Published : 07 Jan 2012, 07:12 PM
ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ | ঢাকা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে আখাউড়া গিয়েছিলাম তিতাস নদীতে বাধ দিয়ে রাস্তা বানানোর উপর একটি টিভি রিপোর্ট দেখে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার এই দৃষ্টান্ত চোখে পড়তেই মনে পড়ে গেল এবছর মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসার দিন মতামত বিশ্লেষণে একটা লেখা লিখেছিলাম মনমোহনের সফর ও বাংলাদেশের ট্রানজিটমুখী উন্নয়ন স্বপ্ন| সেই সময় ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুবিধা অসুবিধা কী হবে তা বিশ্লেষণ করে বলতে চেয়েছিলাম যে ট্রানজিট ফী নির্ধারণে যদি পরিবেশ দূষণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ পলিউশন চার্জ বা দূষণ চার্জ ধরাও হয় তা আসলে ভুক্তভোগী জনসাধারণের কোনো উপকারে আসবে না | দূষণ চার্জ থেকে প্রাপ্ত আয় পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যয় হচ্ছে এরকম নজীর আমাদের দেশে এখনো নেই, বা ভবিষ্যতে হবে সেরকম কোনো উদ্যোগ নেওয়ার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না | তাছাড়া যেই দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুবিধা অসুবিধা সব সময়ই উপেক্ষিত সেই দেশে দূষণ চার্জ আদায় করা হলেও তার ব্যবহার নির্ভর করবে পুরোপুরি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের উপর | কাজেই অর্থনীতিবিদেরা যতই দাবী করুক যে পরিবেশ দূষণ ও ক্ষয়ক্ষতি বাবদ অর্থ দেশের উপকারে আসবে তা আসলে কখনই সম্ভব হবে না | আর এর প্রাথমিক দৃষ্টান্ত এই তিতাস নদীর মাঝখানে দেওয়া বাঁধ|
অনেকটা কৌতুহলবশেই গিয়েছিলাম তিতাসের বাঁধ দেখতে | ওখান থেকে ফেরার পর অনেক পত্রিকায় এই নিয়ে রিপোর্ট দেখেছি | বাংলাদেশের নদীপ্রেমী সচেতন জনগণ নদী হত্যার এই উদ্যোগকে ধিক্কার জানিয়েছে | অনেকে সরেজমিনে দেখে এসেছে তিতাস নদীর গলার উপর ফাসীর দড়ির মত আটকে থাকা বাধ যার উপর দিয়ে প্রতিদিন যায় ভারতীয় মালবাহী ট্রাক| দৃশ্যটি আমাদের জন্য কষ্টের কিন্তু সরকারের বক্তব্য এই বাধের নীচে দিয়ে দেওয়া হয়েছে কংক্রীটের পাইপ, যার মধ্যে দিয়ে এক পাশের পানি আরেক পাশে প্রবাহিত হয় | আমরা আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়ার পথে অনেকগুলি কালভার্টের কাছে থেমেছি | এবং বেশীরভাগ কালভার্টের পরিস্থিতি এক | প্রতিটি খালের উপর ভারী ট্রাক চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে বাধ এবং এর নীচে কনক্রিটের পাইপ দিয়ে দেওয়া হয়েছে পানি প্রবাহের জন্য | বিষয়টি যত সহজে সমাধান করা হয়েছে বলে দাবী করছে সরকার ততটা সহজ সমাধান এটি নয় | কারণ বেশীর ভাগ পাইপের মুখে পলি ও ময়লা জমে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে পাইপের মুখ | তাছাড়া প্রশ্ন করা যায় যদি অল্প খরচে মাটি ফেলে রাস্তা বানিয়ে আর কনক্রিটের পাইপ দিয়ে এখন সমাধান করা যায় তাহলে কালভার্ট বানানোর কী দরকার ছিল? তাহলে আগে থেকেই তো মাটি ফেলে বাঁধ দিয়ে সহজ সমাধান করা সম্ভব ছিল | এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে তাহলে এই বাধ কেন নির্মান করা হলো? উত্তরটি খুব সহজ | বাধ নির্মান কেন করা হয়েছে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে দেখতে হবে কার সুবিধার জন্য বাধ তৈরি করা হয়েছে | সুবিধাভোগী এখানে সাধারণ জনগণ নয়, সুবিধাভোগী এখানে ভারত |
যদিও সরকার বলছেন বৃহৎ অবকাঠামো তৈরি করতে সময় লাগবে এবং এই বাঁধ নির্মান একটি সাময়িক সমাধান মাত্র তারপরও কি নদীর স্বাভাবিক গতিকে প্রতিহত করে নদীতে মাটি ফেলে সরু করে এই সাময়িক সুবিধা দেওয়াকে মেনে নেওয়া যায়? আমরা সরেজমিনে কড্ডা ব্রীজের কাছে এলাকার জেলেদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি এই বাধ দেওয়ার কারণে নৌকা চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে, ফলে ক্ষুদ্র বিক্রেতারা যারা আগে নৌকা ব্যবহার করে ব্রীজের এপাশ থেকে ওপাশ যেত নৌকায় মালামাল পরিবহন করে তারা এখন আর তা পারছে না| তাদেরকে হয় অন্য পথে যেতে হচ্ছে বা নৌকা দিয়ে ব্রীজ পর্যন্ত বাকী পথ মালামাল পরিবহন করতে হচ্ছে হাত পথে | এতে মালামাল পরিবহনের খরচ বেড়ে গেছে | কিন্তু আমরা যখন এই ব্যবসায়ী বা জেলেদের সাথে কথা বলি তাদের কথায় চাপা ক্ষোভ প্রকাশ পায় | জন্ম থেকে এই মানুষগুলি নদীর অববাহিকায় বসবাসের কারণে নানা প্রতিকূলতা দেখে আসছে | তাদের কাছে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকা আর বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া এতটাই নিত্য নৈমত্তিক বিষয় যে নতুন করে বাধ নির্মানের কারণে যেই ক্ষতি তার সাথে তারা মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি দেখছে না | আর ঠিক এই সুযোগটাই নিচ্ছে সরকার | একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর নীরবতায় একটা বিশেষ পছন্দনীয় জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার এইতো উত্তম সুযোগ |
অনেকেই বলতে পারেন নদীর পানি স্বাভাবিকভাবেই এত কমে এসেছে যে এই বাধ নির্মানের ফলে আসলে তেমন বড় কোনো ক্ষতি হচ্ছে না | কিন্তু আমরা জানি নদীর গতিপ্রবাহ এমনিতেই ভীষণ জটিল | তার উপর নদীর উপর মানুষের তৈরি প্রতিবন্ধকতা নিশ্চিতভাবেই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে প্রতিহত করে | এই পরিবর্তন গুলি এতই ধীরে ঘটে যে অনেকসময় ভালোভাবে খেয়াল না করলে আমরা তা টের পাই না | তিতাস নদী এই বিশেষ জায়গায় এসে সরু হয়ে যাওয়ার কারণে খুব ধীরে কিছু পরিবর্তনের আলামত ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে | তার মধ্যে একটি হচ্ছে নদীর তীরবর্তী অনেক জায়গা ইতিমধ্যে বেদখল হওয়া শুরু করেছে | জমির দাম বাড়তে শুরু করেছে | এই ঘটনাগুলি কোনটিই আমাদের দেশের জন্য নতুন ঘটনা নয় | নদী ভরাট হওয়া শুরু করলে, সরু হয়ে গেলে এটাই স্বাভাবিক | কিন্তু ধীরে ধীরে এই দখল কী পদ্ধতিতে হয় সেটা প্রশ্ন করতে হবে | তিতাসের ক্ষেত্রে এবং তিতাস থেকে তৈরি যেই বিস্তীর্ণ খালের জাল ছড়িয়ে রয়েছে আশুগঞ্জ আখাউরা পথে তার পরিবর্তন যে এখনি দেখা যাবে এমন কোনো কারণ নেই | একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এই রাস্তা নির্মানের কারণে আর তার সাক্ষী হব আমরা আরো ১০-১৫ বছর পর | এই তিতাসের উপর নির্মিত বাধ যদি আজকে আমাদের বিচলিত না করে আরো ১০-১৫ বছর পর বিচলিত হওয়া আমাদের কোনো কাজে আসবে না | আর যদি দূষণ চার্জের কথাই ধরি, অর্থনীতিবিদেরা যখন জানেনই না নদীপথ কীভাবে পরিবর্তন হবে, তখন কীভাবেই বা এর ক্ষতিপূরণ করবে ট্রানজিট থেকে আসা অর্থ দিয়ে? এই প্রশ্নের জবাবই বা তারা কী দেবেন ?
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয় | আমাদের দেশে এক জনগোষ্ঠীর জীবিকার বিনিময়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে সুবিধা প্রদান নতুন কোনো ঘটনা নয় | শুধু কড্ডা ব্রীজের ক্ষেত্রেই নয়, বাধ দিয়ে ও পানি নিয়ন্ত্রণ করে একের সুবিধার্থে অন্যের ক্ষতি করার উদাহরণ আমাদের দেশের প্রতি প্রান্তে রয়েছে | নদীর পানির উপর নির্ভর করছে এদেশের আপামর জনগনের জীবিকা | এই আপামর জনগনের মুখের ভাষা প্রতিনিয়ত সেই গুটিকয়েক মানুষের কাছে পৌছায় না যারা নদীতে বাধ দেওয়ার এই নীল নকশা করেন | তাই অনেকেই বলছেন তিতাস নিয়ে জনগনের মধ্যে যেই আবেগ ও উত্তেজনা কাজ করছে তার অনেকটাই ভারত বিরোধী ও জাতীয়তাবাদী চিন্তার বহিপ্রকাশ | তাদের মতে যতটা মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে তিতাস নদীর উপর ততটা মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না দেশের অন্যান্য নদীর উপর আর তাই নদী হত্যা বন্ধের দাবী করলে সব নদী হত্যার দাবী করতে হবে, শুধু তিতাস কেন? এরকম যুক্তি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সর্ব-সমস্যা-সমাধানে ব্রতী উন্নয়ন দার্শনিকেরা আসলে কোনো সমস্যা সমাধান না করার দিকেই ইঙ্গিত করেন| তিতাস নদী নিয়ে জনগনের শংকাকে একটি ভারত বিরোধী চেতনাপ্রসূত আবেগ হিসাবে চিন্হিত করে এই সমস্যাকে খাটো করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায়|
বাংলাদেশের সব নদীর ধীর মৃত্যু যেমন আমাদের জন্য সমস্যা, তেমনি সমস্যা তিতাস নদীর ধীর মৃত্যুও | তিতাস নদী বাঁচানোর দাবী করা মানে অন্য নদীর মৃত্যু কামনা করা নয় | তিতাস নদী বাঁচানোর দাবী না করা মানে নদীর মৃত্যুকে নীরবে সমর্থন করা|