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
কর্মসূচির ব্যাপ্তি সমপ্রসারণ ও কাঠামোগত বাধা অপসারণ
যদিও এইচআইভিকে মাল্টি-সেক্টোরাল অ্যাপ্রোচ বলা হয় সেই প্রথম থেকেই কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি এখনো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ দপ্তরগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওএসটি সেবা শুরু হবার পর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক ব্যবহারকারীদের ঝুঁকি হ্রাসে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। মাদক ব্যবহারকারীদের চিকিৎসাকে ২০১৮ সালে প্রণীত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে (DNC, 2018) যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদক ব্যবহারকারী ও মাদক ব্যবসায়ী উভয়ের জন্য শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে মাদক ব্যবহারকারীদের (যারা আসলে অসুস্থ) নামে মামলা দিয়ে, তাদের গ্রেফতার করে বিচার ব্যবস্থাকে ভারী করে তোলা তাদেরও কাম্য নয়। বিধি সংস্কারে দীর্ঘ সময় ব্যয় না করে আইনের প্রয়োগ শিথিল করে জনস্বাস্থ্য, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে কিভাবে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচির বাস্তবায়নে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করতে হবে সামনের দিনগলোতে।
একজন মাদক ব্যবহারকারীর জীবনে এইচআইভি-ই কি একমাত্র সমস্যা? বা শুধু কনডম, লুব্রিকেন্ট, সুঁই-সিরিঞ্জ, সচেতনতার জ্ঞান দিলেই এইচআইভি নির্মূল হয়ে যাবে? গবেষণা যখন বলছে, মাদকব্যবহারকারী যারা রাস্তায় যারা থাকে তাদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ গুণ বেশি, যারা হোম বেইজড তাদের তুলনায় (Azim T, Chowdhury EI et al, 2009)। এদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কি? এইচআইভি কি একটি সামাজিক সমস্যা নয়? এই প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়- সেটা দেখার বিষয় বা আমরা কিভাবে একটি কার্যকর অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে তাদের এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করবো- সেটা ভাবতে হবে। একজন মাদক ব্যবহারকারীর জন্য ওএসটি বা মাদক নিরাময় চিকিৎসা লাভ করে পরিবারে ফিরে আসার পর একটা পুনর্বাসনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা বাঞ্চনীয়। কিন্তু কিভাবে এটি অর্জিত হবে? অনেকে মনে করে, কিছু ছোট-খাট প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ পরবর্তী সেলাই মেশিন বা পরবর্তীতে আর্থিক সহায়তা পরিস্থিতি পরিবর্তন করে ফেলবে। বিষয়টি ঠিক সেভাবে সফলতা আনে না। যুব উন্নয়ন, মহিলা বিষয়ক (মহিলা মাদক ব্যবহারকারীদের জন্য), সমাজকল্যাণ- সব মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করতে হবে-এভিডেন্স বেইজড পরিকল্পনা হাতে নিয়ে। কোনো এলাকায় কিভাবে এইচআইভি কর্মসূচি তাদের বিদ্যমান সুবিধাসমূহকে কাজে লাগাতে পারবে, সে ব্যাপারে একটি বাস্তবধর্মী বিচার বিশ্লেষণ করে আমাদের আগাতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় বা অধীনস্থ বিভাগের সাথে আলাদাভাবে- এএসপির নেতৃত্বে অ্যাডভোকেসি সেশনের আয়োজন করতে হবে।
মিডিয়ার ভূমিকা
'বাঁচতে হলে জানতে হবে' এই শ্লোগানের মাধ্যমে এইচআইভি মিডিয়া ক্যাম্পেইন যুব সম্প্রদায়সহ সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এইডসকে একসময় মরণব্যাধি হিসাবে মিডিয়াতে চিত্রায়িত করা হতো, কিন্তু এখন বলা হয় নিয়মিত ঔষধ খেয়ে একজন এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ দীর্ঘদিন ভাল থাকতে পারে। কার্যকর ফলাফল থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছুদিন এইচআইভি কর্মসূচিতে মিডিয়াকে সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। শুধুমাত্র হিজড়া কমিউনিটির তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির ইস্যুটিকে মিডিয়াতে ভালোভাবে প্রচার করে হিজড়াদের অধিকার ও সেবার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছে, মাদকাসক্ত বা যৌন কর্মী- এদের বিষয়টি সেভাবে তুলে ধরে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে তাদের প্রয়োজন ও কার্যকর সেবার বিষয়টি সেভাবে প্রচারে আসেনি। বর্তমান সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া (যেমন: ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ) ও কমিউনিটি রেডিওরও একটি ব্যাপক প্রভাব রয়েছে জনজীবনে। এসবের সাহায্যে যেকোনো তথ্য লক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাবে অতিদ্রুত। সুতরাং, এই বিষয়গুলোকে কিভাবে এইচআইভি কর্মসূচির সেবা সম্প্রসারণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটিও সামনের প্রকল্পের ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একজন এইডস রোগীকে de-stigmatized করে সমাজে তার বসবাস, সেবাপ্রাপ্তি সহজ করার ব্যাপারে মিডিয়ার কার্যকর ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।
উপরের আলোচনা থেকে মূল যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, সেগুলো হলো:
১.ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচিতে যুগোপযোগী এবং এভিডেন্স বেইজড সেবাসমূহ সন্নিবেশিত করা (যেমন: মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, আইনগত সহায়তা, হেপাটাইটিস সি সেবা ইত্যাদি);
২. সরকারি সেবা কেন্দ্রসমূহ (যেমন: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদক নিরাময় কেন্দ্রসমূহে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু পরিমাণে ডিআইসি/ওএসটি ক্লিনিক চালু করে এর বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করা;
৩. সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ সমূহকে (বিশেষত: সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রিড়া, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইত্যাদি) এইচআইভি প্রোগ্রামের যে জনগোষ্ঠী বিশেষত মাদক ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রার মানের সার্বিক উন্নয়নে কাজে লাগানো। আলাদাভাবে তাদের সাথে অ্যাডভোকেসির পরিকল্পনা করা, একটা গবেষণাকার্যের মাধ্যমে তাদের প্রায়োগিকতাকে শনাক্ত করা। গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পরিবর্তন শুধুমাত্র কমোডিটি (কনডম, সুই/সিরিঞ্জ ইত্যাদি) সরবরাহের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়, তার জীবনের সামাজিক ঝুঁকি/বসবাসের অবস্থান এসবকেও বিবেচনায় নিতে হবে;
৪. জেলখানায় পরীক্ষামূলকভাবে কিভাবে এইচআইভি সেবা চালু করা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে;
৫. এইচআইভি কর্মসূচিতে মিডিয়ার কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও কমিউনিটি রেডিও এইসব নতুন মাধ্যমকে বিবেচনায় আনতে হবে।
এএসপির লক্ষ্য এইচআইভি কর্মসূচিতে বেসরকারি সহযোগী সংস্থাসমূকে সাথে নিয়ে সরকারের আরো বেশি অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে একটি টেকসই এইচআইভি কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যাওয়া। রাতারাতি যেটি সম্ভব নয় তবে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে, যথাযথ প্রশিক্ষণ, কারিগরী ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে এটি সম্ভব। এইচআইভি কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সফলতা অনেক, আশেপাশের রাষ্ট্রের এইআইভি সংক্রমণের হারের সাথে আমাদের তুলনা করলেই এই সত্যতা দেখতে পাই। বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, দাতা সংস্থার সাথে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের আস্থার যে সম্পর্ক তাকে চলমান রাখতে হবে। যেই পরিবর্তনই আনা হোক, তা হতে হবে এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে, প্রায়োগিকতা যাচাই করে এবং কমিউনিটির সার্বিক মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বৃহত্তর কমিউনিটির সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২০৩০ এর মধ্যে এই জনপদ থেকে এইডস নির্মূল করা সম্ভব হবে।
সহায়ক গ্রন্থাবলী