Published : 07 Sep 2013, 04:09 PM
আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় থাকা কুড়িগ্রামের দরিদ্র এক দিনমজুরের কন্যা ফেলানী আবারও প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপিয়ে দিল পুরো বাংলাদেশ।
ফেলানীকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল বিএসএফ-এর যে জোয়ান, আদালত তাকে নিদোর্ষ বলে রায় দিয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে কারগার থেকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের জওয়ান অমিয় ঘোষ এখন আর 'খুনি' নয়, তাকে আর 'খুনি' বলা যাবে না। আদালত তাকে সে সনদই দিয়ে দিয়েছে!
সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশের নাগরিক খুন হওয়া নিতান্তই গতানুগতিক সংবাদ। ফেলানীর মৃত্যু আরও অসংখ্য মৃত্যুর ভিড়ে হারিয়েই যেত যদি না বেচারী কাঁটাতারে আটকে যেত– যদি না বেচারীর প্রাণহীন দেহটা কাঁটাতারে ঝুলে থাকত।
অপ্রিয় শোনালেও বলি, কিশোরী ফেলানী নয়– কুড়িগ্রামের সহজ-সরল এক মেয়ে যে কি না সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসছিল, সেই স্বপ্নকাতর ফেলানী নয়– আমাদের বিবেক প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল কাঁটাতারে ঝুলে থাকা প্রাণহীন ওই কিশোরীর ছবিটাই।
ছবিটা ছিল বলেই তা নিয়ে আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো গরম করে ফেলতে পেরেছি প্রতিক্রিয়ায়। কাব্য-গানের সুরও তুলতে পেরেছি। কিন্তু সেই ছবি না থাকলে? তাহলে ফেলানী কোনোভাবেই 'ফেলানী' হয়ে উঠতে পারত না, সেটা শতভাগ নিশ্চিত।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে কতজন বাংলাদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন? এ সরকারের আমলে কতজন? গত বিএনপি সরকারের আমলে কতজন? দুই সরকারের আমলে মোট কতজন?
এগুলো নিতান্তই সংখ্যা, পরিসংখ্যান। সংখ্যা কিংবা পরিসংখ্যান কি মানুষের আবেগে নাড়া দেয় যতটা দেয় ছবি? কই, কোনো পরিসংখ্যানই তো সীমান্তে নিহতদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে বিএসএফ বা ভারত সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি। ফেলানীর ছবি কিন্তু পেরেছে। এটা একটা বিজয়, বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধির বিবেকবান মানুষের বিজয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শিক্ষক, লেখক আলী রিয়াজ ফেসবুকে এক পোস্টে পশ্চিমবঙ্গের একজন মানবাধিকার কর্মীকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যার অন্তত ১৯টি ঘটনার ব্যাপারে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল। কিন্তু তার কোনোটারই শুনানি পর্যন্ত হয়নি। ফেলানী হচ্ছে প্রথম ঘটনা যেখানে একজন বিএসএফ জোয়ানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার দায়ে অভিযোগ পর্যন্ত গঠন করা হয়।
ফেলানী হত্যার বিচারের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য আমরা কতটা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম? আদৌ কিছু পেরেছিলাম কি? দেশের পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর হাতে দেশের কোনো নাগরিক প্রাণ হারালে তার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণই দেশের অভ্যন্তরিণ ব্যাপার। ফেলানী হত্যার বিচারকার্য ভারতের নিতান্তই অভ্যন্তরিণ ব্যাপার ছিল না। বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার দায়ে বিচারকার্যটি শুরু হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই এটি আন্তর্জাতিক মাত্রাও পেয়েছিল।
কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ায় কিংবা পর্যবেক্ষণে কোনো আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ কি ছিল? বাংলাদেশেরই কি যথেষ্ট এবং কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল? এসব বিষয় নিয়ে কখনও-ই কোনো ধরনের প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়াও সে অর্থে নজরদারির ভূমিকায় যায়নি।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয় ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ভারতের কোচবিহার জেলায় সোনারি বিএসএফ ছাউনিতে। মিডিয়ার খবর থেকে আমরা জানতে পারি, পাঁচজন বিচারক এ বিচারকাজ পরিচালনা করেন। আর আদালত পরিচালনা করেন বিএসএফের গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি কমিউনিকেশনস সিপি ত্রিবেদী।
অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুন এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। লক্ষণীয়, ফেলানী খুনের বিচার কিন্তু কোনো সিভিল আদালতে যায়নি। বিএসএফ-এর নিজস্ব এবং বিশেষ আদালতে এ বিচার হয়েছে এবং সেটি পরিচালিত হয়েছে নজিরবিহীন গোপনীয়তায়। যে ফেলানীর মৃত্যু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বসম্প্রদায়কে আলোড়িত করেছে, সে ঘটনার বিচার যখন কঠিন গোপনীয়তার পরিচালিত হয়, তখন তা নিয়ে এমনিতেই প্রশ্ন ওঠার কথা।
কিন্তু ফেলানীর মৃত্যু নিয়ে আমরা যত শব্দ ব্যয় করেছি, বিচারের গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করিনি। না সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে, না মিডিয়াতে। খুনি খালাস পেয়ে যাবার পর আমরা জানতে পারছি বিচারের ধরন সম্পর্কে।
পশ্চিমের দেশগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলে সেটি ভিন্ন কোনো সংস্থা দিয়ে তদন্ত করা হয়। কানাডায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য সুশীল সমাজের সমন্বয়ে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার 'নিরপেক্ষ' বিচার আমরা কীভাবে প্রত্যাশা করেছি?
আরেকটি কথা, ফেলানী হত্যার বিচারে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থান কী ছিল? আদৌ কিছু ছিল কি? মিডিয়ার খবর থেকে জানি, কুড়িগ্রাম জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন এ মামলায় ফেলানীর পরিবারকে আইনি সহায়তা দেন। তাদের সঙ্গে বিজিবি-৪৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল হক খালেদও ভারতে যান মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে।
বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যার বিষয়টি দেশের জাতীয় রাজনীতির জন্যও অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ভারত যেখানে সীমান্তে মানুষ হত্যার কথা স্বীকারই করে না, সেখানে প্রথমবারের মতো একটা বিচারের উদ্যোগে কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর কি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যথাযোগ্য ছিলেন?
আর তাকে প্রতিনিধিই বা বলি কীভাবে? মিডিয়া বলছে তিনি ফেলানীর পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন? তাহলে সরকারের হয়ে সেখানে বিচারকাজ পর্যবেক্ষণের জন্য কেউ ছিলেন না কেন? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি অবহিত ছিল এ বিচারের ব্যাপারে? তাদের ভূমিকাই-বা কী ছিল?
বাংলাদেশে এত যে মানবাধিকার সংগঠন, এত যে মানবাধিকাররক্ষার অতন্দ্র প্রহরী— তারাই-বা কোথায় ছিলেন? বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের কেউ তো এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলেননি? এমনকি সরকার যে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন না, সে কথাও তো তারা আমাদের জানাননি?
তাহলে কি ফেলানীকে নিয়ে তারা কেবল রাজনীতি করতেই পছন্দ করেন? সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হওয়া কিংবা ফেলানীর খুনের বিচারের ব্যাপারে আসলে কি তাদের আগ্রহ নেই?
ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিবেচনায় ফেলানী হত্যার বিচারের শুরুটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক একটা বিজয় ছিল। কিন্তু 'ভারতপ্রেমিক' বা 'ভারতবিদ্বেষী' রাজনীতিক বা মানবাধিকারের রক্ষকদের কেউই সে বিজয় কার্যকর করার ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন না।
আর এ সুযোগই নিয়েছে সুচতুর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তারা ঘটনার বিচারও করেছে, আবার তাদের সৈনিককে 'নির্দোষ' হিসেবে রায় দিয়ে বিএসএফ যে সীমান্তে 'খুন-খারাবি' করে না, সে ইমেজও অক্ষুণ্ন রেখেছে।
আর আমরা?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঝড় তুলে, কাব্যচর্চ্যায়, হারমোনিয়ামের রিডে 'নো ওয়ান কিল্ড ফেলানী'– 'ফেলানীকে কেউ খুন করেনি' বলে সুর তুলে নিজেদের প্রতিবাদী (?) চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছি মাত্র!
শওগাত আলী সাগর : `প্রথম আলো'র সাবেক বিজনেস এডিটর এবং কানাডা থেকে প্রকাশিত 'নতুনদেশ ডটকম'-এর প্রধান সম্পাদক।