বিপ্লবী কল্পনা দত্ত : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 6 August 2013, 03:43 AM
Updated : 6 August 2013, 03:43 AM

২৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম মহানায়িকা কল্পনা দত্ত শতবর্ষ পূর্ণ করলেন। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামের শ্রীপুরে এক শিক্ষিত পরিবারে ১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই তার জন্ম। ১৯২৯ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন। কৈশোর বয়স থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিপ্লবীদের প্রতি তার আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ছিল। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, কানাইনালের জীবনী তিনি জেনেছেন। এই সময়ে কলকাতাতেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব ছিল। তিনি কল্যাণী দাসের বিপ্লবী সংগঠন ছাত্রী সংঘে যোগ দেন।

বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখা, মাস্টারদা সূর্য সেনের পরিচালনায় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকারের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করে। এই ঘটনায় সারা ভারতের বিপ্লবী তরুণ সমাজ শিহরিত হয়। কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন।

বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মাধ্যমে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৩১ সালের মে মাসে তিনি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখার সদস্য হন। ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের অভিযোগে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। মাস্টারদা স্থির করেন জেলের ভেতরে ও বাইরে ডিনামাইট বসিয়ে এই বিপ্লবীদের কারাগার থেকে বের করে আনতে হবে।

কল্পনা দত্তর উপরে দায়িত্ব পড়ে কলকাতা থেকে ডিনামাইট ও বোমা তৈরির মাল-মশলা জোগাড় করার। কলকাতায় ছাত্রী সংঘের নেত্রী বিপ্লবী কমলা মুখার্জি এ কাজে তাকে সহায়ক হন। কল্পনা বাড়িতে বসে 'গান কটন' তৈরি করে জেলে বিপ্লবীদের কাছে চালান দিতেন। কিন্তু কারাপুলিশ হঠাৎ জেলে ডিনামাইট আবিষ্কার করায় বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

পুলিশ এ কাজে কল্পনা দত্তকে সন্দেহ করলেও কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। তাই তাকে গ্রেফতার না করলেও তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও রাতে কল্পনা পুরুষের ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রামে গিয়ে মাস্টারদা ও অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মাস্টারদা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তকে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন।

১৯৩১-এর সেপ্টেম্বরে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের কিছুদিন আগেই পুরুষের ছদ্মবেশে চলার সময় কল্পনা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ, প্রীতিলতার জীবনদান এই সমস্ত ঘটনা সারা ভারতের তরুণ সমাজকে নাড়া দেয়। কল্পনা একমাস হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি পান এবং মাস্টারদার নির্দেশে আত্মগোপন করেন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রগার আক্রমণ, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ, জালালাবাদের যুদ্ধ ব্রিটিশ সরকারকে ক্ষিপ্ত করে। তারা মাস্টারদা সূর্য সেন ও তার সঙ্গীদের গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রামের গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করে থাকার সময়ে ব্রিটিশ সৈন্য ওই গ্রামে হানা দেয়, সশস্ত্র লড়াই হয়। এই লড়াই-এ মাস্টারদা সূর্য সেন, ব্রজেন সেন প্রমুখ গ্রেফতার হন।

কল্পনা দত্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মগোপন করে সেদিন পালাতে সক্ষম হন। তারা গহিরা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই গ্রামও ব্রিটিশ সৈন্য আক্রমণ করে। আবার লড়াই হয়, বেশ কয়েকজন নিহত হন। কল্পনা দত্ত প্রমুখ গ্রেফতার হন।

ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহ, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন ও হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি মামলা রুজু করে। মূল অভিযুক্ত হন সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সূয সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয়।

কল্পনা দত্তের সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। অবশেষে কারাদণ্ডের ছয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৩৯ সালে তিনি কারামুক্তি পান এবং ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত স্বগৃহে অন্তরীণ হন। অন্তরীণ অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক হন।

ইতোমধ্যে রুশ বিপ্লবের প্রভাব ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে পড়ে। কল্পনা দত্ত বাদ যান না। তিনি মার্কসীয় মতবাদ গ্রহণ করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪১-এ জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধনীতি ঘোষণা করে। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, পিপলস রিলিফ কমিটি, প্রগতি লেখক সংঘ প্রভৃতি গড়ে ওঠে।

কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর তখন বোম্বেতে। কল্পনা দত্ত পার্টির কেন্দ্রে যান এবং মহিলা আন্দোলনে কেন্দ্রীয়ভাতে নিজেকে যুক্ত করেন। ওই সময়ে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক তরুণ কমিউনিস্ট নেতা পি সি জোশীর সঙ্গে তার প্রণয়। ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি পি সি জোশীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কল্পনা দত্ত হলেন কল্পনা জোশী।

বাংলায় ১৩৫০ সালের মন্বন্তর– আবার দুর্বার গণআন্দোলন। কল্পনা দত্ত পার্টির নির্দেশে চট্টগ্রামে তার কর্মক্ষেত্র বিস্তার করেন। ১৯৪৬ সালে বাংলায় আইনসভায় ১৩ জন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করন। চট্টগ্রামে কংগ্রেস প্রার্থী নেলী সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে সিপিআই প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর পরে অবশ্য তিনি কখনও বিধানসভা, লোকসভায় প্রার্থী হননি।

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজন। কল্পনা দত্তর কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষ। ১৯৪৮ সালে সিপিআই দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসে 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়' বলে উগ্র লাইন গ্রহণ করা হয়। পি সি জোশী পার্টির নেতৃত্ব থেকে অপসারিত এবং শোষণবাদী বলে সাজাপ্রাপ্ত হন। একদিকে পুলিশের হুলিয়া, অপরদিকে পার্টিতে একঘরে। এই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার শুধু জোশী নন, এই অবস্থার শিকার কল্পনা জোশীও। কলকাতায় গোপন ভাড়াবাড়িতে বন্ধুদের সাহায্যে কোনো রকমে তারা দিন যাপন করতেন।

১৯৫১ সালে সিপিআই দল তার ভুলগুলি শুধরে আবার গণসংযোগ ও গণআন্দোলনে নামেন। পি সি জোশী ও কল্পনা দত্ত জোশী তাদের সদস্য পদে সসম্মানে বহাল হন। কল্পনা দত্ত জোশী ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন এবং ভারত সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিকেই তার কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন।

ইতোমধ্যে তাদের দুই ছেলের জন্ম হয়েছে, সুরুজ জোশী এবং চাঁদ জোশী। এই ছেলেদের বড় করা এবং শিক্ষার ব্যবস্থার দায়িত্ব রয়েছে। সুরুজ এবং চাঁদ উভয়েই পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন। পি সি জোশী ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার দেখার দায়িত্বও ছিল কল্পনার।

তিনি তার শেষ জীবন পর্যন্ত অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে আঘাত করে। জীবনের সায়াহ্নে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার স্মৃতিভ্রংশ হয়। কলকাতার হাসপাতালে তাকে পাঁচ মাস কাটাতে হয়। শোনা যায়, ওই সময়ে কল্পনা জোশীই যে মহান বিপ্লবী কল্পনা দত্ত এটি হাসপাতালের কর্মকর্তা এবং সরকারি আমলাদের বোঝাতে নাকি বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তার আপনজনদের।

১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে কলকাতার হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

চট্টগ্রাম বিদ্রোহ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেরই স্মতিচারণমূলক লেখা রয়েছে। এর প্রত্যেকটি বইয়ে ওই সংগ্রামের বীরনায়ক-নায়িকাদের কথা লেখা রয়েছে। প্রত্যেকটি বইয়ে কল্পনা দত্ত'র কথা সম্মানের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক মানিনী চ্যাটার্জি কল্পনা দত্তর পুত্রবধূ। তার লেখা বই নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র 'খেলে হাম জি জানসে'। এতে কল্পনা দত্তর ভূমিকায় সুন্দর অভিনয় করেছেন প্রখ্যাত নায়িকা দীপিকা পাডুকোন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য কল্পনা দত্তকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদর্শন করে। পরিবারের পক্ষে তার পুত্র চাঁদ জোশির স্ত্রী সম্মাননা গ্রহণ করেন।

কল্পনা দত্তর শতবর্ষপূর্ণ হল ২৭ জুলাই। এই দিনটি যেন কেমন উপেক্ষিত থেকেই গেল। তার প্রতিকৃতিতে সরকারি কিংবা বিরোধী দল কেউ ফুল দিল না, শতবর্ষ পালনে উদ্যোগী হল না। এতে কল্পনা দত্তকে অপমানিত করা হল না। অপমান করলাম আমরা নিজেদের।

'৭৫-পরবর্তীকাল পর্বে আমি যখন ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলাম, যখই দিল্লী গিয়েছি, তিনি ছুটে এসেছেন, দেখা করেছেন, বাংলাদেশের খোঁজখবর নিয়েছেন। কতবার যে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছি তা আর বলার নয়। এই রকম একজন মহান নেত্রীর সান্নিধ্য পেয়ে আমি ধন্য।

কল্পনাদির সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল কলকাতার পিজি হাসপাতালে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্র আমাকে নিয়ে যান হাসপাতালের কেবিনে। তিনি তখন বিছানায় শুয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু ডিউটিরত সিস্টার জানাল যে, কিছুক্ষণ আগেই তো ধরে ধরে হাঁটিয়ে এনেছি।

আমি তখন জোরে কল্পনাদিকে ডাকতে থাকলাম এবং আমার পরিচয় দিলাম। 'ও কল্পনাদি, আমি বাংলাদেশের বকুল'।

তিনি চোখ খুলে বললেন, 'ও তুমি বাংলাদেশের বকুল? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে যে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল তা কি ঠিক হয়েছে?'

আমি বললাম, 'না দিদি, তেমন কিছু হয়নি।'

তিনি স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, 'সারা পৃথিবী যেন কেমন হয়ে গেল…'।

তার কথাগুলো ভাসছিল যেন কোন সুদূর থেকে। বলতে বলতে তিনি নিরব হলেন এবং বললেন, 'আমি এখন শুই'।

আর একটি কথাও বললেন না। সেই সঙ্গে নিরব হলাম আমরাও।

মোনায়েম সরকার : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী।