তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভ: অটোমেশন বেকারত্ব সৃষ্টি করে না

Published : 11 Jan 2019, 01:26 PM
Updated : 11 Jan 2019, 01:26 PM

'তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভ' এ বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে আলোচনায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অটোমেশন প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। সঞ্চালক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং দুই মন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অটোমেশন ও রোবট ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী দ্রুত অটোমোশনের কারণে গার্মেন্ট সেক্টরে বেকারত্বের আশংকা করছেন।

রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেকারত্ব সৃষ্টি করে-এটা অমূলক ভীতি। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পেনি গোল্ডবার্গ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোবট সমষ্টিগতভাবে বেকারত্বের সৃষ্টি করে- এমন ধারণার কোনও ভিত্তি তাদের কোনও গবেষণায় পাওয়া যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের মতে অটোমেশনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও  নতুন ধরনের কর্ম সংস্থান হবে, কাজের ধরন পরিবর্তন হবে। অনেক অদক্ষ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারে, কিন্তু অনেক নতুন কর্ম সংস্থান হবে যেখানে সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ঠিক যে, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারে। কিন্তু যেটা আলোচনায় আসেনি, সেটা হলো সার্ভিস সেক্টরে দ্বিগুণ নতুন কর্মসংস্থান হবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবক শ্রমবাজারে কোনও সঙ্কট সৃষ্ট করবে না। পূর্ববর্তী তিনটি শিল্পবিপ্লবের কারণে কোনও ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেয়নি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে তেমন আশংকা নেই।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ব্যাপক অটোমোশনের কারণে আগামীতে ৭৫ মিলিয়ন শ্রমিকের কর্ম হারানোর ঝুঁকি আছে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির কারণে বিশ্বব্যাপী ১৩৩ মিলিয়ন নতুন কর্ম সংস্থান হবে।

প্রস্তুতকারী (ম্যানুফ্যাকচারিং), নির্মাণ  এবং পরিবহন এ ক্ষেত্রগুলোয় বেশি  বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। অপরদিকে, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোই যেমন কাস্টমার সার্ভিস, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন কারিগরি ক্ষেত্রে দ্বিগুণ চাকরি সৃষ্টি হবে। যত সংখ্যক চাকরি হারাবে তার দ্বিগুণ শরীক নতুন চাকরি পাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রীর আশংকা ঠিক যে, গার্মেন্টস সেক্টরে বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। অটোমেশনের কারণে গার্মেন্টস সেক্টরে প্রায় ২৫ শতাংশ শ্রমিকের কর্মচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এই আশংকার কারণে বৈশ্বিক অটোমেশনের মূলধারার চেয়ে ধীরে ধীরে অটোমেশন গ্রহণ করলে, দেশ পিছিয়ে যাবে।

অটোমেশন ছাড়া গার্মেন্টস ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে, পণ্যের মান উন্নত হবে না। যার ফলে গার্মেন্টস শিল্প রপ্তানি বাজার হারাতে থাকবে। প্রবৃদ্ধির ৭/৮ শতাংশ হার কোনভাবেই বজায় রাখা যাবে না।

কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশি চাকরি সৃষ্টি হবে, সে বিষয়ে আমাদের নিজেদের গবেষণার প্রয়োজন আছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষণার ফলাফলের সাথে আমাদের পরিস্থিতি মেলে কিনা নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। আমাদের  যেসব ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের সেই সব কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে কিছু দেশে শুরু  হয়ে গেছে। ইউরোপে কারখানার শ্রমিকদের সার্ভিস সেক্টরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।  পরিবর্তিত  সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের ধরনের কারণে বিশ্বব্যাপী 'গিগ ইকোনোমি' (Gig economy) এর প্রসার ঘটছে। 'গিগ ইকোনমি'তে শ্রমিক স্বল্পমেয়াদী ও ভ্রাম্যমান ধরনের হয়, যাদের সাথে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনও ধরাবাধা চাকরির চুক্তি হয় না। চাকরির ধরন অনেক ফ্রিল্যান্সার এর মতো হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগেই গত দুই দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্প কারখানায় ১০ শতাংশ কর্মচ্যুতি ঘটেছে। অন্যক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। এই কারণে বেকারত্বের হার কমেছে।

গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশনের কারণে  শ্রমিক ছাঁটাই হলেও মুনাফার পরিমান অনেক বেড়ে যাবে। আলোচনায় সঞ্চালক তৌফিক ইমরোজ বিদেশে অবৈধভাবে ব্যাপক অর্থ পাচারের  প্রসঙ্গ তুলেছেন। অর্থ পাচার সম্পর্কে উভয় মন্ত্রী অবহিত। তারা অর্থ পাচার বন্ধে যেমন আশাবাদ প্রকাশ করছেন, তেমন করা গেলে, দেশে কর্মসংস্থানের উৎসব শুরু হবে।

সম্ভাব্য বেকার গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে অবশ্য আমিও একমত। গার্মেন্টস মালিকদের সম্ভাব্য অতিরিক্ত মুনাফার একটা অংশ দিয়ে বেকার শ্রমিকদের সাময়িক বেকার ভাতা দেওয়া যেতে পারে। সরকারেরও ভূমিকা আছে। বেকার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য ক্ষেত্রে চাকরির জন্য প্রস্তুত করা।

অটোমেশনকে যতটা ভয় করা হয়, প্রকৃতপক্ষে শ্রমবাজারে অতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে  না। আমেরিকা, জার্মানি ও জাপানে সবচেয়ে বেশি রোবট ব্যবহার করা হয়। এই তিন দেশেই বেকারত্বের হার এখন সর্বনিম্ন। দেশে যখন এটিএম বুথ চালু হয় অনেকে ভেবেছিল, ব্যাংকগুলোর  অনেক শাখা বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাংকগুলোয় নিয়োগ আগের চেয়ে বেড়েছে। এটিএম বুথ এবং ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং ব্যাংকিং সেবার সম্প্রসারণ। ব্যাংক সেবার ক্ষেত্র বাড়ছে, এই ক্ষেত্রে চাকরিও বাড়ছে। ব্যাংক একটা উদাহরণ। সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু এই কারণে বেকারত্ব বাড়ছে না।

দেশে আগে 'লাগসই' প্রযুক্তির কথা খুব বলা হতো। এর অর্থ প্রযুক্তিকে আর্থ-সামাজিক  ও সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এইগুলো বামপন্থী কথাবার্তা। এই মনোভাব আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা যেকোনও ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কারণে কোনও বেকারত্বের সৃষ্টি হবে না যদি জনশক্তির উন্নয়ন করা যায়। এটাই এখন আমাদের মূল সমস্যা। আমাদের প্রচুর অদক্ষ ও আধা-দক্ষ মানব সম্পদ রয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে।

দক্ষতা বলতে শুধু  পেশাগত বোঝায় না। পেশার সঙ্গে প্রয়োজন যোগাযোগ দক্ষতা, উদ্ভাবনী দক্ষতা, আন্তঃব্যক্তিক ও সমন্বয়ের দক্ষতা। এই দক্ষতার অভাবে তথ্য প্রযুক্তি রপ্তানি খাত পিছিয়ে আছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অটোমেশন প্রযুক্তি আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে যদি আমরা মানব সম্পদ উন্নয়ন করতে পারি।