Published : 01 Jul 2014, 02:29 PM
ফরমালিনের অপ-কারবারীদের বিবেককে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে উনাদের লোভের কাছে আমাদের জীবন জিম্মি রেখে, সহায়-সম্পত্তি সব বিক্রি করে, ক্যান্সারে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাওয়াকে কীভাবে দেখেন?
প্রিয় পাঠক, আমার এই জিজ্ঞাসাটির মাঝে রয়েছে আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকারটি, আর সেটি হচ্ছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। এই অধিকার বাংলাদেশে যেভাবে হরণ করা হচ্ছে, এ রকম ভয়াবহ দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাবেন না কোথাও। ইন্টারনেটে খাদ্যে ফরমালিন লিখে ক্লিক করুন, দেখবেন প্রচুর বাংলাদেশ বিষয়ক ছবি আর সংবাদ। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও দুয়েকটি দেশ খুঁজে পাবেন, তবে এতটা ভয়াবহ মাত্রার নয়।
আমাদের দেশে এত মসজিদ, এত মন্দির, সৎ ব্যবসার এত ওয়াজ-নসিহত– কিন্তু কোথাও কেউ নেই বিবেকের ডাকে একটু সাড়া দেবার! ফরমালিনের মতো একটা বিষাক্ত পদার্থ খাদ্যে মিশানো অপরাধ প্রবণতার চূড়ান্ত এক অবস্থা। এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।
ফরমালিন হচ্ছে ফরমালডিহাইড নামক একটি বিষাক্ত রাসায়নিকের ৩৫ শতাংশ সম্পৃক্ত দ্রবণ। ফরমালডিহাইড এক ধরনের এলডিহাইড যা মিথানল জারণ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। আরেক ধরনের এলডিহাইড হচ্ছে এসিটালডিহাইড যা ইথানল বা সাধারণ ভাষায় মদের বিপাক থেকে তৈরি হয়। মদ এনজাইম বিক্রিয়ার যথাক্রমে এসিটালডিহাইড এবং এসিটিক এসিডে পরিণত হয়ে মূত্রের সঙ্গে বের হয়ে যায়।
সহজভাবে বলতে গেলে, এসিটিক এসিড হচ্ছে আমাদের অতিপরিচিত সিরকা বা ভিনেগারের (৪-৮% এসিটিক এসিড) মূল উপাদান। এসিটালডিহাইড বিষাক্ত এবং শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি করে। অনেকের ক্ষেত্রে এনজাইমের অভাবে বা অতিরিক্ত মদ গ্রহণের ফলে এসিটালডিহাইড এসিটিক এসিডে পরিণত হতে না পারায় তা শরীর থেকে বের হতে পারে না। ফলে ব্যক্তি হ্যাংওভারজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হন, এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে।
ফরমালিনের মূল উপাদান ফরমালডিহাইড আরও বিষাক্ত। ফরমালিনের মধ্যে আরেক বিষাক্ত রাসায়নিক, মিথানলও থাকে। তীব্র গন্ধযুক্ত বর্ণহীন রাসায়নিক ফরমালিন ব্যবহৃত হয় টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, পেপার ও পেইন্ট শিল্পে। তবে এটি অধিক পরিচিত মূলত মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণে।
ফরমালিন তার মূল উপাদান ফরমালডিহাইড গ্যাসের মতো তাৎক্ষণিকভাবে নাক-কান-গলা-চামড়াসহ শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে এলার্জিক ক্রিয়াসহ ব্যাপক ক্ষতি না করলেও দীর্ঘমেয়াদে মূলত মৃত্যুর দিকেই নিয়ে যায়। ফরমালিন ধীরে ধীরে শরীরের অভ্যন্তরীন অঙ্গসমূহ, যেমন কিডনি, লিভার, পাকস্থলীর লাইনিং অকেজো করে এক যন্ত্রণাদায়ক জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দেয়। তিরিশ মিলিলিটার (সিসি) ফরমালিন শরীরে একবারে প্রবেশ করতে পারলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে, এই ফরমালিন কারসিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যান্সার তৈরি করে। এক গবেষণায় জানা যায়, স্বল্পমাত্রায় অর্থাৎ ৬-১৫ পিপিএম (পিপিএম হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ভাগের একভাগ) মাত্রার ফরমালিনের সংস্পর্শে ইদুরকে দু'বছর রাখা হলে তার নাকে ক্যান্সার হয়। মানুষের ক্ষেত্রেও গবেষণার ফলাফল অনুরূপ। প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য বিপদজনক অণুজীব থেকে হাসপাতাল, তৈল খনি ও শোধনাগার, পশুখাদ্য স্থাপনা ও মেশিনারি ইত্যাদিকে জীবাণুমুক্ত করার জন্যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়।
খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মিশানো যেতে পারে, এটি সুস্থ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশে মাছ, শাক-সবজি আর ফলমূল হচ্ছে পুষ্টি সরবরাহের মূল উৎস, আর এই উৎসগুলিই ব্যাপকভাবে ফরমালিন-আক্রান্ত। বাংলাদেশের উষ্ণ আর আর্দ্র আবহাওয়া খাদ্যদ্রব্যের পচন ত্বরান্বিত করে। আর তাই ফরমালিনের জীবানুনাশক ও পচনরোধক চরিত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী যে খাদ্য আমাদের প্রাণ বাঁচাবে, সেই খাদ্যে ফরমালিন মিশিয়ে এক কথায় নিরব গণহত্যা চালাচ্ছে। শুধু ফরমালিন নয়, ফল পাকানোর ইথেফোন এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইডের নির্বিচার ব্যবহার ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রোপজিশন ৬৫ নামক একটি প্রোগ্রাম আছে যার অধীনে স্টেট কর্তৃপক্ষ ক্যান্সার এবং প্রজনন সক্ষমতার জন্যে বিষাক্ত রাসায়নিকের নাম এবং নিরাপদ মাত্রাটি প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভোটাররা বিষাক্ত রাসায়নিকের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে প্রোপজিশন ৬৫ চালু করেন যা অফিস অব এনভাইরনমেনটাল হেলথ হ্যাজারড (OEHHA) এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
প্রোপজিশন ৬৫ এখন ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত এবং আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত হয়েছে। প্রোপজিশন ৬৫ অনুসার, পণ্য উৎপাদকদের তালিকাভুক্ত রাসায়নিকের নাম ও মাত্রা প্রকাশ করতে হয় এবং প্রকাশে ব্যর্থ হলে হাজার হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়। যদি অপ্রকাশিত রাসায়নিক কোনো পণ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া যায় এবং ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে অসংখ্য মামলা-মোকাদ্দমায় জড়িয়ে অবশেষে ব্যবসায়ী বা কোম্পানিটিকে পথে বসতে হয়।
এনভাইরনমেনটাল প্রোটেকশন এজেন্সি, ইউএসএফডিএ-এর সহায়তায় বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে বিপদজনক রাসায়নিকের তালিকা করা হয়। প্রোপজিশন ৬৫ অনুসারে ফরমালডিহাইড মানবদেহে ক্যান্সার উৎপাদনকারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা এজেন্সিরও (IARC) একই অভিমত।
ফরমালডিহাইডের মাত্রা ০.০৫ পিপিএমের নিচে হলে মানুষের নাক গন্ধটি ধরতে পারে না। দীর্ঘদিন যাবৎ নিম্নমাত্রায় খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ফরমালিন বা ফরমালডিহাইড গ্রহণের পরিণতিতে হঠাৎ করেই হাজির হতে পারে যন্ত্রণাদায়ক এবং ব্যয়বহুল কর্কট রোগের ভীতিকর দুঃসংবাদটি।
সম্প্রতি ফরমালিনের অপব্যবহার রুখতে এবং মাত্রা নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে আইনের অনুমোদন দেওয়া হয় তা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আইনটির সঠিক এবং বিবেকবোধতাড়িত ন্যায়ভিত্তিক প্রয়োগের উপর নির্ভর করবে এর সফলতা। ফরমালিনের সংজ্ঞা নিরূপণের ক্ষেত্রটি আরও সম্প্রসারিত করে ফরমালডিহাইড, প্যারাফরমালডিহাইড ইত্যাদি সমার্থক কারিগরি শব্দগুলো একটি ক্যাটাগরিতে এনে আমদানি-সংক্রান্ত জালিয়াতি রোধ করা যেতে পারে। ফরমালিনের আমদানি থেকে উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রয় প্রতি ক্ষেত্রেই আইনটির প্রয়োগ থাকতে হবে।
আশংকা থেকে যাচ্ছে, অতীতের অনেক ভালো আইনের মতো এই আইনটিও অপরাজনীতিকেন্দ্রিক সুবিধাবাদী অর্থনীতির কূটচালে কাগুজে আইন পরিণত হয় কিনা কিংবা রাঘব-বোয়ালদের রেখে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের উপর প্রয়োগ করা হয় কিনা। সামাজিক সচেতনতা ফরমালিনের মতো ম্যালিগন্যান্ট সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফরমালিন-বিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে রাজধানীর এক লাখ যানবাহনে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগানোর কার্যক্রমের উদ্যোগের প্রশংসা করতেই হয়।
মেক্সিকোতে দেখেছি কৃষিবিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাধারণ নিরাপত্তারক্ষীদের বদলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। মেক্সিকোতে জরুরি অবস্থা নেই, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকায় সেনা-উপস্থিতি ভিন্নমাত্রার মনে হল। পরে জানলাম, মেক্সিকোর প্রশাসন কৃষি এবং খাদ্য-নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ ঘোষণা করায় কৃষির সঙ্গে জড়িত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা সেনাবাহিনী দেখভাল করবে। এটি কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নয়, জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে ফরমালিনসহ নানান ভেজাল দিয়ে খাদ্য বিষাক্ত করার বিষয়টি আজকে এমন একটা পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, এই সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিলিয়ন ডলার। যে দেশে বাচ্চাদের স্কুলের সামনে টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহৃত বিষাক্ত রঙের আইসক্রিম দেদারসে বিক্রি হয়, গুঁড়া মরিচের সঙ্গে ইটের গুঁড়া মিশিয়ে দেওয়া হয়, দুধে পানি মিশানোর ঘটনা মোটামুটি সামাজিক ঐতিহ্য, ভেজাল আর ফাঁকি যেখানে অপ্রতিরোধ্য– সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো বিধান তখনই কার্যকর সুফলতা দেবে যখন পুরো প্রশাসনযন্ত্র গুরুত্বের সঙ্গে নির্মোহ থেকে এই নিরব গণহত্যাকে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেই মোকাবিলা করবে।
আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের বাইরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, সরকারি এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মাছ, ফলমূল এবং শাকসবজির সংরক্ষণের পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করা। মাছের জন্যে সুলভে স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত বরফের ব্যবস্থা, কোল্ড স্টোরেজ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ফরমালিন ব্যবহারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিরুৎসাহিত করবে। ফুডগ্রেড কালার আমদানি উৎসাহিত করা, এর ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি, আইসক্রিমসহ যেসব খাদ্যে রঙ ব্যবহার করা হয়, সেসব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসাও জরুরি।
আমাদের উষ্ণ আর আর্দ্র আবহাওয়া কাঁচা আনপ্রসেসড খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে বেশ প্রতিকূল, যা বেআইনি কাজ উৎসাহিত করে। মূলত এই বেআইনি কাজটি ঘটে আমাদের অভ্যন্তরীন বাজার কেন্দ্র করে। মান নিয়ন্ত্রণের কড়া নজরদারি আর উচ্চমূল্যের কারণে মাছ, ফলমূল এবং শাকসবজির রফতানিমুখী বাজারে পণ্য সংরক্ষণের নামে বেআইনি কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে।
রফতানিমুখী পণ্যের অনুরূপ সংরক্ষণ অবকাঠামো আমাদের অভ্যন্তরীন বাজারেও নিরাপদ পণ্যের আবহ তৈরি করতে সহায়তা করবে। পণ্য পরিবহনে পথে পথে চাঁদাবাজি, যোগাযোগ অবকাঠামোর দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু কৃষককেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছে না, ফরমালিনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারেও ভূমিকা রাখছে।
খাদ্যপণ্যে ফরমালিনসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্সের পাশাপাশি, মাছ, ফলমূল এবং শাকসবজির সহজলভ্য মানসম্মত সংরক্ষণ অবকাঠামো তৈরির দিকে নজর দেওয়াও সময়ের দাবি।
ড. শোয়েব সাঈদ: বায়োটেক নির্বাহী, কানাডা।