বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা ও করণীয়

ইসরাত বিজু
Published : 4 Oct 2011, 06:48 PM
Updated : 4 Oct 2016, 11:02 AM

রঙময়ী যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, তখনকার কথা। জীবনে প্রথম 'প্রেমে' পড়ে ও। মোটে দেড় মাসের একটা অবাক কৌতূহলী, রোমাঞ্চকর সম্পূর্ণ নতুন জার্নি, যেখানে সমবয়সী দুজন নিজ নিজ ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর ফার্স্ট গার্ল ছিল। সেই কিশোর-কিশোরীর প্রতিদিন বিপরীতগামী স্কুলে যাতায়াতের সময় পথের এপার-ওপার থেকে পরস্পরকে শুধু দেখাই ছিল প্রেম এবং দুপক্ষের সাপ্তাহিক দুটো চিঠি বিনিময় সার। চিঠিগুলোতে ছিল কার কী প্রিয়, কী খেতে পছন্দ, জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিয়াল 'ওশিন', নাটকের এপিসোড, সদ্য শেষ হওয়া কোনো উপন্যাস রিভিউ, বা জটিল উপপাদ্যের টিউটোরিয়াল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এসব 'আদান-প্রদান' কোনোদিনই মুখের ভাষায় হয়নি, হয়নি কোনো স্পর্শে। শুধু 'প্রেমপত্র'ই (যদি আদৌ সেগুলোকে প্রেমপত্র বলা যায়!) ছিল অনুভূতি বিনিময়ের মাধ্যম।

অতঃপর একদিন গৃহশিক্ষকের গোয়েন্দাগিরিতে 'ঘটনা' প্রকাশ এবং চিঠিসমেত সদর দপ্তরে (বাবার) পেশ। যে শিক্ষক কিনা কিশোরীটিকে 'Molestation' বা যৌনহয়রানির চেষ্টা করেন এবং কিশোরীটির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। শিক্ষকের অত্যাচারের ঘটনাটি কখনও পরিবারের কাছে শেয়ার করতে পারেনি ভয়ার্ত অসহায় ওই কিশোরী।

'প্রেমের' ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর প্রথম রাত মা-বাবা কেউ তার সঙ্গে কথা বলেননি। কেউ খেতে ডাকেননি। বিছানা থেকে সে শুধু প্রথম শ্রেণির বড় সরকারি কর্মকর্তা বাবার গুরুগম্ভীর ও বরফশীতল গলায় মায়ের সঙ্গে কথোপকথন শুনতে পেল, "ও যেন কাল থেকে স্কুলে না যায়। ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ।"

এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখে পড়া ১২-১৩ বছর বয়সী রঙময়ীর ওই রাতটিই ছিল তার জীবনের তখন পর্যন্ত সবচেয়ে আতঙ্কের। কারণ, ছোটবেলা থেকেই মেয়ে বড় সন্তান হওয়ার কারণে পিতামাতার মারাত্মক কড়া শাসনের অভিজ্ঞতা তার আছে। তাঁরা সামান্য-ছোট্ট ভুলে কত বড় শাস্তি দেন, সেটা সে জানে। আর আজ, জীবনের সবচেয়ে 'বড় অপরাধ' ঘটিয়ে ফেলার মাশুল যে কী এবং কত বড় হতে পারে, সেটা সে ধারণাও করতে পারছে না! ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ঝড়ের আগে থমথমে গুমোট ভাব দেখে একাকী অসহায় ছোট্ট মেয়েটি এতটুকু আন্দাজ করতে পারছিল, কালকের ভোর তার জন্য একটি বিভীষিকাময় দিন নিয়ে আসছে।

পরদিন তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হল। বিস্তারিত না গিয়ে শুধু এতটুকুই বলা যায়, চুল টানা, চড়-থাপ্পড় দেওয়ার পাশাপাশি কয়েক রকমের গাছের ডাল, রাবারের পানির পাইপ, মোটা বাঁশের হাতা-খুন্তি, স্যান্ডেল– যেগুলোর সবকটি শেষাবধি যার যার আসল চেহারা হারিয়েছিল! অনেকক্ষণ ধরে চলা শাস্তিপ্রদান প্রকল্পটি মা-বাবার চূড়ান্ত আক্রোশের ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর একটি যৌথ পরিবেশনা ছিল।

বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য থেকে বিছিন্ন করে, তিন মাস অনেকটা একঘরে রেখে পুনরায় তার স্কুলে যাওয়া মঞ্জুর হয়। তবে মাবাবার স্বতঃপ্রণোদিত ইচ্ছে ছিল না এটি। এক প্রতিবেশী মামার 'কাউন্সেলিং'এ রাজী হন তাঁরা, কিন্তু বেশ কয়েকটি কঠিন শর্ত ও প্রতিজ্ঞা করিয়ে। মেধাবী ছাত্রীর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা মিস হয়। বার্ষিক পরীক্ষা হয় চূড়ান্ত খারাপ। পরবর্তী জীবনের পড়াশোনায় হয়তো আর খারাপ করেনি, তবে সে ঘটনাটি রঙময়ীর মানসিক জগতে জীবনব্যাপী অনেক বড় ছাপ রেখে যায়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপারে সে আর কখনও সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। পুড়তে হচ্ছে এখনও, একাকী।

কোনো গল্প নয় এটি; একজনের জীবন থেকে শোনা সত্য কাহিনি।

এখন হয়তো বা হুট করেই চলে যাব 'প্যারেন্টিং প্রেসক্রিপশন' দিতে। না, প্রেসক্রিপশন নয়। প্রেসক্রিপশন দিতে হয় কোনো রোগ হলে, এবং প্রেসক্রিপশন দেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।

কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনের এ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়টিতে সঠিকভাবে 'গাইডেড' না হতে পেরে, না বুঝে করা আচরণগুলো তাদের যে কঠিন সময়ে ফেলে দেয়, তা তো কোনো রোগ নয়, কোনো পাপ নয়। আর আমিও প্রেসক্রিপশন লিখিয়ে কোনো ডাক্তার নই। দীর্ঘদিন শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করা, পড়ালেখা, মনোবিদদের কাছে প্রশ্ন করে, কাছের মানুষদের দেখে, পরিচিত ছোটদের পাশে থাকার চেষ্টা করে এবং সর্বোপরি নিজের পেরিয়ে আসা জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করি।

উপরের গল্পটিকে বলতে পারি বয়ঃসন্ধিকালের 'সমস্যা' এবং পারিবারিকভাবে এর 'মোকাবিলা' করার একটি কম্প্রাইজড বা সংকলিত টুকরো। বস্তুত এগুলো কোনো সমস্যা নয় এবং দ্বিতীয়ত, এগুলো মোকাবিলা করার মতো কোনো নেতিবাচক বিষয়ও নয়।

জীবনের ধাপে ধাপে বেড়ে উঠতে উঠতে যে ধাপে এসে যে বৈশিষ্ট্য 'ফলো' করতে হয় সবাইকে, এটি তেমনি একটি স্বাভাবিক পর্যায় এবং সে পর্যায়ের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তবে সময়টি জটিল অবশ্যই, কিন্তু পীড়াদায়ক বা বিব্রতকর নয় মোটেই। যেখানে শক্ত পারিবারিক বন্ধন এবং সাপোর্টই পারে এ জটিল সময় খুব সুন্দরভাবে এবং গঠনমূলকভাবে কাটিয়ে উঠতে।

প্রথমত আমরা দেখি, এ বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ যে স্বাভাবিক সে সম্পর্কে মেয়েশিশুটি পরিবার থেকে কোনো ধারণা পায়নি। আর সামাজিকতা থেকে যে শিক্ষা সে পেয়েছে, সেখানে একে অত্যন্ত গর্হিত 'অপরাধ' 'কলঙ্ক' ও 'পাপ' হিসেবে দেখিয়েছে। এটি একটি ভুল শিক্ষা ছিল। বরং ব্যাপারটি হতে পারত, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ কী, কেন– এটি যে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সে সম্পর্কে শিশুটিকে ইতিবাচক, বৈজ্ঞানিক ও সর্বজনীন ব্যাখ্যা দেওয়া।

দ্বিতীয়ত, যে পারিবারিক শিক্ষায় ব্যাপারটি আগে থেকেই 'অপরাধ' হিসেবে দেখা হয়েছে, সে পরিবার থেকে অবশ্য এ-সম্পর্কিত গঠনমূলক আলোচনা আশা করা যায় না। কিন্তু, পরিবারের ভূমিকা কী হতে পারত? বিষয়টি নিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের শুরুর দিকেই যদি প্যারেন্ট বিশেষ করে মা সুন্দর আলোচনা করে বুঝিয়ে দিতেন আসন্ন দিনগুলোর প্রস্তুতি সম্পর্কে– বুঝিয়ে বলতেন যে, আবেগ অনুভব করা স্বাভাবিক হলেও, সময়টি তখন উপযুক্ত নয়, কেন উপযুক্ত নয় তার জন্য তাকে সম্যক প্রস্তুতি নিতে হবে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে হবে, দায়িত্ববোধ জন্মাতে হবে, নিজেকে যথেষ্ট উপযুক্ত করে তুলতে হবে– তবেই মেয়েটি ওই ছোট বয়সের বোধ দিয়ে বিষয়গুলো বুঝে নিতে পারত। মা-বাবাকে বন্ধুর স্থানটি করে নিতে হত।

মেয়েটি কিন্তু গৃহশিক্ষক কর্তৃক যৌনহয়রানির শিকার হয়ে আসছিল। মা বা বাবা বন্ধুবৎসল হলে মেয়েটি তাদের সে বিষয়ে আগেই জানাতে পারত। এমনকি ভালোলাগার ছেলেটির সম্পর্কেও শেয়ার করতে পারত। তাহলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না।

তৃতীয়ত, তাঁরা জানার পর মেয়েশিশুটির সঙ্গে যৌথভাবে 'শাসন' নামের মারাত্মক নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন। যেখানে ছিল, 'ক্যাপিটাল পানিশমেন্টে'র পাশাপাশি শিশুটির কাছে দুর্বোধ্য প্রাপ্তবয়স্কদের সামাজিক টার্ম নিয়ে নেতিবাচক মৌখিক অত্যাচার, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বাবার প্রায় তিন মাস কথা বন্ধ রাখা, যে কোনো ইস্যুতেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মায়ের সে প্রসঙ্গ টেনে এনে কথা বলা, বাদবাকি ছোট ভাইবোনগুলোর জন্য যে 'কলঙ্কজনক' অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করে যাওয়া হল তা বারবার শোনানো ইত্যাদি।

শারীরিক অত্যাচারের ক্ষত হয়তো অল্পদিনেই শুকিয়ে যায়, কিন্তু মানসিক কিছু ক্ষত সারা জীবনেও শুকায় না। রঙময়ীর জীবনে যে অনুভূতি এসেছিল– সেটা যদিও সংজ্ঞায় ঠিক 'প্রেম' নয়, বরং বলা যেতে পারে বয়ঃসন্ধিকালে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৌতূহলজনিত নতুন ভালোলাগা, নতুন আকর্ষণ– যেটা তাদের নিজেদের কাছেও ছিল অবাক বিস্ময়ের।

রঙময়ীদের মতো টিনএজদের মা-বাবাদের যা করণীয়–

১. শিশুকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার আগে 'মানুষ' হিসেবে আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া;

২. জীবনের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ ও এর স্বাভাবিকতা, বৈশিষ্টগুলো নিয়ে বোঝানো;

৩. পড়াশোনায় সামর্থ নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনায় এনে তার অর্জিত ফলাফল নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে অযথা চাপ সৃষ্টি না করা। বিজ্ঞান বলে, প্রত্যেক মানুষই প্রায় সমান মেধা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তবে পরিবেশ, সামাজিক ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, সুস্থভাবে বা অসহায়ক পরিবেশে বেড়ে ওঠাই কিন্তু পরবর্তীতে কাউকে এগিয়ে ও কাউকে পিছিয়ে রাখে। এটা বোঝা উচিত, সবাই সব বিষয়ে সমান পারঙ্গমতা বা সক্ষমতা নিয়ে আসে না পৃথিবীতে। সবাই ইউনিক। একেকজনের একেক দিকে প্রচণ্ড দক্ষতা থাকে;

৪. কখনও শারীরিক শাস্তি দিতে যাবেন না। যত বড় অন্যায়ই করে থাকুক, গায়ে হাত তোলা যাবে না। এটা শুধুমাত্র নিষ্ঠুর অমানবিকতাই নয়, একটি শিশু বা কিশোরের সারাজীবনে মানসিক দাগ রয়ে যাওয়ার মতো ক্ষত;

৫. বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা, নিজের কাজগুলোর প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলুন। সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই 'এ কাজ শুধুই মেয়েদের', 'এ কাজ শুধুই ছেলেদের'– এভাবে বৈষম্যের শিক্ষা দেবেন না। পৃথিবীতে কোনো কাজই একান্ত মেয়েদের বা ছেলেদের নয়, কোনো কাজ 'লেবেলড' করে ফেলা ঠিক নয়। সব দায়িত্ব সমান। পুত্রসন্তানকে পারিবারিক দায়িত্ব নেওয়ার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি কন্যসন্তানটিকেও শেখান, পরিবারের 'ভার' নেওয়ার দায়িত্ব সবার সমান।

তেমনি ছোটবেলা থেকেই, মেয়েশিশুকে আপনার ইচ্ছামাফিক পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল জাতীয় খেলনা আর ছেলেশিশুকে রাইফেল, ট্যাংক পিস্তল ইত্যাদি দিয়ে বৈষম্যের শিক্ষা দেবেন না। তাকে খেলনার দোকানে নিয়ে যান। তার যেটা পছন্দ সেটাই তুলে নিক। তার শিশু-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করাই ভালো;

৬. শিশুর নিজের শরীর, নিয়ত পরিবর্তনশীল বর্ধন, বিশেষ করে প্রজননতন্ত্রসমূহের কাজ, লিঙ্গভেদে ভিন্নতা, ব্যক্তিজীবনে সেগুলোর ভূমিকা, যত্ন– সেগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা, তার শরীরের উপর সে ছাড়া আর অপর কোনো ব্যক্তির (সে হোক তার সমলিঙ্গের বা বিপরীত লিঙ্গেও এমনকি মা-বাবারও) কোনো ধরনের অধিকার বা সংশ্লিষ্টতা নেই সেটা বোঝানো, শরীরের নিরাপদ আওতা বুঝিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ একজন মানুষ দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিতে তার যতটুকু জায়গা প্রয়োজন, সেটাই তার অপরের কাছ থেকে নিরাপদ শারীরিক গণ্ডি। কী কতটা অনুচিত, কী উচিত সুন্দর করে যথোপযুক্ত উদাহরণের মাধ্যমে বোঝান।

পিউবার্টির সময়ে ছেলে-মেয়েদের মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে উদার মনোভাবসম্পন্ন হয়ে খোলামেলা কথা বলুন। নারীদের কী কী পরিবর্তন হয়, পুরুষদের কী কী পরিবর্তন হয়, এ সব পরিবর্তনই যে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রকৃতিগত প্রক্রিয়া– সেটা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্য উদাহরণ দিয়ে আগেই বুঝিয়ে মানসিকভাবে তৈরি করে রাখা। এ সময়ে হরমোনজনিত কারণে দ্রুততার সাথে ঘটতে থাকা শরীরের পরিবর্তনগুলো নিয়ে তাদের বিব্রত হয়ে পড়া বেশ পীড়াদায়ক। কিন্তু তাদের আশ্বস্ত করতে হবে, এটাই বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যা ঘটছে তা-ই হওয়ার কথা।

প্রয়োজন হল, এ সময়ে তাদের পাশে থাকা। সবচেয়ে ভালো হয়, মা মেয়েশিশুটির জন্য আগেই একটি 'পিরিয়ড কিট' তৈরি করে রাখতে পারলে। সেখানে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ তাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবহার পদ্ধতি বুঝিয়ে দিয়ে তৈরি করে রাখা। এতে শিশুটি মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি বিষয়টি সামলানোর ব্যাপারে যথেষ্ট তৈরি থাকবে।

ছেলেসন্তানটির ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিন প্রধানত বাবা। পরিবর্তনের এ সময় তাকে শরীরের নতুন পরিবর্তনগুলোর পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ, আচরণ নিয়ন্ত্রণ, মাদক ও অসৎসঙ্গের কুফল, নারীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা শেখানো, যেটা বন্তুত বাবার ব্যক্তিগত জীবনের চর্চারই প্রতিফলন হবে। বাবাকে যদি দেখে স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক এবং সহায়তামূলক আচরণ করতে, সন্তানের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আচরণও তেমনি গড়ে উঠবে।

মা-বাবারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন নিচের বিষয়গুলো–

ক. সন্তানের হঠাৎ গুটিয়ে যাওয়া। লক্ষ্য করুন, কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা বিশেষ মানুষের প্রতি তার কোনো ধরনের ভয় বা বীতশ্রদ্ধ আচরণ বা উল্টোটিও পর্যবেক্ষণ করুন। পরিবারের সদস্য ছাড়া হঠাৎ কারো সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতাও অনিষ্টের কারণ। দেখলে সে মানুষটির সঙ্গে তার মেলামেশা বন্ধ করে দিন। সন্তানকে আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করুন।

খ. হঠাৎ ওজন কমা বা বেড়ে যাওয়া, ঘুমের এবং নিত্যদিনের জীবনযাত্রার ধরনের আমূল পরিবর্তন আসা, আচরণে আমূল পরিবর্তন, অস্বাভাবিক রেগে যাওয়া, ধ্বংসাত্মক আচরণ, বন্ধুমহলে আমূল পরিবর্তন, পুরনো বন্ধুরা কোনো কারণে দূরে সরে যাচ্ছে, নতুন নতুন হঠাৎ বন্ধুর অন্তরঙ্গতা, স্কুল-কলেজে ঘণ্টা পালানো, বা প্রায়শই না যাওয়ার তথ্য পাওয়া, ধর্মীয় ব্যাপারে অতিউৎসাহী মনোভাব এবং ঘরে সবার উপর তার বলপ্রয়োগের চেষ্টা, প্রায়শই হতাশাজনক কথাবার্তা বলা, মজার ছলে, আত্মহত্যা বা কারও প্রতি জিঘাংসার মনোভাব, সারাক্ষণ নিজের ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব বা সংস্পর্শ থেকে গুটিয়ে যাওয়া, নিজের কক্ষে অন্য কারও প্রবেশাধিকার একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া, তার ঘর থেকে সিগারেট, মাদক বা অন্য কোনো আসক্তির জিনিস সম্বন্ধে সন্দেহ হওয়া, সব সময় কিছু লুকোনোর প্রবণতা, মিথ্যা বলার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, ঘরের অর্থ এবং মূল্যবান জিনিস চুরি যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি ইত্যাদি। ইন্দ্রিয় সজাগ রাখলে আরও অনেক কিছু গোচরে আসতে পারে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বুঝতে পারুন, দেখুন আর সন্দেহ করুন– কখনও সরাসরি আক্রমণাত্মক হতে যাবেন না। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বরং সন্তানের কাছে এসে উপযুক্ত পরিবেশে খোলামেলা আলোচনা করুন।

রঙময়ীদের প্রতি–

ক. এ সময়ে অনেক নতুন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে তোমাদের। এ জার্নি অবশ্যই কখনও কখনও অদ্ভুত, বিব্রতকর, অস্বস্তিকর, বেদনাদায়ক এবং বিষাদগ্রস্ত মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবে, এর সবই অত্যন্ত স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক এবং অল্প সময়ের। প্রত্যেক কিশোরীকেই এ পর্যায় পার করে আসতে হয়। মনে রাখবে, এটা তোমার শিশুকাল আর বয়ঃপ্রাপ্তির অতি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। এ সময়ে হরমোন তোমার শরীরকে, মানসিক অবস্থাকে তোমার ভবিষ্যতের জন্য তোমাকে তৈরি করতে থাকে। এ সময় সব ধরনের হরমোনের কাজের দ্রুত এবং শক্তিশালী বিচরণ ঘটতে থাকে শরীরে, বস্তুত যার কাজ ঘটে চলে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে। এ সময়ে প্রয়োজন, হরমোনাল চেঞ্জ এবং বায়োলজিকাল বিষয়গুলো, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিজের শরীর, অ্যানাটমি, মেডিকেল ব্যাপার সম্বন্ধে জানা।

খ. আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যতদূর সম্ভব। এ বয়সটিতে র‌্যাপিড হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন mood swing বা আবেগ এবং যে কোনো ব্যাপারেই অতি সংবেদনশীলতা দেখা দেয়, যা স্বাভাবিক। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

গ. যে কোনো সমস্যা অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের আগে জানাতে হবে। পরিবার অনেক সময় সঠিক তথ্য সঠিকভাবে সঠিক সময়ে জানানোর মতো যথেষ্ট সক্ষম নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে, নির্ভরশীল গঠনমূলক মনোভাবাপন্ন শিক্ষক বা বন্ধুর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা সবার হাতের নাগালে। ইন্টারনেটে puberty, adolescent period, pubertal hormonal change, mood swing, social psychology, teens' health ইত্যাদি শব্দ লিখে তথ্য জানার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ব্লগ, জার্নাল, ডক্টরস কলাম, সাজেশন, গ্রুপে নিজেকে সাবস্ক্রাইবড রাখা, অনেক জানার সুযোগ করে দেবে। এতে আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সঠিক বিষয় সম্বন্ধে জানা যায় এবং ভুল জানা থেকে দূরে থাকা যায়।

ঘ. পিয়ার বা সমবয়সীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। মতামত বিনিময় করতে হবে। তবে কোনো তথ্য বা পরামর্শ পছন্দ না হলে বা সন্দেহের উদ্রেক করলে অন্য কারও সঙ্গে বা ইন্টারনেটে পুনরায় যাচাই করে নেবে।

ঙ. তোমার শরীর সম্বন্ধে যেটা নিজের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়, সেটা থেকে দূরে থাকবে। নিজের শারীরিক 'দূরত্ব-বলয়' বজায় রাখবে। নিজের হাত প্রসারিত করে দুদিকে, সামনে, মাথার উপরে যতটুকু, ততটুকুই তোমার নিজস্ব শারীরিক দূরত্ব-বলয়। নিজের শরীর সম্পর্কে কখনোই কোনো নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবে না। তুমি যা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ, এটাই তোমার জন্য 'বেস্ট'। এটা তোমার শরীর। ভালোবাসো নিজেকে। তুমি অমূল্য।

চ. সঠিকভাবে সেক্স এজুকেশন সন্বন্ধে জান। পর্নোগ্রাফি, ইরোটিকা কখনও সঠিক শিক্ষা দেয় না। সেটা পুরো পেশাদার জগৎ। সঠিক যৌনশিক্ষা দেওয়া তাদের কাজ নয়। ভালো জার্নাল পড়বে, রিলেশনশিপ ব্লগ পড়বে, adolescent, teens' health সম্পর্কে লেখা আর্টিকেল পড়বে। আর বড় হতে হতে ধীরে ধীরে বিস্তারিত জানার জগৎ তো খোলা আছেই। যে সময়ের কাজ তা তখনই ভালো। তবে নিজেকে জানার প্রয়োজন সবার আগে। নিজেকে সম্মান করাাটা সবার আগে, তবেই অপরকে সম্মান করা যায়।

ছ. ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। খেলাধুলা, শরীরচর্চা, অ্যাডভেঞ্চার, স্বেচ্ছাসেবী কাজ, শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। তবে অবশ্যই সবার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে। কারও হাতছানি বা কোনো গ্রুপের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার আগে সব যাচাই করে নিতে হবে। অবশ্যই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারের সদস্য, নির্ভরযোগ্য বড় কেউ, শিক্ষক, মনোবিদ, শিক্ষিত পরিচিত কোনো পেশাগত দায়িত্বপালনরত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে নেবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করবে। অন্তত কোনো একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখার চেষ্টা করবে। যেখানেই যাও, যা-ই কর সব সময় নিজের একটি নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করে রাখতে হবে, যেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার থাকবে না।

জ. প্রতিটি পরিবোরেরই কিছু পারিবারিক নিয়ম, মূল্যবোধ, নৈতিকতার শিক্ষা থাকে। সেগুলো মেনে চলবে, অন্তত নিজের দায়িত্ব একা পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা যতদিন অর্জন না করছ। শ্রদ্ধাবান থাকার চেষ্টা করবে। মতবিরোধ হতেই পারে। কিন্তু যুক্তি হারানো যাবে না। তুমি এখনও বয়ঃপ্রাপ্ত হওনি। উনারা নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে বেশি প্রজ্ঞার অধিকারী। নিশ্চয়ই তোমার ভালোর জন্যই চেষ্টা করেন।

ঝ. নিয়মিত বই পড়া উচিত। সাহিত্যচর্চা যে কী বিশাল পৃথিবী অবারিত করে দেয়, তা পাঠাভ্যাসের চর্চা না করলে কখনও বোঝা যাবে না। সারাক্ষণ তথ্যপ্রযুক্তির জটাজালে আবদ্ধ না থেকে কাগজের পৃষ্ঠাগুলোতে মাঝে মাঝে ডুব দেওয়া উচিত। বলা হয়ে থাকে, বই পড়ার নেশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নেশা!

সন্তান আপনাকে তা-ই উপহার দেবে যা আপনি তাকে দিয়েছেন। আমরা সব সময় বলতে পছন্দ করি, সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু, আদতে জন্মানোর পর থেকেই শুরু হয়ে যায়, তাকে শুধুই 'নারী' বা 'পুরুষ' করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। এ 'মানুষ' করার কাজ কিন্তু শুরু হয়ে যাওয়া উচিত জন্মানোর আগে থেকেই মায়ের পরিপূর্ণ যত্ন নেওয়ার মাধ্যমেই। কন্যা আসছে না পুত্র সে চিন্তায় অধীর না হওয়াই ভালো।

মানবজীবনের ভিত্তি প্রথম দশটি বছর শিশুকে সুন্দর করে উপহার দিয়ে তাকে তার পরবর্তী আরও গুরুত্বপূর্ণ বয়ঃসন্ধিকালের জন্য প্রস্তুত করানো উচিত। যার জন্যে মা-বাবা হিসেবে নিজেদেরও যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা উচিত। কারণ, এ সময়টিই ঠিক করে দেবে, আপনার সঙ্গে আপনার সন্তানের বাদবাকি জীবনের সম্পর্ক কেমন হবে। আপনার সুষ্ঠু সাপোর্ট এবং যথার্থ প্যারেন্টিং পেয়ে আপনার সন্তান সবার প্রতি, দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি তার দায়িত্বপালনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে– নাকি আপনারই অবহেলা, অজ্ঞানতা আর স্বার্থপরতার কারণে নিজেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করে, দেশের না হয়ে সে এক জন নার্সিসিস্টিক সোশিওপ্যাথ বা সাইকোপ্যাথিক 'ভিকটিম' হয়ে যাবে।

তথ্যঋণ:

http://kidshealth.org

http://www.aacap.org

http://depts.washington.edu/healthtr

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3587658/